বিশ্বের যত কিছু আমাদের পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী নিজের নতুন রূপ নেয়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে নমনীয় চেতনা ধারণ করে বই। এর কারণ, আমরা যেমনই মানসিক অবস্থায় থাকি, একটি ভালো বইয়ের পাতায় ঠিক তেমন কিছু খুঁজে পাই। কোনো সত্যিকারের বন্ধুই বইয়ের মতো নয়—বইয়ের মর্মরাশি যখন আত্মায় গভীরভাবে খোদাই হয়ে যায়, তখন বই হয়ে ওঠে আমাদের অন্তরের সঙ্গী।
সাধারণ মানুষ ভাবে—বন্ধু মানে সেই ব্যক্তি, যে তার সাথে একমত হবে। সে দিক দিয়ে বই-ই সবচেয়ে বাধ্য বন্ধু। যদি তোমার মন অলস হয়, বইও হয়ে যায় নীরস; যদি মন খারাপ হয়, বইয়ের পাতাতেই ভেসে ওঠে তিক্ততা; যদি তুমি বিদ্রুপপ্রবণ হও, প্রতিটি শব্দ মনে হয় ব্যঙ্গ; আর যদি জ্ঞানের খিদে জাগে, বই তখন আগ্রহ নিয়ে তোমাকে তার ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেয়।
যারা পড়তে ভালোবাসে, এবং প্রাচীন গ্রন্থের অমর জ্ঞানকে জীবনে কাজে লাগায়, তারা আত্মবিকাশের এক উচ্চস্তরে পৌঁছায়। সবচেয়ে বড়ো উপলব্ধি হলো—বই আসলে, আমাদের, যা দিই, সেটাই ফিরিয়ে দেয়। তার পাতায় পাতায় প্রতিফলিত হয় আমাদের নিজেদের চিন্তা, আমাদের জীবনবোধের ছায়া।
যখন আমরা প্রাচীন গ্রন্থ পড়ি, আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিলুপ্ত জাতি ও সভ্যতার চিন্তাধারা। তাদের বোঝার আলো আমরা খুঁজে পাই নিজের অন্তরের ভেতরেই। আমাদের নিজস্ব চেতনার চাবিই খুলে দেয় তাদের সিলমোহর-দেওয়া পৃষ্ঠা।
বইয়ের দোকান যেন চিন্তার সমাধিক্ষেত্র। সারি সারি ধুলোমাখা পুরোনো খণ্ড, যাদের কেউ কেউ সেই আদিম মানবের যুগ থেকে তাকেই ঘুমিয়ে আছে। লেখকেরা বহু আগে চলে গেছেন, তবু তাঁদের চিন্তা ও আদর্শ রয়ে গেছে বইয়ের পাতায়। তাঁরা মৃত হলেও তাঁদের ভাবনা চিরজীবী। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বইয়ের পাতায় সেই চিন্তা বেঁচে থাকে।
একটি প্রাচীন দোকানে প্রবেশ করলে মনে হয় যেন এক পবিত্র মন্দিরে ঢুকেছি। নিঃশব্দ শ্রদ্ধা নেমে আসে—কারণ বই মানে কেবল কাগজ নয়, এ যেন এক জীবন্ত মস্তিষ্ক, যার ভেতর সঞ্চিত আছে জ্ঞানের ভাণ্ডার।
সেসব দোকানে পাওয়া যায় হাতে-আঁকা বিভিন্ন অলঙ্কৃত বই, কিংবা এমন বই—যা কিনা কোনো এক সন্ন্যাসীর সারাজীবনে লেখা একটিমাত্র গ্রন্থ। কিছু লেখা চামড়ার বাইন্ডিংয়ে, কিছু আবার কাঠখোদাই বাঁধাইয়ে, আবার কিছু বই মানুষের অবহেলায় ছেঁড়া ও ক্ষতবিক্ষত।
তবু প্রতিটি পুরোনো বই আমাদের অতীতের সাথে যুক্ত করে, আজকের জীবন্ত বর্তমানকে মিশিয়ে দেয় মৃত গতকালের সাথে। তাকের ওপর দাঁড়িয়ে-থাকা বইগুলো যেন স্মৃতিফলক—মানুষের চিন্তার সমাধিলিপি। যেমন কবরস্থান ভরা থাকে মানুষের সন্তান দিয়ে, তেমনি এই পুরোনো বইয়ের দোকানগুলো ভরে থাকে মানবচিন্তার সন্তান দিয়ে।
