২২১.
শুদ্ধ ‘আমি’ হলো ‘তুরীয়’, আর আমি ‘তুরীয়াতীত’—পরমে স্থিত। গুরু যখন তাঁর নিজের অবস্থান বর্ণনা করেন, তিনি বলেন—“শুদ্ধ ‘আমি’ হলো ‘তুরীয়’, আর আমি আছি ‘তুরীয়াতীত’ অবস্থায়—যা বাস্তব, যা পরম।” তিনি এই কথার মাধ্যমে গোটা শিক্ষাকে করে তোলেন সহজ, সরল ও স্পষ্ট।
এই ‘আমি’-কে বুঝতে হবে শব্দহীন, নিখাদ রূপে—যেভাবে তা প্রথমবার উদিত হয়েছিল—প্রায় তিন বছর বয়সে, যখন তুমি হঠাৎ জানলে: “আমি আছি”। অথবা তুমি ধরতে পারো তাকে সেই মুহূর্তে—যখন গভীর ঘুম থেকে ঠিকমাত্র জেগে ওঠো, যখন কিছু চিন্তা নেই, নাম নেই, পরিচয় নেই—শুধু নির্মল উপস্থিতি—“আমি”।
এই অবস্থাই হলো ‘তুরীয়’, চেতনার চতুর্থ স্তর—যার উপর দাঁড়িয়ে থাকে জাগরণ, স্বপ্ন, ও নিদ্রা। যখন তুমি এই ‘তুরীয়’-তে স্থিত হও, তখন একসময় তুমি অতিক্রম করে ফেলো এটিকেও—যখন ‘আমি’-র অস্তিত্বও লুপ্ত হয়ে যায়, তখনই তুমি প্রবেশ করো ‘তুরীয়াতীত’–এ, অর্থাৎ সেই চূড়ান্ত অব্যক্ত চৈতন্যে—যাকে বলে পরব্রহ্ম, পরম, নিরাকার বাস্তবতা।
চেতনাস্থিতির চারটি স্তর: ১. জাগরণ (waking), ২. স্বপ্ন (dreaming), ৩. গভীর নিদ্রা (deep sleep), ৪. তুরীয়—শব্দহীন, চেতন উপস্থিতি (pure ‘I am’)
তুরীয় অবস্থাই সেই স্তর, যেখানে তুমি প্রথমবার জানো—“আমি আছি”, কিন্তু কোনো পরিচয়, চিন্তা, ইতিহাস নেই। এই স্তরে স্থিত থাকা মানে 'আমি'–র বিশুদ্ধ অবস্থায় ধ্যান করা, এবং সেটাই সত্য সাধনার কেন্দ্র। কিন্তু পরম উপলব্ধি তখনই আসে—যখন তুরীয়-কেও তুমি অতিক্রম করো, যেখানে না ‘আমি’, না চেতনা, না কিছুই থাকে—থাকে কেবল অভিন্ন পরম, যা নামহীন ও রূপহীন।
এই অবস্থাই তুরীয়াতীত—যার মধ্যে পরমেশ্বর স্বরূপে জীবনযাপন ঘটে, যেখানে ‘আমি’-ও নেই, অভিজ্ঞতাও নেই—কেবল পরম বাস্তবতা। শুদ্ধ ‘আমি’ হচ্ছে ‘তুরীয়’—এক নির্মল চেতনা যা চিন্তা, পরিচয়, নাম-রূপবর্জিত। এই ‘তুরীয়’ অবস্থায় স্থিত হলে, তুমি একসময় ‘আমি’-কেও অতিক্রম করে, প্রবেশ করো ‘তুরীয়াতীত’ স্তরে।
‘তুরীয়াতীত’ অবস্থাই হলো পরম স্বরূপ—যেখানে জীবন হয় পরব্রহ্মস্বরূপ, এক অদ্বিতীয়, অভিজ্ঞতাহীন নিঃশব্দতায়। গুরু নিজেকে বলেন—“আমি তুরীয়াতীত—এবং তাতেই বাস করি, কারণ সেটাই পরম বাস্তবতা।”
২২২.
