ডেটলাইন ১৯ জানুয়ারি ২০১৫ শরৎচন্দ্র অন্ধকারকে ‘ভয়ংকর সুন্দর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পিএটিসি’র শীতের সকালের শুভ্রফেনিল পিটি’কে ‘ভয়ংকর সুন্দর’ বলতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা, বলেই দিলাম! আজ এই সুন্দরের দেখা-না-মেলার শেষ সুখের দিন ছিল। সেশন শুরু হলো যথারীতি ৮:৩০টায়। কালকের লেখায় বলেছিলাম, পিএটিসি সেকেন্ডে চলে। প্রথম সেশন ছিল KEO (Know Each Other) মানে, আইসব্রেকিং সেশন। আমাদের ক্লাস কো-অর্ডিনেটর স্যার এলেন। উনি বেশ চমৎকার ঢঙে কথা বলেন, দেখতেও স্মার্ট। মার্জিত স্বভাবের মানুষ। কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স-মাস্টার্স। আমাদের একটা করে শিট ধরিয়ে দিয়ে সেখানে নিজের সম্পর্কে কিছু পয়েন্ট লিখতে বলা হলো। এরপর আমাদের কাজ, পাশের জনকে আমার শিটটি দিয়ে ওঁর শিটটি নেওয়া। এরপর পরস্পরের সম্পর্কে জেনে নিয়ে সবার সামনে গিয়ে ওঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। একইভাবে উনিও আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন। এখানে একটা পয়েন্ট ছিল: আপনার জীবনের সবচাইতে স্মরণীয় মুহূর্ত কোনটি? প্রায় সকলেই লিখেছে, বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্ট জানার মুহূর্তটি। একটা চাকরি মানুষকে অন্যরকমের সুখের অনুভূতি দেয়। একটা ব্যাপার দেখে মজা পেলাম। অনেকেই ওঁর পার্টনারকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বলছিলেন, “হি ইজ মিস্টার...মাই বেস্ট ফ্রেন্ড...” কিউরিয়াস মাইন্ড ওয়ান্টস টু নৌ, বেস্ট ফ্রেন্ড? এই কয়েক মিনিটেই?! এই পরিচিতি পর্বটা হচ্ছিল ইংরেজিতে। কয়েক জন এত দ্রুত জড়ানো ইংরেজিতে পরিচয় দিচ্ছিলেন যে, কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। ওদের দেখে মনে মনে গাইলাম, “অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি। তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি...” একটা ব্যাপার দেখে বড়োই শান্তি পেলাম। সেটা হলো, সবাই ক্যাডার নয়, কেউ কেউ ব্যাচেলর। আহা আহা! কী শান্তি! আমার মায়ের ধারণা, সবাই বিয়ে করে ফেলছে। মাকে এনে এইসব শীতে-ঠোঁটফাটা-হাসি-হাসা হাসিখুশি ব্যাচেলরদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে কয়েক লক্ষ-কোটি শান্তি লাগত। আমাদের কোর্স কো-অর্ডিনেটর স্যার জানিয়ে দিলেন, আজকের সোয়া ১টার সেশনটা শেষ করে লাঞ্চ সেরে রুমে গিয়ে ব্যাগ রেখে রেডি হয়ে ১:৫০টার মধ্যে রিসেপশনে সবাইকে চলে আসতে হবে। সেখানে আমাদের জন্য গাড়ি ওয়েট করবে। আমরা জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে যাব। ১:৫০টা মানে কিন্তু ১টা ৫০ মিনিট ১ সেকেন্ড বাজার আগেই! পিএটিসি’র কোনো প্রোগ্রামে ছবি তোলা যাবে না, মোবাইল তো ব্যবহার করাই যায় না। কী কণ্ঠ ওঁর! সে