বেদের আলোয় অদ্বৈত: তেইশ



কারণ-কার্য সম্পর্কের স্বরূপ এবং অবিদ্যার ভূমিকা:

অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে কারণ-কার্য সম্পর্ককে প্রচলিত অর্থে দেখা হয় না। প্রচলিত অর্থে আমরা মনে করি, নির্দিষ্ট কিছু উপাদান নির্দিষ্ট কিছু কার্যের জন্ম দেয়—যেমন মাটি থেকে হাঁড়ি তৈরি হয়, সুতো থেকে কাপড় তৈরি হয়। কিন্তু অদ্বৈত মতে, এই ধারণা গভীরভাবে পর্যালোচনা করার দাবি রাখে।

অদ্বৈতের বক্তব্য হলো, সমস্ত কার্য (যেমন হাঁড়ি, কাপড়, আসবাবপত্র, ঘরবাড়ি, এমনকি আমাদের শরীর ও মন) কোনো বিশেষ উপাদানের কারণে নয়, বরং এগুলো অবিদ্যাজনিত। অবিদ্যা মানে হলো অজ্ঞতা বা মায়া। এটি সেই শক্তি, যা ব্রহ্মের একত্বকে ঢেকে রেখে বহুত্বের ভ্রম সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা হাঁড়ি দেখি, তখন আমরা মনে করি, মাটিই তার কারণ। যখন আমরা কাপড় দেখি, তখন সুতোকেই তার কারণ হিসেবে জানি। কিন্তু অদ্বৈতবাদীরা এই ধারণাগুলোকে স্বপ্নাবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন। স্বপ্নে আমরা যে হাঁড়ি বা কাপড় দেখি, তার জন্য মাটি বা সুতোর ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, কারণ স্বপ্নদৃশ্যের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। স্বপ্নকালে মাটি বা সুতো সেখানে উপস্থিত থাকে না এবং জাগতিক কারণ-কার্য সম্পর্ক সেখানে প্রযোজ্য নয়। ঠিক একইভাবে, জাগ্রত অবস্থার কারণ-কার্য সম্পর্কও অবিদ্যারই সৃষ্টি। অর্থাৎ, আমরা যা-কিছুকে কারণ ও কার্য হিসেবে দেখি, তা আসলে অবিদ্যার আবরণেই প্রতিভাত হয়। এই জাগতিক সম্পর্কগুলো আপেক্ষিক সত্য, পরম সত্য নয়।

ব্রহ্মই একমাত্র সত্য: অবিদ্যা ও প্রতীতির রহস্য

অদ্বৈত দর্শনের মূল ভিত্তি হলো, “ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা”। এই সত্যের উপর নির্ভর করে বলা যায়, ব্রহ্ম ব্যতীত সব কিছুই—জ্ঞেয় (যা জানা যায়) হোক, বা জ্ঞান (জানার প্রক্রিয়া)—অবিদ্যারই ফল। এর অর্থ হলো, আমাদের সমগ্র অভিজ্ঞতা-জগৎ, তার বস্তুসমূহ, এবং আমাদের জ্ঞানতত্ত্বের কাঠামো সবই অবিদ্যার মায়িক প্রকাশ। এই সকল জ্ঞেয় ও জ্ঞানের সত্তা কেবল প্রতীতি-নির্ভর (আইরিশ দার্শনিক জর্জ বার্কলির মত—esse est percipi—অস্তিত্ব (esse) হলো প্রত্যক্ষ/অনুভূত হওয়া (percipi)), অর্থাৎ তাদের অস্তিত্ব উপলব্ধির উপর নির্ভরশীল—“অস্তিত্ব মানেই প্রত্যক্ষ হওয়া” বা “To be is to be perceived”। যা উপলব্ধ হয় না, তা বাস্তবে অস্তিত্বহীন—এই দৃষ্টিকোণ থেকে, যতক্ষণ আমরা কোনো কিছুকে উপলব্ধি করি, ততক্ষণই তার অস্তিত্ব থাকে। যখন অবিদ্যা অপসারিত হয়, তখন এই প্রতীতিরও অবসান ঘটে, এবং একমাত্র ব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকে।

(“প্রতীতি” (Sanskrit: pratīti) শব্দের অর্থ হলো—উপলব্ধি / ধারণা / cognition / perception—জ্ঞানের জন্ম / অভিজ্ঞতার উপস্থিতি / কোনো কিছুর উপলব্ধি হওয়া—কোনো বিষয়কে যখন আমাদের চেতনায় উপস্থিত বা প্রকাশিত হয়, তখন তাকে প্রতীতি বলা হয়।

ন্যায়-দর্শনে (Nyāya): প্রতীতি মানে জ্ঞানের উৎপত্তি—যে-জ্ঞানের দ্বারা আমরা কোনো বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে অবগত হই। যেমন “এটি ঘড়া” বলে জানার মধ্যে যে-জ্ঞান জন্মায়, সেটি প্রতীতি।

বৌদ্ধ দর্শনে: “প্রতীতি-সমুত্পাদ” (pratītya-samutpāda) মানে হলো “পরস্পর নির্ভর করে উৎপন্ন হওয়া”। এখানে প্রতীতি মানে হলো “নির্ভরতা” (dependence)। যেমন: “অবিদ্যা থাকলে সংস্কার হয়, সংস্কার থাকলে চিত্তপ্রবাহ হয়…” ইত্যাদি।

অদ্বৈত বেদান্তে: প্রতীতি বলতে সাধারণত অভ্যাসগত ভ্রান্ত উপলব্ধি বোঝানো হয়। যেমন দড়িকে সাপে দেখা = ভুল প্রতীতি। মাটির পাত্রকে স্বর্ণ মনে করা = ভ্রান্ত প্রতীতি। এগুলো অবিদ্যা-জাত প্রতীতি।

উদাহরণস্বরূপ, ইন্দ্রিয়গত প্রতীতি: চোখে ফুল দেখা; মানসিক প্রতীতি: স্বপ্নে অভিজ্ঞতা হওয়া; ভ্রান্ত প্রতীতি: মরীচিকায় জলের প্রতীতি।)

এই ধারণার সমর্থন মেলে ঋষি বাশিষ্ঠের ঘোষণায়, যা যোগবাশিষ্ঠ নির্বাণপ্রকরণ (৬.২০)-এ বলা হয়েছে: “সব কিছু অবিদ্যা থেকে উৎপন্ন; তারা বুদ্‌বুদের মতো ক্ষণিক; এবং অবশেষে মহাসমুদ্রস্বরূপ জ্ঞান (অর্থাৎ ব্রহ্ম)-এ বিলীন হয়।” এই উপমাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সমুদ্র থেকে বুদ্‌বুদ যেমন উৎপন্ন হয়ে আবার সমুদ্রেই মিশে যায়, তেমনি জগৎ ও তার সমস্ত নামরূপ ব্রহ্ম থেকেই উৎপন্ন হয়ে আবার ব্রহ্মেই ফিরে যায়। বুদ্‌বুদ ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর, কিন্তু সমুদ্র চিরন্তন ও অপরিণাম-নির্ভর। ঠিক তেমনি, জাগতিক বস্তুসমূহ ক্ষণস্থায়ী ও মায়িক, কিন্তু ব্রহ্ম নিত্য ও সত্য।

প্রতিপক্ষের আপত্তি এবং অদ্বৈতপক্ষের অবস্থান: অদ্বৈত দর্শনের এই radical (মৌলিক) দাবি স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আপত্তির সম্মুখীন হয়েছে।

