নীল,
আজ খুব ভোরে হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো, যেন তুমি এসে মাথার চুলে হাত ডুবিয়েছ, আর কলমিলতার মতন তোমার আঙুলগুলো এদিক-ওদিকে হেঁটে বেড়াচ্ছে সন্তর্পণে! খুব চমকে গেছি, জানো!
হুড়মুড়িয়ে উঠে দেখি, কোথাও তুমি নেই—জানলায়, কপাটে, জলের গ্লাসে, বইয়ের ভাঁজ-করে-রাখা তেত্রিশ পৃষ্ঠায়, রাতের অবশিষ্ট মিটবলে, বিছানার বাঁ-পাশটায়…যেখানটায় তুমি ঘুমোতে, নামাজের বিছানায়…যেখানে তুমি ক্রিস্টালের তাসবিহ্টা রাখতে—প্রত্যেকটা জায়গায় এক-পা, দু-পা করে খুঁজেছি, কোথাও যে তুমি এলে না বড়ো!
উত্তেজনায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, টেবিলে-রাখা আধ-খাওয়া জলের গ্লাসটা দেখে মনে হলো, তুমি বুঝি ঠোঁট ডুবিয়ে গেলে!
খুব ইচ্ছে হলো, খানিকটা জল তোমায় লুকিয়ে আমিও একটু চেখে দেখি! ক্যালেন্ডারে আজ হেমন্তের ১০, বাইরের পাঁচিল-ঘেঁষা বাগানটা বলছে, আমার এখনও শ্রীপুরেই আবাস।
নীল,
সন্ধেবেলা পেপারোমিয়া গাছটা দেখে এলাম; মনে হচ্ছে, জল খেয়েছে বেশ, ব্যাঙাচির মতন ডালপালাগুলো কেমন টসটস করছে, গোলাপি বর্ণে কেমন একটা বসন্ত বসন্ত আমেজ! কিশোরী জীবনটা বোধ হয় ফুরিয়ে এসেছে। আমাদের ছোট্ট পেপারোমিয়া, কবে যে এতখানি বড়ো হয়ে গেল, টেরই পেলাম না!
মেয়েটা মনে হয় প্রেমে জড়িয়েছে! . . . উঁহু, তুমি যা-ই বলো না কেন, আমি ঠিক জানি, মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে। ইদানীং বিকেলের শেষে একটা ছোট্ট চড়ুই ওপাশের জানলায় এসে বসে। কী যেন ফিসফিস করে দু-জনে মিলে। হয়তো বলে, পেপু ভাই, চলো, আজ একটু শ্যামলা দিঘির পাড়টা ঘুরে আসি; কিংবা বলে, রাঙাদার বাগানে বেশ নোনা পেকেছে, ক-টা চুরি করে নিয়ে আসি গে! আমার টেপা আর বুলুর বাবা নোনা খেতে খুব ভালোবাসে!
না কি অন্যকিছু বলে, নীল? তোমার কথা, আমার কথা, আমাদের কথা…বলে? এই যেমন ধরো, গ্রামের সবকটা পুকুরধারে হাঁসের ডিম খুঁজতে গিয়ে ভাঙা ঝিনুকে পা কেটে ফিরে আসতাম, সুপারিগাছের শুকনো পাতার খোলটাকে ভেলা বানিয়ে তুমি বসতে আর আমি ডগা মুঠোয় করে তোমায় সারাবাড়ি চড়িয়ে বেড়াতাম। ঊর্মিদের বাড়ির ছাতিহানি গাছটা তুমি কী যে ভালোবাসতে, সবসময় বলতে, এ আমার বড্ড আদরের, কেমন শৈল্পিক দেখেছেন? আর কী মিষ্টি গন্ধ, ইচ্ছে হয়, সুতো দিয়ে নাকের ডগায় বেঁধে রাখি।
জানো নীল, গাছটার পাশ ধরে হাঁটলে মনে হয়, তুমি আছ খুব কাছে, এই আশেপাশে কোথাও!
তারপর, ওই যে মাচার উপর আচারের বয়ামে হাত ঢুকিয়ে একখাবলা রোদে-পোড়া, সরষেতে-ভেজা গুটিকয়েক জলপাই তুলেই দৌড়, ফিরে এসে তোমার সেই যাচ্ছেতাই কাণ্ড, তেল-সরষে-মাখা হাতখানা আমার সাদা রুমালটাতেই মোছা!
এখনও তেলের দাগটুকু যায়নি, তুমিই চলে গেলে, নীল!
মনে আছে, ও-পাড়ার জমাদার বাড়িতে জাকের স্যারের বাগানে প্রথম মধুমঞ্জরি দেখে তুমি বলেছিলে, জানেন, এই ফুলের নাম ক্যাসিয়া জাভানিকা। আসলে ওগুলো মধুমঞ্জরি ছিল, তোমার ভুলটা সেদিন আর আমি ভাঙাইনি; মনে হলো, এত নিষ্পাপ ভুল ক-জন করতে পারে তোমার মতো! তুমি ভুল করলে আজও ভীষণ প্রেম জাগে, নীল!
