ফলস্বরূপ, জ্ঞান এবং জ্ঞানের বস্তুর মধ্যে স্বতন্ত্র বা স্বাধীন পার্থক্য স্থাপন করা যায় না। অদ্বৈত বেদান্তের মূল উদ্দেশ্য হলো—এটিই প্রদর্শন করা যে, দ্বৈততার ধারণা (জ্ঞান এবং জ্ঞেয় বস্তুর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য) যৌক্তিক যাচাই-বাছাই সহ্য করতে পারে না। সকল দৃশ্যমান পার্থক্য কেবল মায়ার আবরণ, এবং শেষ পর্যন্ত কেবল অদ্বৈত ব্রহ্মই পরম সত্য। জ্ঞান এবং জ্ঞেয় বস্তুর অভিন্নতাই পরমার্থিক সত্য।
পার্থক্য প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিতীয় জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা: ধরা যাক, যুক্তির খাতিরে, একটি প্রথম জ্ঞান জানার জন্য একটি দ্বিতীয় জ্ঞানের প্রয়োজন। এই পরিস্থিতিতে, যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে, একটি পাত্র এবং একটি পাত্রের জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য এই দ্বিতীয় জ্ঞান দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এখন, এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়: এই ‘পার্থক্য’ জানার জন্য, এর প্রতিযোগী (pratiyogi) এবং এর আশ্রয় (anuyogi) কি আগে থেকেই জানা প্রয়োজন? প্রতিযোগী (Counter-entity): পাত্রের জ্ঞান (পাত্রের উপলব্ধি)। আশ্রয় (Locus): পাত্র নিজেই।
প্রথম বিকল্প: প্রতিযোগী এবং আশ্রয়ের পূর্ব জ্ঞানের প্রয়োজন নেই—যদি আপনি দাবি করেন, প্রতিযোগী এবং আশ্রয়ের পূর্ব জ্ঞানের প্রয়োজন নেই, তাহলে একটি উল্লেখযোগ্য অসুবিধা দেখা দেয়। কেউ কখনও এমন একটি পার্থক্যের জ্ঞান লাভ করে না, যার কোনো ভিত্তি (আশ্রয়) বা প্রতিযোগী নেই। আমাদের চেতনা সর্বদা “এটি তার থেকে ভিন্ন” আকারে থাকে। অতএব, পার্থক্যের জ্ঞান সর্বদা একটি আশ্রয় এবং একটি প্রতিযোগী অনুমান করে।
দ্বিতীয় বিকল্প: প্রতিযোগী এবং আশ্রয়ের পূর্বজ্ঞান আবশ্যক—যদি তবে আপনি জোর দেন যে, প্রতিযোগী এবং আশ্রয়ের পূর্বজ্ঞান সত্যিই আবশ্যক, তাহলে এটি একটি অনন্ত অনুক্রমের (regressus ad infinitum) দিকে নিয়ে যায়। কেন? কারণ: দ্বিতীয় জ্ঞান প্রথম জ্ঞানকে প্রকাশ করবে। তৃতীয় জ্ঞান দ্বিতীয় জ্ঞানকে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হবে। চতুর্থ জ্ঞান তৃতীয় জ্ঞানকে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হবে—এবং এভাবেই একটি অন্তহীন শৃঙ্খলে আবর্তিত হবে।
তৃতীয় বিকল্প: একই দ্বিতীয় জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য জানা—যদি আপনি প্রস্তাব করেন যে, “পার্থক্যের জ্ঞান এই একই দ্বিতীয় জ্ঞানের মধ্যেই ঘটেছিল”, তাহলে এটি স্ব-নির্ভরতার ত্রুটির (আত্মাশ্রয় দোষ) উপস্থাপন করে। এই পরিস্থিতিতে, দ্বিতীয় জ্ঞান একই সাথে কারণ এবং প্রভাব উভয় হিসাবে কাজ করছে। এটি দাবি করে—এটি যে-পার্থক্যটি প্রকাশ করছে, তা ইতিমধ্যেই তার নিজস্ব কারণ হিসাবে বিদ্যমান ছিল।
অতএব, প্রত্যক্ষ জ্ঞান, কেবল “অস্তিত্ব আছে” বলে, কখনও পার্থক্যের জন্য প্রমাণ সরবরাহ করতে পারে না—বস্তু এবং বস্তুর জ্ঞান আলাদা। সহজভাবে বলতে গেলে, যদি আপনি দাবি করেন, “পাত্র এবং পাত্রের জ্ঞান আলাদা, এবং এই পার্থক্যটি একটি দ্বিতীয় জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করা হয়”, তাহলে আপনি অনিবার্যভাবে হয় একটি অনন্ত অনুক্রম বা স্ব-নির্ভরতার ত্রুটির মধ্যে পড়বেন। ফলস্বরূপ, দ্বৈতবাদ প্রমাণ করা যায় না; বরং, অদ্বৈতবাদী অবস্থান (অদ্বৈত) হলো সেটি, যা যুক্তির পরীক্ষায় টিকে থাকে।