জপে ‘আমি’ লুপ্ত হয়, তুমিও নাম-রূপ ছাড়িয়ে পরমে মিলিয়ে যাও। ‘সোহম’ (আমি সেই) অথবা ‘অহম্ ব্রহ্মাস্মি’ (আমি ব্রহ্ম) এই ধরনের মন্ত্রের জপ, যদি দীর্ঘ সময় ধরে নিষ্ঠা ও একাগ্রতায় করা হয়—তবে তা তোমাকে নিয়ে যায় নির্মল ‘আমি’-র স্তরে।
এই জপের মাধ্যমে মন ও চিন্তার স্তর ফিকে হতে থাকে, আর তুমি পৌঁছে যাও সেই অবস্থায়—যেখানে থাকে কেবলমাত্র অনুভব"আমি আছি"—কিন্তু কোনো পরিচয়, সংজ্ঞা, ভূমিকা নেই। এরপর একসময় আসে এমন একটি গভীর নীরবতা, যেখানে এই ‘আমি’-র জ্ঞানটুকুও বিলীন হয়ে যায়।
সেই শেষ আত্মবোধ—যেটি প্রথমে সত্যপ্রতীতি হয়ে এসেছিল, এখন সেটাও তোমার কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তখন ঘটে সেই চূড়ান্ত উত্তরণ—তুমি মিলিয়ে যাও তোমার প্রকৃত স্বরূপে, যা নামহীন, রূপহীন, গুণাতীত, চিন্তাতীত—একান্ত পরম, পরব্রহ্ম।
‘জপ’ বা মন্ত্রপাঠ হলো আত্মবোধে ফিরে যাওয়ার এক উপায়—যাতে মন ধীরে ধীরে আত্মার কেন্দ্রে স্থির হয়। দীর্ঘ সাধনার পর এই জপ তোমাকে নিয়ে যায় শুদ্ধ 'আমি'-র স্তরে—যে-‘আমি’ চিন্তাহীন, সংজ্ঞাহীন, নীরব। এই ‘আমি’-ই হলো সর্বশেষ জ্ঞান—এর পর কিছু বলার মতো থাকে না।
একসময় এই ‘আমি’-ও লুপ্ত হয়ে যায়, আর তখনই তুমি পরমে বিলীন হও, যা কোনো জ্ঞানের বিষয় নয়, বরং নিজস্ব স্বরূপে অবস্থান। এই অবস্থায় পৌঁছালে মন্ত্র, জপ, জ্ঞান—সব কিছু অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, কারণ তুমি নিজেই হয়ে ওঠো সেই পরম, যাকে খোঁজার জন্য জপ করা হয়েছিল।
‘সোহম’, ‘অহম ব্রহ্মাস্মি’ প্রভৃতি মন্ত্রের দীর্ঘ জপ তোমাকে নিয়ে যায় ‘আমি’-র নির্মল স্তরে। এই স্তরে স্থিত হয়ে ধ্যান করলে, একসময় সেই ‘আমি’-র জ্ঞানটুকুও বিলীন হয়ে যায়। তখন তুমি পৌঁছাও তোমার প্রকৃত স্বরূপে—যা নাম, রূপ, ধারণা ও অভিজ্ঞতার অতীত। এই অবস্থাই হলো চূড়ান্ত মুক্তি, যেখানে ‘আমি’ নেই, জ্ঞান নেই, কেবল পরম অস্তিত্ব।
২২৩.
যদি তুমি ‘আমি’-তে স্থিত হও, বাহ্যিক জগৎ তোমার উপর প্রভাব হারাবে। আমাদের উপর বাহ্য জগতের আসক্তি ও প্রভাব এতটাই প্রবল যে, খুব কম মানুষই চিন্তা করে—“এই সব কিছু মিথ্যা হতে পারে”।
তবে কিছু মানুষের হৃদয়ে হঠাৎ জেগে ওঠে একটি নামহীন আকুলতা—এক অন্তর্লীন আহ্বান, যা চায় চিরন্তন, অশেষ কিছুকে। এই আত্মিক আকাঙ্ক্ষা থেকেই শুরু হয় সন্ধান ও প্রশ্ন—“আমি কে?”, “কেন?”, “কী সত্য?”, “কী চিরস্থায়ী?”
