ওদিকে ওর বাসার সবাই হুলস্থূল কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলছে। এ ওকে, সে তাকে ফোন করে করে সবাই রেডি হচ্ছে আমাদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করার জন্য। এমনিতেই ফোনের পর ফোন, এবার সেটা আরও বেড়ে গেল। এক-একটা কলের ভেতর পাঁচ জন করে ওয়েটিং-এ থাকছে। বাইরে লোকজন দেখছে, মানসম্মান আর থাকল না, তাই ভাইয়া আমাদেরকে ঘরে নিয়ে এল। তখনও সে কলে এক-একজনকে বলছে, তাকে আটকে রাখা হয়েছে। সে এখন আটকানো অবস্থায়। যখন আমার ভাই বা আম্মু আসে, তখন কেউ ফোন করলে বলে, এখন একটু ভালো আছে সে। অন্য সময় একের পর এক বলেই যাচ্ছে, সে আটকানো অবস্থায়। কয়েক জনকে বলেছে, আমরা ওকে শিকল দিয়ে আটকে রেখেছি। অথচ রুমে আমরা দুজনই শোয়া বা বসা। আমাদের আশেপাশের অনেকে আমার ভাইকে বলল, ‘আজ রাতে ওদের যেতে দিয়ো না। পথে গিয়ে যদি কোনও বিপদে পড়ে, বলবে, তুমি করেছ। ওদের বাসার কেউ আসুক। নিজ চোখে দেখে যাক, তাকে আটকে রাখার কিংবা মারার মতো এ বাড়িতে কেউ নাই। আমরা কে কেমন সব দেখে তারপর এদেরকে নিয়ে যাক।’ ভাইও ভেবে দেখল ব্যাপারটা। এরপর তাকে বাসায় এটা বলতে বলল। সে বাসায় আবার বলল, ‘ওরা আমাকে আটকে রেখেছে। তোমরা কেউ এসে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাও। তোমরা কেউ না এলে আমাকে ওরা ছাড়বে না। হয়তো মেরেই ফেলবে। তখন আমার লাশটাও আর পাবে না। আমাকে বাঁচাও!’ তখন আমার ভাই ওদেরকে ফোনে বলল, কেউ একজন না এসে আমার শ্বশুরই যেন আসেন। তবে নিজ চোখে দেখলে এই সন্দেহটা দূর হবে, সম্পর্কটা হয়তো ঠিক হবে। কিন্তু নিহাল তখন মিথ্যা বলল। বলল, তার আব্বু নাকি অসুস্থ। অথচ উনি আসলে একদমই সুস্থ। ওরা পরে পাশের বাসা থেকে একটা ছেলেকে পাঠাতে চাইল, রকিব তার নাম, সে এসএসসি পাস করল মাত্র। ও কী বুঝবে এসব! ভাই বলল, ‘কী বলেন আপনারা! এতে হয়?’ পরে আমাদের ভার্সিটিতে পড়ত ওর এক ফ্রেন্ড, তার নাম হাসান, তাকে ডাকল, কিন্তু সে অ্যাভেইলেবল ছিল না, কী একটা কারণে জানি। এরপর ওর ছোটো দুলাভাই, তার চাচাত মামার ফুপাত ভাই নাকি একজন, তাকে পাঠাল আমাদের বাসায়, কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে আটকে রেখে ওকে মারছি আমরা, সেটা বোঝার জন্য। তিনি এলেন। এসে আমাদের বললেন যে তিনি সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার। খুলনাতে পোস্টিং। পরে জেনেছি, আসলে তিনি সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের একটা বাস-কাউন্টারের ম্যানেজার। তবে লোকটা জ্ঞানী এবং ভালো মনের ছিলেন, তাঁর ব্যবহারে তা বুঝেছিলাম। উনি আসার সময় আমাদের এলাকার মেম্বার এবং আর-একজন অনেক প্রবীণ ব্যক্তি, সম্ভবত কোন এক এক্স-মেম্বার, তাঁকে ডেকে নিয়ে এলেন। তখন নিহাল বসে বসে ফেসবুকে মানুষকে জানাচ্ছে উলটাপালটা কথাবার্তা। আর আমি ওর পাশে শুয়ে শুয়ে জব সল্যুশন পড়ছি। সেদিন হুট করে আমাদের বাসায় তিন জন লোক হাজির। ওই লোকটাও আমাদের জানাননি যে ওঁরা আসবেন আমাদের বাসায়। হাতে নাতে দেখবেন, ওঁরা এমন উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছেন। এসে ওঁরা দেখলেন সব। আমার এক চাচাত মামাকে ডাকল আমার ভাই। ভাই আর মামা টুকটাক পরিস্থিতি আর ঘটনা সম্পর্কে বলল ওঁদের। ওই মামাটা সব শুনে নিহালকে বললেন, ‘নিহাল এসব কী? আমি তো কিচ্ছু না জেনেই এসেছি। তবে যেটুকু শুনে এসেছি, সেসব কই? তুমি তো আটকানো নও। এসব কেন করছ? তোমরা দুজনেই শিক্ষিত। তুমি আশা ইউনিভার্সিটি থেকে সিএসই’তে গ্রাজুয়েশন করেছ, আর সানজিদা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ কমপ্লিট করেছে। দুজনে মিলেমিশে অনেক ভালো কিছু করবে। সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ গড়বে। এসব কেন করছ? শোনো, কোনও কিছুকে ভেঙে ফেলা খুব সহজ, তবে গড়া অনেক সাধনার ব্যাপার। এতদিন ধরে দুজনে যা গড়েছ, সেটা এভাবে ভেঙে ফেলো না। তুমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ সম্পর্কে জানোই না। কত জনের সাথে ফাইট করে এক-একটা পজিশন নেওয়া! তুমি একে যে-কোনও জায়গায় যে-কোনওভাবে কাজে লাগিয়ে দিতে পারবে। আর তুমিও তো কিছু একটা করবে। এসব কোরো না।’ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ওই মামা নাকি নিহালের ছোটো দুলাভাইয়ের দুঃসম্পর্কের মামা। কিন্তু এই মামা তাঁর জীবদ্দশায় নিহালের দুলাভাইকে দেখেননি, আর নিহালকে তো চিনতেনই না। নামও জানতেন না। সেই মামা অনেক বোঝালেন আমাদের দুজনকে। আর আমাকে বললেন, ‘আম্মু, তুমি এসবের ভেতরেও পড়ছ দেখে ভালো লাগছে। তুমি জীবনে অনেক বড়ো হও, দোয়া করি। দুজনে মিলেমিশে থাকো।’ আর আমার ভাইকে মামা বললেন, ‘বিষয়টা নিছকই ভুল বোঝাবুঝি ছাড়া আর কিছু না। আমি শুনেছি, ওকে শিকলে আটকে মারছেন আপনারা। আসলে কী বলব জানি না। তবে এই ব্যাপারে দুই পরিবার মুখোমুখি হওয়া দরকার। তাহলেই সব মিটমাট হবে। তৃতীয়পক্ষ দিয়ে কিছু হবে না। নিহালকে আমি নিয়ে যাব না। কারণ এটা আমার উচিত হবে না। আমি নিহালের আব্বুকে বলব আসতে।’ এইটুকু বলে ওঁর নম্বরটা দিয়ে চলে গেলেন উনি। পরের দিন ওঁর ছোটো দুলাভাইয়ের আব্বু এলেন। এই আঙ্কেলই আমাকে বলেছিলেন, আমার মতো মেয়েকে ভাগাড়ে ফেলতে তাঁর একসেকেন্ডও সময় লাগে না। এরকম খুনখারাবি উনি বহুত করেছেন জীবনে। তবে দেখেছেন, ওই জীবনে সুখ নাই, তাই সুখ খোঁজেন এখন। কিন্তু প্রয়োজন হলে আবার অস্ত্র ধরবেন। এসব কথাবার্তা। সেই আঙ্কেল ওই মামার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ওরকম আমাদের না জানিয়ে হুট করে এসে হাজির। এসেই খুব ভাব-টাব নিয়ে নিয়ে কথা বলছেন। আমার মামা যখন কথাগুলি খুলে বললেন, তখন উত্তর খুঁজে পেলেন না। বললেন, ‘আসলেই তো! এসব কী! ওর আব্বুর এসে দেখা উচিত। আচ্ছা, আমি গিয়ে ওদের আসতে বলব।’ বলেই উনি চলে গেলেন। এদিকে নিহাল ওর অফিসে ফোন দিয়ে জানাচ্ছে, ‘স্যার, আমি খুলনা এসেছিলাম। আমি আসলে ম্যারিড (সম্ভবত এতদিন সে সিঙ্গেল পরিচয়ে চলত।), আর আমার শ্বশুরবাড়ি খুলনাতে। সেখানে এরা আমাকে আটকে রেখেছে। যদি বাঁচিয়ে রাখে, তবে যেদিন ছাড়বে, সেদিনই সোজা অফিসে চলে আসব, স্যার।’ ওর এসব কাণ্ড দেখে আমি কিছু বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি। তবে এটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি যে, বেঁচে থাকতে চাইলে আমাকে পড়তে হবে। আমার জীবনের কোনও নিশ্চয়তা নাই। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে! তাই একটু সময় পেলেই বই পড়ি টুকটাক। ১৮ আগস্ট ২০১৯। ওর আব্বু, পাশের বাড়ির এক কাকা (কোনও এককালে মেম্বার ছিলেন, এখন সংসার চলে এসএসসি পাস ওই রকিবের অন্যের ক্ষেতে কাজ করে পাওয়া পয়সায়), যিনি তাঁর পরিচয় দিয়েছেন এলাকার মেম্বার, এক এক্স-চেয়ারম্যান, রকিব, ওর বড়ো দুলাভাই আমাদের বাড়িতে এল। যেহেতু ছোটো দুলাভাই বার বার প্যাঁচ লাগিয়েই যাচ্ছে, তাই এখন সে আর সামনে আসছে না। ওরা এল খুব সকালে। আমাদের দরজা ছিল খোলা। ওরা এসেই হুট করে ঘরে ঢুকে পড়েছে। তখন আমরা শুয়ে গল্প করছি। সে তখনও অনেককেই জানিয়ে যাচ্ছে যে আমরা ওকে আটকে রেখে দিয়েছি। ওরা ঘরে এসেছে। বাসায় তখন ভাইও নেই। ভাই গেছে নিহালের জন্য যে শার্ট-প্যান্ট বানাতে দিয়েছি, ওসব আনতে। সবাইকে বসতে দিয়ে শরবত, মিষ্টি, সেমাই দিচ্ছি। আর ভাইকে ফোন করলাম বাসায় আসতে। শার্ট-প্যান্ট নিয়ে ভাই বাসায় এল। ওদের লোকজনকে আমার মামা আর ভাই সব জানিয়েছে। এ-টু-জেড শুনে চেয়ারম্যান বললেন, ‘সানজিদার জায়গায় আমার মেয়ে থাকলে আমিও আমার মেয়েকে এমন জায়গায় পাঠাতাম না। তাহলে ১৫ দিন সময় নেওয়া হোক, আলাদা থাকুক দুজন। যদি এর ভেতর নিহালের ফ্যামিলি থেকে ফোন দেয়, তবে বুঝবেন তারা বউ চায়। তবে সানজিদাকে ওরা এসে নিয়ে যাবে। আর যদি ফোন না দেয়, তবে বুঝবেন, তারা বউ চায় না। যারা বউ চায় না, তাদের কাছে গিয়ে একটা মেয়ে থাকতে পারে না। অতএব, ডিভোর্স হবে তখন। সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ এক মাস হবে, যা হওয়ার তখন হবে। তবে ছেলের আর মেয়ের মুখের কথা শুনতে চাই আমরা।’ আমার সেই দূরসম্পর্কের মামা আমাকে বোঝালেন, ‘যারা তিন দিনের দিন নতুন বউকে ধরে মারতে পারে, তারা সেই বউকে খুন করতেও দ্বিধা করবে না। তুই এই মুহূর্তে অন্ধ-ভালোবাসার টানে ওখানে যাস না। গেলে মরবি। তুই গিয়ে সবার সামনে গিয়ে বলবি, “আমার ভয় লাগছে। যদি ওইদিন চাচি-শাশুড়ি আমাকে না বাঁচাতেন, তবে আপনি আমার ফ্যামিলিকে কীভাবে বুঝ দিতেন? কিংবা যদি ওরা আমাকে মেরে ঝুলিয়ে দিয়ে বলত, ‘সানজিদা সুইসাইড করেছে’, তখন?”’ উনি আরও বললেন, ‘দেখ মা, তুই যে মানুষটাকে ভালোবেসে সব মেনে নিবি, সেই তো শতকরা নিরানব্বই ভাগ কথাই বলে মিথ্যা। যখন তখন কী করে ফেলবে, আর মিথ্যা দিয়ে চেপে দেবে। তোর আব্বু-আম্মু ছেলেকে টেন পাস করিয়ে মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছে, তাদের মনে কীভাবে সান্ত্বনা দিব যদি ওরা তোকে মেরে ফেলে?’ এসব বিভিন্ন কথা উনি আমাকে বোঝালেন। ওরা সবাই নিহালকে জিজ্ঞেস করল তার কিছু বলার আছে কি না। সে তখন আবছা আবছা এলোমেলো কথা বলছে। ওরা তখন ওকে থামিয়ে দিয়ে আমার কাছে জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, ‘আঙ্কেল, আপনি হয়তো আমার দায়িত্ব নেবেন। তবে ওই দিনের মতো ঘটনা রিপিট হলে আমি আপনার কান পর্যন্ত আমার কথা পাঠাব কীভাবে? কিংবা যে পরিমাণ মিথ্যা নিহাল বলে, তাতে সে আমাকে মেরে ফেলে যদি সব ধামাচাপা দিয়ে দেয়, তখন আপনি কীভাবে কী করবেন, সেটা একটু আমাকে বলেন, আঙ্কেল।’ এর উত্তর উনি দিতে পারেননি। নিহালের ফ্যামিলি থেকে যারা এসেছিল, একজন মানুষও ‘আমাকে নিয়ে যাবে’ এটা বলেনি। রকিবের মতো বাচ্চাছেলেও আমাদেরকে অপমান করতে ছাড়েনি। আমরা খাবার দিলে ওরা কেউ খায় না। খাবারের দিকে কেমন করে করে তাকাচ্ছে। আর নিহালকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে বা বলতে গেলে তারা সবাই আমাদের সামনে এসে পড়ছে, এমনই একটা অবস্থা। নিহাল আমাকে ওরা আসার আগে বলেছিল, ‘আব্বু এলে আমাদের একসাথে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের মাস্ট ডিভোর্স হয়ে যাবে। তবে ওরা এলে আমি ওদের তবু বোঝাব যে আমরা একসাথে থাকতে চাই।’ অথচ ওর আব্বু ঘরে ঢুকলে ও পেছনে গিয়ে বসে বলল, ‘আব্বু, এরা আমাদের ফ্যামিলির সেই যুগ যুগ আগের যে ঝামেলাগুলি, সেগুলি টেনেও কথা তুলছে। এরা আমাকে নানান কথা শুনিয়েছে এই কয়টা দিন। আটকে রেখেছে। আপনি না এলে যেতে দেবে না, এরকম বলেছে। সানজিদার কথা কী আর বলব! সেই আগের সানজিদা সে আর নেই। বাসায় এসে সে রাজকন্যা হয়ে গেছে। আমি কিছু খেতে চাইলে অনেক ধরনের কথা শুনিয়ে তারপর খেতে দেয়। তার ভাইসহ সে আমাকে নানা রকমের ভয় দেখায় শুধু।’ নিহাল এসব বলল। আমি হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওদের চেয়ারম্যান বা আমার মামা নিহালকে কিছু জিজ্ঞেস করলে রকিব খুব দম্ভ করে করে আমার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলছিল, ‘ভাইয়াকে কেন, ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করেন।’ এভাবে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে বলে যতভাবে পারা যায়, ওরা আমাদের অপমান করেছে। অবশ্য রকিব আমাদের কাবিনের পরে ওদের বাসায় নেওয়ার আগেও ফোনে আমাকে অপমান করেছিল। কিন্তু নিহাল তাকে কিচ্ছু বলে নাই। একবার ধমক দিয়ে বলেনি যে, ‘সানজিদা তোর বয়সে আর সম্পর্কে সিনিয়র। এমন করলি কেন? এমনটা ঠিক না।’ বা এরকম কিছু বলে ধমকায়নি। সে উলটা আমাকে বলে, ‘তুমি নিশ্চয়ই এমন ব্যবহারের যোগ্য, তাই তোমার সাথে ও এমন করেছে। কই, আমাকে তো এমন কিছু বলেনি!’ এক পর্যায়ে কথা হলো, আমাকে ওরা আগস্টের বাকি দিন, মানে ১৫ দিনের জন্য রেখে যাবে, ওরা বউয়ের খোঁজ নিলে বা যোগাযোগ করলে আমি যাব, নইলে আরও ১৫ দিন পর, অর্থাৎ এখন থেকে ঠিক এক মাস পর ১৮ই সেপ্টেম্বর যা হবার হবে, মানে ডিভোর্স হয়ে যাবে।…এই কথা শুনে আমি নিহালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছি, আর হাউমাউ করে কাঁদছি। কারণ যখন থেকে এই সম্পর্কের শুরু, মানে যখন থেকে আমিও তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি, তখন থেকে আমি তাকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছি যে আমি শুধু তার কাছেই থাকতে চেয়েছি। আমার এতটাই মায়া কাজ করে যে আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারি না। নিহালও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। হাউমাউ করে কাঁদছে। এর আগের রাতে নিহাল আমার ডায়েরিটা চেয়েছিল। অভিমান হলে আমি তাকে নিয়ে কী লিখি, তা দেখার জন্য। আমিও এনে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ডায়েরিতে তেমন কিছু লেখা ছিল না। সারাজীবন সেই স্কুল থেকে আজ অবধি যতগুলি মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি, তাদের নম্বরগুলি লেখা ছিল শুধু। আমার আব্বু আম্মু খালা খালু আর এরকম কিছু কাছের মানুষের জন্মদিন আর বিয়ের তারিখ লেখা ওখানে। আর একটা পেইজে আমার প্ল্যান লেখা ছিল যে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবব পাঁচ বছর, সেই সময়ে চলব শুধু আমার একদম কলিজার পাশের মানুষগুলির সাথে। সেই মানুষগুলির নামের তালিকা---১)আম্মু, ২)আব্বু, ৩)নিহাল, ৪)ভাইয়ের মেয়ে সামিনা। সেই ডায়েরিটা নিয়ে নিহাল আমাকে বলে, ‘বাবু, আমি আর কখনও রাত জাগব না। আর ভুলেও রাত জাগলে বকবে কে? আমি আর সিরিয়াল বা মুভি দেখব না। নইলে কে রাগ করবে আমার উপর? গোসলে আমার গা ডলে দেবে কে? মুখে তুলে ভাত দেবে কে? সন্ধ্যায় ফেরার সময় যে ‘হোমকামিং’ মেসেজ দিতাম, সেটা কাকে দেবো? আসার সময় ভেলপুরি আনলে তা খেয়ে কে জান্নাতি মেওয়া খাওয়ার মতো তৃপ্তি পাবে? দেখো, আমি ঠিক ঠিক সময়মতো সব কাজ করব।’ এরপর ওখানে সে রুটিন লিখেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করছিল সে কোন সময়ে ঘুম থেকে উঠবে, এরপর কী করবে, তারপর অফিসে যাওয়ার আগে কী কী করবে, এসব নিয়ে। আমি কান্না করতে করতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলছি, ‘এমন কেন করছ? আমরা কেন আলাদা হব? আমি পারব না তোমাকে ছাড়া থাকতে।’ এরপর নিজেকে আবার শক্ত করে সটান হয়ে বসে ওকে বললাম, ‘দেখো, আমাদের কান্নার সময় আসছে সামনে, যদি আমরা একে অপরের হাত ছেড়ে ফেলি। আমি কাঁদতে কাঁদতে মরেই যাব, বিশ্বাস করো। প্লিজ ভাবো, কীভাবে কী করব আমরা। কীভাবে মীমাংসা করব। আমি তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারব না। তোমাকে ছেড়ে বেঁচে থাকতে চাই না।’ ও আমার কলেজের এক বান্ধবী সিনথিয়াকে ফোন করে বলল, সে যেন এসে সবাইকে বলে যে আমরা একসাথে থাকতে চাই। আমাদেরকে যেন কেউ আলাদা না করে। কিন্তু সেই বান্ধবীর আম্মু তখন মারাত্মকভাবে অসুস্থ। ও এই হসপিটাল সেই হসপিটাল ছুটে বেড়াচ্ছিল। পরদিন মানে ১৮ তারিখেই সিনথিয়া আমাদের বাসায় আসে। দুজনকে বোঝায়। আর যেহেতু সে মেহমান আর আমি তার বান্ধবী, তাই আমাকে একটু বেশি করেই বলে যেন সে বান্ধবীকে টানছে, এটা নিহাল বলতে না পারে। এরপর আমাদের কান্না দেখে নিহালের বড়ো দুলাভাই এসে আমাদের উপর রাগ করে। ধমক দিয়ে বলে, ‘এখন আর কেঁদে কী হবে! ওকে ছাড়!’ আর আমাকে বলে, ‘সানজিদা, একটু অন্য রুমে যাও তো।’ আমাকে অন্য রুমে পাঠিয়ে ওরা ফিরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। কিন্তু নিহাল একটা বারও মুখ ফুটে বলছে না, ‘আমি আমার বউকে চাই। আমি সানজিদাকে নিয়ে সংসার করব।’ বা এই জাতীয় কোনও কথাই। আবার ওর বড়ো দুলাভাই বা ওর আব্বু একটা বারও বলছে না, ‘যা হবার হয়েছে। থাক, আমাদের ছেলেবউ আমরা নিয়ে যাব। সানজিদা, রেডি হও।’