তীব্র ভালোবাসার অনুভূতি আপনাকে সবসময়ই স্বস্তি দেবে, এমনটা না-ও হতে পারে। এটা বহু বার হয়েছে যে—আমি ভালোবেসেছি নিঃস্বার্থভাবে, কিন্তু সেই ভালোবাসার অনুভূতিটা যথেষ্ট তীব্র নয়। ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসতে পারার সুখ কতটা গভীর আর দীর্ঘ, তার প্রমাণ একবার পেয়েছিলাম।
আমার এক কাছের বন্ধুর কথা শুরুতেই বলেছি—তাকেই আমি আমার জীবনের একাধিক দ্বন্দ্বের কথা চিঠির মাধ্যমে জানাতাম। তার কাছে আমার সমস্যাগুলো একেবারেই তুচ্ছ হবার কথা…তবুও সে গভীর মনোযোগে আমার সবকটা লেখাই পড়েছে।
এতে কতখানি সময়ের অপচয় হয়েছে, ভাবতে পারছেন! তাকে অবশ্য আমি বলতে ভয় পেতাম এবং এখনও ভয়ই পাই—”আমি তোকে ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসতে চাই!”, কেননা আমি জানি, তা সম্ভব নয়।
আমি কিন্তু আগে এমন অসুস্থ ছিলাম না…হঠাৎ করেই কী যে হয়েছে আমার! তার সাথে যোগাযোগটা এভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছে...ভাবতেও বুকের ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যায়। আমি যদি একজন মৃত মানুষকে ভালোবাসতে পারতাম, তবে কেমন হতো?
উফফ্, অস্বস্তি! এমনিতেই অন্ধকারে ঠিকমতো কিছু দেখা যাচ্ছে না। সামনে ওটা কী? ভোর হতে বেশি সময় বাকি নেই, কিছুটা আবছা আলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে...
আমি আজকাল চোখে বেশ কম দেখি, চোখের দৃষ্টিও কেমন যেন ক্ষয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, কোনো একটা জন্তু আমার পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে এসে পড়েছে, কিছুতেই ছাড়ছে না। এ কী! কামড়ে-টামড়ে দেবে না তো আবার!
আমার একসময় গান শেখার বড়ো ইচ্ছে ছিল। বেহালার করুণ সুরে কানের একপাশটা ছিঁড়ে যাচ্ছে...বুকের ভেতরে এক ধারালো ছুরি দিয়ে কে যেন অবিরত আঘাত করে চলেছে। সেই সুরটা আমার হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল—আমি যে-কোনো পরিস্থিতিতেই এটিকে খুব কাছ থেকে কল্পনায় আনতে পারি৷
আজ আকাশে ভীষণ মেঘ করেছে। ঝুমবৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। ক্যালেন্ডারে তাকিয়ে দেখলাম, আজ নভেম্বর মাসের ৭ তারিখ। জানালার কাচে পুরু একস্তর ধুলো জমেছে, ঘিচিমিচি অক্ষরে কী যেন লেখা...
অক্ষরগুলোতে আলতো হাত বুলিয়ে দিতেই আমার চোখে জল এসে গেল! বুঝতে পারলাম, আজ আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটার জন্মদিন! ইচ্ছে করছে তাকে বাক্সভর্তি উপহার পাঠিয়ে দিই—কিন্তু, অতটা সামর্থ্য যে আমার নেই।
কাছের মানুষ বলতে…আমার কেউই কি কখনও ছিল না? মানুষের তো কাছের মানুষ থাকে, তাহলে আমার কেন নেই? আমি কি এখন অবধি মানুষই নই?