যদি এই সাধক সত্যিই ভাগ্যবান হন, তবে তিনি একজন সত্যিকারের গুরু–র কাছে পৌঁছান, যিনি তার সমস্ত অনুসন্ধানকে থামিয়ে একটি সহজ বাণীতে নিয়ে আসেন: “‘আমি আছি’—এই জ্ঞানেই স্থিত হও। এই ‘আমি’-ই তোমার সাধনা।”
গুরু বোঝান—যদি তুমি শব্দহীন ‘আমি’-তে স্থিত হও, তবে ধীরে ধীরে সব বাহ্যিক বিষয়, আকর্ষণ ও বন্ধন তোমার উপর থেকে আলগা হয়ে যাবে। এই ‘আমি’-তে স্থিতি ও একাগ্রতা তোমাকে এনে দেবে স্বাধীনতা বাহ্যিক জগতের বন্ধন থেকে, এবং নিয়ে যাবে তোমার চূড়ান্ত স্বরূপে। যদি সাধক এই নির্দেশ যথাযথভাবে বোঝেন ও গভীর নিষ্ঠায় পালন করেন, তবে তার মুক্তি অবশ্যম্ভাবী।
বাহ্যিক জগতের প্রতি আমাদের আকর্ষণ আমাদের ‘আমি’-র বিশুদ্ধতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এই আকর্ষণ সংবেদন, নাম, রূপ, সম্পর্ক, অর্জন ইত্যাদির মাধ্যমে তৈরি হয়—যার ফলে আমরা বিশ্বাস করি, বাহ্যিক জগৎই বাস্তব, আর নিজের ভিতরকার নীরব সত্তা অস্পষ্ট ও দুর্বল। কিন্তু যখন একজন সত্যিকারের গুরু দেখান—“এই 'আমি'–বোধ–ই প্রকৃত শিক্ষা ও সাধনা”—তখন সেই বহির্জগতের মোহ ধীরে ধীরে কেটে যেতে শুরু করে।
‘আমি’-তে স্থিত হওয়া মানে ধীরে ধীরে পরিচয়হীন, নীরব অস্তিত্বে স্থিত হওয়া—যেখানে বাহ্যিক কিছুই আর তোমাকে নাড়াতে পারে না। এই সাধনা-ই মুক্তির পথ—কারণ এটি আত্মজ্ঞান ও আত্মস্থতার জন্ম দেয়।
বাহ্যিক জগতের আকর্ষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে তোমাকে ‘আমি’-তে স্থিত হতে হবে। এই ‘আমি’-তে স্থিতি মানে শুদ্ধ অস্তিত্বে প্রতিষ্ঠা—যা শব্দহীন, সংজ্ঞাহীন, চিন্তাহীন।
একজন সত্যিকারের গুরু এই পথ নির্দেশ করেন—বাহ্য জগৎ নয়, ‘আমি’-তেই রয়ো স্থির। যদি সাধক সেই নির্দেশ মেনে চলে—তবে একসময় বাহ্যিক সমস্ত আকর্ষণ ও বন্ধন হালকা হয়ে যায়, এবং সে পৌঁছায় নিজের স্বরূপে—পরম চৈতন্যে।
২২৪.
অদ্বৈত ভক্তি: ‘আমি’-তে বিলীন হয়ে অজানার অতলে লুপ্ত হওয়া। সাধনার শেষপর্যায়ে গুরু বলেন—তোমার জ্ঞান, অনুভব, ধ্যান—সব কিছু এমন এক গভীর জায়গায় পৌঁছাক, যেখানে তোমার ভিতর থেকে এই একমাত্র সত্য জন্ম নেয়: “আমিই আছি, আমিই একমাত্র—আমার বাইরে আর কিছু নেই।”
এই ‘আমি’-বোধে যখন তুমি সম্পূর্ণরূপে একীভূত হয়ে যাও, তখন তা হয়ে ওঠে ‘তুরীয়’ অবস্থা—চেতনার চতুর্থ স্তর, যা জাগরণ, স্বপ্ন ও নিদ্রার পেছনে নীরবভাবে বিরাজ করে।
এই অবস্থায় ‘আমি’-র উপাসনা আর কেবল ভাব নয়, এটা হয়ে ওঠে অদ্বৈত ভক্তি—যেখানে ভক্ত ও ভগবান আলাদা থাকে না, উপাসক নিজেই হয়ে ওঠে ‘উপাস্য’। তুমি যত গভীরভাবে এই ‘আমি’-র প্রেমে নিমগ্ন হও, ততই তুমি তোমার সমস্ত স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে ফেলো।
আর একসময়—এই ‘আমি’-ও নিজেই বিলীন হয়ে যায়, তুমি হারিয়ে যাও অজানার বিশালতা-স্বরূপে। তখন আর কেউ থাকে না—না ভক্ত, না ঈশ্বর, না ‘আমি’—থাকে কেবল এক নীরব, নামহীন, চিরন্তন পরম।
এই সাধনা কোনো দ্বৈতভিত্তিক ঈশ্বরভক্তি নয়—বরং ‘অদ্বৈত ভক্তি’, যেখানে ভক্ত নিজেকেই ভগবানে বিলীন করে। এখানে ‘আমি’-র ধ্যান কোনো ব্যক্তিগত পরিচয়ের ধ্যান নয়—বরং সেই নির্মল আত্মস্মরণের, যেখানে তুমি উপলব্ধি করো: “আমি ছাড়া কিছুই নেই।”
এই বোধ তোমাকে নিয়ে যায় তুরীয় অবস্থা-তে—যেখানে চিন্তা নেই, ইন্দ্রিয় নেই, শুধুই আত্মা। আর যখন ‘আমি’-র মধ্যেই ভক্তি পরিণত হয় পরম প্রেমে, তখন ঘটে স্বলীনতা—তুমি আপনার মাঝেই লুপ্ত হয়ে যাও।
এই অদ্বৈত ভক্তি কোনো উপাসনার মাধ্যম নয়, এটি ভগবান হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা—এবং তার পরেও ভগবান ভাবনার বিলয়। দীর্ঘ ধ্যান ও জপের মাধ্যমে তুমি যখন উপলব্ধি করো: “আমি ছাড়া কিছুই নেই”—তখনই শুরু হয় অদ্বৈত ভক্তি। এই ভক্তি তোমাকে ‘তুরীয়’ চেতনায় স্থিত করে, যেখানে তুমি হয়ে ওঠো ‘আমি’ নিজেই।
এরপর গভীর একতার সাধনায় ‘আমি’-ও মুছে যায়, আর তুমি লুপ্ত হও নামহীন পরম সত্যে। এই অবস্থা হলো: "না জ্ঞান, না উপাসনা, না ভক্ত—কেবল চিরন্তন সত্তা—নিঃশব্দ পরম।"
২২৫.
