দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ২



অনেক স্থানে সেই সন্ধ্যাতেই ভিক্ষুরা ধর্মদেশনা দেন, মানুষকে ধ্যান ও করুণার পথে উদ্বুদ্ধ করেন। গৃহী ভক্তরা তখন ‘কঠিন বস্ত্র’ দানের সঙ্গে সঙ্গে আরও নানা করুণার্ঘ্য অর্পণ করেন—যেমন খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, আলো-সজ্জা, বিহারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তহবিল, কিংবা আশ্রমের অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এইভাবে কঠিনের দিনটি একদিকে যেমন নিঃস্বার্থ দানের আনন্দে ভরে ওঠে, তেমনি তা হয়ে ওঠে করুণা, সহযোগিতা ও মানবিকতার এক জীবন্ত সাধনা।

এই একদিনের আয়োজন কেন এত গুরুত্ববহ?

প্রথমত, এটি ভিক্ষু-গৃহীর পারস্পরিক নির্ভরতার উজ্জ্বল স্মারক: ভিক্ষুদের জীবনযাপন সম্পূর্ণ সংযম ও দানের উপর প্রতিষ্ঠিত; গৃহীরা দানের মাধ্যমে সেই সংযম-শীলকে ধারণ করেন।

দ্বিতীয়ত, কঠিন দান ‘সমবায়’—এখানে ব্যক্তিগত পুণ্যের চেয়ে বড় হয় সমষ্টিগত কৃত্য: কেউ কাপড় আনে, কেউ কাঁচি হাতে বসে, কেউ রং করে, কেউ রান্না বানায়—এসব এক দিনে সম্পন্ন হয় বলে প্রত্যেকে অপরের উপর নির্ভরশীল।

তৃতীয়ত, এটি দয়ার (অহিংসার) ইতিহাস বহন করে: বর্ষার কাদাপথে হাঁটতে গিয়ে অজান্তে ক্ষুদ্র প্রাণীর ক্ষতি এড়াতে বুদ্ধ বর্ষাবাসের বিধান দেন; সে-কারণে বর্ষা শেষে সম্মিলিত চীবর-দান যেন ‘করুণা থেকে জন্ম নেওয়া শৃঙ্খলা’র বার্ষিক উদ্‌যাপন।

বৌদ্ধ বিনয় পিটক অনুযায়ী, কঠিন অনুষ্ঠানের সঙ্গে একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক ও শাসনগত ফল জড়িত, যাকে বলা হয় “কঠিনানুকম্পা”। এর অর্থ হলো—এই সময়ে ভিক্ষু-সংঘের জন্য কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম বা বিধিনিষেধে সাময়িকভাবে শিথিলতা বা অবকাশ প্রদান করা হয়।

যেমন—চীবর বা বস্ত্র মেরামতের নির্দিষ্ট সময়সীমা কিছুটা বাড়ানো যায়, দীর্ঘযাত্রার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে, কিংবা সংঘজীবনের কিছু শৃঙ্খলাজনিত নিয়মে নমনীয়তা আনা যায়। তবে এই সুবিধা ব্যক্তিগত নয়; এটি কেবল সেই বিহারের ভিক্ষুদের জন্য প্রযোজ্য, যারা ওই বছর বর্ষাবাসে একত্রে অবস্থান করেছিলেন। অর্থাৎ, এটি একধরনের সামষ্টিক প্রাপ্যতা, যা সংঘজীবনের ঐক্য ও পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতীক।

এভাবে দেখা যায়, কঠিন কেবল দান বা আচারিক উৎসব নয়; এটি বৌদ্ধ সংঘজীবনের বাস্তব চাহিদা, নিয়মশাসন ও পারস্পরিক সহমর্মিতার সঙ্গে যুক্ত এক ‘সাংবিধানিক’ পর্ব। এখানে দান ও বিধান, করুণা ও শৃঙ্খলা—দুটি হাত ধরাধরি করে চলে। যেমন দান ধর্মের উষ্ণতা প্রকাশ করে, তেমনি বিনয় ধর্মের স্থিতি রক্ষা করে। কঠিনের এই দ্বৈত দিকই বৌদ্ধ সংঘের জীবনের ভারসাম্যকে প্রকাশ করে—যেখানে করুণা, নিয়ম ও প্রজ্ঞা একসঙ্গে মিশে গিয়ে গঠন করে এক পরিপূর্ণ জীবনের আদর্শ।

“কঠিন” (Kaṭhina)–প্রতীকী অর্থে এটি এক সুশৃঙ্খল রূপান্তরের পর্ব। বর্ষাবাসের তিন মাস জুড়ে ভিক্ষু-সংঘের জীবন ছিল অন্তর্মুখ ধ্যান, শীল, সংযম ও আত্মসমালোচনার নিবিড় ