দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ৪



সম্যগ্‌দর্শন কেবল দার্শনিক ধারণা নয়, এটি এক মানসিক বিপ্লব—অন্ধবিশ্বাস থেকে প্রজ্ঞায় উত্তরণ, অজ্ঞানতার আঁধার থেকে চেতনার আলোয় জাগরণ। এটি সেই মুহূর্ত, যখন মানুষ জগতকে বিচার নয়, বোধের চোখে দেখে; আর তখনই দেখা রূপান্তরিত হয় জ্ঞানে, আর জ্ঞান রূপান্তরিত হয় মুক্তিতে।

“সম্যগ্‌জ্ঞান” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো—সঠিক জ্ঞান, অর্থাৎ এমন জ্ঞান, যা বাস্তবতাকে তার প্রকৃত রূপে দেখায়, কোনো বিকৃতি বা অজ্ঞতার আচ্ছাদন ছাড়া। জৈন দর্শনে এই জ্ঞান কেবল তত্ত্ব বোঝা নয়; এটি এমন এক উপলব্ধি, যা শাস্ত্র, যুক্তি ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা—এই তিনের সংমিশ্রণে গঠিত হয়। কারণ, একমাত্র তত্ত্ব বা গ্রন্থজ্ঞান যথেষ্ট নয়—যে-জ্ঞান বাস্তবে নিজের ও জগতের সম্পর্ককে আলোকিত করে, সেটিই প্রকৃত সম্যগ্‌জ্ঞান।

জৈন শাস্ত্র বলে, জ্ঞান মানুষের চেতনার প্রাকৃতিক গুণ, কিন্তু তা কার্মিক আবরণে ঢাকা থাকে। সাধনার মাধ্যমে যখন সেই আবরণ পাতলা হয়, তখন আত্মার স্বাভাবিক দীপ্তি প্রকাশ পেতে শুরু করে। এই জ্ঞানের প্রকাশ ধাপে ধাপে ঘটে, আর সেই ধাপগুলোই জৈন দর্শনে জ্ঞান-পঞ্চভেদ নামে পরিচিত।

প্রথম স্তর হলো মতিজ্ঞান (Mati-jñāna)—এটি আমাদের সাধারণ জ্ঞান, যা ইন্দ্রিয় ও মনের সহায়তায় জন্মায়। দেখা, শোনা, স্পর্শ, স্বাদ বা গন্ধ—এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাগুলো মন বিশ্লেষণ করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। যেমন—আমরা আগুন দেখে জানি, তা গরম; এটি মতিজ্ঞান। কিন্তু এই জ্ঞানে ভ্রম বা ভুলের সম্ভাবনা থাকে, কারণ ইন্দ্রিয় সীমাবদ্ধ।

দ্বিতীয় স্তর হলো শ্রুতিজ্ঞান (Śruta-jñāna)—এটি শোনা বা পড়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান, অর্থাৎ শাস্ত্র, গুরু বা অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া জ্ঞান। যেমন একজন শিষ্য যখন গুরুর কাছ থেকে জৈন তত্ত্ব শোনে বা আগম (ভগবান মহাবীর এবং তাঁর শিষ্যদের দ্বারা প্রদত্ত উপদেশ ও শিক্ষা) পাঠ করে বোঝে, তখন সে শ্রুতিজ্ঞান অর্জন করে। এটি মতিজ্ঞানের তুলনায় উচ্চতর, কারণ এতে যুক্তি ও শৃঙ্খলা আছে; কিন্তু এটি পরোক্ষ—নিজের অভিজ্ঞতার নয়।

তৃতীয় স্তর হলো আবধিজ্ঞান (Avadhi-jñāna)—এর অর্থ “সীমিত দূরদৃষ্টি”। এই জ্ঞানে সাধক এমন জিনিস উপলব্ধি করতে পারেন, যা সাধারণ ইন্দ্রিয়ের নাগালের বাইরে—যেমন দূরের বস্তু বা অতীত-ভবিষ্যতের কিছু অংশ। এটি একধরনের অতেন্দ্রিয় উপলব্ধি, যা গভীর তপস্যা ও আত্মশুদ্ধির ফল। তবে একে “সীমিত” বলা হয়েছে, কারণ এর ক্ষেত্র নির্দিষ্ট—সব কিছু নয়, কিছু পরিধি পর্যন্তই উপলব্ধ।