কণ্ঠ দৃঢ় ও কঠিন অথচ আশ্চর্য ধরনের আন্তরিক। সে কণ্ঠ আমলার কণ্ঠ। এরপর ছিল হেলথ চেকআপ। পিএটিসি’র করিডোরে ট্রেইনিদের হাঁটার দৃশ্য দেখার মতো। পিপীলিকার সারি চলতে দেখেছেন না? ওরা কীভাবে চলে মনে আছে? একের পর এক চলে, কেউ কাউকে ছাড়িয়ে যায় না। ধরা যাক, একটা সারি আসছে পূর্ব দিক থেকে, আরেকটা দক্ষিণ দিক থেকে। দুটোই যাবে উত্তর দিকে। পিঁপড়েরা কী করে? ওদের কোনো সারিই কিন্তু থেমে থাকে না, হঠাৎ হঠাৎ একটু থমকে যায় শুধু। পূর্ব দিকের সারিটা এসে উত্তর দিকেরটার সাথে মার্জ করে। কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, একেক জন দাঁড়িয়ে থাকে একটু করে, একটা একটা করে পিঁপড়ে এসে সারিতে জায়গা করে নেয়। এরকমই তো হয়, না? আমাদের এখানে আমরাও চলি ঠিক পিঁপড়েদের মতো করে। করিডোরের একটা সাইড থেকে অন্য সাইডে তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখলে পিঁপড়েদের চলার কথা মনে পড়ে যায়। পিঁপড়ের দল হেলথ চেকআপে যাবে। আমিও সেই দলে। গেলাম। মেডিকেল সেন্টারের আশপাশটা মুগ্ধ করে দেবার মতো। আম, পেয়ারা, কাঁঠাল, আমলকি-সহ হরেক রকমের ফলের গাছ, কিছু দূরে দূরে ঝোপের মতো করে ছাঁটা হলদেটে সবুজ গাছ, পাতাবাহারের বাহার, অর্কিডের মেলা, এই সব কিছু মিলেমিশে মেডিকেল সেন্টারটাকে কী এক দুর্নিবার আকর্ষণের কেন্দ্র করে দিয়েছে যেন! এখানে বারে বারে আসার জন্য অসুস্থ হতে ইচ্ছে করতেই পারে, অসুস্থ না হলে যে-কারও ই মন খারাপ হতেই পারে! আমরা সেখানে গিয়ে পাশের একটা রুমকে ওয়েটিংরুম বানিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কখন ডাক আসে। ডাক্তারের সামনে গিয়ে যে যার সমস্যাগুলো বলছে। আমি ভাবতে লাগলাম, কী বলা যায়! আমার যে কোনো সমস্যাই নেই! ও আচ্ছা, আছে তো! আমার নাক চুলকায় না কেন? ভাত খেলে আর খিদে পায় না কেন? মাথা ব্যথা করে কিন্তু চুল ব্যথা করে না কেন? এই শীতে গরম লাগে না কেন? নাহ্! এসব কি আর বলা যায়! ডাক্তারের কাছে গিয়ে কিছুই বললাম না। ডাক্তার চেক-টেক করে দেখলেন, একটু হতাশই হলেন মনে হয়। তবুও তো কিছু বলতে হয়! বললেন, আপনাদের ট্রেনিং তো শীতকালে, খুব সাবধানে থাকবেন। হঠাৎ মাথায় এল, এই রে পেয়েছি! বললাম, স্যার, আমার খুব ঠান্ডার সমস্যা। সকালে পিটি করলে সমস্যাটা আরও বেড়ে যেতে পারে। উনি সাথে সাথে বললেন, এই জন্যই তো বললাম, সাবধানে থাকবেন, গরম জামাকাপড় পরে পিটিতে যাবেন। বুঝলাম, লাভ নাই, কোনোই লাভ নাই। সুখ নাইরে পাগলা! ডাক্তার সাহেবকে সালাম দিয়ে চলে এলাম। আগে একটা সময়ে স্টুডেন্টরা স্ট্যান্ড করত। সেই সময়ে যারা স্ট্যান্ড করত, ওরা রাতারাতি তারকাখ্যাতি পেয়ে যেত। আকাশের তারাগুলো মাটিতে নেমে আসত যেন। এরপর এল জিপিএ সিস্টেম। কী যেন হল! কম্পিটিশন বেড়ে গেল, মোটামুটি কিংবা খারাপ রেজাল্ট করা কঠিন হয়ে গেল, এতে করে অনেক ভালো স্টুডেন্টও হারিয়ে যেতে শুরু করল। মাটির তারাগুলো আকাশে মিলিয়ে যেতে লাগল। