বেদ ও ব্রহ্ম: আট




আবার বলা হয়: “কেন আমরা বেদ অধ্যয়ন করব? কেন আমরা যজ্ঞ করব?”—এসব জায়গায় যজ্ঞাদি ত্যাগের কথা বলা হয়েছে। অতএব, “তিন ঋণ শোধ করে তবে জ্ঞানলাভ” (মনুসংহিতা, ৬।৩৫)—এই বাক্যের আসল উদ্দেশ্য হলো—যে-ব্যক্তি গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করেছে, অথচ মনে করে: “শুধু আত্মজ্ঞানেই আমার লক্ষ্য সিদ্ধ হবে”, এবং সেই কারণে তিন ঋণ শোধ করতে (নির্দিষ্ট যজ্ঞাদি করতে) উদাসীন থাকে—সে যদি সেগুলো সম্পন্ন না করে, তবে সে পাপী হয়। আর সেই পাপই হয়ে দাঁড়ায় জ্ঞান-উদয়ের অন্তরায়। সহজ করে বললে: শাস্ত্রের সব বিধানই জ্ঞানপথে নিয়ে যায়—এটা সাধারণ নীতি নয়। কিছু গ্রন্থে যজ্ঞ-ত্যাগ, কিছু গ্রন্থে যজ্ঞ-সম্পাদন—উভয়ই প্রসঙ্গভেদে বলা হয়েছে। তাই “তিন ঋণ শোধ না করলে জ্ঞান হবে না”—এটা গৃহস্থাশ্রমীর জন্য প্রযোজ্য নিয়ম; কিন্তু সর্বজনীন সত্য নয়।

আরেক ধরনের মত অনুযায়ী, যজ্ঞাদি—যাদের ফল (যেমন স্বর্গলাভ) দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়—তবুও জ্ঞানের অন্তর্গত সহায়ক হিসেবে তাদেরকে ধরা হয়, “দ্বৈত-অদ্বৈত একত্ব”-এর নীতি অনুযায়ী। যেমন শ্রুতি বলেছে—“ব্রাহ্মণেরা বেদ অধ্যয়ন ও যজ্ঞের মাধ্যমে সেই (ব্রহ্ম) জানতে চায়” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৪।৪।২২)। কিন্তু এখানে যাগ-যজ্ঞাদি জ্ঞানের সহায়ক—এই অর্থে যে, সেগুলি জ্ঞানকে প্রকাশিত করতে সাহায্য করে, আলাদা কোনো ফল উৎপাদনে নয়; যেমন প্রাযাজ নামক আচারাদির ভূমিকা থাকে ফল আনয়নে; কারণ জ্ঞানের বাইরে অন্য কোনো ফল নেই।

প্রাযাজ (Prāyāja) হলো বৈদিক যজ্ঞের একটি অঙ্গযাগ (sub-ritual)। মূল যজ্ঞ শুরু হবার আগে অগ্নিতে যে পাঁচটি ছোটো ছোটো হোম করা হয়, সেগুলোকে প্রাযাজ বলে। এর অর্থ: “প্রা + আযাজ” → প্রারম্ভিক যাগ বা পূর্বাহুতি। এগুলো মূল যজ্ঞের (যেমন দর্শপূর্ণমাস, অগ্নিষ্টোম ইত্যাদি) জন্য প্রস্তুতি ও পবিত্রতা তৈরি করে। প্রাযাজ ছাড়া মূল যজ্ঞ অসম্পূর্ণ ধরা হয়। এগুলো যজ্ঞকে কার্যকর করার জন্য সহায়ক, কিন্তু নিজেরা স্বাধীন কোনো ফল আনে না। সাধারণত পাঁচটি দেবতার উদ্দেশ্যে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়: অগ্নি, সোম, সবিতা, সরস্বতী, পূষণ। এই পাঁচ দেবতা যজ্ঞশক্তি, জীবনশক্তি ও জ্ঞানশক্তির প্রতীক। প্রাযাজ হলো যজ্ঞের শুরুতে করা ছোটো হোম। এগুলো মূল যজ্ঞের সহায়ক (subsidiary); যেমন দেহে উষ্ণতা ছাড়া প্রাণ টেকে না, তেমনি প্রাযাজ ছাড়া মূল যজ্ঞ পূর্ণতা পায় না।