চতুর্থ স্তর হলো মনঃপর্যায়জ্ঞান (Manaḥparyāya-jñāna)—এটি আরও সূক্ষ্ম। এই জ্ঞানে সাধক অন্যের মনোভাব পড়তে পারেন; অন্যের চিন্তা, অনুভব বা ইচ্ছা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নয়, বরং আত্মার সূক্ষ্মতা এতটাই বেড়ে যায় যে, অন্য চেতনার স্পন্দনও তার কাছে স্বচ্ছ হয়ে পড়ে।

সবচেয়ে উচ্চ স্তর হলো কেবলজ্ঞান (Kevala-jñāna)—এটি জৈন দর্শনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। ‘কেবল’ মানে সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, অখণ্ড। এটি সেই অবস্থান, যেখানে আত্মা সমস্ত কার্মিক আবরণ (অতীতের কর্মের ফলস্বরূপ সৃষ্ট মানসিক ও সূক্ষ্ম স্তরের প্রভাবের সমষ্টি) থেকে মুক্ত হয়ে নিজের আসল স্বরূপে—অসীম জ্ঞান, অসীম দর্শন, অসীম শক্তি ও অসীম আনন্দে—প্রকাশিত হয়। তখন আর কোনো অজ্ঞান বা সীমাবদ্ধতা থাকে না; আত্মা তখন সর্বজ্ঞানী ও সর্বদর্শী—সব কাল, সব দিক, সব বাস্তবতার সাক্ষী।

এই পাঁচ স্তরের মধ্যে মতিজ্ঞান ও শ্রুতিজ্ঞান আমাদের পার্থিব জীবনে ব্যবহার্য, আর অবধি, মনঃপর্যায় ও কেবলজ্ঞান হল সাধকের অন্তর্দৃষ্টির পরিণত ফল। তাই সম্যগ্‌জ্ঞান মানে শুধু তথ্য জানা নয়; এটি আত্মার ধীরে ধীরে উন্মোচন—অজ্ঞান থেকে আলোকের পথে উত্তরণ।

যেমন অন্ধকার ঘরে সূর্যের আলো ঢুকলে সব কিছু নিজে থেকেই দেখা যায়, তেমনি আত্মা যখন কার্মিক মেঘ সরিয়ে ফেলে, তখন সমস্ত সত্য নিজে থেকেই উদ্ভাসিত হয়। এই অবস্থায় মানুষ আর বাহ্য জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে না; সে নিজেই আলোকিত—নিজের চেতনার দীপ্তিতেই দেখে, জানে ও উপলব্ধি করে। এই সম্পূর্ণ অবস্থা—কেবলজ্ঞান—জৈন ধর্মে মুক্ত আত্মার প্রতীক, যা আর জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনে আবদ্ধ থাকে না।

সম্যগ্‌চারিত্রের মূল ভাব হলো—জ্ঞান ও দর্শনের যে-আলো আত্মার ভেতরে জেগে ওঠে, তা যেন প্রতিদিনের আচরণে প্রতিফলিত হয়। এই আচরণ তাই নিছক ভদ্রতা বা শিষ্টাচার নয়; এটি জৈন মুক্তিপথের জীবন্ত প্রকাশ। সম্যগ্‌দর্শন ও সম্যগ্‌জ্ঞান তখনই কার্যকর, যখন তারা জীবনযাপনের প্রতিটি স্তরে অনুশীলিত হয়—চিন্তায়, কথায়, কাজে। তাই সম্যগ্‌চারিত্রের উদ্দেশ্য হলো, মন, বাক্য ও শরীরকে এমন স্বচ্ছ নিয়ন্ত্রণে রাখা, যাতে কোনো ক্ষণে হিংসা, মিথ্যা, চুরি, কামনা বা আসক্তি তার বিশুদ্ধ ধারাকে বিকৃত করতে না পারে।

জৈন শাস্ত্রে এই নিয়ন্ত্রণের রূপ পায় পাঁচটি ব্রত বা মৌলিক নৈতিক প্রতিজ্ঞায়—অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ।

অহিংসা মানে শুধু আঘাত না করা নয়; এটি জীবনের প্রতি গভীর সহানুভূতির মনোভাব। ক্ষুদ্রতম প্রাণীকেও কষ্ট না দেওয়া, এমনকি চিন্তা বা বাক্যে হিংসা না জন্মানোই সত্য অহিংসা।

সত্য মানে বাস্তবকে সঠিকভাবে প্রকাশ করা—কাউকে আঘাত না করে, কোনো বিভ্রান্তি না ঘটিয়ে। সত্যবাদী হওয়া মানে শুধু সত্য বলা নয়, এমনভাবে বলা, যাতে তা অন্যের উপকারে আসে এবং নিজের মনও স্বচ্ছ থাকে।

অস্তেয় বা “চুরি না করা” মানে অনুমতি ছাড়া কোনো বস্তু বা অধিকার গ্রহণ না করা। এটি কেবল বস্তুগত নয়; অন্যের সময়, কৃতিত্ব বা মানসিক শান্তিও “চুরি” হতে পারে—তাই সতর্কতা প্রয়োজন।

ব্রহ্মচর্য শব্দটি সাধারণত যৌনসংযমের সঙ্গে যুক্ত হলেও, জৈন দৃষ্টিতে এটি আরও গভীর—ইন্দ্রিয় ও মানসিক প্রবৃত্তির উপর আত্মনিয়ন্ত্রণ, যাতে কামনা মনকে অস্থির না করে।

আর অপরিগ্রহ অর্থ আসক্তিহীনতা—সম্পদ, সম্পর্ক বা চিন্তার প্রতি আঁকড়ে না ধরা। জিনিস যত বাড়ে, বন্ধনও তত ঘনীভূত হয়; তাই অপরিগ্রহ হলো মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ।

এই পাঁচটি ব্রত সন্ন্যাসীদের জন্য মহাব্রত, অর্থাৎ পূর্ণমাত্রায় পালনীয় প্রতিজ্ঞা। তারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই নিয়মগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ করেন—অহিংসায় এতটাই নিখুঁত যে, তারা পায়ের নিচে ক্ষুদ্র প্রাণের ক্ষতির ভয়েও সাবধানে হাঁটেন। গৃহস্থদের জন্য এগুলো অনুব্রত নামে পরিচিত—একই আদর্শের সহজ রূপ, যা সংসারজীবনে সম্ভব সীমায় অনুশীলন করা যায়। সন্ন্যাসী ও গৃহস্থের অবস্থান আলাদা হলেও, উভয়ের লক্ষ্য এক—কষায় বা অন্তরের চার কলুষ, অর্থাৎ ক্রোধ, মান (অহং), মায়া (প্রবঞ্চনা), ও লোভ—এই চার বিষকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করা।

জৈন দর্শনে বলা হয়, এই কষায়গুলোই আত্মার দীপ্তিকে আচ্ছাদন করে রাখে; তারা কার্মিক পদার্থকে আকর্ষণ করে এবং আত্মাকে জড়জগতে বেঁধে ফেলে। সম্যগ্‌চারিত্র মানে এই কষায়কে প্রতিদিন একটু একটু করে আলগা করা—সংযম, করুণা, সততা ও আসক্তিহীনতার মাধ্যমে। যত এই কষায় কমে, তত আত্মার জ্যোতি উদ্‌ভাসিত হয়; মানুষ নিজের অন্তরের আলোয় আলোকিত হতে থাকে।

সম্যগ্‌চারিত্র হলো জৈন মুক্তিপথের হৃদস্পন্দন—যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই সংযমের, প্রতিটি চিন্তাই করুণার, প্রতিটি বাক্যই সত্যের প্রতিধ্বনি। এটি এমন এক আচার নয়, যা বাইরে চাপিয়ে দেওয়া হয়; বরং এটি ভেতর থেকে বিকশিত এক সামঞ্জস্য—জ্ঞান, দর্শন ও আচরণের নিখুঁত সুরেলায়ন।

