প্রগতিশীল লেখক কী বিষয় নিয়ে লিখবেন এবং পাঠকদের চিন্তাধারাকে কীভাবে প্রভাবিত করবেন, সে সম্পর্কে যথেষ্ট আলোচনা বিভিন্ন পুঁথিপত্রে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু যা পাওয়া যায় না, তা হলো, এই যে…প্রগতি শিবিরে পাঠক পরিমণ্ডলে লেখকের ভূমিকা কী হওয়া উচিত।
যে-কোনো লেখক একজন ব্যক্তি বটে, কিন্তু সব ব্যক্তিই লেখক নন। ফলে লেখকের যেমন নিজস্ব ভাবধারা থাকে, তেমনি সেই ভাবধারা তাঁকে সংগ্রহ করতে হয় সমাজপ্রবাহ থেকে। সমাজ যেহেতু শ্রেণিবিভক্ত, সেহেতু কোনো লেখকই শ্রেণিস্বার্থের ঊর্দ্ধে অবস্থান করতে পারেন না। সুতরাং তাঁর লেখার বিষয়বস্তু এবং চিন্তাধারা তাঁর শ্রেণিস্বার্থের চৌহদ্দির মধ্যেই ঘুরপাক খাবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অতএব শ্রেণিচরিত্রের প্রকাশ না ঘটিয়ে কোনো লেখক নিজেকে ব্যক্ত করতে পারেন না। তাই লেখকের কর্মধারার ফলে একটি সুস্পষ্ট পাঠক পরিমণ্ডল গড়ে উঠে।
লেখকের ভাবধারায় যে-সমস্ত পাঠক অবগাহন করেন, সেই সমস্ত পাঠকের ভাবগত ঐক্য ও সখ্য গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। পাঠকের চিন্তাচেতনার মধ্যে লেখক নিজের ভাবধারার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে যে অদৃশ্য ভাবগত বন্ধনে পাঠকদের আকর্ষণ করেন, তা থেকে লেখক ও পাঠকের মধ্যেও এক সুমধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লেখক পাঠকের কাছ থেকে বহুদূরে অবস্থান করলেও সেই দূরত্ব মানসিক ক্ষেত্রে ব্যবধান সৃষ্টি করতে পারে না। আর এখানেই লেখকের জীবন সদর্থে সার্থক হয়। তাই প্রগতিশীল লেখক ও পাঠকের মধ্যবর্তী স্থান কত দ্রুত সংকুচিত হয়, তার দিকে সর্বাগ্রে লক্ষ রাখার দায়িত্ব লেখকের।
বহু লেখক পাঠকের পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে যেমন ব্যর্থ হচ্ছেন, তেমনি পাঠকদের কাছ থেকে নিজেদের বহু দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, ভালো লেখকের মধ্যে একধরনের ইগোর সৃষ্টি হচ্ছে। অহম্-সর্বস্বতার বরফে নিজেকে জমিয়ে রাখার এক বিরাট প্রচেষ্টা অনেক লেখকের মধ্যে দেখা যায়। এর ফলে লেখক যে ভালো পাঠক পেয়েও তার নৈকট্যাধীন হতে কুণ্ঠাবোধ করেন, তার পরিচয় পাওয়া যায়। পাঠকের সদিচ্ছাকে মর্মাহত করে উভয়ের সম্পর্কের মধ্যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করতে তিনি সাহায্য করছেন বলে কেউ ভাবলে তাকে কোনো দোষ দেওয়া যায় না।
প্রগতিশীল সংস্কৃতিবান মানসিকতার বিরোধী চরিত্রের রূপ অনেক লেখকের মধ্যে অবাঞ্ছনীয়ভাবে দেখা দেয়। সুলেখক মাত্রেই প্রগতিশীল। বৈষয়িক কনটেক্সট নিয়ে লিখলেই যে তিনি কায়েমি স্বার্থবিরোধী শ্রেণীর পঙ্ক্তিতে আসীন হবেন, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
অনেক ভালো ভালো লেখক আছেন, যাঁরা নিজেদেরকে, চলচ্চিত্রের তারকাদের মতো, পাঠকদের কাছে মোহসৃষ্টি করার জন্য, দূরে দূরে অবস্থান করান। মনে হবে যেন তিনি স্বর্গীয় দেবদূত। তিনি পাঠকবৃন্দকে ভক্তবৃন্দে পরিণত করতে ভালবাসেন। ভক্ত যেমন গুরুদর্শনে নিজেকে ধন্য মনে করে, তেমনি যেন পাঠকবৃন্দ লেখকের প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে ভক্তের মতো করপুটাঞ্জলি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয় যেন লেখক ভূমিচ্যূত হয়ে বহুদূরে গজদন্তমিনারে আসীন থেকে পাঠকদের সাথে অপার্থিব যোগসান্নিধ্য রক্ষা করে চলতে চান।
এ ধরনের লেখকের হাত দিয়ে দারুণ দারুণ প্রগতিশীল শব্দবানে সাহিত্য-সংস্কৃতির দেহে যতই শিল্পসুষমা ফুটে উঠুক না কেন, সেই লেখকের হৃদয়াকাশে একখণ্ড কালো মেঘের আবির্ভাব শেষমেশ ঘটেই থাকে, যার ফলে পাঠক তাঁর কাছে আলোর ঠিকানা পেতে সততই ব্যর্থ হয়।
আবার অনেক নামিদামি লেখক আছেন, যাঁরা আমলাতান্ত্রিকতার ভাবধারায় অবগাহন করে পাঠকদের সাবঅর্ডিনেট ভাবতে ভালোবাসেন। পাঠকদের প্রতি তাঁদের অবহেলার চিহ্নগুলি পরিষ্কার হয়ে ধরা পড়ে। দূরের পাঠক এই সমস্ত লেখকের লেখাগুলি গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করে একধরনের মানসিক যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েন। তাঁদের অগোছালো হৃদয়াবেগের লিপিখণ্ডগুলি লেখকের নিষ্ঠুর মুষ্টিবন্ধে আহত হয়ে কঁকিয়ে উঠে ময়লা কাগজের আশ্রয়স্থানে নিক্ষিপ্ত হয়। কী যে করুণ দৃশ্যের অবতারণা ঘটে, যখন এইসব প্রগতিশীল লেখক পাঠকদের হৃদয়ের গহনকাননে প্রস্ফুটিত কুসুমগুলিতে একে একে দলিত-মর্দিত চিহ্ন এঁকে দিয়ে চিরতরে সৌরভহীন সত্তায় নিজেকে বিসর্জন দেন!
