ভাবনা: ঊনত্রিশ।
……………………..
: ওহে রামচরণ, যাচ্ছিস কোথায় এমন হেলেদুলে? ওদিকে তোর বাড়িঘর ভেঙে দিচ্ছে, তোর ছেলেকে ধরে মারছে, তোর বউ-মেয়েকে বেইজ্জত করছে। এক্ষুনি বাড়ি যা। দৌড়ে যা! তোর সব শেষ হয়ে গেল রে!
(রামচরণ সে কথায় বিন্দুমাত্রও কর্ণপাত না করে, আগের চাইতে আরো আয়েশ করে হুঁকাসেবনে প্রবৃত্ত হল। তার চলার গতি শ্লথ হল না, তার মধ্যে কোনো রকমের চিন্তার ছায়াও পড়ল না। রামচরণের এমন নির্বোধ নিঃস্পৃহতা দেখে সেই মহৎ লোকটি প্রায় দৌড়ে রামচরণের কাছে এসে ওর হাত থেকে হুঁকাটা অনেকটা কেড়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন……)
: এই ব্যাটা, কানের মাথা খেয়েছিস নাকি? কী বললাম, শুনিসনি? তোর গোয়ালে আগুন দেবে ওরা। ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করে ফেলছে। এখুনি যা! আর দেরি করিস না। দৌড়া!
(রামচরণ এতক্ষণে মুখ খুলল।)
: কী যে বলেন বাবু! কে আমার ক্ষতি করবে? ক্ষতি দূরে থাক, এ জীবনে কারো মুখে কোনোদিনই আমার সামান্য নিন্দা পর্যন্ত শুনলাম না! আর করবেই বা কেন? প্রশ্নই তো ওঠে না! আজ পর্যন্ত তো কখনো কারো কোনো উপকার করলাম না। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। হুঁকাটা দিন, বাবু।
হ্যাঁ, রামচরণই ঠিক। সত্যিই ওর ক্ষতি করার কেউ নেই। রামচরণরা কখনো কারো উপকার করে না, তাই ওরা মানুষের সকল ঈর্ষা, অকৃতজ্ঞতা আর কৃতঘ্নতা থেকে পুরোপুরি নিরাপদ, নিশ্চিন্ত। মানুষ তাদেরই বেশি ক্ষতি করে যারা অন্যের উপকার করে। আপনার একশোটা ভাল কাজের দাম মানুষের কাছে শূন্য হয়ে যাবে, যদি আপনি একটাও খারাপ কাজ করেন। মানুষ একশোটা ভাল কাজের কথা মনে রাখে না, একটা খারাপ কাজের কথা খুব ভালভাবে মনে রাখে। কাউকে একশোদিন পোলাওকোর্মা খাওয়ানোর পর একদিন ভাত খাইয়ে দেখুন সে আপনাকে কেমন গালিটা দেয়। যতোই মানুষের উপকার করুন না কেন, আপনি কখনো বিপদে পড়লে পাশে তাদের কাউকেই তেমন একটা পাবেন না, বরং এমন কেউ এসে আপনার পাশে দাঁড়াবে কোনোদিনই যার বিন্দুমাত্রও উপকার করেননি, এমনকি যার সাথে আপনার তেমন একটা যোগাযোগ পর্যন্ত কখনো ছিল না। আপনি বিপদে পড়ার আগ পর্যন্ত কোনোভাবেই এটা বলতে পারবেন না যে অমুক মানুষটি আপনার সত্যিকারের বন্ধু। মানুষের চরিত্র মোটামুটি এরকমই। সকল ধর্মগ্রন্থেও বলা হয়েছে, মানুষ অকৃতজ্ঞ, ঈর্ষাকাতর, কৃতঘ্ন প্রাণী।
(বিহারীলাল সরকারের ‘বিদ্যাসাগর’ বইয়ের ৩৫৪ পৃষ্ঠার ৩য় অনুচ্ছেদের অনুপ্রেরণায় লেখা)
ভাবনা: ত্রিশ।
……………………..
