দ্বা সুপর্ণা: ২



দূরত্বটা বড্ড বেড়েছে—একদম চোখে পড়বার মতন। পাতার পর পাতা লিখেও, যখন তুমি কিছু পাবে না…তখন তোমার ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা ভর করবে—এই মুহূর্তটা অতিক্রম করতে পারলেই খেলাটি আমরা চালিয়ে যেতে পারব দীর্ঘক্ষণ, স্থায়ীভাবে।

এ এক খেলাই বটে! যার সংস্পর্শে মিলবে একধরনের শুদ্ধতা, তবে আত্মার যে-আকুতি তোমার শরীর ও মনকে গ্রাস করবে—তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তোমার বাস্তবতাকে বহন‌ই করে না।

এভাবে দীর্ঘসময়…দিনের আলো শরীরে না মেশাতে মেশাতে চামড়ায় একধরনের ফ্যাকাশে ভাব এসেছে—শক্ত আবরণে আটকে আছে শরীরের বেশিরভাগ অংশ।

আমার মনে হয়েছিল, সব কিছু ঠিকঠাক আছে—এখন আমি সবার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পারব। অথচ, বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।

আমি মধ্যদুপুরে আবার একদিন হাঁটতে বেরোলাম…তা-ও, মাসখানেক পর। বলতে পারেন, অনেকটা বাধ্য হয়েই…তার আগের তিন দিন উপোস থেকেছি, বিশেষ কোনো কারণে তো নয়ই— বরং, কোনো খাবার সেই মুহূর্তে সংরক্ষণে ছিল না বলে।

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের সরবরাহ ঠিক রাখাটা সত্যিই জরুরি। তবে বাঁচার ইচ্ছেটাই যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে অবশ্য ভিন্ন কথা। মৃত্যুভয় দেখিয়ে লাভ নেই, ওসবে আমি ভয় পাই না।

আসলে, এসব একদমই ফালতু কথা। মৃত্যুভয় না থাকলে কি আর মানুষ নিজেকে নিয়ে এত বেশি ভাবে? অতখানি স্বার্থপরই-বা হয় কী করে! দিনশেষে, আমিও তো স্বার্থপর।

একটা সময় আমি আমার এই সেলফোনের নোটপ্যাডে লেখালেখির কাজটা করতাম। তবে দু-মাস হলো, আমি এই পৃষ্ঠাগুলোকে বেছে নিয়েছি। মনে হচ্ছে, এর থেকে ভালো কোনো উপাদান লেখালেখির জন্য হয় না। ভাবছি, ফোনটা বিক্রি করে দেবো।

মুঠোফোনটা প্রায় সবসময়ই, বন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে ঘরের এককোণে। তা নিয়ে আমার তেমন কোনো মাথাব্যথা থাকে না। আজকাল এই সোশাল নেটওয়ার্কের যুগে মোবাইল নামক এই যন্ত্রটি থেকে দূরে থাকা নাকি বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার, শুনেছি! আমিই হয়তো যুগের সাথে ঠিকঠাক তাল মিলিয়ে উঠতে পারছি না।

ফোন বাজছে, ফোনে মেসেজ এসেছে...এসব আমার কাছে ভয়াবহ দৃশ্য!

সে যা-ই হোক, আমার অবশ্য আফসোস হয় না কখনও। আফসোস করার পুরোপুরি যোগ্য, এমন অনেক ব্যাপার‌ও আমার আজ খুব চেষ্টা করলেও মনে পর্যন্ত পড়ে না।

যেহেতু আমার দিনের বেশিরভাগ সময়ই গভীর ভাবনাচিন্তায় ডুবে থেকে কাটে…তাই আমি গভীর রাতে সেগুলোকেই আবার কাগজে লিখতে শুরু করি।

আমার কেন জানি মনে হয়…ঘুমোনোর কাজটা আমি আজকাল ঠিকমতো করছি না। চোখদুটো বন্ধ করে কী যেন ভেবেই চলেছি, উদ্ভট সব স্বপ্ন দেখি…

অবচেতনভাবেই আমি মিশে যাই অন্য এক জগতে। যেখানে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে মানুষ, জানোয়ার, এমনকি পশুপাখিরাও। এমন সব ভাবনা আমাকে ঘিরে ধরে—যে-ভাবনার কোনো তল নেই।

লেখালেখি বাদে, আমার পছন্দের কাজ আর একটিই, তা হচ্ছে মিউজিক রপ্ত করা। এই অর্থে যে, শুধু শোনাই নয়, বরং আমি মিউজিক আত্মস্থ করি—হ্যাঁ, এই কথাটিই ঠিক।

চপিনের একটা বিখ্যাত ইন্সট্রুমেন্টাল আছে, জানেন তো…Spring Waltz! ইউটিউববাসী অসংখ্য নেটিজেন একে ভুলবশত অনেক দিন ধরে চপিনের সৃষ্টি বলেই ভেবেছে। অথচ সুরটি প্রকৃতপক্ষে পল ডি সেনেভিলের সৃষ্টি এবং ওটার নাম Mariage d’amour (Marriage of Love)! মানে, এই অসাধারণ সৃষ্টি চপিনের নয় এবং ওটার নামও Spring Waltz নয়। ইউটিউবে সুরটির বর্ণনা বদলে দেবার আগেই ওটার ভিউ-সংখ্যা ৩৪ মিলিয়ন ছাড়িয়েছিল। পৃথিবীর অগণিত মানুষ এটাকে দীর্ঘদিন ধরে, এমনকি এখনও, ভুল পরিচয়েই জানে, পরম আনন্দে শোনে!