সম্যগ্‌চারিত্রের আসল শুরুটা ঘটে ভেতরে—যেখানে মন ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়, আর সেই স্বচ্ছতা প্রথমে বাক্যে, তারপর শরীরের আচরণে ছড়িয়ে পড়ে। জৈন শাস্ত্র এ ধারাবাহিক অন্তর-বাহির শৃঙ্খলাকে বলে গুপ্তি—অর্থাৎ সংযমের অন্তরনিয়ন্ত্রণ। তিনটি গুপ্তি আছে: মনগুপ্তি, বাক্‌গুপ্তি এবং কায়গুপ্তি।

মনগুপ্তি মানে নিজের মনের অদৃশ্য স্তরে কাজ করা—যে-কোনো হিংসাত্মক কল্পনা, ঈর্ষা, প্রতিশোধের গোপন আগুন, মান-অহংকারের চাপ—এসবকে সময়মতো চিনে থামিয়ে দেওয়া। এখানে “সংযম” কোনো দমন নয়; এটি সচেতনতার আলো জ্বালানো—যেন ভাবনা উস্কে উঠলেই আমরা বুঝি, “এ পথটা হিংসার, আমি ফিরছি।”

মন পরিষ্কার হলে বাক্য নিজেই কোমল ও সত্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে; এটিই বাক্‌গুপ্তি—অতিরিক্ত, কটু, বিভাজন সৃষ্টিকারী বা অসত্য কথাকে নীরবে থামিয়ে দেওয়া, আর এমনভাবে বলা শেখা যাতে সত্যটিও দয়া-সহচর হয়ে বেরোয়।

বাক্য সংযত হলে শরীরও অকারণে ক্ষতি করে না—এটি কায়গুপ্তি: হাঁটা, বসা, ধরা, রাখা, খাওয়া—সবটিতে এক অনবরত সতর্কতা, যাতে অজান্তেও কোনো প্রাণীর ক্ষতি না হয়।

এই অন্তর্গত গুপ্তি পরে দৈনন্দিন বিধিতে রূপ নিতে নিতে “সমিতি” হয়ে ওঠে—“সতর্ক আচরণ”। সমিতি পাঁচ প্রকার: ইর্য্যা-সমিতি (চলা-ফেরায় সতর্কতা), ভাষা-সমিতি (বক্তব্যে সতর্কতা), এষণা-সমিতি (অন্ন/ভিক্ষা অনুসন্ধানে সতর্কতা), আদান-নিক্ষেপণ-সমিতি (ধরা-রাখায় সতর্কতা) এবং উৎসর্গ-সমিতি (বর্জ্য-নিক্ষেপে সতর্কতা)।

ইর্য্যা-সমিতিতে পথচলা নিজেই ধ্যানের মতো—পা ফেলবার আগে দৃষ্টি নিচে, ঝাড়ু দিয়ে পথ মসৃণ করা, রাতের অন্ধকারে অযথা চলাফেরা এড়ানো; উদ্দেশ্য একটাই—স্থাবর (অচল, এক-ইন্দ্রিয় জীব যেমন মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু, উদ্ভিদ) ও ত্রাস (চলমান বহু-ইন্দ্রিয় জীব)—কাউকেই আঘাত না করা।

ভাষা-সমিতিতে কথা বলার আগে একমুহূর্ত থেমে নেওয়া—আমি কি অপ্রয়োজনীয়/অসত্য/অমার্জিত কিছু বলতে চলেছি? সত্যও যেন অস্ত্র না হয়।

এষণা-সমিতিতে আহার সংগ্রহের সময় বিশুদ্ধতা—যা দেওয়া হয়েছে ততটুকুই, অতিরিক্ত চাহিদা নয়; জল ছেঁকে নেওয়া, পুরোনো খাদ্য না নাড়া, যাতে অণুজীব নষ্ট না হয়।