‘আমি’ কি তোমার ইচ্ছায় এসেছিল? না কি নিজেই উদিত হয়েছিল? গুরু যখন তোমাকে বোঝান—“তুমি শুধু এই ‘আমি’-বোধকে বোঝো, এটি-তেই স্থিত হও”—তখন একসময় এই প্রশ্ন ধীরে ধীরে জেগে ওঠে: “এই ‘আমি’-র বোধ কি আমার ইচ্ছায় এসেছে?” “আমি কি চেয়েছিলাম এই ‘আমি’-কে?” “আমি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে জন্মেছিলাম? অথবা জেগেছিলাম?”
তুমি যদি সত্যিই গভীরভাবে দেখো, তাহলে বোঝো—এই ‘আমি’ তো নিজেই এসেছিল, তুমি চাওনি, তবুও এসেছিল, আর একদিন নিজেই চলে যাবে। এই বোধ—“‘আমি’-র আগমন বা লয় আমার নিয়ন্ত্রণে নয়”—তোমার ভিতরে এক বিশাল স্ফোট ঘটায়।
তখনই তুমি উপলব্ধি করো—তুমি কোনো কিছু করো না, তুমি করার যোগ্য নও, তুমি কেবল এক সাক্ষী মাত্র, যার উপর দিয়ে সব কিছু ঘটছে। এই উপলব্ধি ‘আমি কর্তা’—এই বিশ্বাসে চরম আঘাত হানে, এবং ধীরে ধীরে কর্তৃত্বভাব সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়।
‘আমি’ বোধের উদয় (জন্ম, জাগরণ) ও লয় (মৃত্যু, ঘুম) কোনো ইচ্ছাকৃত কর্ম নয়, বরং এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে। যদি তুমি নিজের ভিতরে গভীরভাবে দেখো, তুমি খুঁজে পাবে না—তুমি কখনও চেয়েছিলে এই ‘আমি’-বোধকে। এই বাস্তবতা, যে ‘আমি’-ও আসা-যাওয়ার বিষয়, তোমার ভেতরের “আমি কর্তা” ধারনাটিকে চূর্ণ করে দেয়।
আর এই কর্তা-ভাব বিলীন হওয়ার সাথে সাথে তুমি প্রবেশ করো সেই নির্বিকার সাক্ষিত্বের চৈতন্যে, যেখানে কিছুই “আমার দ্বারা” হয় না, সবই ঘটে, আর তুমি থাকো তাতে অচ্ছিন্ন, অনাসক্ত।
গুরু যেই মুহূর্তে তোমাকে ‘আমি’-র গুরুত্ব বোঝান, তখন থেকেই তোমার কাজ হলো—এর উৎপত্তি ও বিলয় পর্যবেক্ষণ করা। প্রশ্ন করো নিজেকে: “আমি কি চেয়েছিলাম ‘আমি’-কে?” “জন্ম, জাগরণ কি আমার সিদ্ধান্তে ঘটেছে?” সত্য উত্তরে তুমি খুঁজে পাবে—না, এটি ঘটেছে নিজে থেকেই। এই অন্বেষণেই মিথ্যা কর্তা-ভাব ভেঙে পড়ে, আর তুমি প্রবেশ করো সাক্ষীস্বরূপ চৈতন্যে, যেখানে নেই কিছু করবার, নেই কিছু ধারণ করবার।