আজ রাতের এই প্রহরটা, নিঃসন্দেহে অন্য যে-কোনো সময়ের থেকে একেবারে ভিন্ন। ক্ষীণস্বরে গোঙানির অস্পষ্ট এক আওয়াজে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল! আমি অনুভব করতে পারলাম…শব্দটা আমার ভেতর থেকেই আসছে। বেশ অন্যমনস্ক থাকায়, কাল বিকেলের পর থেকে কী কী করেছি, আমার আর কিছুই মনে নেই।
অতিরিক্ত ক্লান্তিতে আমার শরীরটা যেন অবশ হয়ে গিয়েছে—এ অবস্থায়, বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াবার মতন গায়ের জোরটুকুও আমার নেই। চুপচাপ কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকাটাই শ্রেয়। শরীরটা এমন অবশ হয়ে আছে—বাঁ-পাশের হাতটা ঠিকমতো নাড়াতে পারছি না এবং চেষ্টাও করছি না। এভাবেই বেশ আরাম লাগছে…তবে, মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা অসহ্য ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠছে।
নাহ্! এভাবে আর বেশিক্ষণ শুয়ে থাকাটা ঠিক হবে না। অনেক কষ্টে পাশ ফিরে শুতে চেষ্টা করলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই সফল হলাম, কিন্তু শরীরের বাঁ-দিকটা কেমন যেন অসাড় হয়ে আছে। বোধ হয়, ওপাশ ফিরে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম, তাই এমনটা মনে হচ্ছে! তবুও, আমার ডান হাতটা বেশ সচলই আছে এবং ঠিকমতো অনুভব করতে পারছি সব কিছুই।
শরীরটাকে ধীরে ধীরে স্পর্শ করতে থাকলাম আর বোঝার চেষ্টা করছি, আসলে সমস্যাটা কোথায়! আমার নিজের শরীর ছুঁয়ে দেখতে আগে কক্ষনো এতটা ভালো লাগেনি—যতটা গভীর অনুভব এখন এবং ইদানিং হচ্ছে!
চাঁদের আলোয় আমি আমার শরীরের অংশগুলো স্পষ্ট দেখতে পারছি! হাত বুলিয়ে দিতেই মনে হচ্ছে…নরম কোনো গভীর খাদে হাতটা তলিয়ে যাচ্ছে! ভীষণ সুন্দর তবে ভিন্ন রকমের তীব্র এক সুঘ্রাণে আমার অস্থির লাগছে!
এর আগে আমার একবার এমন হয়েছিল—যখন আমি আমার ভালোবাসার মানুষটিকে খুব শক্ত করে শেষবারের মতন আলিঙ্গন করেছিলাম। সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনাটিকে আমি আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য হিসেবে ধরে নিয়েছি।
একসময়, ঘ্রাণ নিয়ে ভীষণ রকমের বাড়াবাড়ি ছিল আমার মধ্যে। মিষ্টি কোনো সুঘ্রাণ…আমার কল্পনাশক্তিকে চমৎকারভাবে বাড়িয়ে দিত; বেশ কিছু ফুলের তীব্র ঘ্রাণও আমার পছন্দের তালিকায় ছিল; মানুষের মধ্যে কতখানি সত্যতা, তীক্ষ্ণতা ও ঘৃণা রয়েছে, তার সবকটি মাত্রাই আবিষ্কার করা সম্ভব—এই ঘ্রাণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
তবে, ভালোবাসার মানুষের শরীরের চেনা ঘ্রাণেই—আমার সবথেকে বেশি অস্থির লাগত। বলতে পারেন, সেখান থেকেই সব পাগলামির শুরু।
ব্যাপারটা বুঝতে পারা কিন্তু এত সহজ কাজ নয়—কারও আত্মার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে বাস করতে শুরু করলেই, অর্থাৎ কোনো মানুষকে ছুঁয়ে যদি আপনার মধ্যে প্রচণ্ড রকমের পাগলামি আর ভালোবাসার অনুভূতি কাজ করে…তবে তখনই আপনি সেই হালকা মিষ্টি সুঘ্রাণকে আপনার কল্পনায় ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারবেন; যদিও এই কাজটি আয়ত্ত করতে পারাও ভীষণ কষ্টসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। তবে হ্যাঁ, আমি কাজটি খুব সহজেই করতে পেরেছিলাম—কেননা আমি জানতামই না, এটা রপ্ত করা এতখানি দুঃসাধ্য ব্যাপার।
