নির্জন গহনে: ৪১




২০১.

‘নিঃশব্দ ধ্বনি’—সেই ‘আমি’, যা ঈশ্বরের স্মরণ, এবং আত্মস্বরূপের দ্বার। সেই নিঃশব্দ ধ্বনি—অতি সূক্ষ্ম ‘আমি’ বোধের গুংগুন শব্দ, এটি এক নিত্য স্মরণ—যে তুমি-ই ঈশ্বর। শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্য দিয়ে যে সূক্ষ্ম ‘So Hum’ ধ্বনি ওঠে—তা যেমন স্বতঃসিদ্ধ, তেমনি এর থেকেও গভীর এক অভ্যন্তরীণ অনুরণন—‘আমি’-র গূঢ় নিঃশব্দ ধ্বনি, যা মন ছুঁতে পারে না, কেবল চেতনার গভীর স্তরে উপলব্ধ হয়।

এই ‘আমি’-র নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি-তে ধ্যান করাই হলো এই সত্যকে উপলব্ধি করার উপায়—যে তুমি কেবল শরীর-মন নও, তুমি সেই নিরাকার সত্তা, পরম চৈতন্য। কেবল তত্ত্ব জেনে বা কথা শুনে ‘আমি’-কে বোঝা যায় না—একে উপলব্ধি করতে হয়, একীভূত হতে হয়। আর এই একীভবনের পথ হলো—ধ্যান, আত্মস্থতা, ও নিঃশব্দে সেই ‘আমি’-র সাথে মিশে যাওয়া।

অদ্বৈত বেদান্তে ‘আমি’-বোধ হচ্ছে আত্মস্মরণের প্রথম স্পন্দন। তবে এই ‘আমি’ কোনো উচ্চারিত শব্দ নয়, এটি এক অভ্যন্তরীণ ধ্বনির মতো, যা চিন্তার ঊর্ধ্বে এবং ভাষারও অতীত।

শ্বাস-প্রশ্বাসে যে ‘So Hum’ ধ্বনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায়, তা এক প্রতীক—যা বোঝায় “আমি সেই (পরম)”। কিন্তু তারও সূক্ষ্মতর হলো—‘আমি’-র শব্দহীন গূঢ় অনুরণন, যা তোমার চেতনায় সদা চলমান।

এই নিঃশব্দ অনুরণনের উপর ধ্যানই হলো আত্মজ্ঞান অর্জনের একমাত্র পথ—যেখানে তুমি তত্ত্ব জানো না কেবল, বরং তাতে দ্রবীভূত হয়ে যাও। ‘আমি’ বোধের এক গূঢ় নিঃশব্দ ধ্বনি রয়েছে, যা প্রতিনিয়ত তোমাকে স্মরণ করায়—“তুমি ঈশ্বর”। এই ধ্বনি ‘So Hum’ থেকেও সূক্ষ্ম, এবং একমাত্র ধ্যানের মধ্য দিয়েই এর প্রকৃত উপলব্ধি সম্ভব। শুধু বই পড়ে, বক্তৃতা শুনে নয়—এই ‘আমি’-কে বুঝতে হলে তাতে স্থিত হতে হয়, মিলিত হতে হয়।

ধ্যানের মাধ্যমেই তুমি এই শব্দহীন চেতনার সঙ্গে একীভূত হতে পারো, আর তখনই উদিত হয় আত্মস্বরূপ—যেখানে ‘আমি’-ও নেই, আছে কেবল তুমি নিজেই—পরম চৈতন্য।

২০২.

‘আমি’-তে আছ, চেষ্টা কোরো না; ব্যাখ্যা থামলেই শুরু হয় সত্য সাধনা। তুমি আগে থেকেই ‘আমি আছি’ অবস্থাতেই আছ—এর জন্য তোমাকে কোনো প্রচেষ্টা করতে হয় না। তাই কেবল এই অবস্থায় থাকো। তুমি কি আলাদা করে চেষ্টা করো জানার জন্য যে তুমি আছ? না—এই ‘আমি’ বোধ এমনিতেই রয়েছে।

তাই তাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও করো না—কারণ ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, সংজ্ঞা—এসবই চিন্তা-ভিত্তিক ও ভাষা-নির্ভর, যা শব্দহীন ‘আমি’-কে ধরতে পারে না। আসলে যখন সব ব্যাখ্যা থেমে যায়, তখনই তুমি সত্যিকার অর্থে ‘আমি’-তে প্রবেশ করো—যা কেবল উপলব্ধি, অনুভব—কোনো চিন্তা নয়।