দ্বৈতবাদীদের অনুমান যুক্তি এবং অদ্বৈতবাদীদের খণ্ডন: জ্ঞান ও জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্ক
১. দ্বৈতবাদীর অনুমান যুক্তি: দ্বৈতবাদীরা দৃঢ়ভাবে দাবি করেন যে, জ্ঞেয় বস্তু (যেমন, একটি হাঁড়ি) এবং সেই বস্তু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান (যেমন, হাঁড়ি-জ্ঞান) একে অপরের থেকে পৃথক। এই পার্থক্যের কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, বস্তুর মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম বিদ্যমান, যা বস্তুটি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত। উদাহরণস্বরূপ, একটি হাঁড়ির রয়েছে নির্দিষ্ট আকার, ওজন, রং, এবং এটি স্থান দখল করে। এগুলি ভৌত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ‘হাঁড়ি-জ্ঞান’ (মনের মধ্যে হাঁড়ির ধারণা)—এ ধরনের কোনো ভৌত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে না; এটি একটি মানসিক প্রক্রিয়া, বিমূর্ত।
দ্বৈতবাদীরা এই যুক্তিকে আরও স্পষ্ট করতে একটি উপমা ব্যবহার করেন: যেমন কাপড় এবং হাঁড়ি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু, কারণ তাদের ধর্ম একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একটি কাপড়ের ধর্ম (যেমন নরম, স্থিতিস্থাপক, পরিধানযোগ্য) হাঁড়ির ধর্মের (যেমন শক্ত, ভঙ্গুর, ধারণক্ষম) সঙ্গে মেলে না। তেমনি, তাঁদের মতে, হাঁড়ি প্রপঞ্চটিও (অর্থাৎ হাঁড়ির অস্তিত্ব) কাপড়ের প্রপঞ্চের মতোই স্বতন্ত্র এবং ভিন্ন। সুতরাং, তাঁদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, হাঁড়ি অবশ্যই ‘হাঁড়ি-জ্ঞান’ থেকে আলাদা। অর্থাৎ, বস্তু এবং বস্তুর জ্ঞান দুটি ভিন্ন সত্তা।
২. অদ্বৈতবাদীর খণ্ডন: অদ্বৈতবাদীরা দ্বৈতবাদীদের এই অনুমান যুক্তিকে অসার এবং ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেন। তাঁদের মূল আপত্তিটি হলো, দ্বৈতবাদীরা যে ‘ধর্মের বিরোধিতা’-র (opposition of attributes) উপর নির্ভর করে জ্ঞান ও জ্ঞেয় বস্তুর পার্থক্য প্রমাণ করতে চাইছেন, সেই বিরোধিতাকে জানার জন্য প্রথমে জ্ঞান ও জ্ঞেয় বস্তুর মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটি জানা আবশ্যক।
চক্রাকার যুক্তি ও প্রমাণহীনতা: অদ্বৈতবাদীদের মতে, যদি বস্তুর জ্ঞান ও বস্তুর মধ্যে পার্থক্যই প্রথমে প্রমাণিত না হয়, তাহলে তাদের ধর্মের মধ্যে বিরোধিতা আছে—এমন দাবি করা যায় না। এটি এক প্রকারের চক্রাকার যুক্তি বা ‘petitio principii’ (begging the question)। আপনি যদি বলেন যে ‘ক’ এবং ‘খ’ ভিন্ন, কারণ তাদের ধর্ম ভিন্ন, তাহলে আপনি ইতিমধ্যেই ধরে নিচ্ছেন যে, ‘ক’ এবং ‘খ’ ভিন্ন। কিন্তু এই মৌলিক পার্থক্যই তো প্রমাণের বিষয়।