যখন গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়ার আগেই ব্যক্তি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন ব্যক্তি আর গোষ্ঠীবদ্ধ হতে চায় না। সে তার মতো করে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য নিয়ে চলতে থাকে। কখনও কখনও সে ব্যক্তি গোষ্ঠীবদ্ধ হয় এই শর্তে যে, গোষ্ঠীর মধ্যে সে অধিক সুবিধা এবং সম্মান ভোগ করবে। গোষ্ঠী সেটাতে রাজি না হলেই সূচনা হয় ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বের। সমাজে সবাই সমান সুবিধা নয়, বরং যোগ্যতার ভিত্তিতে সুবিধাভোগ করবে—-এটা গোষ্ঠী বোঝে ঠিকই, কিন্তু অমান্য করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যখন গোষ্ঠীর পরিচয়ে ব্যক্তি নয়, বরং ব্যক্তির পরিচয়ে গোষ্ঠী পরিচিত হয়, তখন ব্যক্তি অবশ্যই বাড়তি কিছু মর্যাদার দাবিদার। সে মর্যাদা না পেলে ব্যক্তি গোষ্ঠীর অন্যদের সাথে নানান বিষয়ে স্বাভাবিকভাবেই সহমর্মিতা প্রকাশ করবে না। উন্নত চিন্তাভাবনা ও দর্শনের ব্যক্তি গোষ্ঠীর যেকোনো সদস্যের চাইতে গোষ্ঠীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেশি ক্ষমতা ধারণ করে, ফলে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। সে ব্যক্তিকে প্রাপ্য সম্মান এবং গুরুত্ব না দিলে সাধারণত ব্যক্তি সে গোষ্ঠীর প্রতি কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা অনুভব করে না। এটা স্বার্থপরতা নয়, এটা আত্মমর্যাদাবোধ।
যখন দীর্ঘদিন ধরে কোনো (অপেক্ষাকৃত) ক্ষুদ্র সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে, হোক সেটা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, কিংবা রাষ্ট্রীয়, তখন আস্তে-আস্তে তাদের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য একতার বন্ধন সৃষ্টি হয়। মজার ব্যাপার হলো, যখনই সেই গোষ্ঠীর কেউ কোনো না কোনোভাবে অন্যদের তুলনায় একটু বেশি নিরাপত্তা ভোগ করার যোগ্যতা অর্জন করে, তখন তাকে গোষ্ঠীর অন্যকেউ আর সহ্য করতে পারে না এবং সবাই তাকে মনেমনে শ্রেণীশত্রু ভাবে। যদি কখনও সে ব্যক্তিটি কোনো কারণে আবারও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তখন গোষ্ঠীর অন্যরা খুশি হয়ে ওঠে। একজন নিরাপত্তাহীন ব্যক্তি আশেপাশের সবাইকেই নিরাপত্তাহীন হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। এভাবে করে একটাসময় সে বিশ্বাস করতে শুরু করে, নিরাপত্তাহীনতাই তার নিয়তি, এবং সে ভাবনায় সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ওটাতে থেকে যাওয়াটা সহজ, ওটা থেকে বেরিয়ে আসতে বাড়তি কিছু যোগ্যতার প্রয়োজন হয়, তাই সে সহজে ওটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। বেরিয়ে আসার চেষ্টা তো করেই না, বরং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কিছু কিছু ভিত্তিহীন যুক্তি আর অভিযোগ দাঁড় করিয়ে ফেলে। এভাবে করে একজন নিরাপত্তাহীন ব্যক্তি সারাজীবন অভিযোগ করে করে আরও অনেক নিরাপত্তাহীন ব্যক্তির সাথে নিরাপত্তাহীনতায় কাটাতে ভালোবাসে।
এমন অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক সংকটটি বাঙালি জাতির মধ্যে সবচাইতে তীব্র।
ভাবনা: একত্রিশ।
……………………..