….ওরা চলে যাবে বলে রেডি হচ্ছে, তখন আমি যেন পাগল হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, আমার প্রাণটা যেন বেরিয়ে যাচ্ছে, কী যেন হারিয়ে ফেলছি, আমার কী যেন কে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে! আমি আবার ছুটে গেলাম নিহালের রুমে। আমি এবার সরাসরি ওর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে শুধু বলছি, ‘আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’ কিন্তু ওর মুখে কোনও কথা নেই। ওই সময়টায় নিহালও কেঁদেছে। আমার সামনে কাঁদে, আবার আমি সরে গেলে ওদের সাথে কী কী সব বলে। ওহ্ হ্যাঁ, নিহাল আমাকে কয়েকবার বলেছিল, ‘আমাকে মাফ করে দাও।’ আমি বলছিলাম, ‘তোমাকে কীসের জন্য মাফ করব। তুমি আমার স্বামী। তুমি তো আমার কাছে কোনও অন্যায় করোনি, করবেও না।’ আমাকে ঘটা করে ডিভোর্স দিলে কাবিনের টাকা খরচ হবে। কিন্তু আমাকে রেখে সে আবার বিয়ে করলে বা আমাকে তদবির করে পাগল বানিয়ে ফেললে অথবা মেরে ফেলে সুইসাইড বলে ঝুলিয়ে দিলে হয়তো জায়গামতো ৫০ হাজার দিলেই সব ক্লিয়ার। ওরা এসবই ভেবে রেখেছিল। আমি অন্য মাধ্যমে নিহালদের এই প্ল্যান সম্পর্কে জেনেছি। কিন্তু এসব আমি আমলে নিতাম না। ভাবতাম, মরবই তো একদিন। আমি নাহয় ভালোবাসার মানুষের হাতেই মরি। তবুও ওকেই ভালোবাসি। তবে ওইবার আমার বাসা থেকে এবং ওদের চেয়ারম্যানের মধ্যে যখন কথা হলো সময় নেওয়ার, তখন আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই এই সময়ের ভেতর সব মীমাংসা হয়ে যাবে। আমরা আবার সুন্দরভাবে সংসার করব। সহ্য করে থাকি এই কয়দিন। এজন্য নিহাল আমাকে কয়েকবার বলেছিল ওই মুহূর্তে ওর সাথে যেতে, কিন্তু আমি চুপ করে ছিলাম, হ্যাঁ বা না কিছুই বলিনি। বলেছিলাম, ‘এই কথাটা সবার সামনে বলো, প্লিজ। সবাই এটাই চায় যে তুমি মেরুদণ্ড সোজা করে সবার সামনে বউকে নিয়ে যাবার কথা বলো।’ কিন্তু সে তাতে রাজি হয়নি। নিহাল আমাকে বলেছিল, ‘ডিভোর্স দিতে কারণ লাগে, অকারণে হয় না। কাবিনের টাকাসহ তিন-চার মাসের খোরপোষ দিতে হয়। আর এই সময়ে মেয়ে প্রেগন্যান্ট থাকলে সেই বাচ্চার খরচও দিতে হয়। যদি ফ্যামিলির চাপে আমাদের ডিভোর্স হয়, তবে সেটা ডিভোর্স হবে না। কারণ আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি, ছাড়তে চাই না। আমরা স্বামী-স্ত্রী থাকব। আমি তোমার খোঁজ রাখব। আর ডিভোর্স দিলেও তিন মাস আমাদের হাতে সময় থাকবে আবার সব ঠিক করে নেওয়ার, মানে ডিভোর্স হলেও তিন মাস তুমি আমার স্ত্রী থাকবে। ততদিনে সব ঠিক করে নেব আমরা। মন খারাপ কোরো না, পাগলি। আমি শুধুই তোমার। আমি কই যাব, বলো? কার কাছে যাব? আমি সুযোগ বুঝে বুঝে ফোন দেবো তোমাকে। ভালোবাসি তো!’ এসব বলে সে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদছে আর আমি ওর মন খারাপ দেখলে সহ্যই করতে পারি না। তখন ওসব শুনে আমিও ‘আল্লাহ গো আম্মু গো’ বলে চিৎকার করে কাঁদছিলাম। আমার মাথায় কিছু আসছিল না। কিচ্ছু না। একটু পর পর শুধু বলছিলাম, ‘আল্লাহ, তুমি আমাকে পথ দেখাও। প্লিজ আল্লাহ, তুমি একটাবার দেখা দাও, নইলে একজন মেনটরের দেখা দাও। আমি কী করব, কোথায় যাব, আমি কিচ্ছু জানি না।’ আমি তখন পাগল হয়ে উলটাপালটা কাজ করেছি। আমার ডিসিপ্লিনের স্যারকে ফোন দিয়েছি। স্যারের ওয়াইফ, আমাদের ভাবি রিসিভ করেছেন। হাউমাউ করে গলা ছেড়ে কেঁদে দিয়ে বললাম, ‘ভাবি, আমার নিহাল চলে যাচ্ছে। আর উলটাপালটা বকছে যেন আর কখনও ফিরবে না।’ সেই ভাবি আগে থেকেই জানতেন আমার রিলেশন আর বিয়ের কথা। উনি সব দিনই আমাকে ফিরতে বলতেন। আমি পারতাম না। উনি তখন আমাকে বললেন, ‘ঠান্ডা হও। দেখো কী হয়! এসব যে হবে, তা তো নতুন না, আমি আগেই অনেকবার বলেছি তোমাকে। তুমি এমনভাবে কেন কাঁদছ?’ ওঁর সাথে আর কথা না-বলে কলটা কেটে দিয়ে আমি আমার কয়টা বান্ধবীকে ফোন করে কাঁদলাম। সবাই একই কথা বলে। কারও কথা আমার মাথায় ঢুকল না। ওদের কল কেটে দিয়ে আমি আবার নিহালের পা ধরে কাঁদছি। অবশেষে ওরা যখন চলেই যাচ্ছে, আমি কিছুই ম্যানেজ করতে পারলাম না বলে সহ্য করতে না পেরে রাগে দুঃখে ক্ষোভে অভিমানে ওদের বাসা থেকে দেওয়া জিনিসগুলি ফেরত দিয়ে দিলাম। জানি না, ওটা অন্যায় বা ভুল ছিল কি না। তবে আমার মনে হয়েছে, এত ছোটো মন যাদের, তাদের জিনিস আটকে রাখা উচিত হবে না। আমাকে ওদের বাসায় নেওয়ার পর নিহালের আম্মু পাশের বাড়ির এক বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে কথাপ্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ের অভাব হবে না, তুমিও হয়তো ছেলে পাবে। তবে কলঙ্ক হবে তোমার, আর আমাদের যাবে কিছু গয়না, এই যা!’ ওদের মুখে যা শুনেছি তা হলো, পাশের বাড়িতে নাকি একটা নতুন বিয়ে হয়েছে। বউ এসে তিন-চার দিন থেকে এরপর নাইয়র-যাওয়া না কি জানি বলে ওরা, মানে বাপের বাড়ি যাওয়া, সেখানে গেছে। তো সেই প্রথমবার গিয়ে আর ফিরে আসেনি বউ। বউ নাকি নিজেই সেই ছেলের সাথে সংসার করতে চায়নি। সাত-আট ভরি গয়না দিয়েছিল ছেলেরা। বউ ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছিল, তবে ওই গয়না বা কাপড়চোপড় আর ফেরত দেয়নি। আমার ওই কথা মনে করে মনে হলো, ওরা আমাকে হয়তো রাখবে না, তাই টাকা খরচ করেনি আমার পেছনে, যদি আমি ফেরত না দিই, সে ভয়ে। তাই আমি যতটুকুই ছিল, তা ব্যাগে ভরে ওর কাছে দিয়ে বললাম, এগুলি নিয়ে যাও। ভয়ের জন্যই তো তেমন কিছু কখনও দিতে চাওনি, তবে যা দিয়েছ, তা-ই নিয়ে যাও। গিয়ে ছোটো আপুকে দিয়ো। সে অনেক খরচ করেছে আমার জন্য। আমাকে আবার যখন নিয়ে যাবে, তখন তোমাদের বাসায় গিয়ে নাহয় পরবো এসব। ওদের বাড়িতে আমি ভাবির শাড়ি পরে যাওয়ার পর আমার বিয়ের আগের জামা পরতাম, আশেপাশের মানুষ এসে আমাকে দেখে বলত, আমাকে ওরা কেন কিচ্ছু দিল না। একটা জামা তো অন্তত দিতে পারে। তাই মুখরক্ষার্থে আমাকে ওরা দুইটা থ্রিপিস এনে দেয়। তবে সেগুলি পরার কপাল আমার হয়নি। প্রথমবার কিনে বানাতে দেয়, এরপর আমি ঢাকা যাই। কুরবানি ঈদে এসে সেগুলি হাতে দিল। নিয়ে খুলনা এলাম। পরার সুযোগ হয়নি। তবে সেগুলি নাকি ওর ছোটো আপু কিনে দিয়েছে। ওদের বাসার কেউ একটা দুই টাকার শ্যাম্পু আনলেও আমাকে বলত, এটা নিহালের ছোটো আপু কিনে দিয়েছে। আর আমার যাওয়ার পর প্রথমবার রমজানের ঈদে নিহালের ফ্রেন্ড কমল একাই একটা শাড়ি দিয়েছিল আমাকে, আর কুরবানি ঈদে ছয়টা ফ্রেন্ড মিলে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি। শাড়িটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু ভাঁজ খুলে দেখার সুযোগও হয়নি। ঈদে নিহাল যে শাড়িটা কিনে দিয়েছিল, ওটা যেহেতু আমার ভালোবাসা আমাকে কিনে দিয়েছিল, তাই শুধু ওটাই বুকে টেনে রেখে দিই। বাকিগুলি ফেরত দিই আর বলি, ‘আপুকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে আমার জন্য। এগুলি তাকে দিয়ো।’ ওরা চলে গেল আর আমি গলা ছেড়ে ‘আল্লাহ গো আম্মু গো’ বলে অনেক কেঁদেছি সেদিন। ওর ছোটো দুলাভাই ঢাকার বনশ্রীতে অ্যাপেক্স জুতার একটা শোরুমে থাকে। মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা। ছোটো আপুর সংসারটাই চলে বাপের বাড়ির চাল ডাল তেলে। সেটা নিহালও বলেছে আগে। আশেপাশের লোকজনও বলেছে। তা-ও ওরা এরকম ছোটলোকি করত সব সময়। এক ঘণ্টা পর নিহাল আমাকে ফোনে টেক্সট করে। আমি সেই টেক্সট পেয়ে পাগলের মতো চিৎকার করে করে কেঁদেছি। এসব দেখে আশেপাশের লোকজন বিরক্ত হতো। এরপর দেড় মাস কষ্ট ছাড়া আর কিচ্ছু নাই আমার জীবনে। শুধুই কিছু তীব্র অনুভূতি! ওসব মনে করতে অন্তর পুড়ে যাচ্ছে। সে ১৮ তারিখ নড়াইল গেল, ওদের বাড়িতে। ঢাকায় গেল না। বাড়িতে গিয়ে আমাকে আর ফোন করে না। আমার ফোন ধরেও না। এদিকে আমি প্রতিটা সেকেন্ড কান্নাকাটি করে মরছি। তিন দিন পর এদিকে আমার ভাই-ভাবি অকারণে আমাকে ডিভোর্সি