কিন্তু তাঁদের চিন্তাগুলি মরে না—ওরা চিরকাল বেঁচে থাকে, শুধু অপেক্ষা করে সেই পাঠকের জন্য, যে ভালোবাসা দিয়ে আবার ওদের মুক্তি দেবে।
চলুন, আমাদের নিজস্ব চিন্তার আলো আর জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জীবিত রাখি সেই মহান সত্যগুলোকে। এইসব বইয়ের অনেকগুলোই ছিল মৃত্যুশয্যায় লেখা শেষদান—সেসব মানুষের, যাঁরা মানুষের জন্য সব কিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাঁরা লিখেছিলেন সেই সময়ে, যখন একটি কলমের আঁচড়ও ছিল দুর্দান্ত কষ্টসাধ্য, যখন একটি ভাবনা প্রকাশ করাই মানে ছিল আগ্নেয় চিতায় বা চাকার ঘূর্ণনে মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো।
তাই এই বইগুলো দাঁড়িয়ে আছে একেকটি জীবন্ত সাক্ষী হয়ে—মহান আত্মাদের সাহসের প্রতীক হয়ে। এরা হলো কবি, মরমি, যুগের স্বপ্নদ্রষ্টাদের শেষ উচ্চারণ; যাঁরা অনেক কষ্ট সয়েও তাঁদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে গেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
বই হচ্ছে লেখকের আত্মার কণ্ঠস্বর। ভালো বই আসলে ধনরত্ন—কারণ লেখকের আত্মা কথা বলে বইয়ের প্রতিটি পাতায়। আজ দুর্ভাগ্যক্রমে মহান আদর্শ ও মহৎ চিন্তাধারার বই কমে গেছে। কিন্তু অতীতে, একটি বই ছিল পুরো জীবনের সাধনা, যেখানে প্রতিটি শব্দ জ্বলজ্বল করত লেখকের রক্তের রঙে।
প্রতিটি বইয়ের পেছনে থাকে এক বিশেষ বেদনা, যা আকৃষ্ট করে সেই পাঠকদের, যাদের মধ্যে আছে গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধার অনুভূতি। মানুষ কেন শ্রদ্ধায় কেঁপে উঠবে না—যখন তার হাতে ধরা থাকে আরেকজন মানুষের সারাজীবনের সাধনা, যিনি আজ নীরবে শুয়ে আছেন ছোট্ট কোনো সমাধিক্ষেত্রের উঠোনে, আর যাঁর লেখা পড়ে আছে তাকের ধুলোয় ঢাকা?
বইপড়া একটি শিল্প। অধিকাংশ মানুষ আসলে জানেই না কীভাবে একটি বই পড়তে হয়। যদি জানত, তাহলে এত বই পড়ত না। একজন পাঠককে বই পড়তে হবে যেমনভাবে তা লেখা হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই—ভাবনার সাথে ভাবনা, আত্মার সাথে আত্মা মিলিয়ে।
দার্শনিকদের কাজ বোঝার জন্য আমাদের দার্শনিকের মন থাকতে হবে। প্রাচীন সত্যের অর্থ বুঝতে হলে আমাদের মনকে সুর মেলাতে হবে সেই আত্মাদের সাথে, যাঁরা একদিন তা লিখেছিলেন।
যে সত্যিকারভাবে পড়ে, সে আসলে অমরত্বের রাজ্যে প্রবেশ করে, কারণ প্রতিটি বাক্য বেঁচে থাকার জন্য বছরের পর বছর ধরে আহ্বান করে, প্রতিটি ভাবনা পাঠকের হাতে অর্পিত এক-একটি সন্তান হয়ে ওঠে।