আমি খেয়াল করে দেখেছি, সুখী মানুষের সাথে না, দুঃখী মানুষের সাথে আমার মিল আছে। সুখী মানুষ যে কাজটা অতিসুখে করে, দুঃখী মানুষ সে একই কাজটাই হয়তো জীবনের প্রয়োজনে করে। এই যেমন, এখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটা বাজতে চলল, আমার চোখে ঘুম নেই। কী কী সব বিলাসী কষ্টে আমার বুকের ভেতরটা কেমন একটা যেন হয়ে আছে, মনের ব্যথায় আমার ঘুম আসছে না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, কী যে দেখছি, তাও জানি না। ওই যে একটা বিল্ডিংয়ের নির্মাণকাজ চলছে। এই শীতরাতে শ্রমিকরা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে, ওদের পরনে তেমন গরম কাপড় নেই, দুএকজনের গায়ে ছেঁড়াপুরনো সোয়েটার দেখতে পাচ্ছি। আমার মতো ওদেরও কষ্ট হচ্ছে, ওদেরও শরীরমনে ব্যথা, ওদের চোখেও ঘুম নেই, সবই আমার মতোই, তবে পার্থক্য একটাই—ওদের যন্ত্রণা আমারটার মতো বিলাসী যন্ত্রণা নয়।
সকালে পার্কে হাঁটতে গেলে দেখা যায় না, দামি-দামি সব গাড়িতে করে এসে গাড়ি পার্ক করে বড়লোকরা সব দেদারসে হাঁটা দিচ্ছে…….ওদের দেখলেই আমি মনে-মনে বলে উঠি, “নে হাঁট্, বেশি করে হাঁট্, পারলে তো গাড়ি নিয়েই তেরোতলায় বাসার ভেতরে ঢুকতে চাস্! কোথাও গেলে, এক কদমও হাঁটতে ইচ্ছে করে না, আর নে, এইবার হাঁট্…….! হাহাহাহা……..” অথচ, এই যে, এই হাঁটাটা, এটা কিন্তু গরীব মানুষও হাঁটে, কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে, বাধ্য হয়ে, যেখানে রিকশায় যাওয়া দরকার, সেখানে রিকশায় না চড়ে সোজা হাঁটা নেয়, রিকশায় যাওয়ার অতো পয়সা ওদের নেই।
বড়লোকদের ঘরে খাবারের কোনো অভাব নেই—যেমনি বৈচিত্র্যে, তেমনি পরিমাণে। কিন্তু হায়, সে খাবার ওরা খেতে পারে না, ডাক্তারের নিষেধ আছে যে! এটা খাওয়া যাবে না, ওটা খাওয়া যাবে না, আর খেতে পারলেও পরিমাণে এইটুকু মাত্র! আমি ভাবি, আহা, তাহলে এতো এতো খাবার ঘরে থেকে কী আর লাভ হলো? এদের মতোই খেতে পারে না গরীব দুঃখী মানুষগুলোও, ওদের খাবার নেই বলে ওরা খেতে পারে না, আর বড়লোকরা খাবার থাকা সত্ত্বেও খেতে পারে না। তাহলে কী দাঁড়াল? শেষমেষ দুইদলেরই তো একই অবস্থা হল—কেউই খেতে পারছে না, শুধু কারণটা ভিন্ন। তবে, আমার খাবার নেই, তাই খেতে পারছি না—এই দুঃখের চেয়ে, আমার খাবার আছে, তবুও খেতে পারছি না—এর কষ্টটা বেশি। দিনের শেষে কেউই ভাল নেই। হায় জীবন!
ভাবনা: বত্রিশ।
……………………..
জীবন—৩টা ভিতে দাঁড়িয়ে—নীরবতা। কান্না। হাসি। কীরকম? প্রায় ১৭/১৮ বছর পর ছোটবেলার কোনো বন্ধুর সাথে কথা হলে, সে যখন জিজ্ঞেস করে আমার বাম গালের ‘তিল!’এর কথা—তখন, প্রথমে থমকে যেতে হয়—এতোদিনেও মনে আছে ওর? এরপর, খুশিতে চোখে জল এসে যায়। শেষে, ভেতরটা ভীষণ শব্দ করে করে হাসতে থাকে। সত্যিই, ভালোলাগাটা সীমা ছাড়িয়ে যায়। কারোর-কারোর, কিছু-কিছু কথায়, এই তিন স্টেপের মাঝখানেরটা কষ্টের হয়। তবে, ওটাও কান্না। বেশ কিছুটা সময় কাটলে পরে মনে হয়, কার কথায় কাঁদছি? যে শুধু কাঁদাতেই চায়, ওর? কেন কাঁদছি? ও যা চায়, তা-ই তো করছি তবে। এতে যে ওকে জিতিয়ে