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এল, কিন্তু স্টুডেন্টদের গুণগত মান বাড়ল না। যা-ই হোক, পরের সেশনটা ছিল পিএটিসি’তে আমাদেরকে কোন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে, সে সম্পর্কে পরিচিতি ক্লাস। এই ৬ মাসে আমাদের সবার সম্পর্কে একটা করে আলাদা আলাদা পেন-পিকচার রিপোর্ট লেখা হবে। সেখানে লেখা থাকবে, আমি কেমন, এটা নিয়ে ওরা এই ৬ মাসে কী ভেবেছে, কী বুঝেছে। সেখানে কিছু-না-কিছু লেখা থাকেই! এই যেমন একজন ট্রেইনির রিপোর্টে লেখা ছিল, “উনি ভালো, তবে একটু নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করেন।” এটা নিয়ে কথা হলো। সবাই ভেবে নিল, আচ্ছা, উনি নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করেন মানে, উনি একটু কবি-সাহিত্যিক টাইপের। লোকজনের সাথে মেশেন-টেশেন কম। এরকম কেন হবে? এটা তো ঠিক না। এখন আমার কথা হলো, এই স্টেরিওটাইপ থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি না কেন? শুধু কি কবি-সাহিত্যিকরাই নিভৃতে থাকতে পছন্দ করেন? মনে তো হয় না। দস্তয়ভস্কি ওঁর লেখাগুলো খুব নিভৃতে লিখেছেন বলে তো আমরা কখনও শুনিনি। ‘লাস্ট ফর লাইফ’ পড়ে জানতে পারি, ভ্যান গঘ কিংবা পল গঁগ্যা তাঁদের অনেক ছবিই শান্ত সমাহিত পরিবেশে আঁকেননি। সন্দীপন-শক্তি’রা তো আর তপোবনে গিয়ে গল্প-কবিতা লেখেননি। যা-ই হোক, এরপর ক্লাসে এলেন আইটি সেকশনের ইনচার্জ স্যার। ওঁর কাছ থেকে জানলাম, বাংলাদেশে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে পিএটিসি’র ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক সবচাইতে শক্তিশালী। স্যারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইন্সট্রাকশনের একটি ছিল, “স্মার্ট ফোনে ওয়াইফাই কানেক্টিভিটি দেওয়া হবে না। আপনাদের ল্যাপটপে ওয়াইফাই ব্যবহার করার ম্যাক অ্যাড্রেস আমরা দিয়ে দিচ্ছি, তবে কোনোভাবেই আপনারা ল্যাবের কম্পিউটারে কিংবা ল্যাপটপে অ্যাডাল্ট সাইটগুলোতে ঢুকবেন না।” (শেষ অংশটি বলে না দিলেও কি রুম বাদ দিয়ে ল্যাবে বসেই প্রকাশ্যে কেউ ঢুকত ওসব সাইটে? কী জানি! অবশ্য, ভিন্নরুচির্হি লোকঃ; তাই হয়তো স্যার রিস্ক নিলেন না! কেউ ঢুকে গেলেও অন্তত বলতে তো পারবেন, আপনাদের তো বারণ করাই ছিল, তাই না? তবে ঢুকলেন কেন?) সোয়া ১টার সেশন শেষ হলো ১:২০টায়, মানে ৩০০ সেকেন্ড লেট! তা-ও আবার আজকের এই প্যাকড শিডিউলে! পড়িমরি করে সবাই ছুটলাম ডাইনিংয়ের দিকে! শুরু হলো খাবারের টেবিলে চামচের ঝনঝনানি, হাজার বছরের পুরোনো সে ঝনঝনানি। ঠিক ১:৫০টায় রিসেপশনের সামনে এসে সবাই জড়ো হলাম। রোল নাম্বার অনুসারে বাস অ্যাসাইন করা ছিল। আমরা বাসে উঠলাম, বাস ছুটল স্মৃতিসৌধের দিকে। আমার একটা মানসিক সমস্যা আছে। সেটি হলো, খুব ছোটো ছোটো