জীব তো ব্রহ্ম থেকে অবিভক্ত—জীব আসলে ব্রহ্ম থেকে আলাদা নয়; তবে কেন “অবিদ্যা” কল্পনা করা হলো? আসলে, এই অবিভক্ত অবস্থাতেই অবিদ্যা (avidyā) কল্পনা করা হয়েছে, কারণ এই অবিদ্যা জীবের মধ্যে ব্রহ্মের জ্যোতির্ময় স্বভাব বা চির-উজ্জ্বল চৈতন্যকে আড়াল করে রাখে।
যদি জীবকে সত্যিই ব্রহ্ম থেকে পৃথক ধরা হয়, তবে কী হবে? যদি বলা হয় যে, জীব আলাদা কোনো সত্তা—তখন জীবকে জড় (insentient) বা সীমিত জ্ঞানসম্পন্ন (finite intelligence) ভাবতে হবে। সেই অবস্থায় অবিদ্যাকে কোনো ইতিবাচক সত্তা (positive entity) হিসেবে ধরা যাবে না। কারণ আড়াল করার ক্ষমতা তখন যুক্তিসঙ্গতভাবে দেখানো সম্ভব হবে না।
যদি জীব ব্রহ্ম হয়, তবে সমস্যা কোথায়? যদি জীব প্রকৃতিগতভাবে ব্রহ্মই হয়, এবং যদি অভিন্নতার জ্ঞান (জীব = ব্রহ্ম) সবসময়ই শাশ্বতভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকত, তাহলে অভিন্নতার শিক্ষা (tādātmya-upadeśa, যেমন “তত্ত্বমসि”—“তুমি সেই”) অর্থহীন হয়ে যেত, কারণ তখন নতুন করে শেখানোর কিছুই থাকত না।
তাই বলা হচ্ছে—যারা শ্রুতি, স্মৃতি, এবং ন্যায়শাস্ত্রে পারদর্শী, তারা মেনে নেয় যে: ব্রহ্মই আসলে এক সমরূপ চেতনা (homogeneous consciousness)। সেই ব্রহ্মই হলো অনাদি অবিদ্যার কারণে অসীম সংখ্যক জীব-ভ্রমের আধার (substratum)। অর্থাৎ, জীবেরা আসলে ব্রহ্ম, কিন্তু অবিদ্যা তাদের প্রকৃত স্বরূপ আড়াল করে রেখেছে।
যেমন, আকাশে সবসময়ই সূর্য আছে। কিন্তু মেঘ ঢেকে দিলে সূর্যকে দেখা যায় না। সূর্য কখনও হারায় না, কিন্তু মেঘের কারণে তার আলো আমাদের কাছে পৌঁছায় না। তেমনি জীব সবসময়ই ব্রহ্ম, কিন্তু অবিদ্যা নামের মেঘ তাকে আড়াল করে রাখে। অবিদ্যা (Avidyā) মানে অজ্ঞতা, বা অসত্য জ্ঞান, যা ব্রহ্ম-স্বরূপ চৈতন্যকে আড়াল করে রাখে। এটি শাশ্বত (anādi)—কারণ এর কোনো শুরুর সময় নেই। কিন্তু এটি চিরন্তন (ananta) নয়—কারণ জ্ঞান উদিত হলে অবিদ্যা ধ্বংস হয়ে যায়।
জ্ঞান হলো সূর্যের আলো। জ্ঞান উদিত হলে অবিদ্যা-মেঘ ভেদ হয়ে যায়। আবরণশক্তি ভেঙে আত্মার প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশিত হয়। বিক্ষেপশক্তি নষ্ট হয়, আর তখন ভ্রান্ত ধারণা (আমি দেহ, আমি কর্তা, আমি ভোগী) মুছে যায়। সূর্য = আত্মা (ব্রহ্ম), মেঘ = অবিদ্যা, মেঘ ঢেকে সূর্য দেখা না যাওয়া = আবরণশক্তি, মেঘের আকারে অন্য কিছু দেখতে পাওয়া (যেমন মেঘকে সিংহ, হাতি মনে হওয়া) = বিক্ষেপশক্তি, মেঘ কেটে গেলে সূর্য স্পষ্ট হয়ে ওঠা = জ্ঞান দ্বারা অবিদ্যার ধ্বংস।
“অবিদ্যা অনাদি (শুরুহীন), কিন্তু সৎ নয় (চিরন্তন নয়)”—এর মানে কী? অবিদ্যা অনাদি—শুরুহীন, “অনাদি” মানে—এর কোনো শুরু নেই। আমরা যদি বলি, “অবিদ্যা শুরু হয়েছিল এই সময়ে”—তাহলে প্রশ্ন আসবে, “তাহলে তার আগে জীব কী অবস্থায় ছিল? তখন কি সে মুক্ত ছিল?”