দেয়াই হয়! এটা মনে এলেই, ‘কোনো শালাকেই আমার লাইফে লাগে না’ ভেবেটেবে নিজের জন্যই, চোখ আর ঠোঁট দুটোই একসাথে হাসতে থাকে। এই হাসিতে আসতে একটু সময় লাগেই, ওই হাসিতে পৌঁছনোর রাস্তায় প্রায়ই জ্যাম লেগে থাকে, যত শর্টকাট ধরেটরে হাসি পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়, ততই মঙ্গল। যদি শর্টকাটই না থাকে, তবে যাকিছু কাঁদায়, তা থেকে নিজেকে যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে মূল রাস্তায় আসা উচিত। যত আগে ঠিক রাস্তায় চলতে শুরু করা যাবে, তত আগে হাসিতে পৌঁছোনো যাবে। হায়, এই টোপটাতেও মন কাজ করে না প্রায়ই।
যে স্মৃতি মনে করতে চাই না, সে স্মৃতিই মনে চলে আসে বারবার।
যে কথা শুনতে চাই না, সে কথাই শুনতে হয় বারবার।
যে মুখোশ পরতে চাই না, সে মুখোশই পরতে হয় বারবার।
এর শেষ কোথায়? হাসির রাস্তায় কবে যাবো? কবে সেই হাইওয়েতে ছুটব বাধাহীনভাবে? কেন হাত বাড়ালেই সবচাইতে কাছের জিনিসটাই সবার আগে দূরে সরে যায়? অর্থহীন কাজে-কাজে, অর্থপূর্ণ জীবনটা কেন প্রায়শই নিরর্থক হয়ে পড়ে—সেই অর্থটাই খুঁজে পাওয়া যায় না বলে, জীবনটা কখনো-কখনো অর্থশূন্য মনে হতে থাকে। এই মনে হওয়াটা ভীষণ ভয়ংকর। প্রায়ই, যা নয়, তাও মনে নিয়ে আসে। মাঝে-মাঝে, যা সত্য, তাকেই ঘাড় ধরে মন থেকে বের করে দেয়। বারবারই, শুধু হেরে যাই….তখন মনে আসে, সত্যিই, বুঝি হারতেই খেলি—জীবনের কিছু রেস এমনই…..পাগলের মতো দৌড়াই—শুধুই হেরে যাওয়ার নেশায়। হারবো জেনেই দৌড়ানো। তাও…..রেসে! ভাবা যায়? যে রেসে হারার প্রতিযোগিতা হয়, সে রেসে জেতা সবচাইতে কঠিন। কে সবচাইতে বেশি হারতে পারে—সে লড়াই বড় কঠিন লড়াই। উল্টো রাজার দেশের প্রজারা বড় দুঃখী। ওরা অন্য রাজা চায়—পায় না; ওরা অন্য দেশ চায় না—পেয়ে যায়।
বাদ দিন এসব ফালতু কথা। কাজের কথায় আসি। সাঁতারটা শিখছেন না কেন? ডুবে মরার মরাটা সবচাইতে কষ্টের মৃত্যুর মেরিটলিস্টে সেকেন্ড প্লেসে আছে। জানেন না? যেদিন মরবেন, সেদিন আমাকে মনে পড়বে। অবশ্য, মরে যাওয়ার সময়টাতে, আদৌ কিছু মনে পড়ে কিনা, তার খোঁজ কেউ দয়া করে জীবননদীর ওই পার থেকে এসে দিয়ে যাননি, তাই কেউই আসল সত্যিটা জানেও না। মনে-মনে বলছেন, সে কী পাজির হাড্ডি! একটা জলজ্যান্ত মানুষকে পানিতে ডুবিয়ে মারছ?…..হুমম্ মারছিই তো……যিনি পানিতে ডুবে মরে যাওয়ার সুযোগটা রাখবেন—সে সুযোগ তো কাজে লাগতেই পারে যেকোনো সময়ে! বুঝলেন, মাই ডিয়ার? আরেকটা কথা। মাথায় এল, বলে ফেলি, পরে নাহলে বলতে ভুলে যাবো। যদি বিয়ের আগেও দক্ষিণমেরুর টান…..বিয়ের পরও সেই দক্ষিণমেরুরই এত টান—তবে কেবল বিয়ের সময়ই এত উত্তরমেরুর খোঁজ কেন, অণুবীক্ষণ যন্তরটন্তর লাগিয়ে?—প্রশ্নটা ছেলেদের প্রতি। মেয়েদের প্রতিও, তাদের, যারা সেই উত্তরমেরুতে বসে থাকে, উত্তরমেরুর অভিযাত্রীদের প্রতীক্ষায়। আসলে, কে কোন মেরুতে যাবে, তা কেউই জানে না। যাওয়ার অবাধ সুযোগ, পাসপোর্ট করার ঝামেলাটুকু পর্যন্ত নেই, শুধু গেলেই হয়, যাওয়ার ইচ্ছেটাই সব! অথচ, দোষ পড়ে শুধু ছেলেদের।
ভাবনা: তেত্রিশ।
……………………..