ধ্যান, উপলব্ধি, আত্মজ্ঞান—সবই একে অপরের পরিপূরক, কিন্তু এগুলোর উদ্দেশ্য হলো একটিই—তোমাকে শব্দের বাইরে, বিশ্লেষণের বাইরে, নিঃশব্দ ‘আমি’-তে স্থাপন করা। এমনকি এই লেখা—একেও একসময় পাশে সরিয়ে রাখতে হবে। কারণ, শেষত—শুধু নিঃশব্দ উপস্থিতিতেই শুরু হয় প্রকৃত সাধনা।

অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়—আত্মা কখনও অর্জনের বস্তু নয়, কারণ তুমি সবসময় সেই চেতনাতেই অবস্থান করছ। ‘আমি’ বোধ এক চিন্তার বিষয় নয়—এটি শব্দহীন উপস্থিতি, যার উপলব্ধি হয় ভাবনাহীন স্থিতির মাধ্যমে।

জ্ঞানী বলেন—তুমি যত ব্যাখ্যা করবে, ততই তুমি দূরে সরে যাবে। আর তুমি যত নিঃশব্দ থাকবে, ততই তুমি একীভূত হবে। অতএব—ধ্যান, উপলব্ধি, পাঠ—সবই একসময় উপশমে পরিণত হয়। শেষত, শুধু থাকা—নিঃশব্দে, ব্যাখ্যাহীনভাবে—এই ‘আমি’-তে—এটাই প্রকৃত সাধনার সূচনা।

তুমি আগে থেকেই ‘আমি’-তে আছ, এজন্য আলাদা কোনো চেষ্টা লাগে না। কিন্তু এই বোধকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলে, তুমি ভাষা ও চিন্তার খাঁচায় বন্দি হয়ে যাও। যখন ব্যাখ্যা থেমে যায়, তখনই তুমি শব্দহীন ‘আমি’-তে স্থিত হতে পারো। এমনকি সাধনাগ্রন্থও একসময় ছেড়ে দিতে হবে—কারণ সাধনা তখনই শুরু হয়, যখন ভাষা শেষ হয়ে যায়।

২০৩.

দেহে ‘আমি’-র স্থিতি যদি নিখাদ হয়, তবে জন্ম-মৃত্যু অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এই মুহূর্তে তুমি এক দেহ ধারণ করে আছ, আর এই দেহের ভেতরে উদিত হয়েছে এক অন্তর্নিহিত জ্ঞান—‘আমি আছি’।

এই ‘আমি’-কে আগে বোঝো, তারপর তাকে গ্রহণ করো, এবং শেষে তাতে স্থিত থেকো। এই ‘আমি’-র জ্ঞান নিজেই যখন নিজের উপর ধ্যান করে, দীর্ঘসময় ধরে—তখন ধীরে ধীরে সব কিছু ঝরে পড়ে, শুধু ‘আমি’-ই থেকে যায়, আর কিছু নয়।

তখনই এই দেহ-স্থিত ‘আমি’-র সর্বোচ্চ অবস্থা প্রকাশ পায়—যা ‘তুরীয়’ (Turiya) বলা হয়, চেতনার চতুর্থ স্তর—জাগরণ, স্বপ্ন, নিদ্রার ঊর্ধ্বে। একবার যদি তুমি এই ‘আমি’-কে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করো, স্বীকার করো, ও তাতে নিমগ্ন হও, তাহলে আর পুনর্জন্মের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

অদ্বৈত বেদান্তে, ‘আমি’ বোধ হচ্ছে আত্মস্মরণের প্রথম বুদ্‌বুদ, যা দেহে অবস্থান করলেও চৈতন্যের ইঙ্গিত বহন করে। সাধনার সূচনা হয় এই ‘আমি’-র সঙ্গে ধ্যানময় সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে—‘আমি’ নিজেই নিজের উপর ধ্যান করে, একে এক আত্ম-প্রতিবিম্ব ঘটে।