পদাধিকার বলে বড়োজোর বইবিক্রেতা হওয়া যায়, কখনও সৃষ্টিশীল লেখক হওয়া যায় না। আমলা ও বড়ো ব্যবসায়ীর স্ত্রী বই লিখলে (ছাপালে) তাঁরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাঠকদের বিরক্ত করে ছাড়েন। জোর করে কুকুর পোষা যায়, পাঠক নয়।
অমন লেখকের হাত দিয়ে যতই প্রগতিশীল রচনালোক প্রকাশিত হোক না কেন, সেই আলোক পাঠকদের যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ে শান্তির প্রলেপ দিতে ব্যর্থই হয়ে থাকে। আমলাতন্ত্রের পোশাকপরিহিত বহু লেখককে দেখা যায় প্রগতি শিবিরে। তাঁদের মনে যে-ভাবটি ক্রিয়াশীল থাকে, তা হলো যে, তাঁরা পাঠকদের দর্শন দিয়ে কৃপাধন্য করছেন। দূর থেকে, নাগালের বাইরে থেকে তাঁরা পাঠকদের উপর আশীর্বাদ বর্ষণ করতে চান।
দিনমজুর প্রভৃতি ‘ছোটোলোকদের’ প্রতি যে-রকম নাকসিটকানো মনোভাব এক শ্রেণীর মানুষের থাকে, অথচ ওদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বৈপ্লবিক কাজ সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে তারা ক্লান্তিবোধ করেন না, তেমনি একশ্রেণীর লেখক প্রগতিশিবিরে থেকে পাঠকদের জ্বালাময়ী লেখা উপহার দিতে ক্লান্তিবোধ করেন না; কিন্তু পাঠকরা যখন তাঁদের নৈকট্যাধীনে আসতে চায়, তখন তাঁরা কেতাদুরস্ত বাবুর মতো ধূলিঝাড়া দিয়ে সরে দাঁড়ান। এমন আমলাতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন লেখকের সংখ্যা প্রগতি শিবিরে যত কম প্রবেশ করে, ততই পাঠকদের তথা প্রগতিশীল আন্দোলনের পক্ষে মঙ্গল হবে।
যে-সমস্ত লেখক প্রগতিশীল হয়ে জীবিকাস্বরূপ কলমকে বুকে তুলে নিয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই কাছে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবন বিভীষিকাস্বরূপ। তাঁরা জানেন যে, কী করুণ ও কঠিন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকজীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থে আত্মত্যাগ করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এমন কঠিন-করুণ অবস্থা যে-কোনো প্রগতিশীল লেখকের জীবনে আজও নেমে আসতে পারে; অর্থাৎ দারিদ্র্যের সাথে পরম আত্মীয়তার বন্ধনে যে-কোনো প্রগতিশীল লেখককে আবদ্ধ থাকতে হতে পারে।
লেখকের জীবনকে বেছে নিয়ে একক জীবিকার সন্ধানে ব্রতী হয়েছেন, এমন লেখকের সন্ধান পাওয়া আজকাল খুবই কঠিন। প্রায় প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনো জীবিকা বেছে নিয়ে লেখকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ফলে লেখকের মধ্যে দ্বৈত চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এই দুইয়ের মধ্যে জীবিকায় আসক্ত ব্যক্তিসত্তাই প্রধান। লেখক হিসেবে তিনি দ্বিজ। এই দ্বিজপদে পাঠকের গলিত স্নেহ-ভালোবাসা বিফলে মাথা কুটে ফিরে যায়।
প্রগতিশীল ধারায় অবগাহন করে আগামীদিনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হতে পাঠকদের যিনি প্রেরণা দেন, পাঠকদের দূরে সরিয়ে রেখে অমিত্রসুলভ আচরণ করতে তিনি যদি সচেষ্ট থাকেন, তাহলে তো প্রকৃত বিচারে তিনি কপটই হবেন। তাই প্রগতি শিবিরে পাঠক পরিমণ্ডলে লেখকদের ভূমিকা কীরূপ হওয়া উচিত, তিনি প্রগতিশিবিরে শুধু স্ব-বিরোধিতায় ভুগবেন কি না, সে বিষয়ে পণ্ডিতব্যক্তিদের কিছু বলা দরকার। অবশ্য একইসাথে এটা মনে রাখলে ভালো: সরব পণ্ডিতের মুণ্ডুহীন দেহ শাসকের বরাবরই পছন্দের।