পৃথিবীতে পা রেখে চাঁদকে স্পর্শ করার ক্ষমতা মানুষের নেই…..চাঁদেরও নেই মানুষকে স্পর্শ করার ক্ষমতা। কিন্তু চাঁদকে ভালোবেসে, জ্যোৎস্না রাতে বাইরে এলে, চাঁদের মায়াবি আলো মানুষের সমস্তটাকে তীব্রভাবে স্পর্শ করে দেয়। নিন্দুকেরা বলবে—সে আলোর স্পর্শ তো ভালো না বাসলেও পাওয়া যায়। হ্যাঁ, পাওয়া যায় বৈকি—কিন্তু তা কি অনুভব করা যায় একটুখানিও? ভালোবাসা থাকলেই কেবল অনুভব করা যায়। যে স্পর্শে অনুভব নেই, সে স্পর্শ কষ্টই বাড়ায় শুধু। একটা হাত হয়তো স্রেফ স্পর্শেই রক্তাক্ত হয়ে যায়, কিন্তু হৃদয়ে দাগ কাটেনা এক বিন্দুও। আবার যে হাত স্পর্শ করিইনি কখনো—করা হবেও না হয়তো কোনোদিনই, সেই হাতেরই স্পর্শকল্পনার অনুভূতি, প্রতিনিয়ত হৃদয়কে স্পর্শ করতে-করতে রক্তাক্ত করে ফেলে একেবারে। মাঝে-মাঝে, নিজের মধ্যেই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে ফেলি নিজেকে। কখনো মনে হয়, অন্যায়গুলোকে ক্ষমা করে দিই, আবার কখনো মনে হয়, আমার ধৈর্যের ব্যাপ্তি অন্যায়ের মাত্রাকে যেন আরও প্রসারিত করে।
অবিমিশ্র ভাল খুবই খারাপ পরিণতি নিয়ে আসে। একটু ভাবুনতো, যিনি বাঁচার সময়টাতে সর্বদাই চারটা বোনাসসহ ছত্রিশ দাঁত বের করে হেসেই চলেছেন, তিনি তাঁর এই সর্বদা বেরকরা দাঁত নিয়ে, ছোটোখাটো সমস্যায় তো পড়েনই—সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েন, যখন কোনো শোকসভায় যান…..প্রায় ঘণ্টাখানেক ওই দাঁতগুলো চেপেচুপে ভেতরে আটকে রাখাটা বড়ই কষ্টকর হয়ে পড়ে। বেচারা দাঁতগুলি যেন দম আটকে মারা যায়! আমিও দাঁত বের করেই রাখি। ওতে বড়ো সুবিধে, কষ্ট লুকানো সহজ হয়। তবে, নিজের কানে শুনতে ভাল লাগে, যখন কেউ বলে, “জানিস, তোর সাথে যতক্ষণ থাকি, ততক্ষণই মনে হয়, জীবনে কোনো দুঃখ নেই……” আমিও মনে-মনে ভাবি, আমি এত ভাল অভিনয় জানি! এ কৃতিত্ব কার? আমার? নাকি, দাঁতের? ভালথাকার নিয়ম শিখতে পারিনি, ভালরাখার বিদ্যেটা ঠিক-ঠিক রপ্ত করে ফেলেছি। যাকগে সেসব! প্রতিদিনই, সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়……সূর্যের তীব্রতা বাড়তে থাকে—এটা একটা সাধারণ ঘটনা। কিন্তু সব সাধারণই কি সাধারণ হয়েই রয়ে যায়, সবসময়ই? কিছু কিছু সাধারণও, কখনো-কখনো হয়ে যায় অসাধারণ। সাধারণ যখন অসাধারণ হয়ে যায়, তখন অসাধারণের চেয়েও বেশি অসাধারণ হয়। এই প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দুপুরেও মাকে শুনছি, পাশের রুমে গুনগুন করছে—অন্তত গত ৫ বছরে যা হয়নি। আজ কেন হচ্ছে? মা ঠিকঠাক আছে তো? সে ব্যাখ্যা আর না খুঁজি। কিছু-কিছু অসাধারণ, ব্যাখ্যায় ফেলতে চাইলেই শুধু যে সাধারণই হয়ে যায়, তা নয়—প্রায়ই, কোথায় যেন হারিয়ে যায়। বেশ ভাল লাগছে। কেন লাগছে, কারণ খুঁজব না। শুভ দুপুর……দুপুরের রাগ বাড়ছে, আমারটা কমছে। আমার পাজি মা’টাও কখনো-কখনো খুশি করে দেয়! হিহিহিহি……
ভাবনা: চৌত্রিশ।
……………………..