যখন এই ধ্যান পর্যাপ্ত গভীর হয়, সব চিন্তা, ধারণা, ব্যাখ্যা ঝরে পড়ে, শুধু শব্দহীন, রূপহীন ‘আমি’ বোধ রয়ে যায়। এটিই ‘তুরীয়’—যা তিনটি চেতনার স্তর (জাগরণ, স্বপ্ন, গভীর নিদ্রা) অতিক্রম করে স্থিত হয় এক নিঃসীম নীরবতায়। এই অবস্থায় পৌঁছে গেলে—সাধক আর “ব্যক্তি” থাকেন না, তাঁর জন্য জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, তিনি আর পুনরায় শরীর ধারণ করেন না।

তুমি এখন দেহে অবস্থান করছ, আর তোমার ভেতরে আছে ‘আমি’ বোধ। এই ‘আমি’-কে বোঝো, গ্রহণ করো এবং ধ্যানের মাধ্যমে এতে স্থিত হও। যখন এই ‘আমি’ নিজেই নিজের উপর ধ্যান করে—সব কিছু নিঃশেষ হয়ে গিয়ে কেবল ‘আমি’-ই টিকে থাকে।

এটিই ‘তুরীয়’ অবস্থা—চৈতন্যের চতুর্থ স্তর, যা জাগতিক সব অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে। এখানে পৌঁছালে তুমি আর জন্ম-মৃত্যুর ঘূর্ণিতে পড়ে থাকো না—তুমি মুক্ত, তুমি পরম।

২০৪.

‘আমি’—পরমের বিজ্ঞাপন, কিন্তু নিজেই মায়া। এই ‘আমি’ বোধ—যখন এটি তার শব্দহীন, বিশুদ্ধ রূপে থাকে, তখন এটি একপ্রকার বিজ্ঞাপনমাত্র—যা পরম সত্য বা পরব্রহ্ম-কে ইঙ্গিত করে।

কিন্তু এই ‘আমি’-র রয়েছে একটা শুরু এবং শেষ, এটি উদিত হয় এবং আবার লুপ্ত হয়। তাই এর প্রকৃতি অস্থায়ী, এটি স্বপ্নের মতো, একটি মায়া, যা তোমাকে সত্যের দিকেই ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু নিজে সত্য নয়। এই মায়াময়তা বোঝার জন্য, তোমাকে ফিরে যেতে হবে সেই মুহূর্তে—যখন এই ‘আমি’ প্রথমবারের মতো তোমার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদিত হয়েছিল।

যদি তা বোঝা কঠিন হয়, তাহলে সকালে গভীর নিদ্রার পর যখন তুমি জেগে ওঠো, ঠিক সেই মুহূর্তে ‘আমি’ বোধ যেভাবে উঠে আসে, সেটিকে চুপ করে পর্যবেক্ষণ করো। যে এটি জানে যে, ‘আমি’-ও এক ভাসমান বিজ্ঞাপনমাত্র, সে-ই জানে সেই অবিনশ্বর চিরন্তন মূলনীতি—যা কোনো বিজ্ঞাপন চায় না, কোনো রূপ নেয় না, তবুও সর্বত্র আছে।

অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়—‘আমি’ বোধ হলো আত্মচেতনার প্রথম অভিব্যক্তি, কিন্তু এটি নিজে পরম নয়, বরং একটি দিকচিহ্ন যা পরমের দিকে ইঙ্গিত করে। এটি ঠিক যেমন একটি বিলবোর্ড, যা তোমাকে একটি গন্তব্য দেখায়—কিন্তু সেই গন্তব্য নিজে নয়।

‘আমি’ বোধের উদয় যেমন স্বতঃসিদ্ধ (deep sleep থেকে জেগে ওঠার সময়), ঠিক তেমনই তার অন্তর্ধানও স্বতঃসিদ্ধ (deep sleep এ বা samadhi তে)। এ থেকে বোঝা যায়—‘আমি’ আসা-যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তুমি নিজে নও কখনও এই ‘আমি’।

যে-ব্যক্তি এই ভেদ বোঝে যে, ‘আমি’ বোধও একটি ছায়া, সে-ই চেনে পরব্রহ্ম, যিনি কখনও উদিত হন না, লুপ্তও হন না—তিনি চিরস্থায়ী, নিরাকার, নিঃশব্দ, শুদ্ধ চৈতন্যমাত্র।

‘আমি’ বোধ নিজে পরম নয়, এটি পরমের এক অস্থায়ী প্রকাশ, যা কেবল তাকে ইঙ্গিত করে। এই বোধের শুরু ও শেষ রয়েছে, তাই এটি অসত্য বা মায়াময়—যেমন স্বপ্ন আসে ও যায়, তেমনই এই 'আমি'–ও। এই সত্য উপলব্ধি করতে চাইলে, গভীরভাবে খেয়াল করো জাগরণের সেই প্রথম মুহূর্তে—যখন নিদ্রা থেকে উঠে ‘আমি’ বোধ জন্ম নেয়।

যে জানে, ‘আমি’-ও মিথ্যা, সে-ই জানে চিরন্তন সত্য—যিনি সাক্ষী, যিনি কখনও আসেন না, যান না—তিনি পরম ব্রহ্ম।

২০৫.