প্রতিপক্ষের আপত্তি: যদি অদ্বৈতবাদীরা মাটি, সুতো ইত্যাদিকে হাঁড়ি বা কাপড়ের বাস্তব কারণ হিসেবে অস্বীকার করেন, তবে সংশয়বাদীও তো কিছু অনুমানের উপর নির্ভর করতে বাধ্য। অর্থাৎ, যখন কোনো কিছুকে অস্বীকার করা হয়, তখন তার পিছনেও কোনো-না-কোনো যুক্তি বা প্রমাণ থাকে। এই যুক্তির উপর নির্ভর করে প্রতিপক্ষ মনে করেন যে, কারণ-কার্য সম্পর্ক সত্য। যদি কারণ-কার্য সম্পর্ককে সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া হয়, তবে অবিদ্যা জগতের কারণ—এটি কীভাবে প্রমাণিত হবে, যখন এর জন্য কোনো সঠিক উদাহরণ (confirmatory instance) নেই? অর্থাৎ, আমরা কোনো এমন দৃষ্টান্ত দেখি না, যেখানে অবিদ্যা সরাসরি কোনো বস্তুর কারণ হচ্ছে, যেমন আমরা মাটি থেকে হাঁড়ি তৈরি হতে দেখি। প্রতিপক্ষ এই 'অবিদ্যা' নামক ধারণার উপর সন্দেহ প্রকাশ করেন, কারণ এর কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ তাদের অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে না।

অদ্বৈতপক্ষের অবস্থান: এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতপক্ষ দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে যে, ইন্দ্রিয় কোনো জ্ঞানের যন্ত্র নয়, কারণ জ্ঞান ও জ্ঞেয় উভয়ই অবিদ্যাজাত। এখানে 'ইন্দ্রিয়' বলতে কেবল পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয় নয়, বরং মন ও বুদ্ধিকেও বোঝানো হচ্ছে, যা জাগতিক জ্ঞান আহরণ করে। অদ্বৈতমতে, যা-কিছু আমরা জানি এবং যার সম্পর্কে জানি, সবই অবিদ্যার মায়া। আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান, আমাদের যুক্তিবাদী চিন্তা—সব কিছুই অবিদ্যার গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অতএব, ইন্দ্রিয়লব্ধ প্রমাণ বা জাগতিক যুক্তি দিয়ে অবিদ্যাকে বিচার করা যায় না, কারণ সেই বিচার প্রক্রিয়াটিও অবিদ্যারই অংশ।

অদ্বৈতবাদীরা জোর দিয়ে বলেন যে, হাঁড়ি-মাটি বা কাপড়-সুতো প্রভৃতি কারণ-কার্য সম্পর্কও অবিদ্যা-সৃষ্ট ভ্রান্তি। আমাদের জাগতিক অভিজ্ঞতা অনুসারে যে কারণ-কার্য সম্পর্ক দেখা যায়, তা চূড়ান্ত সত্য নয়, বরং অবিদ্যারই প্রকাশ। এই আপেক্ষিক সত্যকে অতিক্রম করে পরম সত্যে পৌঁছাতে হলে অবিদ্যার আবরণ উন্মোচন করতে হবে। একমাত্র সত্য ব্রহ্ম। বাকি সব কিছু অবিদ্যা-সৃষ্ট বুদবুদের মতো, যা ক্ষণস্থায়ী এবং অবশেষে ব্রহ্মেই লীন হয়। এই বুদ্‌বুদের উপমাটি অদ্বৈত দর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ক্ষণস্থায়ী মায়াময় জগতের সঙ্গে শাশ্বত ব্রহ্মের পার্থক্য বোঝায়। যেমন বুদ্‌বুদ সমুদ্র থেকেই উৎপন্ন হয়ে আবার সমুদ্রেই মিশে যায়, তেমনি জগতের সমস্ত নামরূপ ব্রহ্ম থেকেই উৎপন্ন হয়ে আবার ব্রহ্মেই ফিরে যায়। এটি জন্ম, স্থিতি ও লয়ের চক্রকে ব্রহ্মের সাথে একীভূত করে।

প্রতিপক্ষের আরও গভীর আপত্তি এবং অদ্বৈতের সংকট: প্রশ্ন উঠতে পারে—অবিদ্যাকে যদি জগতের কারণ বলা হয়, তবে কি কারণ-কার্য সম্পর্ককে সত্য (real) ধরে নিতে হবে? যদি না ধরি, তবে অবিদ্যার কার্য-কারণও বলা যাবে না। যদি ধরি, তবে তখন যুগপৎ উপস্থিতি-অনুপস্থিতি (anvaya–vyatireka) ইত্যাদি অনুমানপদ্ধতিও (যা সাধারণ কারণ নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়) বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হিসেবে মানতে হবে।