কেউ, কখনো, আমাকে সুন্দরী বললে (কিংবা, বলে গালি দিলে), আমারও বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, ওই মানুষটা, তার সারাজীবনে যদি একটাও সত্যি কথা বলে, তবে সেটা হলো, ওটা। মুখে অবশ্য, ‘কী যে বলেন! সব মেকাপের কারসাজি।’ টাইপের কমন কথাবার্তা বললেও, মনে-মনে ভীষণ খুশি হয়ে উঠি। ওকে দেখলে, ভাবলে, কেমন জানি ভাল-ভাল লাগে। ও কথোপকথন এগিয়ে নিতে চাইলে, আমি কিছু মনে করি না—পরিচ্ছন্ন, নিষ্পাপ সব কথার রথটা এগোয়, সাথে, ভাল লাগালাগিও। সমস্যা হচ্ছে, আমার একবার ভালোলাগা শুরু হয়ে গেলে, সেটা ক্রমশই, মুগ্ধতার দিকে চলে যায়, কিংবা আমিই নিজ থেকে সেটাকে টেনে নিয়ে যাই মুগ্ধতার দিকে। নির্ভরতার বীজ বুনি, তা থেকে চারাগাছ বের হতে শুরু হলে, আস্তে-আস্তে বুঝতে পারি, আমি আসলে এমন কারোর কথায় খুশি হতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, যে, সেইসময়, পুরোটা আমি’কে নয়, আমার ‘বিশেষ কোনো আবেদন’কে সুন্দর বলেছিল। আমাকে শুধু ওইটুকুতেই সে চায়, সেটার চাইতে বেশিকিছু চাওয়ার এতদিনের আর্তি ছিল নিছকই নিপুণ অভিনয়। ওটা না পেলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ও। শুধুই ওটা পাওয়ার জন্যই আমাকে সময় দেয়া যায়, আর কিছুই নেই আমার মধ্যে। এমনটা দেখলে, নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। ওর প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হয়ে যাওয়ার আগেই যদি ও আমাকে ওই ধাক্কাটা দিয়ে দিত, হয়তোবা, এতোটা অসহায় হয়ে যেতাম না। কেউ-কেউ, খুব ভাল করে বোঝে, কখন, কীভাবে, কোথায় ধাক্কাটা দিলে, সবচাইতে বেশি ব্যথা লাগে। যার সম্পর্কে যা কোনোদিন চিন্তাও করিনি, যাকে ভাবতাম, একটু অন্যরকমের, অন্যদের চাইতে আলাদা—তাকেও, ওরকম দৃষ্টিতে ভাবতে, ভীষণ কান্না পায়। পছন্দের মানুষটিকে নিয়ে একটিও খারাপ চিন্তা করতে সাহস হয় না। তখন, দুটো ব্যাপার খুউব পীড়া দেয়। এক। আমিই হয়তো নিজের অজান্তেই এমনকিছু করে ফেলেছি, বা দেখিয়ে ফেলেছি, যা দেখে উনার মনে হয়েছে, আমি বিছানায় যাওয়ার মতোই—আমাকে নির্দ্বিধায় ওরকম প্রস্তাব দেয়াই যায়। দুই। হয়তো, কারো-কারো সাথে, উনার ওরকম রিলেশন আছে—এটা মাথায় এলেই, ওই মেয়েদের উপর ভীষণ রাগ হয়। জানি, এটা সম্পূর্ণই যার-যার ব্যক্তিগত বিষয়, অভিরুচি; তবুও হয়।—এই দুটো ভাবনা আমাকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়, একেবারে নাড়িয়ে, নড়বড়ে করে দেয়।
ভাবনা: পঁয়ত্রিশ।
……………………..