সুন্দরেও মুগ্ধ হয়ে যাই। একেবারে প্রতিদিনের আটপৌরে ব্যাপারগুলোও আমাকে মোহিত করে রাখে। প্রকৃতির খুব তুচ্ছ তুচ্ছ খেলাগুলো নিয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাবতে আর খুব খুশি হয়ে উঠে হাসতে ভালো লাগে। বাস যাবার সময় রাস্তার দু-ধারে দেখলাম বিরান শস্যখেত, নাড়াগুলোতে রাতের শিশির একটু আলোর প্রতীক্ষায় আছে। সারি সারি গাছের নিবিড় আমন্ত্রণে ওদের শীতের রোদমাখা ধূসর ছায়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। একেক বার মনে হচ্ছিল, বাস থেকে এক্ষুনি নেমে যাই। ওই খেতে খানিকক্ষণ দৌড়ে আসি! পারলাম না! চাকরি করি যে! সান্ত্বনা খুঁজে নিলাম জীবনানন্দে...“পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।” এভাবে করে বাস এসে পৌঁছল জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বরে। এখানে নেমে দেখলাম, কুয়াশার নরোম চাদরে চারদিকটা এখনও ঘুমিয়ে আছে। কিছু প্রেমিকের সোয়েটারের উলে প্রেমিকার খোলা চুল একাকার হয়ে লেপটে আছে। পাশেই বাজছে, সব কটা জানালা খুলে দাও না...যে-বৃদ্ধ বৃদ্ধ হবার আগেই তাঁর ছেলেকে হারিয়েছেন, তিনি একটা ইউক্যালিপটাসের নিচে বসে বসে বুড়ো-হাতের ক্লান্ত বুড়োআঙুলে জীবনের হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছেন। শাড়ি আর স্যুট পরা পিপীলিকার সারি এগিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে অবাক বিস্ময়ে বাদামওয়ালারা বাদাম বেচতে ভুল মেরে বসে আছে; ওদের ঝুড়ির বাদাম ওদের পেটেই মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত! আমাদের দেখাচ্ছে পেঙ্গুইনের মতো। ছেলেবুড়োরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেঙ্গুইন-দলের কাণ্ডকারখানা দেখছে। পুরো চত্বরটাকে যেভাবে করে সাজানো হয়েছে, অতটা মনকাড়া সৌন্দর্যের বেদী আপনি আপনার উপচে-পড়া ডলারের সবটুকু খুইয়েও পৃথিবীর আর কোথাও পাবেন না। শীতের স্মৃতিসৌধের আবেদন তুলে ধরতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখকটিও মার খেয়ে যাবেন, এই কথা আমি বাজি ধরে বলতে পারি। পৃথিবীর যে-কোনো সুন্দর পার্কের চাইতেও আমাদের স্মৃতিসৌধটি সুন্দর। সুনীলের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ পড়েছেন না? ওখানে মার্গারিটকে পাশে নিয়ে উনি যে-পথ দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন, সে পথের স্বাদ আজ এখানে অনুভব করলাম যেন! হায়! পাশে মার্গারিট ছিল না, মার্গারিটের চাচাত-মামাত-খালাত-ফুপাত ভাইয়েরা সবাই-ই ছিল। মনে হচ্ছিল, কোনো এক মহৎ কবির কবিতার খাতাটি ভুল করে স্মৃতিসৌধ হয়ে গেছে! “আপনাদের সবার জন্য এই উদাত্ত আহ্বান, আসুন, ছবির মতো এই দেশে একবার বেরিয়ে যান।...” শীতের একটা জাদু আছে। সে কীভাবে যেন আশপাশের মায়াবী গাছগুলোকে, ঝিরিঝিরি লেকটাকে হিমেল ধোঁয়াশায় অস্পষ্ট