যদি জীব মুক্ত থাকত, তবে আবার কীভাবে অবিদ্যা শুরু হলো? মুক্তি তো নষ্ট হয় না। তাই অবিদ্যাকে শুরুর সময় দেওয়া যায় না। যেমন: ঘুমোতে গেলে স্বপ্ন কবে শুরু হলো, তা নির্দিষ্ট বলা যায় না। স্বপ্ন একসময় জেগে উঠে ভেঙে যায়, কিন্তু “এটা শুরু হয়েছিল ঠিক এই মুহূর্তে”—এটা বলা যায় না।
অবিদ্যা সৎ নয়—চিরন্তন নয়। “সৎ” মানে চিরস্থায়ী, নিত্য। অবিদ্যা নিত্য নয়, কারণ জ্ঞান উদিত হলে অবিদ্যা ধ্বংস হয়ে যায়। যা জ্ঞান দ্বারা দূর হয়, তা চিরন্তন হতে পারে না। যেমন: দড়ির ওপর সাপের ভ্রম যতক্ষণ আলো নেই, ততক্ষণ থাকে। আলো এলেই ভ্রম মুছে যায়। যদি ভ্রম সত্যি হতো, তবে আলো এলেও তা নষ্ট হতো না।
অবিদ্যা = অনাদি, কিন্তু অনন্ত নয়। যা অনাদি, তা অনন্ত নয়। “অনাদি” বোঝায় শুরুহীনতা, “অনন্ত” বোঝায় শেষহীনতা। অবিদ্যার শুরু নেই, কিন্তু শেষ আছে—যখন জ্ঞান আসে। তাই অবিদ্যাকে বলা হয়: অনাদি-সিদ্ধ, কিন্তু সৎ নয়।
অন্ধকার: অন্ধকারের কোনো শুরুর সময় বলা যায় না (অনাদি)। কিন্তু আলো এলেই অন্ধকার শেষ হয়ে যায় (সৎ নয়)। স্বপ্ন: ঘুমের মধ্যে কখন থেকে স্বপ্ন শুরু হলো, সেটা নির্দিষ্ট বলা যায় না (অনাদি)। কিন্তু জেগে উঠলে স্বপ্ন আর থাকে না (সৎ নয়)। অবিদ্যা: কখন থেকে জীব নিজেকে দেহ-মন ভেবে ভুল করছে, তা বলা যায় না (অনাদি)। কিন্তু আত্মজ্ঞান হলে সেই ভুল ভেঙে যায় (সৎ নয়)। তাই উপনিষদ ও আচার্যরা বলেন: “অবিদ্যা অনাদি, কিন্তু জ্ঞান দ্বারা ধ্বংসযোগ্য।”
এমন আপত্তি (পূর্বপক্ষের কথা) উঠতে পারে—ঠিক আছে, ধরা যাক আলাদা কোনো বস্তু নেই। কিন্তু “প্রতিচ্ছবি আর আসল বস্তু একই”—এই দাবি মানা যায় না। কেননা, আমরা দেখি—শঙ্খে যখন রুপা বলে ভ্রান্তি হয়, তখন সেই ভ্রান্ত রুপা আসল রুপার মতোই প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ, যদিও সেটা মিথ্যা, তবু আসল রুপার সঙ্গে তার স্বরূপ-সাদৃশ্য আছে।
সিদ্ধান্তবাদীর উত্তর দেন—আসলে ব্যাপারটা তা নয়। শঙ্খে রুপার ভ্রান্তি নাকচ (sublation) হয়, তাই বোঝা যায়, এটা মিথ্যা। কিন্তু আয়নায় প্রতিচ্ছবির ক্ষেত্রে তাকে ভ্রান্ত বলে নাকচ করার কোনো প্রমাণ নেই। আয়না সরালে প্রতিচ্ছবি অদৃশ্য হয় বটে, কিন্তু সেটা নাকচ হওয়ার উদাহরণ নয়। যদি সত্যিই নাকচ হতো, তবে আয়নাটিকেও নাকচ করতে হতো।