এখন, “শুদ্ধি”-সংক্রান্ত গ্রহণযোগ্য মতটিও দেখা যাক—যজ্ঞাদি মানুষকে শুদ্ধ করে তোলে, আর সেই শুদ্ধিই তাকে জ্ঞানলাভের যোগ্য করে। এজন্যই স্মৃতিতে বলা হয়েছে: “শুদ্ধ ব্যক্তির কাছেই জ্ঞান উদয় হয়।” এবং ব্রহ্মসূত্রেও (৩।৪।৩২) বলা হয়েছে—“আশ্রম-সংক্রান্ত যজ্ঞাদি অবশ্যই পালন করতে হবে, কারণ সেগুলো শাস্ত্রে নির্দেশিত।” যজ্ঞের নিজস্ব ফল থাকলেও (যেমন স্বর্গলাভ), এগুলো আসলে জ্ঞানকে প্রকাশে সাহায্যকারী। জ্ঞান ছাড়া অন্য কোনো পরম ফল নেই। যজ্ঞ মানুষকে অন্তঃশুদ্ধি দেয়, আর শুদ্ধ ব্যক্তির কাছেই আত্মজ্ঞান উদিত হয়। এজন্যই শাস্ত্র বলছে—আশ্রমধর্মের যজ্ঞাদি অবশ্যই পালন করতে হবে।

আপত্তি: জ্ঞান উৎপন্ন হয় প্রত্যক্ষ জ্ঞানপ্রমাণ থেকে; তাই যেসব প্রত্যক্ষ উপায় অনুশীলনযোগ্য—যেমন মন নিয়ন্ত্রণ, ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি—এসব বিশেষ উপায়, এবং যা যা চিত্তের অশান্তি নিবারণ করে, সেগুলো অবশ্যই অনুসরণযোগ্য। কারণ, কেবল সেই ব্যক্তি—যিনি শান্তচিত্তে ধ্যানচর্চা করেন—তাঁর কাছেই বিশুদ্ধ জ্ঞান উদিত হয়। যজ্ঞাদি এখানে প্রয়োজনীয় নয়; কেননা যজ্ঞ ছাড়াও কেবল ধ্যানের দ্বারা জ্ঞান লাভ ঘটে।

খণ্ডন: এটি সত্য; এইভাবেই আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনকারীরা বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভ করতে চান, এমনকি যজ্ঞাদি ছাড়াও। তবে একটা পার্থক্য রয়েছে সময়-এর দিক থেকে—বিশেষ উপায় থাকলে জ্ঞান দ্রুত বা অত্যন্ত দ্রুত প্রকাশিত হয়; আর সেই উপায় না থাকলে তা ধীরে বা অত্যন্ত ধীরে প্রকাশিত হয়। এজন্যই বলা হয়েছে—“যজ্ঞাদি সমস্ত কর্মেরও প্রয়োজন আছে, কারণ শাস্ত্র যজ্ঞ প্রভৃতি নির্দেশ করেছে; যেমন ঘোড়ার ক্ষেত্রে।” (ব্রহ্মসূত্র, ৩।৪।২৬) এখানে অর্থ হলো—যদিও কেবল ধ্যানের দ্বারাই জ্ঞান লাভ হতে পারে, তবুও সমস্ত যজ্ঞের প্রয়োজন আছে, কেননা শ্রুতি বলেছে—“যজ্ঞ দ্বারা, দান দ্বারা…” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৪।৪।২২)।

একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলছি। কোনো গ্রামে ঘোড়া ছাড়া গেলেও পৌঁছনো যায়, কিন্তু দ্রুত বা কষ্টহীনভাবে পৌঁছনোর জন্য ঘোড়া নেওয়া হয়—তেমনি জ্ঞানও কেবল ধ্যানের দ্বারা হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু যজ্ঞ ইত্যাদি সহায়ক হলে তা দ্রুত ও সহজে অর্জিত হয়। অজ্ঞান বা অবিদ্যা দূর করতে কেবল ধ্যানই যথেষ্ট, কিন্তু তাতে সময় বেশি লাগে। যজ্ঞ, দান, ব্রহ্মচর্য, ইন্দ্রিয়-সংযম এগুলো সহায়ক উপায়—যেগুলো জ্ঞানলাভকে দ্রুত ও সহজ করে।

আপত্তি: এভাবে বলা যেতে পারে—ব্রহ্ম তো স্বভাবতই জ্ঞানস্বরূপ; জ্ঞান ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন কিছু নয়; আর সেই ব্রহ্ম নিত্য, তাই তাকে নতুন করে কোনো কিছুর দ্বারা সৃষ্টি বা উৎপন্ন করা যায় না। যদি তা-ই হয়, তবে এর জন্য অন্যকিছুর প্রয়োজন কেন?

