তরী,
আমার ইচ্ছে করে কোথাও পালিয়ে যেতে। আর কত এমন করে দম আটকে থাকব? আমার মনের যুদ্ধগুলো, স্নায়ুর যুদ্ধগুলো, এসবের শেষ কোথায়? অপু-দুর্গার মতো সহজ জীবন পাবার অধিকার কি আমারও ছিল না? নাহয় হতামই একটু গরিব, হাভাতে আর বেহায়া। তবুও, জীবনটা সহজ তো হতো!
রাতে ভাত রান্না হবে—শুধু সেই খুশিতেই রাতের পর রাত উল্লাস করতে আমিও তো পারতাম। দশ কিংবা এগারোতে বিয়ে হয়ে গেলে, অপুর মা সর্বজয়ার মতো, কত ভালো হতো—ভেবেছিস? আমি ইদানীং খুব ভাবছি।
হরিহর রায়ের মতো সাদামাটা, চিরকাল অভাবী লোকের সংসার করা নিশ্চয়ই খুব কঠিন হতো। অভাবের তাড়নায় আমারও গলায় দড়ি দিতে মন চাইত বেলায় বেলায়—জানি। তবুও তো জীবন সহজ হতো! শুধু বেঁচে থাকার কী তীব্র আকুতি—খড়কুটো আঁকড়ে, অপমান আঁকড়ে হলেও বেঁচে থাকা তো হতো!
দুটো পুজো অন্তর অন্তর মুখার্জি বাড়ির বউদের ছেঁড়া একটা করে থান, বাচ্চাদুটোর জন্য পুরোনো কাপড়, স্বামীর জন্য পুরোনো ধুতি—এটুকুতেই খুশি হবার মতো মন আমারও চাই, তরী। আমি এত খাই খাই করা, চাই চাই করা মন আর চাই না। এই কামাও, ওই জমাও, ওটা কিনতে হবে, জমিটা বেচে হলেও আমার অত টাকা লাগবে—এসবের ভিড়ে শ্বাস নিতে ভুলে যাই, নিজেকেও ভুলে যাই।
তরী, আমাকে বাঁচা। আমি নিশ্চিন্দিপুরের মতো একটা গ্রামের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছি। জানি, ওই জীবন কষ্টের হবে, কিন্তু এই আধুনিক জীবনের যে-সুখ—এতে কোনো তৃপ্তি নেই। তৃপ্তি ছাড়া সুখ পাচ্ছি, আবার বছর বছর সেই সুখের জাকাত হিসেবে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি। আমার এত এত চাই আর চাই না। সরলতা চাই, তুষ্টি চাই। অল্প ভাতে বেশি স্বাদ চাই, নোনা ফল, ঝুনো নারকেল চাই।
আমি নিশ্চিন্দিপুরে চলে যাচ্ছি সামনের মাসে। এর পরের চিঠিটা ওখান থেকেই লিখব। তুই চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারিস। এটা শহুরে দাওয়াত নয় যে ফোন করেই আসতে হবে! যে-কোনো সময়, যখন ইচ্ছে হয় চলে আসিস।
আমার ব্যাগ গোছানো অনেকটাই বাকি। তোকে পরে আবার লিখব।
ইতি,
নিশ্চিন্দিপুরের নতুন বাসিন্দা