তখন মনে হয়, কবিতা লিখে ফেলি, গান গেয়ে উঠি, তোমার নামে সুর গড়িয়ে দিই, জলঘড়ি পাখা আবার ঘুরে আসি।
একদিন তুমি আমার হবে, ঠিক মিলিয়ে নিয়ো, জীবনের কোনো থেমে-যাওয়া অবসরে।
একদিন আবার জাভানিকা ফুটবে, হয়তো ভুল বাগানে, তবুও তো ফুটবে!
রুয়েলিয়া গান গাইবে; সান্তা ডেল প্রিসিলার দরোজা, ঠিক দেখে নিয়ো, একদিন খুলবে।
পত্রলেখার পাতায়-বোনা সংসার হাসি-গানে মুখরিত হবে, আবার গাইবে কেয়া সেই চন্দ্রিমা উদ্যানে।
আমি জানি, একদিন তুমি ঠিক আমারই হবে।
নীল,
আজ কী যেন হয়েছে আমার! তোমাকে কিছুতেই মনে করতে পারছি না, তোমার চোখদুটো যেন কেমন? গাঢ় কালো, না কি ব্রাউন?
আর তোমার চুল? খুব কি লম্বা, না ঘাড়ের আশেপাশে?
তুমি যেন কেমন এলোমেলো হাসতে? তোমার অবয়ব কেমন যেন দূরের মনে হয়!
যতদূর মনে পড়ে, তোমার চোখদুটো বেশ কথা বলত, মনে হয়, শুধু ভালোবেসেই যাই।
পেপুকে জিগ্যেস করলাম, হ্যাঁ রে, তোর মায়ের কথা মনে আছে? তোকে যে রোজ গোলাপি জল খাওয়াত?
মা কেমন দেখতে ছিল, বল না!
পেপুটা কেমন চুপ করে থাকে, তোমার স্বভাবটাই দেখছি পেয়েছে।
বলি, তোমার নাহয় মুখে বুলি ফোটেনি, তা মেয়েটাকেও অমন বানালে কেন! আমায় কি তুমি শব্দের আকালে মেরে ফেলবে?
আজ একটু কথা বলো না, নীল! আমি ভীষণ ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত! কেউ জল দেয়নি আমায়, বিশ্বাস করো। অন্য কারুর হাতে জল খেতে গেলে আমার যে কেমন অরুচি হয়।
আজ একটু আমার নাম ধরে ডাকো না, নীল। বহুকাল হলো, কেউ আমায় নাম ধরে ডাকেনি। অন্য কারুর মুখে ডাক শুনতে আমার যে কেমন বিদ্রোহ জাগে, নীল! একটু ছুঁয়ে যাও না আমায়, হৃদয়ের ভেতরটা রোদে পুড়ে অনাবৃষ্টিতে ভুগছে খুব!
নীল, আজও তুমি সেই গল্পের নিভৃত নীলাম্বরী হয়েই রইলে।
জানো, তোমায় নিয়ে রোজ বয়োবৃদ্ধ কৃষ্ণচূড়াটার ছায়ায় মুখোমুখি বসি, কত কথা বলি…সব মেঘের গায়ে ছাপা হয়ে যায়, কখনও বৃষ্টি হয়ে ঝরে না কেন তবে? সৌন্দর্যের বুঝি অনেক দাম, বাতিল মানুষকে তাই দেখা দিতে চায় না?
তোমার মনে আছে, একবার তোমায় বলেছিলাম, একসময় এই মানুষটাকেই তোমার মানুষ হিসেবে খুব জঘন্য মনে হবে?
দেখলে, মিলে গেল তো! নীল, এই জঘন্য বাতিল মানুষটকেই তো তুমি ভালোবাসতে! কী করে পারতে?
তোমাকে মাঝে মাঝে পৃথিবীর কেউ মনে হয় না, ঠিক যেন এই আলো-হাওয়ার কেউ নও! তুমি কে, নীল? আর আমি? আমি কে? তুমি জানতে আমায়?
জানো, নিজেকে আমার গার্সিয়া মার্কেজের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড’-এর হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া মনে হয়। না, না, তা কেন! হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তো উরসুলার হাত ধরে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিতে পেরেছে, নিজেদের স্বপ্নের মতো করে একটা গ্রাম সাজিয়েছিল, দু-জনে মিলে নাম দিয়েছিল 'মাকোন্দ'! কিন্তু আমার তো তুমি নেই, নীল! একটা খেলনাবাড়িও সাজাইনি দু-জনে মিলে! সম্পর্কের মতন আমরাও নামহীন রয়ে গেলাম!
আচ্ছা, তোমার কামুর বিখ্যাত চরিত্র ফারমিনা ডাজা আর ফ্লোরিন্টিনো আরিজার কথা মনে পড়ে? আমার জানো, তোমাকে ঠিক ফারমিনা ডাজার মতন মনে হয়; একদিন যখন তুমি আমার হবে, তখন নিজেকে ফ্লোরিন্টিনো আরিজার মতন মনে হবে। জুভেনাল উরবিনো তবে কে, নীল?
আমার ভাগ্যরেখা অতিক্রমকারী সেই সৌভাগ্যবান মানুষটা, তাই না?
আমাকে খুব নির্মম ঠেকছে কি, নীল?
আজ বরং আসি, পেপুকে খাওয়াতে হবে যে!