খণ্ডন: এটির উত্তরে বলা হচ্ছে—যেমন একটি রত্নের রং পাশের কোনো আবরণ দ্বারা ঢেকে যায়, তখন তার আসল রং প্রকাশের জন্য সেই আবরণ সরাতে হয়; এখানেও একইভাবে বুঝতে হবে। আসলে রত্নের পূর্বের রং আবরণের কারণে নষ্ট হয়ে যায়নি; আর আবরণ দূর হলে নতুন করে আরেকটি রংও জন্মায় না। আবার, যদি ধরা হয়, অনেকগুলো ভিন্ন রঙের (যেমন লাল রঙের) মুহূর্ত পেরিয়ে গিয়ে আগের সাদা রং হঠাৎ নতুন করে জন্ম নিল—তাহলে তা কোনো কারণ ছাড়া সম্ভব নয়। যেমন আগুন নিভে গেলে কাঠ একবার কয়লায় পরিণত হলে, সেই কয়লা থেকে আবার নতুন কাঠ হয়ে ওঠে না।

রত্নের রং আসলে আদৌ উৎপন্ন নয়—কেবল আবরণের কারণে ঢাকা ছিল; তাই তাকে প্রকাশের জন্য আবরণটির অপসারণ প্রয়োজন। একইভাবে, আত্মার স্বরূপও কোনো নতুন সৃষ্ট বস্তু নয়, বরং অজ্ঞতার আচ্ছাদন দূর হলেই তা প্রকাশিত হয়। ব্রহ্ম/আত্মা নিত্য, জ্ঞানস্বরূপ, নতুন করে উৎপন্ন হয় না। শুধু অজ্ঞতার আচ্ছাদন সরলেই তার আসল স্বরূপ প্রকাশিত হয়।

আপত্তি: ঠিক আছে, তা-ই হোক; কিন্তু যে-জ্ঞান (রত্নের প্রকৃতি সম্বন্ধে) একজন ব্যক্তি অর্জন করতে চায়, তার জন্য কিছু তো প্রয়োজন। আর সেই জ্ঞান, যা রত্ন থেকে ভিন্ন, সেটাই তো অর্জনযোগ্য। এই ক্ষেত্রে, ব্যক্তির প্রয়াস আসলে জ্ঞানের জন্যই।

খণ্ডন: তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—জ্ঞান কি নিজের জন্যই খোঁজা হয়, না কি বস্তুর স্বরূপ নির্ধারণের জন্য? উত্তর হচ্ছে, জ্ঞান সাধারণত নিজের জন্য খোঁজা হয় না, কারণ আমাদের সমস্ত কার্যকলাপ বস্তুসংশ্লিষ্ট। কার্যকলাপ কেবলমাত্র জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল নয়; ভ্রান্ত জ্ঞানের ওপরও নির্ভরশীল। যদি বলা হয়—বস্তুর প্রকৃতি জানার জন্যই জ্ঞান খোঁজা হয়, তবে আমাদের জ্ঞান অনুসন্ধান আসলে বস্তুর জন্যই। জ্ঞান বস্তুর মধ্যে কোনো পরিবর্তন ঘটায় না; কারণ জ্ঞানের সঙ্গে বস্তুর সরাসরি কোনো যোগ নেই। কাছাকাছি অবস্থান বা সহাবস্থান সর্বত্র ঘটে, কিন্তু সেটা প্রকৃত যোগ নয়। টেবিলে-রাখা কলম ও বই একসঙ্গে আছে, কিন্তু কলমের সঙ্গে বইয়ের কোনো প্রকৃত যোগ বা সম্পর্ক নেই। শরীরের ছায়া শরীরের সঙ্গে দেখা যায়, কিন্তু ছায়া কোনো বাস্তব যোগে শরীরের অংশ নয়। তেমনি, জ্ঞান আর বস্তু পাশাপাশি ঘটে মনে হলেও, জ্ঞান বস্তুতে কোনো পরিবর্তন আনে না। আবার যদি বলা হয়—জ্ঞান বস্তুতে কোনো পরিবর্তন ঘটায়, তাহলে সেটা সবার কাছেই সমানভাবে ধরা পড়ত।

