দ্বা সুপর্ণা: ১



সেই 'নোংরা' কুকুরটার সাথে আমি একসময় বসবাস শুরু করি।...যা বেশিরভাগ মানুষের কাছেই কুৎসিত।

উচ্চবিত্ত লোকসমাজের বাইরে দৃষ্টি রাখতেই—কটাক্ষের এক চরম সীমায় পৌঁছে যায় আমার মস্তিষ্ক। সেই সীমা ভেদ করে আরও তাচ্ছিল্য-বিদ্ধ এক ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে উঠেছিলাম পরিবার নামক বন্ধনের চোখে। আক্রমণাত্মক দৃষ্টিতে সকলেই আমাকে কী কী যেন বলে চলেছে—যে অসহ্য বিদ্রূপ আমায় কোণঠাসা করে দেয় প্রতিটি মুহূর্তে।

একজন মানুষ, যে কিনা পৃথিবীতেই নেই—তাকে আমি আমার নিশ্চিত এক আশ্রয় বলে ভেবে চলেছি। তবে, এমন কেউই কি নেই…আমার অবস্থান সম্পর্কে যে অবগত?

না নেই।
অতঃপর…
যা অপেক্ষা করছিল আমার জন্য, তা ছিল আমার কল্পনারও বাইরে।

আমাদের সমাজে ঘটে-যাওয়া এমন অনেক কিছুই আমরা কেবল এড়িয়ে চলছি—ইচ্ছেতে, কিংবা ইচ্ছের বিরুদ্ধে।

এই গল্পটি কোনো সাধারণ কিছু নয়—আমি এর কিছু অংশ লিখে পাঠিয়েছিলাম আমার এক কাছের বন্ধুর কাছে…কেবলই সামান্য সম্মতির জন্য—অর্থাৎ, তার কাছে এই বাস্তবতাকে গল্প মনে হলে…সেখানেই আমার সার্থকতা।

আসলে, আপনি যদি ভীষণ বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রথম অংশটির পাঠ সম্পন্ন করতে পারেন—তবেই আপনার মনে হবে…এটা নিছকই এক গল্প নয়, রূঢ় বাস্তবতার একাংশ।

শীতের সময়, খুব ভোরে, এই শহরের রাস্তায় তেমন কোনো মানুষ আপনার চোখে পড়বে না—এ এক বড়ো সুবিধে, জানেন তো!

আমার মানুষ ভয় লাগে, আমি এদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। অথচ, আমার মধ্যকার এই ব্যাপারটা আজ পর্যন্ত কোনো মানুষই ধরতে পারেনি—এমনকি, কাছের কিংবা পরিবারের…কেউই নয়।

পরিবারের মানুষ সাধারণত মন বোঝার মানুষ নয়। মন বোঝার মানুষ বা সত্যিই কাছের মানুষ পেয়ে যাবার চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য আর হয় না। অত সৌভাগ্য নিয়ে আমি জন্মাইনি।

খুব ভোরে…সম্ভবত রাতের শেষপ্রহরে, আমার ঘুম ভেঙে যেত এবং আমি রাস্তায় হাঁটতে বের হতাম। ভোরের আলো ফোটার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আবার ফিরে আসতাম এবং এই সময়টাতেই মূলত আমি লেখালেখির কাজটা করতাম। আবার নিয়ম করে দুপুরবেলা, একটু অগোছালোভাবে বের হয়ে যেতাম…অনিশ্চিত কোনো গন্তব্যে।

আমি সারাজীবন‌ই পালাতে চেয়েছি। পালিয়ে যাবার জায়গা ঠিক করে ফেলতে পারলে আপনারা আমাকে আজ আর চিনতেন না। অবশ্য, চেনেন যে, তা-ও নয়। এ পৃথিবীতে আমরা কেউ কাউকে চিনি না।

প্রথম প্রথম, দুপুরের প্রখর রোদে বের হয়ে হাঁটতে বেরোনোর এই ব্যাপারটা আমার বেশ ভালোই লাগত। ফেরার পথে প্রয়োজনীয় কিছু খাবারও আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম।

কিন্তু…ধীরে ধীরে, আমি সেই অভ্যেসটিও বদলে ফেললাম। কেননা, আমার মনে হচ্ছে—এই সময়টা আমার জন্য তেমন সুবিধের নয়।

আজকাল দিনের আলো গায়ে এসে পড়লে সহ্য হয় না। আমি ক্রমশই নিজেকে নির্জন এক মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিলাম। প্রায় সারাদিনই নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখতাম।

রাস্তায় বহুদূর অবধি আমি একা হেঁটেছি, তবে কক্ষনো কেউ আমার মতন এই অধমের পথ আটকায়নি। প্রায়ই একটা কুকুর আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে যেত—ওর অবস্থাও খানিকটা আমারই মতন।

রাস্তার কোণের দিকটায় ময়লার উচ্ছিষ্ট পড়ে থাকাতে, ওই জায়গাটা ভালোভাবে কেউ খেয়াল‌ও করে না। দেখলাম, সুযোগ বুঝে কুকুরটা সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে। আশপাশ থেকে ঢিল ছুড়ছে কিছু লোক। লোকের কাজ‌ই তো এমন অকাজ‌!

রাগে-গজগজ-করতে-থাকা একটা লোকের চোখেমুখে বেশ বিরক্তির ছাপ লক্ষ করলাম। আচমকা এসে আমার কাছে জানতে চাইল—আপনি কী দেখছেন...অ্যাঁ? মানে ওই…হতচ্ছাড়া কুকুরটার কথা বলছিলাম। এই যে! আপনি কানে শুনতে পান না নাকি?

(প্রথম পর্ব শেষ)