এই পদ্ধতি অনুযায়ী, একটি কারণ উপস্থিত থাকলে কার্য ঘটে, এবং কারণ অনুপস্থিত থাকলে কার্য ঘটে না। কারণ কার্য-কারণ প্রমাণের জন্য অন্য কোনো পদ্ধতি নেই। অতএব, যখন হাঁড়ি-মাটি, কাপড়-সুতো ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই অনুমান পদ্ধতিতে কারণ নির্ধারণ করা হয়, তখন অবিদ্যাকে কারণ বলে গ্রহণ করে মাটি, সুতো ইত্যাদিকে অস্বীকার করা অনুচিত। প্রতিপক্ষ বোঝাতে চাইছেন যে, অদ্বৈতবাদীরা একদিকে কারণ-কার্য সম্পর্ককে মিথ্যা বলছেন, আবার অন্যদিকে অবিদ্যাকে জগতের কারণ হিসেবে উপস্থাপন করছেন, যা একটি স্ব-বিরোধিতা। যদি কারণ-কার্য সম্পর্কই মিথ্যা হয়, তবে অবিদ্যার সাথে জগতের কার্য-কারণ সম্পর্ক কী করে সত্য হতে পারে?

আবার, অবিদ্যাকে জগতের কারণ বলে যে, তাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত—অবিদ্যা কি একমাত্র কারণ, না কি কর্মফল (অদৃষ্ট), ঈশ্বর, ও অন্যান্য সাধারণ কারণের সঙ্গে মিলিত হয়ে কার্য করে? যদি বলা হয়, অবিদ্যা একমাত্র কারণ—তবে তা মানা যায় না। কারণ, একক কারণ থেকে বহুবিধ কার্য উৎপন্ন হওয়া অসম্ভব। জগতে যে বৈচিত্র্যময় কার্য দেখা যায়, তা একটি মাত্র কারণ থেকে উৎপন্ন হতে পারে না। উপরন্তু, অবিদ্যা জড় (অচেতন), তাই চেতন আশ্রয় (যেমন ঈশ্বরের ইচ্ছা) ছাড়া এটি কার্যকর হতে পারে না। জড় বস্তুর পক্ষে স্বাধীনভাবে কার্য উৎপাদন করা সম্ভব নয়। আবার যদি বলা হয়, অবিদ্যা কর্মফল, ঈশ্বর ইত্যাদির সঙ্গে মিলিত হয়েই কারণ—তাহলেও সমস্যা। কারণ তখন যেহেতু এই বিভিন্ন কারণ দিয়েই বহুবিধ কার্য ব্যাখ্যা করা যায়, তবে অবিদ্যাকে বিশেষভাবে কারণ ধরার প্রয়োজন কী? যদি ঈশ্বর বা কর্মফলের মাধ্যমেই জগতের বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করা যায়, তবে অবিদ্যার অতিরিক্ত ধারণাটির আর প্রয়োজন থাকে না। এটি 'লাঘব' (simplicity) নীতির লঙ্ঘন।

প্রতিপক্ষের আরও বক্তব্য—এভাবে প্রমাণিত হলো যে, ইন্দ্রিয় ও অন্যান্য মানবীয় প্রমাণ, এবং বেদের প্রারম্ভিক অংশ (যা যজ্ঞ ইত্যাদি দ্বারা পুত্র, পশুসম্পদ, স্বর্গ প্রাপ্তির কথা বলে)—সবই বিশ্বাসযোগ্য। যদি অদ্বৈতবাদীরা মানবীয় প্রমাণ (প্রত্যক্ষ, অনুমান ইত্যাদি) এবং বেদের প্রারম্ভিক অংশের (কর্মকাণ্ড) বিশ্বাসযোগ্যতা অস্বীকার করেন, তবে কোন মত গ্রহণ করা যায়? কারণ এতে মানুষ বাস্তব অভিজ্ঞতা (যা ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধ) ও বেদ (যা পরম প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত)—উভয়ের বিরোধী অবস্থায় দাঁড়ায়।