‘আমি’-র আগমন ও অপসান জীবনের এক নিঃশব্দ রেখাচিত্র। গর্ভে থাকার সময়, ‘আমি’-র বোধ ছিল সুসুপ্ত, অপ্রকাশিত। প্রায় তিন বছর বয়সে, এই ‘আমি’ বোধ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে ওঠে—“আমি আছি”—এই অনুভব জন্ম নেয়। এরপর মধ্যবয়সে পৌঁছে এই বোধ চূড়ান্ত তীব্রতায় বিস্তৃত হয়—নিজেকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পরিচয়, দেহবোধ, অর্জনের আকাঙ্ক্ষা।

তবে বার্ধক্যে, এই ‘আমি’ বোধ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকে, নিজের গুরুত্ব হারায়, নিজেকেই বহন করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এবং একসময়—মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে—এই ‘আমি’-ও নিঃশব্দে অন্তর্হিত হয়। এই ‘আমি’-র উত্থান ও পতনের মাঝেই আবৃত থাকে একটি সম্পূর্ণ জীবন। এর আসা ও যাওয়া দুটোই তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এগুলি ঘটে স্বতঃসিদ্ধভাবে—তুমি শুধু তাদের সাক্ষী।

জীবনের এই পরিবর্তনের একটি সূক্ষ্ম সূচক হলো—তোমার হস্তাক্ষর (signature)। যখন তুমি যুবক ছিলে, তোমার সই ছিল তীক্ষ্ণ, আত্মবিশ্বাসী, স্থির। বার্ধক্যে গিয়ে, সেই একই সই করতে গেলে তা হয় না—অথবা হলেও তাতে লাগে অধিক প্রচেষ্টা, আর তার মধ্যে থাকে এক কম্পিত অস্থিরতা।

‘আমি’ বোধ আত্মার নিজস্ব কিছু নয়—এটি চেতনাশক্তির এক অস্থায়ী প্রকাশ। জন্মের সময় এটি অনুপস্থিত, শৈশবে উদিত হয়, জীবনের মধ্যভাগে সবচেয়ে দৃঢ়, তবে বার্ধক্যে তা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে অবশেষে বিলীন হয়ে যায়।

অদ্বৈত বেদান্তে, এটাই প্রমাণ যে ‘আমি’-ও মিথ্যা, কারণ যা জন্ম নেয় ও মরে, তা চিরন্তন নয়। হস্তাক্ষরের পরিবর্তন এই সত্যের বাইরের প্রতিফলন—যেখানে দেখা যায়, ‘আমি’-র প্রকাশ যত গভীর, তত দৃঢ় আত্মপ্রকাশ, আর ‘আমি’ ক্ষীণ হলে, সব প্রকাশই নরম, কাঁপা, অস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তবে যে-ব্যক্তি এই উত্থান ও পতনের পেছনের নিঃশব্দ সাক্ষীসত্তা হিসেবে নিজেকে জানে—সে-ই চেনে চিরন্তন সত্য—‘আমি’-র আগেও ছিল, ‘আমি’-র পরে–ও থাকে।

গর্ভাবস্থায় ‘আমি’ বোধ সুপ্ত থাকে। তিন বছর বয়সে এটি জাগে, মধ্যবয়সে পৌঁছে চূড়ান্ত আত্মপ্রকাশ করে। বার্ধক্যে তা ক্ষীণ হয়ে যায়, এবং মৃত্যুর সাথে বিলীন হয়। এই উত্থান ও পতন এক জীবনের পূর্ণ রেখাচিত্র—যার সূচক হয়ে থাকে আমাদের হস্তাক্ষর। কিন্তু যিনি এই পরিবর্তনের পেছনের নিঃশব্দ উপস্থিতি, তিনিই জানেন চিরন্তন সত্য—পরব্রহ্ম, অস্মিতাহীন চৈতন্য।