আবার প্রশ্ন আসে। আপত্তি ওঠে—আচ্ছা, “তত্ত্বমসি” (তুমি সেই) বাক্য থেকেই তো নাকচ প্রমাণিত হয়, তাই না? সিদ্ধান্তবাদীর উত্তর—না, তা নয়। “তত্ত্বমসি” বাক্যের অর্থ হলো—জীব, যে-প্রতিচ্ছবির (pratibimba) মতো অবস্থায় আছে, তার প্রকৃত স্বরূপ আসলে ব্রহ্ম, যা বস্তুর (bimba) মতো। নইলে বাক্যটি হতো “তুমি নও”—যেমন বলা হয় “রুপা নেই”।
শঙ্খে রুপার ভ্রান্তি আর আয়নায় প্রতিচ্ছবি—এই দুইটা এক জিনিস নয়। শঙ্খে রুপার ভ্রান্তি নাকচ (মনে আর (ভ্রান্ত) শঙ্খ থাকে না, রুপা এসে যায়) হয়, তাই সেটা মিথ্যা। আয়নায় প্রতিচ্ছবি নাকচ হয় না (আয়না এলে প্রতিচ্ছবি আবার আসবে, আয়নার বিলোপ তো হয়নি এখানে), তাই এটাকে ভ্রান্ত বলা যায় না। আর “তত্ত্বমসি” বলছে—জীব আসলে ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু নয়।
জীব প্রকৃতিগতভাবে ব্রহ্ম, কিন্তু অবিদ্যা সেই সত্যকে আড়াল করে রাখে। আয়নার প্রতিচ্ছবিকে যেমন ভ্রান্ত বলা যায় না কেবল অদৃশ্য হওয়ার কারণে, তেমনি জীবও ব্রহ্মের প্রতিচ্ছবি হিসেবে টিকে থাকে। “তত্ত্বমসি” বলছে—জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। যদি তারা আলাদা হতো, তবে বাক্যটি হতো—“তুমি নও”।
বিম্ব (Bimba) ও প্রতিবিম্ব (Pratibimba)-এর ধারণা: বিম্ব মানে আসল বস্তু বা মূল সত্তা। যেমন—সূর্য। প্রতিবিম্ব মানে সেই বস্তুর প্রতিফলন। যেমন—পুকুরের জলে সূর্যের প্রতিচ্ছবি। সূর্য আর প্রতিফলন দেখতে আলাদা মনে হলেও, প্রতিফলন ছাড়া আসলে আর কিছু নেই। প্রতিফলন হলো সূর্যেরই ছায়া বা তার প্রতিফলিত রূপ।
জীব ও ব্রহ্মের সম্পর্ক: ব্রহ্ম = বিম্ব (সূর্যের মতো মূল চেতনা)। জীব = প্রতিবিম্ব (পুকুরে-পড়া সূর্যের প্রতিচ্ছবির মতো)। জীব নিজে কোনো স্বাধীন সত্তা নয়—সে কেবল ব্রহ্মের প্রতিফলন, যা মায়ার (অবিদ্যার) জলে প্রতিফলিত হয়ে আলাদা মনে হয়।
“তত্ত্বমসি” বাক্যের মানে: যখন বলা হয়, “তত্ত্বমসি”—“তুমি সেই”, তখন এর মানে: তুমি যে জীব হিসেবে নিজেকে দেখছ, সেটা আসলে প্রতিবিম্ব মাত্র। তোমার আসল স্বরূপ সেই বিম্ব—ব্রহ্ম। যদি জীব আর ব্রহ্ম আলাদা হতো, তবে বাক্যটা হতো—“তুমি নও” (যেমন “রুপা নেই” বলা হয়)।
শঙ্খে রুপার ভ্রান্তি: শঙ্খে আসলে রুপা নেই, শুধু শঙ্খই আছে। কিন্তু ভুলবশত সেখানে রুপার ধারণা আরোপ হয়। তাই একে পুরোপুরি ভ্রান্তি বলা হয় (pure illusion)। জ্ঞানের দ্বারা (সঠিকভাবে বুঝে নেওয়া মাত্রই) এই ভ্রান্তি নাকচ হয়ে যায়।