অনেককেই দেখেছি, যে আমার কেউই নয়, কখনো হবেও না, এমনকি, যার সাথে ন্যুনতম মানসিক সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি এখনও—সেও, ওকে যা ইচ্ছা তা-ই করুক, তাতে ওর কিছুই এসে যায় না। আবার অনেককে দেখেছি—সে যাকে ভালোবাসে, সেই মানুষটিকে যদি সে পায়, তবে সে মানুষটি তার কাছে আকাশের চাঁদের চাইতেও বড়ো কিছু একটা যেন—তাকে অনেক আদরযত্নে রাখতে সে দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর যদি তাকে না পায়, তবে সে মানুষকে রাস্তায় বেড়ালকুকুরে খাক—তাতেও তার কিছুই এসে যায় না। যে যেরকম করে ভাবে—যেরকম করে ভেবে ভাল থাকে আরকি। তবে, আমার কাছে তা নয়। ধরুন, আপনি আমার কেউ নন, হবেনও না কোনোদিনই, তারপরও আপনার একটা খারাপ কিছু, আমাকে যথেষ্টই কষ্ট দেবে, কারণ, আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমার কাছে, ভালোবাসাটা প্রাপ্তির কিংবা হিসেবনিকেশের কোনো ব্যাপার নয়। যাকে আমি মনে জায়গা দিয়েছি, সে আমার প্রার্থনায় আর শুভকামনায়ও জায়গা করে নেয়। আমার একটা ভাবনা লিখছি। একটা মানুষের, তার ভালোবাসার মানুষের সাথে, ভালোলাগার মানুষের সাথে, কিংবা যাকে সে ভালোবাসার বা ভালোলাগার মানুষ মনে করছে, তার সাথে, পারস্পরিক ইচ্ছে এবং সম্মতির ভিত্তিতে শারীরিক সম্পর্ক হয়ে যেতে পারে—বলছি না এটা খারাপ, তবে ওরকম ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগা নিশ্চয়ই বিলানোর জিনিস নয়। একটা মানুষের, পাঁচটা মানুষকে ভালোবেসে, ভালোলেগে, পাঁচটা মানুষের সাথেই, সেই সম্পর্কটি হলো—এটাও নাহয় মেনেই নিলাম! একটা মানুষের মধ্যে, একাধিক মানুষের প্রতি, বিশেষ-বিশেষ কারণে, বিশেষ-বিশেষ মুহূর্তে, আকর্ষণের জন্ম হতেও পারে। কিন্তু, ভালোবাসা নেই, এমনকি তেমন কোনো ভালোলাগাও নেই, প্রায় কিছুই নেই বলতে গেলে দুজনের মধ্যে, কেবলই শরীরের টানে, একের পর এক শরীর ভোগ করে যাওয়া—এ কীভাবে মানুষ করে যায়, আমার মাথায় আসে না। এটা করতে দেখেছি অনেককেই—তাও আবার, সভ্য সমাজের সবচাইতে সভ্য ব্যক্তিরা! এ কেমন সমাজ! কেমন তার মানুষগুলো! এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার, ফেসবুকে এক মহিলার সাথে বন্ধুত্ব। মহিলা বয়সে তার দশ বছরের বড়। ওই মহিলা তার মেয়ের সাথে এই ভদ্রলোকের বিয়ে দিতে চান। ওদের মধ্যে কথা চলছে, সাথে গল্পও। কদিন পর, সেই মহিলার সাথেই ওই লোকের শারীরিক সম্পর্ক হল। তারপরও তিনি ওই কর্মকর্তার সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে চান। এই মনস্তত্ত্বটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে কি বিয়ের পর……একদিন সেই মহিলা, আরেকদিন তার মেয়ে, কিংবা, একসাথেই দুজন? আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি নোংরা করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, বিয়েটা হয়েছে—পরের গল্পটুকু জানি না।