সাধারণ নিয়মের অপূর্ণতা: দ্বৈতবাদীরা যে-‘সাধারণ নিয়ম’ (universal premise) ব্যবহার করছেন—”ধর্মের বিরোধিতা সবসময় পার্থক্য নির্দেশ করে”—সেই নিয়মটিও অদ্বৈতবাদীদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। এই নিয়মটি তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যখন আমরা অসংখ্য উদাহরণে পার্থক্য এবং ধর্ম-বিরোধিতা উভয়ই প্রমাণ করতে পারি। কিন্তু দ্বৈতবাদীরা তাদের যুক্তিতে এই নিয়মের প্রতিষ্ঠা প্রমাণ করতে ব্যর্থ। তাদের দেওয়া কাপড় ও হাঁড়ির উদাহরণে পার্থক্যটি স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে হলেও, অদ্বৈতবাদীরা এই স্বতঃসিদ্ধতাকেও চ্যালেঞ্জ করেন।
প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা: অদ্বৈতবাদীরা বলেন যে, কাপড় এবং হাঁড়ির পার্থক্যও আসলে কোনো চূড়ান্ত প্রমাণে দাঁড় করানো যায় না। এই পার্থক্য প্রমাণ করার জন্যও তো প্রত্যক্ষ জ্ঞান (direct perception) প্রয়োজন। অর্থাৎ, আমরা চোখ দিয়ে দেখে বা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বুঝতে পারি যে, কাপড় আর হাঁড়ি আলাদা। কিন্তু এই প্রত্যক্ষ জ্ঞান নিজেই কি চূড়ান্ত সত্য? যদি বলেন, প্রত্যক্ষ জ্ঞান দ্বারা পার্থক্য প্রমাণিত হয় না, তাহলে দ্বিতীয় অনুমান দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করলে অনন্ত প্রত্যাবর্তন (infinite regress) অথবা দোলাচল (logical see-saw) দেখা দেবে।
অনন্ত প্রত্যাবর্তন (Infinite Regress): এর অর্থ হল, একটি বিষয় প্রমাণ করতে গিয়ে আরেকটি বিষয়কে প্রমাণ করার প্রয়োজন হয়, এবং সেই দ্বিতীয়টি প্রমাণ করতে তৃতীয়টি, এভাবে অসীম পর্যন্ত চলতে থাকে। যেমন, ‘ক’ প্রমাণ করতে ‘খ’ প্রয়োজন, ‘খ’ প্রমাণ করতে ‘গ’ প্রয়োজন, এবং এভাবে চলতেই থাকে, যার কোনো শেষ নেই। ফলে মূল বিষয়টি কখনোই প্রমাণিত হয় না।
দোলাচল (Logical See-Saw): এর অর্থ হলো, দুটি ধারণার একটিকে প্রমাণ করার জন্য অন্যটির উপর নির্ভর করা, এবং অন্যটিকে প্রমাণ করার জন্য প্রথমটির উপর নির্ভর করা। এটি এমন এক অবস্থা, যেখানে কোনো একটি ধারণা স্থির বা স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
অদ্বৈতবাদীদের উপসংহার: অতএব, অদ্বৈতবাদীদের মতে, দ্বৈতবাদীরা তাঁদের অনুমান যুক্তি দ্বারা কখনোই এটা প্রমাণ করতে পারে না যে, বস্তু (যেমন হাঁড়ি) এবং বস্তুর জ্ঞান (হাঁড়ি-জ্ঞান) দুটি ভিন্ন সত্তা। প্রত্যক্ষ জ্ঞান যেমন এই পার্থক্যকে চূড়ান্তভাবে দেখাতে পারে না, তেমনই অনুমানও পারে না। সহজ ভাষায়, দ্বৈতবাদীরা যে কাপড়-হাঁড়ির উদাহরণ দিয়ে ‘পার্থক্য’ প্রমাণ করতে চাইছেন, তা আসলে একটি চক্রাকার যুক্তি। তাঁরা এমন কিছুর উপর নির্ভর করে পার্থক্য প্রমাণ করতে চাইছেন, যা নিজেই পার্থক্য প্রমাণের অপেক্ষায় রয়েছে। অর্থাৎ, তাঁদের যুক্তি স্ব-প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং এক প্রকার ফাঁদে আটকে গেছে। অদ্বৈতবাদীরা এখানে বোঝাতে চাইছেন যে, জ্ঞান এবং জ্ঞেয় বস্তুর মধ্যে পার্থক্য এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন, যা জ্ঞানকেই সেই পার্থক্য উপলব্ধির ভিত্তি করে না তোলে।
বেদান্ত দর্শনের মূল ভিত্তি হলো অদ্বৈতবাদ—এই মতবাদ যে, ব্রহ্মই একমাত্র পরম সত্য এবং জগৎ ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়: যদি বেদের চূড়ান্ত শিক্ষা অভেদ বা অদ্বৈততা হয়, তবে কীভাবে বেদ জগতকে ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন বা দ্বৈতরূপে উপস্থাপন করতে পারে?