আয়নায় প্রতিচ্ছবি দেখা: এখানে আসল বস্তু (বিম্ব) সত্যিই আছে—মুখ আছে বলেই প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। প্রতিচ্ছবি নিজে স্বাধীন সত্তা নয়, বিম্বর উপর নির্ভর করে। তাই এটি শঙ্খে রুপার মতো মিথ্যা নয়, বরং বাস্তবের এক প্রতিফলন। তবে প্রতিফলন বিকৃত বা সীমাবদ্ধ হতে পারে—যেমন ময়লা বা ঘোলা জলে মুখের প্রতিচ্ছবি কেমন বিকৃত হয়। এ বিকৃতির কারণ অবিদ্যা বা মায়া।
জীব-ব্রহ্ম সম্পর্ক: জীব আসলে ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু অবিদ্যা বা মায়া জীবকে আলাদা মনে করায়, যেমন ময়লা জলে মুখ বিকৃতভাবে দেখা যায়। তাই জীবকে আলাদা, সীমাবদ্ধ, দুঃখভোগী মনে হলেও আসল স্বরূপ ব্রহ্মই।
শাস্ত্রও প্রতিফলনের বাস্তবতার উদাহরণ দিয়েছে। যেমন: “সূর্যকে কখনও দেখা উচিত নয়—সদ্যোদিত অবস্থায়, অস্ত যাবার সময়, গ্রহণগ্রস্ত অবস্থায়, জলে প্রতিফলিত অবস্থায়, কিংবা মধ্য-আকাশে।” এখানে সূর্যের প্রতিফলনকেও সূর্যের সঙ্গে অভিন্ন বলে গণ্য করা হচ্ছে।
ভুল বোঝাবুঝি হয়, যখন কেউ ভাবে: প্রতিচ্ছবি (pratibimba) আর মূল বস্তু (bimba) আলাদা, এবং প্রতিচ্ছবি স্বাধীনভাবে দৃষ্টিরশ্মি দ্বারা প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু অভিজ্ঞতাই দেখায় যে, প্রতিচ্ছবি মূল বিম্ব ছাড়া কখনও থাকে না। তাই আলাদা তত্ত্ব দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই, অভিজ্ঞতাই তার খণ্ডন করে দেয়।
শঙ্খে রুপা পুরো ভ্রান্তি। আয়নায় প্রতিচ্ছবি ভ্রান্তি নয়, বরং সত্যের প্রতিফলন। জীবও আলাদা কোনো সত্য নয়—ব্রহ্মেরই প্রতিচ্ছবি, যা মায়ার কারণে বিকৃত মনে হয়।
প্রভাকর মিশ্র (Prabhākara Miśra) ছিলেন সপ্তম শতাব্দীর একজন মীমাংসক দার্শনিক। তিনি ভাট্ট মীমাংসা (Bhāṭṭa school)-এর গুরু কুমারিল ভট্টের শিষ্য ছিলেন। তাঁর নিজস্ব একটি দার্শনিক মত গড়ে ওঠে, যা পরে “প্রভাকর মীমাংসা” বা “গুরুমত” নামে পরিচিত হয়। তাঁর প্রধান দার্শনিক মতবাদ—জ্ঞানের স্বপ্রকাশবাদ (Svataḥ-prāmāṇya-vāda): জ্ঞান নিজে থেকেই সত্য, তাকে প্রমাণ করার জন্য বাইরের কোনো প্রমাণের দরকার নেই। অর্থাৎ, আমরা যখন কিছু জানি, তখন সেই জ্ঞানকে প্রমাণ করার জন্য আলাদা কোনো প্রমাণ খুঁজতে হবে না।
প্রভাকরের মতে, “আমি” আলাদা কোনো সত্তা নয়। বরং, “আমি জানি”, এই জ্ঞান-অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই “আমি”-বোধ প্রকাশ পায়। তিনি মনে করেন, মানুষ কর্মফল ভোগ করে, কিন্তু সে নিজে কর্মের স্বাধীন স্রষ্টা নয়। তাঁর মতে জ্ঞান, কর্ম, ভোগ—সবই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