বলে বলে খোঁচা মারা শুরু করল। কথায় কথায় এটা তুলে গালিগালাজ করে। নিহালকে অনেক অনেক মেসেজ করি, সে রিপ্লাই করে না। হাত পা ধরে মেসেজ দিয়ে কোনওমতে কল ধরাতে পারলেও এমন দোষ-চাপানো আর কষ্ট-দেওয়া কথা বলে যে তাতে আমি আরও কাঁদি। নিজেকে দোষ দিই, আল্লাহকে ডাকি, নিজের কপালকে দোষারোপ করি। নিজের মাথা দিয়ে দেয়ালে জোরে পাগলের মতো বাড়ি দিই, তাতে আমার সামনের একটা দাঁত ভেঙে যায়। নিজের বুকে নিজে কিল মারি। মরতে যাই। আমার ভাই-ভাবি বলে, আমি ইয়াবা খাই, তাই কান্না করি। নইলে একটা ছেলের জন্য এতটা কান্না আসে না সাধারণ সুস্থ মানুষের। আমি কান্না করলেই ভাই-ভাবি আশেপাশের লোক ডেকে আনত। আমাকে দেখিয়ে সবাইকে বলত, আমার ভাই নাকি আমার জন্য জীবন নষ্ট করেছে, আর আমি ভার্সিটিতে গিয়ে বাজে ছেলে-মেয়ের সাথে মিশে ইয়াবাখোর হয়েছি। একটু গ্রাম্য পরিবেশের মহিলারা বা সমাজটা যে কেমন হয়, সেটা আমি আগে এতটা বুঝিনি। ওরা সবাই মিলে পুলিশকে ফোন দিতে যায়। আমাকে বলে, ‘তুই কেন মরিস না? এমন মেয়ে জন্ম দেওয়াও পাপ। আমাদের মানসম্মান কিছুই রাখছে না এক ছেলের জন্য! এত ভালোবাসা, তবে বরটা রাখতে পারলে না কেন?’ আমার ভাই আর মামার কথা শুনে অনেক ক্ষেত্রেই আমি ভেবেছি যে আমার আসলেই কয়দিন সময় নেওয়া উচিত। যাওয়া উচিত না। কিন্তু ওরা আমাকে বলেছিল, যদি আমি তখন যাই, তবে ওরা আমাকে রিভেঞ্জের জন্য মেরে ফেলবে। তখন এরা কেউ আমাকে দেখতেও যাবে না। রাস্তার পাশের পোকামাকড়ে আমার লাশ খাবে। বাসার সবাই সিম পালটে ফেলবে। বাসাও পালটাবে। আমি আর কাউকে খুঁজে পাব না। এসব যারা আমাকে বোঝাল, তারাই এখন আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছে, কেন আমি বাসার কথা শুনলাম! এত ভালোবাসা যদি থাকবে, তবে কেন আমি ওদের সাথে জোর করে হলেও যাইনি? এসব। আমি নিহালকে বলি, ‘আমি চলে আসব ঢাকাতে। আমার যা হয় হোক।’ নিহাল বলে, ‘খবরদার এসো না। সময়ই সব বলবে এবার। সময়কে বলতে দাও সব।’ নিহাল আমার সেই বান্ধবী সিনথিয়াকে ফোন করে বলে যে সে নাকি একা থাকতে পারছে না। সারাক্ষণই আমাকে মনে পড়ে। আর কাঁদে। সিনথিয়া নিজে দায়িত্ব নিয়ে আমাকে ওর কাছে পাঠাতে চাইলে সে আবার বলে, ‘না না, খবরদার। সানজিদা যেন না আসে!’ আমি নিহালের কাণ্ডকারখানা কিছুই বুঝতে পারি না। আমি কাঁদি, পাগলামি করি, বকা খাই। আমি যদি চলে যাই, সেই ভয়ে নিহাল আগের সেই বাসা পালটে অন্য বাসায় গিয়েছে। কমল ইসলামিক ইউভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকাতে এসেছে জব-কোচিং করার জন্য। অবশ্য কোন কোচিং-এ যাবে, কোন বই পড়বে, তা-ও আমার কাছে শুনে শুনে নিয়েছে কমল ভাইয়া। সে সহই আমি আর নিহাল থাকতে চেয়েছিলাম। আর এখন আমাকে বাদ দিয়ে তারা দুজন মিলে বাসা নিয়েছে। আমার মাথা কাজ করছিল না, তাই লেখায় একটু ভুল হয়েছে, সরি। আমাকে ভাই-ভাবি ডিভোর্সি ডেকে ডেকে খোঁচা দিত ডিভোর্সের তিন দিন পর থেকে, ওই সময়ে না। যা-ই হোক, একদিন রাত তিনটায় ফোন করে সে আমাকে বলে, সে নাকি আমাকে স্বপ্নে দেখেছে। এটা বলেই হাউমাউ করে কাঁদে। আর এসব শুনে শুনে আমি আরও বেশি কাঁদি। দিন-রাত বলে কিছু নাই। আমি ওই মামাকে গিয়ে বলি ওদের সাথে যোগাযোগ করতে। ওদিকে সেই চেয়ারম্যানও ফোন ধরেন না। হাজারবার ফোন করলে যদি ধরেন তো, খবর কী, এটা জিজ্ঞেস করলে চেয়ারম্যান বলেন, ‘যে ছেলে নিজেই চায় না, তাকে সংসার করাবে কে!’ এটা শুনে আমি বিশ্বাসই করি না, কান্নাকাটি তো দূরে থাক। নিহালের সাথে কথা বললে তো আমার মনে হয়, সে আমাকে চায়, কিন্তু পরিবারের কারণেই সে কিছু করতে পারছে না। সে আমাকেই ভালোবাসে। ফাঁকা জায়গায় বিলের মাঝখানে গিয়ে ওকে ফোন করে আমি গলা ফাটিয়ে কাঁদি, পা ধরি, কসম দিই, রাগ করি, আবার কাঁদি, নিজের মুখে চড়াই, বুকে কিল মারি, হাতে যা থাকে সব ছুড়ে মারি। চেঁচামেচি শুনে লোকজন জড়ো হয়। বাসায় খবর যায়। আম্মু এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায় বাসায়। এরপর ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। ছয় দিন একটানা কিচ্ছু খাওয়া নাই, গোসল নাই, ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখে কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভাঙে, জেগে থাকলে আরও বেশি মনে পড়ে। বাসায় কাঁদলে ভাই আমাকে র্যাবের কাছে, পুলিশের কাছে দিতে চায়। কোত্থাও একচিলতে শান্তি নাই আমার। আমি বাঁচার জন্য চলে যাই কোচিং-এ, যেখানে ২ মাস পড়েছিলাম বিসিএস-এর জন্য। কনফিডেন্স, বয়রা শাখা। আমরা লাইব্রেরিতে বড়ো টেবিলটায় ১০-১১ জন মিলে পড়তাম। ওরা জানে, আমি শ্বশুরবাড়ি গিয়েছি। হুট করে আমাকে লাইব্রেরিতে আমাকে দেখে ওরা সবাই অনেক খুশি। তবে আমার চেহারা দেখে ওরা কেউই আমাকে চিনতে পারছে না। আমাকে ওরা জিজ্ঞেস করছে, ‘বিয়ে করলে সবার চেহারা খোলে, তোর এ অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে, এটা তুই না। হুট করে তোর বয়স ১২ বছর বেড়ে গেছে, আর শরীর তেমনই ১২ বছর কমে গেছে। কিছু কি হয়েছে?’ আমি বলি, ‘নাহ্! কী হবে!’ বলেই হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছি। ওরা ওইদিন আমাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে ফাঁকা জায়গায় বসে সব শুনল। আমার মন ভালো করার জন্য ওরা ওইদিন কেউ পড়েনি। আমাকে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু আমার অন্তরের কষ্ট যাবে কই! পাঁচমিনিট অন্তর অন্তর হাউমাউ করে কেঁদে উঠছি অকারণেই। সারাদিন ওদের সাথে থাকি। ওরা পড়ে, আমি দেখি। বাসায় গেলে তো ভাই-ভাবির মেনটাল টর্চার শুরু হয়ে যাবে। আমাকে দুই দিন পর পর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় ভাই। তখন বই-খাতা নিয়ে সিনথিয়ার বাসায় গিয়ে উঠি। ওরা আমাকে ওই সময়ে ফ্যামিলির মতো সাপোর্ট দিয়ে গেছে। এর ভেতর রেজাল্ট দিল ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পোস্টের, রিটেনে টিকলাম, ভাইভা নভেম্বরে। সাধারণ বিমায় টিকলাম, ভাইভা নভেম্বরের ২ তারিখ, প্রাইমারিতে টিকলাম, ভাইভা অক্টোবরের ২৩ তারিখ বোধহয়। এসব বলার মতোও কেউ নাই আমার পাশে। বান্ধবীকে বলি। আর ও খুশি হয়। ওদিকে ভাই মাকেও বলে রেখেছে যেন আমার সাথে যোগাযোগ না করে। বান্ধবীর বাসায় থেকে লাইব্রেরিতে যাই। কিন্তু পড়তে পারিনি। লাইব্রেরিতে যাই শুধু স্বপ্ন দেখতে শিখব বলে। ভাবতাম, এখানে আমি ওই দুমাস কত সুন্দর করে পড়তাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাই, টিটু ভাই। আমাকে দমানোর জন্য খুঁজে খুঁজে কঠিন কঠিন ম্যাথ এনে দিতেন। আমি কোনও দিনই একটা ম্যাথেও ফেইল খাইনি। শর্টকাটে তিন-চার মিনিটের ভেতর করে দিতাম। ভাই অবাক হতেন সব সময়। পরে সাধারণ জ্ঞানে আমাকে হারিয়ে দিতেন। আমি তখন মাত্র দুমাস পড়েছি। সাধারণ জ্ঞানটা অত ভালো পড়ে পারিনি। আর ওটা পড়তেও আমার ভালো লাগত না। ইংলিশ আর ম্যাথ ভালো পারতাম। সেই ভাই আমি লাইব্রেরিতে গেলে আমাকে আবার ম্যাথ দেওয়া শুরু করলেন। আমি ভেবেছি, পারব না। কিন্তু তখন কেন জানি পেরে গেলাম। কিন্তু ম্যাথ আর ইংলিশের বেসিক ছাড়া আমার ভেতরে আর কিচ্ছু নাই। আমি ভাবলাম, পড়াশোনা বাদ দেবো। এসব হবে না আমাকে দিয়ে। তখন আমি বান্ধবীর বাসায় থাকছি, আর সারাদিনই কান্নাকাটি। ফোনটাও নষ্ট হয়ে গেল। কারও সাথে যোগাযোগ নাই। যার ফোন হাতে পাই, তার ফোন দিয়েই নিহালকে কল দিই, আর সে আমাকে যা-তা বলে কষ্ট দেয়। এর ভেতর এনএসআই এডি’র প্রিলি পরীক্ষার ডেট পড়ে গেছে। আগস্ট শেষ হলো। সেপ্টেম্বর এল। তারা যে ১৫ দিনের কথা বলেছিল, সে ১৫ দিন গেল। আমাদের কারও ফোন ওরা ধরে না। ওরাও ফোন দেয় না। সেপ্টেম্বরের যে ডেট ওরা দিয়েছিল, সেটাও এল। ১৮ সেপ্টেম্বরে ওরা আমাকে ডিভোর্স দেবে বলেছিল। সেই ডেটও এসেছে, তবুও ওরা যোগাযোগ করে না। আমাদেরও কথা বলার সুযোগ দেয় না। (চলবে…)