আর দূরবর্তী করে দিচ্ছিল। সুন্দরের আকর্ষণ তো আড়ালেই। হৃদয় দিয়ে ছোঁয়া যাবে, হাত দিয়ে নয়। খুব ইচ্ছে করছিল, গাছের নিচে বসে লেকটার দিকে তাকিয়ে থাকি, ভেজা মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি, ঘাসের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা বুনোফুলের গন্ধ নিই, গাছের গুঁড়িতে শীতের পোকারা কীভাবে চলে সে খবর নিই, স্মৃতিসৌধের আশপাশটায় ঘুরে ঘুরে ঘুমিয়ে-পড়া ভাইদের কানে কানে বলি, “আমরা জেগে আছি, তোমরা শান্তিতে ঘুমাও।” কিছুই হলো না! ফিরে এলাম পিপীলিকার সারিতে। আমরা সিভিল অ্যান্টস! আমরা সিভিল পেঙ্গুইনস! যাঁরা এই লেখাটা পড়ছেন, তাঁদের বলছি, আপনাদের কেউ কি স্মৃতিসৌধের গাছগুলোর নাম জানেন? আমি আজ যাকেই পাশে পেয়েছি, তাকেই গাছগুলোর নাম জিজ্ঞেস করেছি। মাত্র দু-একটা গাছের নাম জানতে পেরেছি। বড়ো ভালো লাগায় ওই গাছগুলো। ওদের নাম জানব না, তা কী করে হয়? ওরা যে বড়ো বেশি ভালো! কেউ জানলে, আমাকে দয়া করে জানাবেন। আপনাকে সাথে নিয়ে আমি আরেক বার ওখানে যেতে চাই, ঘুরে বেড়াতে চাই, গাছগুলোর সাথে একটুখানি গল্প করতে চাই। মজার বিষয় হলো, দেশের প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য আজ আমাদের ৮টা গাড়ির আসা-যাওয়ার সময় সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল একটা পুলিশের গাড়ি। সেখানে ছিলেন ১ জন এএসআই’য়ের দায়িত্বে থাকা ৩জন কনস্টেবল। আমাদের দলে প্রায় ৪০ জন এএসপি ট্রেইনি অফিসার (আমাদের রেক্টর স্যারের ভাষায়, আমরা ‘স্টুডেন্ট অফিসার’)। ওই সময়ে আমার শেক্সপিয়ারের Much Ado About Nothing-এর একটা সংলাপ মনে পড়ছিল: Claudio: Benedick, didst thou note the daughter of Signor Leonato? Benedick: I noted her not, but I looked on her. আজকের দিনের লাস্ট সেশন ছিল ‘রেক্টরস টি’, মানে ‘কফি উইথ করন’-এর মতো কিছু-একটা, তবে গুরুত্বের দিক থেকে নিঃসন্দেহে অনেক অনেক ভারী। রেক্টর স্যার আমাদের সবার সাথে পিএটিসি’র ফ্যাকাল্টি মহোদয়দের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য এই ‘চায়ের সাথে টা’ সেশনটির আয়োজন করেছিলেন। এই সেশনে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সবাই সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা হাই প্রোফাইল অ্যাকাডেমিশিয়ান। ওঁরা একে একে নিজেদের পরিচয় দিলেন। এরপর আমাদের পালা। এই পরিচিতি পর্বে কিছু মজার ব্যাপার ছিল। এত সিনিয়র অফিসারদের সামনে দাঁড়িয়ে পরিচয় দেবার সময় আমরা অনেকেই নার্ভাস হয়ে কিছু কাণ্ড ঘটিয়েছি। কয়েকটি শেয়ার করছি: # অনেকে আসসালামুয়ালাইকুম বলার পর স্যার বলতে ভুলে গেছি। কেউ কেউ সালাম দিতেই ভুলে গেছি। পরে রেক্টর স্যার মনে করিয়ে দিয়েছেন। # পরিচয় ইংরেজিতে দেবার সময় অনেকেই বলেছি এভাবে, “আমি আই অ্যাম...” # অনেকে