মানুষ যা দেখে, তার সবটা সত্য না-ও হতে পারে। এবং, প্রায়ই তা হয়। নিজের দেখা কিংবা নিজের ভাবাটাই কেবল ঠিক, এই গোঁয়ার্তুমি থেকে বেরোতে না পারলে মানুষের মানুষ হতে সময় লাগে। কেবল নিজেরটাই ঠিক, বাকিদেরটা ভুল, এমন ভাবনার কুৎসিত মানুষকে যে-কোনো মূল্যে এড়িয়ে চলতে পারলে ভালো।

জৈনদের একটি চমৎকার ধর্মীয় দর্শন আছে—অনেকান্তবাদ—যার যা সত্য, তার তা জীবন। ওরা অন্যের মত ও পথকে বিনয়ের সাথে চুপচাপ মেনে নিতে জানে। ওদের ধর্মই এটা শেখায়, চর্চা করায়। জৈন ধর্মদর্শন সব ধর্ম ও মতের মানুষকে সম্মান ও মূল্যায়ন করতে নির্দেশ দিয়েছে। এ কারণেই জৈনরা অনেক উদার আর ভদ্র হয়। অন্যের ধর্মের ব্যাপারে অসহিষ্ণু মানুষের ধর্ম সুন্দর কিছু শেখায় বলে বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয়। আমরা মাকে চিনি না, সন্তানকে চিনি; অথচ গালিটা কিন্তু সন্তান একা খায় না!

আমার একসময় বেশ বন্ধুবান্ধব ছিল, আর এখন আমি মানুষের কাছ থেকে…অর্থাৎ, পরিচিত, অপরিচিত কিংবা আগন্তুক—যে কার‌ও কাছ থেকেই নিজেকে গুটিয়ে রাখি।

বেশি মানুষ মানেই বেশি ঝামেলা। মজার ব্যাপার, বেশিরভাগ মানুষ বোঝেই না যে, সে অন্যদের অহেতুক বিরক্ত করছে। আচ্ছা, এই রোগে কি কেবল বাঙালিরাই আক্রান্ত? না কি পৃথিবীতে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন জাতি আরও আছে?

কেউ কখনও আমার ভেতরটা ছুঁতে পারেনি। কেউই যে পারেনি, তা বললে অবশ্য ভুল হবে—আমি যার স্পর্শ, ঘ্রাণ ছাড়া অসহ্য কষ্টে ডুবে যেতাম…সেই মানুষটার কাছ থেকেও নিজেকে একটা সময় পর দূরে সরিয়ে ফেললাম—এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ নেই। উদ্দেশ্য একটাই: তাকে মুক্ত রাখা। কাউকে ভালোবাসলে তাকে একদমই তার নিজের মতো করে থাকতে দিতে হয়। থাকতে না দিলে ওটাকে ভালোবাসা বলে না, স্বার্থপরতা বলে।

আশ্চর্যজনকভাবে, আমাদের বাহ্যিক অবয়ব ভেতরের মানুষটার থেকে একেবারেই আলাদা।

দিনের অধিকাংশ সময়‌ই আমি ঘুমিয়ে থাকি। তবে বিশেষ কোনো তথ্য জানার হলে…আমি তা অনুমান করে বোঝার চেষ্টা করি।

বহুদিন হয়ে গেল, পরিবারের কারও সঙ্গেই আমার তেমন যোগাযোগ নেই। হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠলে, আমার বড্ড ভয় হয়…এই বুঝি কারও মৃত্যুর খবর পাবো! ওপাশ থেকে কার‌ও কণ্ঠে আমার নামটা উচ্চারিত হলে—আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে! আমি বিস্মৃতিতে নিক্ষিপ্ত হতে ভালোবাসি।

আবার, আমার এক অদ্ভুত স্বভাবের সন্ধান পেয়েছি—যতক্ষণ অবধি দমবন্ধের শেষপর্যায়ে না পৌঁছুব, ততক্ষণ অবধি কেবল লিখতেই থাকব।

এই ব্যাপারটা চালিয়ে যাওয়া আমার জন্য ভীষণ কষ্টকর ছিল। কারণ, আমার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে, ইনহেলার ছাড়া আমার পক্ষে সারভাইভ করাটাই অসম্ভব। তবুও, এই খেলাটি আমার বিশেষ পছন্দের—কেননা, শুধু এই সময়টাতেই আমি মৃত্যুর যন্ত্রণাকে…সামান্য কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারি, এবং পরক্ষণেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। কোনো কারণে যদি, মুহূর্তের হের-ফের ঘটে—তবে মৃত্যু নিশ্চিত।

ভোর হতে আরও দু-ঘণ্টা বাকি। সময় হয়ে এসেছে। আমাকে বেরোতে হবে। যথাসময়ে আবার ফিরতে হবে।

সেদিন, আজকের মতোই একটা গতানুগতিক দিনে, ঘটেছিল অদ্ভুত এক ঘটনা। ভোরের আবছা আলোয় তাড়াহুড়ো করে…আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে-পড়া কুকুরটা কিছুক্ষণের জন্য আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল…

(দ্বিতীয় পর্ব শেষ)