প্রতিপক্ষ দাবি করে যে, অদ্বৈতের অবস্থান সাধারণ লৌকিক অভিজ্ঞতা এবং বৈদিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অতএব, প্রতিপক্ষ উপসংহার টানলেন—”অবিদ্যাই জগতের একমাত্র কারণ”—এমন দাবি অতিত্বরিত ও অবিবেচনাপ্রসূত। তাদের মতে, এটি কেবলমাত্র একটি দার্শনিক অনুমান, যা প্রতিষ্ঠিত প্রমাণের উপর ভিত্তি করে নয়। এই আপত্তিগুলো অদ্বৈত বেদান্তকে তার নিজস্ব যুক্তির মধ্যে সুসংহত থাকার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। অদ্বৈতবাদী এর উত্তরে শ্রুতি (বেদান্ত/উপনিষদ)-কে পরম প্রমাণ হিসেবে স্থাপন করে, এবং যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরে। তারা বলে, অবিদ্যাকে কেবলমাত্র 'অনির্বচনীয়' হিসেবেই বর্ণনা করা যায়, অর্থাৎ একে 'আছে' বা 'নেই' কোনো ভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না, কারণ এটি ব্রহ্মের মতো সৎ নয়, আবার শূন্যের মতো অসৎও নয়। এটি ব্রহ্মে অধ্যস্ত, কিন্তু ব্রহ্মের সত্যতাকে স্পর্শ করে না।

এখানে মূল বিতর্কের জায়গাটি হলো, অদ্বৈত পক্ষ মনে করে, অবিদ্যাই একমাত্র কারণ। এই মতবাদের বিরোধীরা এর কার্য-কারণ সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করে। যদি কার্য-কারণ সম্পর্ককে সত্য বলে ধরা হয়, তাহলে অবিদ্যাকে আলাদা করে কারণ বলা অযৌক্তিক। বরং কর্মফল, ঈশ্বর ইত্যাদিই যথেষ্ট। আর যদি কার্য-কারণ সম্পর্ককেই অস্বীকার করা হয়, তবে অবিদ্যাকে কারণ বলা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

অদ্বৈতপক্ষ এই বিতর্কের উত্তরে বলে, কোনো কার্যকে “পূর্বে বিদ্যমান” থেকে উৎপন্ন বলা যায় না, তেমনি “পূর্বে অবিদ্যমান” থেকেও উৎপন্ন বলা যায় না। এর কারণ হলো, কার্য-কারণ সম্পর্কের স্বরূপই ব্যাখ্যাতীত—এটি শেষ পর্যন্ত অবিদ্যায় পৌঁছে যায়। কেন পৌঁছে যায়? ভেঙে বলছি।

কার্য-কারণ সম্পর্ক—কার্য (effect) = ফলাফল / উৎপন্ন বস্তু; কারণ (cause) = যা থেকে কার্য উৎপন্ন হয়; উদাহরণ: মাটি (কারণ) থেকে ঘড়া (কার্য) তৈরি হয়। মানুষের যুক্তি ও অভিজ্ঞতার জগতে সবসময় আমরা কার্যকে কারণে নির্ভর করিয়ে বুঝি—“এটি ওটার ফল।”

কিন্তু এতে সমস্যা কোথায়?

যখন দর্শনশাস্ত্রে গভীরে গিয়ে কার্য-কারণের মূল স্বরূপ বিশ্লেষণ করা হয়, তখন দেখা যায়—কার্য আসলে কারণে আগে ছিল, না পরে হলো? যদি আগে থেকেই কারণে থাকে, তবে সৃষ্টি বা নতুন কিছু হওয়ার অর্থ কী? আর যদি একেবারেই আগে না থাকে, তবে অকারণ থেকে কিছু হঠাৎ হলো কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর যুক্তি দিয়ে চূড়ান্তভাবে দেওয়া যায় না।