আমার অবস্থা অনেকটা সেই বাম্বলবিয়ের মতন—যে নিজেও জানত না, উড়তে পারার মতন কোনো বৈশিষ্ট্যই তার শারীরিক গঠনে নেই, তবুও সে দিব্যি উড়ে চলেছে। কারণটা আরও খুলে বললে—এই বড়ো আকৃতির মৌমাছিটি জানতই না যে, সে কক্ষনো উড়তে পারবে না। এজন্যই বোধ হয় সবসময় সব কিছু জানতে নেই, সব সত্যের মুখোমুখি হতে নেই—এতে বেঁচে থাকার ইচ্ছে, এমনকি শক্তিটাই শেষ হয়ে যায়।
কিছু মিথ্যে কল্পনা মনকে শান্ত করে এবং বেশিরভাগ সময়ই তারা মোমের আলোর মতো স্নিগ্ধ এবং পাপড়ির মতো কোমল—বাস্তবতাটুকু ওই মুহূর্তের জন্য জানতে চাওয়ার দরকারই-বা কী? আমিও আসলে অনেক কাজ নিজের অজান্তেই করে ফেলেছি, যা ভেবেও এখন নিজেকে—অদ্ভুত অদৃশ্য এক নীরব অনুভূতির সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে হয়।
…তবে, এই ঘ্রাণটা আরও একটু বেশিই অন্যরকম। এর আগে…এত সুন্দর ঘ্রাণ আমি কক্ষনো গ্রহণ করিনি; নিস্তব্ধ একটা দীর্ঘ সময় ধীরে ধীরে অতিবাহিত হতে শুরু করল...যেখানে অতিরিক্ত কোনো আলাপ নেই, নেই কোনো সংশয়—আছে কেবল মৃদু নিঃশ্বাসের নিঃশব্দ কম্পন...যা প্রকৃতপক্ষে ভারী, অথচ প্রচণ্ড উত্তাপে হালকা হাওয়ার মতোই অনুভব করা যায়।
আচ্ছা…চাঁদের আলো ঘরে ঢুকল কী করে? এমন তো হবার কথা নয়। পুবদিকের এই জানলাটা সবসময় বন্ধই থাকে।
ইস্, ভুলে গিয়েছিলাম…পাশের মাঠে ছোটো বাচ্চাগুলো রোজ বিকেলে দলবেঁধে ক্রিকেট খেলতে আসে, ওদেরই কাজ এটা।
জোরে একটা শব্দ হয়েছিল সেদিন…যখন আমি পুরো শরীরটা জলে ডুবিয়ে নিজেতে মগ্ন ছিলাম। তাহলে জানলার এককোণের কাচটা ফেটে গিয়েছিল—গত পরশুই।
চোখ আসলে কীসের প্রতীক? ভয়ের? তাচ্ছিল্যের? যন্ত্রণার? না কি ঘৃণার? যে-চোখদুটো আমাকে প্রায় সময়ই তাড়া করে বেড়ায়, তার অস্তিত্ব কি আদৌ রয়েছে? পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই তো ঘটছে—যার ব্যাখা আমাদের কাছে নেই, হয়তো ঈশ্বরই ভালো জানেন এই রহস্যের গতিবিধি সম্পর্কে।
আচ্ছা, মানুষের বোধের বিকাশটা ঠিক কোন মুহূর্তে ঘটে? থাক, এসব নিয়ে অন্য কোনো সময় ভাবা যাবে। এখন, ঠিক এই মুহূর্তে, আমার সমস্ত শরীরজুড়ে যে-অস্থিরতা কাজ করছে…বরং তা নিয়েই বিশ্লেষণ করা যাক; কিন্তু এদিকে নানা প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে।
অদ্ভুত একটা ব্যাপারও হয়েছে…এ নিয়ে তেমন ভাবছিলাম না এতক্ষণ, কেননা চাঁদের আলোয় ঈশ্বরপ্রদত্ত অবয়বের এ সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করে রেখেছে!
কিন্তু ব্যাপারটা হয়েছে কী—আমি কখনোই শরীরে কাপড় ছাড়া ঘুমোতে যাই না। আর এখন নভেম্বর মাস হওয়াতে, রাতে বেশ শীত করে…তাই প্রশ্নই আসছে না এভাবে…সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় ঘুমোনোর। তবে, যতখানি অস্বস্তিতে পড়বার কথা ছিল…তেমন কিছুই আমার মনে দাগ কাটছে না।
আহহ্! এই তীব্র সুঘ্রাণটা আমাকে পাগল করে দেবে! আচ্ছা, এটা কি হাসনাহেনা ফুলের তীব্র ঘ্রাণ? না কি অন্য কিছু? না না, এটা কোনো সাধারণ ফুলের ঘ্রাণ নয়। তবে কী এটা?
আচ্ছা, গত পরশুই যদি ওই বিকট শব্দের ক্ষণে—জানলার কাচের একটুকরো খসে পড়ে…তবে আমি তা খেয়াল করলাম না কেন? তবে কি এই দুইদিন ধরে আমি এই বিছানাতেই এভাবে শুয়ে আছি!
(চতুর্থ পর্ব শেষ)