বেহালার সেই সুরটি আবারও কানে বেজে উঠল! পুরোনো একটা সময়ের কথা আজ খুব মনে পড়ছে—সত্যি, লেখালেখির ভূতটা আমাকে তার জন্যই চেপে ধরেছিল…
সেই সময়টা বড়ো সুন্দর আর রঙিন ছিল। আমি তেমন গোছানো শব্দে সাজিয়ে লিখতে পারতাম না, লেখার মধ্যে খাপছাড়া ভাবটা বড্ড বেশিই চোখে পড়ত। তবে, এসবের মাঝেও সেই লেখাগুলোর প্রতিটি অক্ষরে অনুভূতির কম্পনটা ছিল বেশ জোরালো আর সুতীব্র।
সেই সময়, আপাতদৃষ্টিতে, আমার কল্পনার জগৎটা ছিল বেশ রঙিন—যেখানে কোনো ভেদাভেদ নেই, সবাই সমান। এই যে আমার এত দুশ্চিন্তা, রোগব্যাধি, হীনম্মন্যতা...সব কিছুই সেখানে কেমন মিলিয়ে যেত…রঙিন সেই জগতে।
আমি কল্পনার সেই জগৎটাকে একটা সময় পর...আরও বিস্তৃত করলাম। অথচ, এখন সেখানে আমি নিজেই বাস করছি না। কিছু ভয়ানক জীবজন্তু আর কীটপতঙ্গ আমার বুকের পিঞ্জিরাটা আরাম করে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, উদ্দেশ্যহীনভাবে…এমন মানুষকে গালমন্দ করাটা কি নামধারী ভদ্রলোকেদের অধিকার নাকি? কী জানি! আমার তো নিজেকে বেশ সুবিধেরই মনে হচ্ছে—তবে ওদের যে কীসের এত অসুবিধে আমাকে নিয়ে, বুঝি না। ইস্! ওদের একটু কাজ থাকত!
দুঃসাহসিক কিছু করে ফেলাটা আমার পক্ষে সত্যিই সম্ভব। যদি এমনই হয়, তবে সে কাজগুলো না করে বসে আছি কেন? কার জন্যই-বা অপেক্ষা করছি? কীসের অপেক্ষা? আর কেন এই ‘সময়’ নামক এক—তুচ্ছ, প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্বহীন বিষয়ের জন্য ভাবতে শুরু করেছি!
আমি যতক্ষণ শ্বাস নিতে পারছি, তার পুরো সময়টাই তো আমার। যা গেছে…তা দিয়ে আমার কী কাজ? তা ফিরিয়ে এনেও-বা আমার কী লাভ? যা আসেনি, তা আদৌ আসবে কি না, কিংবা এলেও আমি নিজে তা দেখতে পাবো কি না, তার কী নিশ্চয়তা আছে আমার সামনে? এসবের তোয়াক্কা এখন আর আমি করি না।
আমি একটা নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি—অনেকক্ষণ…প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা যাবৎ, আমি পুরো শরীরটা পানিতে ডুবিয়ে রাখব; এরপর শরীরে স্যাঁতস্যাঁতে একটা ভাব এলে, ঠিক সেই মুহূর্তে নিজেকে মনে হতে থাকে কুৎসিত আর নারকীয় এক প্রাণী; এবং তৎক্ষণাৎ, ওখান থেকে সরে এসে—সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গকে নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করা।
এতে করে, আমার বুঝতে আর অসুবিধে হয় না যে, মানুষের অস্তিত্বের দৃঢ়তা আর মোহনীয়তার মধ্যে খুবই সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য রয়েছে। ধীরে ধীরে গায়ের চামড়ায় পানির ফোঁটাগুলো যখন শুকিয়ে আসে এবং শরীরটা বেশ কোমল হয়ে আসে—অদ্ভুত এক সৌন্দর্য ঘিরে ধরে আমায়।
সেই মুহূর্তে, শরীর স্পর্শ করতে ভারি মোলায়েম লাগে, আচমকা শিহরনে আমার অনিচ্ছুক প্রচেষ্টায় সুখের সমস্ত অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করে জোরপূর্বক…আর, ক্ষীণ উত্তেজনার রেশ ধরে।
আমি শরীরের স্পর্শকাতর স্থানগুলো গভীরভাবে ছুঁয়ে দেখি; এমনভাবে, যেন আমার এই সৌন্দর্যে পৃথিবীর আর কারও কোনো অধিকার নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই, আমার চোখজুড়ে ক্লান্তি নামে…
অবচেতনভাবেই, এক অজানা অনুভূতির বিস্ময়ে ডুবে যেতে থাকি আমি—যা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে আমার শরীর একেবারেই অপ্রস্তুত! আমি বুঝতে পারি, এই বিশেষ অনুভূতিটির উৎস—বাইরের কোনো এক অজানা জগৎ, যা নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
অনুভব করি, এক অসহ্য সুখকর অনুভূতিতে যেন পুরো শরীরটা অবশ হয়ে আসছে ক্রমশই!
(তৃতীয় পর্ব শেষ)