আদান-নিক্ষেপণ-সমিতিতে জিনিস ধরা-রাখায় কোমলতা—বাটি, দরজার পাল্লা, বই, বস্ত্র—কিছুই ধাক্কা দিয়ে, জোরে ফেলে নয়; আলতোভাবে ধরা, আলতোভাবে রাখা—কারণ শক্ত ধাক্কায় ক্ষুদ্রজীব আঘাত পায়।

উৎসর্গ-সমিতিতে বর্জ্য-নিক্ষেপের শুচিতা—থুথু, জল, মল-মূত্র এমন জায়গায় ফেলা, যাতে জীব-ক্ষতি কম হয়; নোংরা জল ছেঁকে তবেই ঝাড়া; আবর্জনা ছড়িয়ে না দেওয়া।

এই সূক্ষ্ম সতর্কতাগুলো—বাইরের চোখে তুচ্ছ—আসলে সম্যগ্‌চারিত্রের স্পন্দন, যা অহিংসাকে অভ্যাসে পরিণত করে।

এখানে “অহিংসা” কেবল আঘাত না করা নয়; এটি এক মনোভাব—যেখানে অন্যের স্বার্থ, ছোটো ছোটো প্রাণের বেঁচে থাকা, অদৃশ্য জগতের অণুজীবেরও বেদনা—সব কিছুর কথা মনে রাখা হয়। তাই গুপ্তি-সমিতি একত্রে অহিংসাকে ভাব (মানসিকতা) থেকে দ্রব্য (আচরণ) পর্যন্ত নামিয়ে আনে—জৈন ভাষায় যাকে বলা হয় ভাব-অহিংসা ও দ্রব্য-অহিংসার সামঞ্জস্য। মনগুপ্তি ভাব-অহিংসাকে স্থির করে; সমিতিগুলি দ্রব্য-অহিংসাকে সুসংহত করে। ফলত মন-ভাবনা, বাক্য-উচ্চারণ ও দেহ-ব্যবহারে এক সুর বেজে ওঠে—সংযমের সুর, করুণার সুর।

জৈন দর্শনে কষায় শব্দটির অর্থ হলো—মনকে আচ্ছন্ন করে রাখা সেই চারটি গভীর প্রবণতা, যা আত্মাকে ভারী ও অশান্ত করে তোলে। এই চারটি হলো ক্রোধ, মান (অহংকার), মায়া (প্রবঞ্চনা) এবং লোভ। কষায়কে বলা হয় আত্মার “কার্মিক চৌম্বক ক্ষেত্র”—যে-শক্তি বাহ্য পদার্থের সঙ্গে আত্মাকে বেঁধে রাখে। যতক্ষণ এই কষায় সক্রিয় থাকে, ততক্ষণ আত্মা তার শুদ্ধ চৈতন্য অবস্থায় ফিরতে পারে না।

প্রথমত, ক্রোধ (Krodha)—এটি এক অগ্নিসদৃশ বিকার, যা যুক্তিবোধকে গ্রাস করে। ক্রোধ উঠলে মানুষ নিজের আত্মিক শান্তি হারায়, এবং তৎক্ষণাৎ কার্মিক পদার্থ তার চারপাশে জমতে শুরু করে। তাই জৈন সাধক শেখেন, ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলেই শ্বাসে ফিরে আসা—অর্থাৎ গভীর শ্বাস নিয়ে সচেতন হওয়া। এই সামান্য বিরতিই আত্মাকে রক্ষা করে।

দ্বিতীয়ত, মান (Māna)—যাকে অহং বা গর্ব বলা যায়। এটি আত্মাকে সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে ভারী করে। মানের উপস্থিতিতে মানুষ নিজের পবিত্রতাকে অন্যের তুলনায় উঁচু মনে করে, ফলে তার দৃষ্টি সংকীর্ণ হয়। মান জেগে উঠলে জৈন সাধক গুরুর স্মরণ করেন—গুরু মানে, যে-আত্মা অহংহীন হয়ে মুক্তির পথে গেছে; সেই স্মরণই অহংকে নম্র করে।