মীমাংসার মূল লক্ষ্য ছিল: ধর্ম (যজ্ঞ, বিধি ইত্যাদি) বোঝা। প্রভাকর মনে করতেন—বেদ স্বয়ংপ্রমাণ (self-valid), এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না; অর্থাৎ, বেদান্তের সঙ্গে তাঁর মীমাংসা-দর্শনের কিছু তর্ক-বিতর্ক ছিল। তাই শংকরাচার্যের ভাষ্যে (যেমন ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য) “প্রভাকর” শব্দটি প্রায়শই একজন প্রতিপক্ষ দার্শনিক হিসেবে উঠে আসে।
প্রভাকর প্রশ্ন তুলছেন (প্রতিপক্ষ হিসেবে): যদি একটি বস্তু সীমাবদ্ধ, একক ও স্বভাবতই একরূপ হয়, তবে সেটি কীভাবে একসঙ্গে দুটি আলাদা জায়গায় পূর্ণরূপে প্রকাশ পেতে পারে? অর্থাৎ, মুখ একটিই, কিন্তু তা কীভাবে একইসঙ্গে দুই জায়গায় (যেমন আসল মুখে ও আয়নায়) প্রকাশিত হতে পারে?
সিদ্ধান্তকার এখানে উত্তর দিচ্ছেন, আমরা বলছি না যে, প্রতিফলন (প্রতিবিম্ব) সম্পূর্ণ বাস্তব। আমরা কেবল বলছি—এখানে একত্ব (oneness) আছে। অর্থাৎ, বিম্বর (আসল মুখ) সঙ্গে প্রতিফলনের সম্পর্ক অভিন্নতার—দুটি আলাদা সত্তা নয়। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় আলাদা আলাদা রূপে দেখা দেওয়া হলো মায়ার খেলা। মায়া বাস্তবকে বিরোধ করে না, বরং বাস্তবকে বিকৃতভাবে প্রকাশ করে।
পূর্বপক্ষীর দ্বিতীয় আপত্তি: যদিও প্রতিফলনের সঙ্গে বিম্বর অভিন্নতা বোঝা যায়, তবুও প্রতিফলনকে আলাদা মনে হওয়ার ভ্রান্তি থেকেই যায়। অনুরূপভাবে—যদিও বেদান্ত অধ্যয়ন ও মননের মাধ্যমে জীবের সঙ্গে ব্রহ্মের অভিন্নতা বোঝা যায়, তবুও জীব ও ব্রহ্ম আলাদা—এমন ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মনে রয়ে যায়। অর্থাৎ, “আমি ব্রহ্ম” জানার পরেও মনে হয় “আমি আলাদা এক সত্তা”—এই ভুল ধরা যায় না সহজে।
সিদ্ধান্তকার সমাধান জানাচ্ছেন—আসলে প্রতিফলিত অংশ (প্রতিবিম্ব) হলো দেবদত্তের (শাস্ত্রীয় উদাহরণে ব্যবহৃত…ব্যক্তির generic নাম; যজনদত্ত, সোমদত্ত…এরকম) জড় অংশ। আয়নার ধূসরতা বা জড়ত্ব যেমন প্রতিফলনকে প্রভাবিত করে, তেমনি মায়া-আয়না জীবকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ফলে জীব (প্রতিবিম্ব) নিজের আসল পরিচয়—ব্রহ্ম (বিম্ব)—এর অভিন্নতা উপলব্ধি করতে পারে না। প্রতিফলন সচেতন নয়, জড়—যেমন আয়নায় মুখ নিজে কিছু বোঝে না। অভিজ্ঞতাও তা-ই দেখায়: আসল মুখ না নড়লে প্রতিচ্ছবি নড়ে না।