আর এ-ও সম্ভব নয় যে, যে-বস্তু ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়েছে বা যা এখনও আসেনি, তার উপর জ্ঞান কোনো পরিবর্তন আনতে পারে। অতএব, যেমন রত্ন আসলে আচ্ছাদিত নয়, তবুও যেন আচ্ছাদিত মনে হয়, এবং যেন কোনো আচ্ছাদন সরালেই আসল রূপ প্রকাশ পাবে—তেমনি আত্মার বাস্তবতাও আসলে আচ্ছাদিত নয়, তবুও যেন আচ্ছাদিত বলে মনে হয়, আর প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রকাশ পেতে হবে বলে মনে হয়। আত্মা/ব্রহ্ম আসলে সবসময় প্রকাশিত, কিন্তু অজ্ঞতার কারণে যেন ঢাকা বলে মনে হয়। জ্ঞান কোনো নতুন বস্তু সৃষ্টি করে না, কেবল ওই “ঢাকা মনে হওয়া” অবস্থাকে দূর করে।

‘সম্বন্ধ’ হচ্ছে দুটি পদার্থের মধ্যে স্থায়ী বা অস্থায়ী সম্পর্ক। এটি মূলত দুই রকম:

সমবায় (Samavāya) বা অবিচ্ছেদ্য যোগ, যেখানে একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্বই অসম্ভব। উদাহরণ: গুণ–দ্রব্য (রং আর পদার্থ), অংশ–অংশী (হাত–শরীর)। এগুলো অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।

সংযোগ (Saṃyoga) বা অস্থায়ী যোগ ঘটে, যখন দুটি স্বতন্ত্র পদার্থ বাইরে থেকে যুক্ত হলো। উদাহরণ: টেবিলের উপর রাখা কলম, মাটির সঙ্গে পাথরের সংযোগ। এটি সাময়িক ও বিচ্ছিন্নযোগ্য সম্পর্ক।

এখন জ্ঞান–বস্তু প্রসঙ্গে আসি। প্রশ্ন হলো: জ্ঞান (cognition) ও বস্তু (object)-এর মধ্যে কোনো সম্বন্ধ কি আছে? যদি সমবায় বলি—তাহলে জ্ঞান বস্তু ছাড়া থাকতে পারবে না; কিন্তু বাস্তবে জ্ঞান কেবল “প্রকাশক”, বস্তু নিজেই স্বতন্ত্রভাবে থাকে, তাই ‘সমবায়’ যোগ এখানে খাটে না। যদি সংযোগ বলি—তাহলে জ্ঞান ও বস্তু কেবল সাময়িকভাবে যুক্ত, যেমন কলম–টেবিল; কিন্তু এ-ও সঠিক নয়, কারণ জ্ঞান বস্তুতে গিয়ে কোনো বাহ্যিক সংযোগ ঘটায় না। তাই, ন্যায়দর্শনে বলা হয়: জ্ঞান ও বস্তুর মধ্যে কেবলই সহাবস্থান (co-existence) থাকে, এটি কোনো প্রকৃত সম্বন্ধ (সমবায় বা সংযোগ) নয়।

আরও কিছু উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ধোঁয়া ও আগুন: কার্য-কারণ সম্পর্ক—অবিচ্ছেদ্য যোগ। রং ও ফুল: সমবায়—কারণ এখানে রং আলাদা করে টেকে না। চাঁদ ও মেঘ: কেবলই সহাবস্থান—যোগ নেই। জ্ঞান ও বস্তু: সহাবস্থানের মতোই—প্রকৃত যোগ নয়। “কাছাকাছি অবস্থান বা সহাবস্থান সর্বত্র ঘটে, কিন্তু সেটা প্রকৃত যোগ নয়”—মানে: শুধু পাশাপাশি থাকা মানে সমবায় বা সংযোগ নয়। জ্ঞান-বস্তু সম্পর্ক প্রকৃত যোগ নয়, শুধুই সহাবস্থান। জ্ঞান বস্তুকে বদলায় না, শুধু প্রকাশ করে।