বলেছি, “মাই নেম ইজ এমডি মোহাম্মদ...” # ইংরেজি ভাষায় বিরতিহীন তোতলামো তো ছিলই! এমন কিছুতেই নয় যে, আমরা ইংরেজি পারি না বলে কথা বলার সময় নার্ভাস ছিলাম। চাকরির পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁরা ভাইভা পরীক্ষা নিয়ে এই ভয়ে আছেন যে, পরীক্ষার সময় নার্ভাস ফিল করবেন, তাঁদের বলছি, আমরা চাকরি পেয়ে যাবার পরও এখনও বসের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় নার্ভাস ফিল না করার দুঃসাহস দেখাতে পারি না। এই ব্যাপারটা নিশ্চয়ই চাকরির ভাইভা পরীক্ষা দেবার সময়েও ছিল। বসের সামনে নার্ভাস ফিল করাটাও একটা সাধারণ ভদ্রতা। তাই, খুশিমনে নার্ভাস ফিল করুন, হাসিমুখে চাকরি পান। ৪টা মন-ভালো-করা কথা দিয়ে এই লেখাটি শেষ করছি: এক। আমাদের করিডোরে যে অর্কিড গাছগুলোর কথা কালকে বলেছিলাম, সেগুলোর ৭টাতে আজকে ফুল দেখলাম। হলুদ, লাল, বেগুনি আর নীল রঙের অর্কিড ফুল। এই ফুলগুলো এত সুন্দর এত সুন্দর…শুধু এই ফুলগুলো দেখতেও পিএটিসি’তে আসা যায়। দুই। আমার প্রিয় গোলাপের বাগানে আজকে দেখলাম শাদা শাদা একঝাঁক রাজহাঁস। ওরা ঘাসের মধ্যে ঠোঁট দিয়ে কী যেন খুঁটিয়ে খাচ্ছে। কী অপরূপ দৃশ্য! মনে হচ্ছিল, শাদা মেঘমালা ভেসে বেড়াচ্ছে। তিন। পিএটিসি’তে আমাদের চলাফেরা একটু রেসট্রিক্টেড। আমরা চাইলেই সব জায়গাতেই যেতে পারি না। কিছু কিছু জায়গা খুব সুন্দরভাবে পরিপাটি করে গোছানো। ফোয়ারা থেকে জল ছড়িয়ে পড়ছে, তার চারদিকে মার্বেল পাথর বসানো। পাশে মানিপ্ল্যান্ট, পাতাবাহার আর অর্কিডের সুবিন্যস্ত সজ্জা। আজ এরকমই একটা জায়গা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা কফিশপ আবিষ্কার করলাম। শপের বাইরে চেয়ারে বসে কফির ধোঁয়ায় কুয়াশায় ভেজা ঠোঁটে উষ্ণতার আমেজ ছড়িয়ে দেওয়া যাবে আয়েশ করে করে। আমি কফিতে-বেঁচে-থাকা মানুষ। এই কফি-কর্নারকে মনে হচ্ছে যেন এই ৬ মাসের মরূদ্যান! নেসক্যাফের কাগুজে কাপের চুম্বন-শিহরনে প্রেমিকার ওষ্ঠযুগলের উষ্ণতার ব্যর্থ খোঁজ! এ যেন ফিনিক্স পাখির পেছনে ছুটে চলা! চার। এই শীতের নিঃসঙ্গ রাতের (অশরীরী) প্রেয়সীর শারীরিক উষ্ণতা উপেক্ষা করে আগামীকাল ভোর ৬টায় শুভ্রবেশে ছুটতে হবে মাঠে। পিটিতে। ভুপেন হাজারিকার টানে।...এই মাঠ তোমাদের জন্য, পিটি তোমাদের জন্য, একটু যন্ত্রণা কি তোমরা সইতে পার না? ও বন্ধু...তোমরা কম্বলকে প্রেমিকা করো, তোমরা বিছানায় স্বর্গ গড়ো, যদি সিসি স্যারের হাতে ধরা পড়ো, লজ্জা কি তুমি পাবে না? ও বন্ধু...(যাঁদের বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, তাঁরা কষ্ট করে গতকালকের লেখাটি পড়ে নিন।) রাত ফুরোতে না ফুরোতেই সকালবেলার পিটি’র কথা ভাবতেই ভয়ে মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। খুশিতে নারিকেল গাছের আগায় উঠে নাচতে ইচ্ছে করছে। হে ধরণী! দ্বিধা হও, আমি গাছে উঠি!