বেদ, বিশেষত উপনিষদ অংশ, ব্রহ্মজ্ঞান এবং মুক্তি লাভের পথ নির্দেশ করে। এই শিক্ষাগুলির মূল নির্যাস হলো: “একমেবাদ্বিতীয়ম” (তিনি এক এবং দ্বিতীয় রহিত), “নেহ নানাস্তি কিঞ্চন” (এখানে বহুত্ব বলতে কিছুই নেই), এবং “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (এই সব কিছুই ব্রহ্ম)। এই মহাবাক্যগুলি স্পষ্টত ঘোষণা করে যে, ব্রহ্মই একমাত্র বাস্তব সত্তা এবং জগৎ তার থেকে পৃথক নয়। যদি বেদের প্রধান উদ্দেশ্য অভেদ জ্ঞান প্রদান হয়, তবে এটি অসম্ভব যে, বেদ একই সাথে ভেদ বা দ্বৈততা শেখাবে, অর্থাৎ জগৎ বাস্তব এবং ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন—এমন কোনো ধারণা প্রচার করবে। কারণ, যদি এমনটা হতো, তাহলে বেদের বাক্যগুলিতে স্ববিরোধিতা দেখা দিত, যা কোনো প্রামাণ্য শাস্ত্রের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
আপত্তি: সৃষ্টি-বিষয়ক বেদবাক্য এবং দ্বৈততার ধারণা—তবে, একটি গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি উত্থাপিত হয়, যখন আমরা বেদের সৃষ্টি-বিষয়ক বাক্যগুলি পর্যবেক্ষণ করি। উদাহরণস্বরূপ, যখন বেদ বলে, “ব্রহ্ম থেকে জগতের উৎপত্তি,” তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে যে, সৃষ্ট জগৎ ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন। যদি জগৎ ব্রহ্ম থেকে অভিন্নই হতো, তবে “উৎপত্তি” শব্দটি ব্যবহারের কোনো সার্থকতা থাকত না। উৎপত্তির ধারণাটি একটি কার্য-কারণ সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে কার্য (জগৎ) কারণ (ব্রহ্ম) থেকে পৃথক বলেই বিবেচিত হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মনে হয়, বেদ নিজেই দ্বৈততাকে স্বীকার করছে।
বেদান্তের উত্তর: সৃষ্টি-বাক্যের প্রকৃত উদ্দেশ্য—এই আপত্তির উত্তরে বেদান্ত দর্শন একটি গভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। এর মূল যুক্তি হলো: সৃষ্টি-বিষয়ক বেদবাক্যগুলির উদ্দেশ্য জগৎকে ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন প্রমাণ করা নয়, বরং অন্যান্য দার্শনিক মতবাদ, যেমন সাংখ্যদর্শনের ‘প্রধান’ বা ‘প্রকৃতি’-কে জগতের কারণ হিসেবে অস্বীকার করা। সাংখ্যদর্শন জগৎকে প্রকৃতি নামক একটি স্বাধীন ও জড় উপাদান থেকে উৎপন্ন বলে মনে করে। বেদান্ত এই মতবাদকে খণ্ডন করে প্রমাণ করতে চায় যে, একমাত্র ব্রহ্মই জগতের কারণ।
এটিকে একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বোঝা যেতে পারে: যেমন মাটি ও হাঁড়ির (কারণ ও কার্য) মধ্যে প্রকৃত ভেদ নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। হাঁড়িকে মাটিরই একটি বিশেষ রূপ বা বিকার বলা হয়, মাটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো সত্তা নয়। তেমনি, ব্রহ্ম (কারণ) ও তার কার্য (জগৎ)—এর মধ্যেও কোনো প্রকৃত ভেদ নির্দিষ্ট করা যায় না। জগৎ ব্রহ্মের একটি প্রকাশ বা নামরূপ মাত্র, ব্রহ্ম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক কোনো বাস্তব সত্তা নয়। অতএব, সৃষ্টি-বিষয়ক বেদবাক্যগুলির প্রকৃত উদ্দেশ্য থাকে শুধু এই বোধ তৈরি করা যে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, দ্বিতীয় কিছু নেই। এই বাক্যগুলি মূলত অদ্বৈত জ্ঞানকে আরও দৃঢ় করার একটি উপায়।
নিষেধ-বাক্যের গুরুত্ব এবং অনুমান বনাম শ্রুতি: যদি আমরা ধরে নিই যে, বেদ ভেদ-শিক্ষা দিচ্ছে, তবে বেদে বিদ্যমান নিষেধ-বাক্যগুলি, যেমন “ব্রহ্মে কোনো ভিন্নতা নেই” (নেহ নানাস্তি কিঞ্চন), “নেতি নেতি” (এ নয়, ও নয়)—এগুলির কোনো মানেই থাকবে না। এই নিষেধ-বাক্যগুলি ব্রহ্মের নির্গুণ, নিরাকার এবং অভিন্ন সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। যদি সৃষ্টিবাক্যগুলি ভেদ প্রমাণ করত, তবে এই নিষেধ-বাক্যগুলি অর্থহীন হয়ে পড়ত, যা বেদের আভ্যন্তরীণ সঙ্গতির পরিপন্থী।