একটি পুরোনো বই হলো একটি রেকর্ড—যা ফিসফিসিয়ে শোনায় সেই যুগের কণ্ঠস্বর, যুগের ইতিহাস, মানবপ্রগতির কাহিনি। পুরোনো বইয়ের দোকানের তাকগুলোয় যে সারি সারি বই শুয়ে আছে, তাদের তুলনা চলে এক মহাজাগতিক গ্রন্থাগারের সাথে—যা আসলে মানব-আত্মার ভেতরেই রক্ষিত।
মানুষের মস্তিষ্কের ধূলিমাখা চিলেকোঠায় আছে এক অদৃশ্য কক্ষ, যেখানে সঞ্চিত আছে বহু বিস্মৃত দিনের স্মৃতি। যদি কেউ অলৌকিক দৃষ্টি পেত সেখানে প্রবেশ করার, তবে সে দেখতে পেত যুদ্ধ আর প্রেম, ঘৃণা আর ভয়, হৃদয়ের দুঃখ আর আনন্দ—সব জীবন্ত হয়ে আছে সেই কক্ষের নীরব দেয়ালে।
এই লুকোনো কক্ষে সঞ্চিত আছে—নালন্দা কিংবা অ্যালেক্সান্দ্রিয়ার ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রন্থাগার, ইনকা ও অ্যাজটেক সভ্যতার পবিত্র গ্রন্থরাজি, এবং প্রাচীন যুগের রহস্যময় শাস্ত্র, জাদু, দর্শন ও শিল্প।
এ সবের প্রতিটিই জীবন্ত আত্মার ন্যায্য অধিকার। আহা, মানুষ যদি শুধু যুগের ধুলো সরিয়ে আবার সেই কক্ষে প্রবেশ করত! এই কক্ষই হলো মহান চিন্তার সূতিকাগার, যা মানবমনের ভেতরে অমর। আর বই আসলে—কাগজে-লেখা চিন্তারাশি মাত্র।
আমাদের পৃথিবীর ইতিহাস—আত্মার চোখে দেখা হলে—প্রতিটি জীবন যেন এক-একটি পৃষ্ঠা, যা আমরা উলটে যাই আর জমা রাখি অতীতের অন্ধকার কোণে, প্রাচীন কোনো পাণ্ডুলিপির মতো।
যখন আমরা জ্ঞানের পথে হাঁটি, যখন অন্তরের আলো আরও দীপ্ত হয়ে ওঠে, তখন আমরা নিজেদের খুঁজে পাই সেই প্রাচীন কক্ষগুলোর মাঝে, রহস্যময় গ্রন্থে ঘেরা। যদি আমরা পড়তে চাই, তবে তাক থেকে নামালেই হবে—আর সেই ধুলোমাখা পাতার ভেতর তখন আবিষ্কার করব আমাদেরই অস্তিত্বের ইতিহাস।
মানবমস্তিষ্কে আছে এক অশেষ ভাণ্ডার—জ্ঞান ও সত্যের এক অক্ষয় ভাণ্ডার। কিন্তু এর দরজা খুলতে পারে কেবল তারা, যারা খুঁজে পেয়েছে সেই গোপন কড়া, যাতে টোকা দিলেই খুলে যায় পথ।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষ এই বিশাল গ্রন্থাগার রচনা করে চলেছে—আগুন আর অশ্রুর আঁচড়ে আঁচড়ে লিখে চলেছে তার নিজেরই ইতিহাস।
একদিন, এক অলৌকিক দিনে, আমরা খুঁজে পাবো সেই ছোট্ট কক্ষ—সেখানে দাঁড়িয়ে, অতীতের আদর্শে-ঘেরা আমরা আবার চিনে নেব—যা করেছি, যে-শক্তি ধারণ করেছি। তখন বুঝতে পারব—আমাদের কোনো পরিশ্রমই বৃথা যায়নি, কারণ আমাদের এই বিশাল গম্বুজাকৃতি চেতনার গ্রন্থাগারে, জীবন্ত ইথারে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে আমাদের প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি কর্ম। এবং, প্রাচীন বইয়ের মতোই, আমাদের যা করতে হবে, তা হলো: শুধু যাপনের তাক থেকে তুলে নেওয়া—আর তাতে ভেসে উঠবে আমাদেরই জীবনচিত্র।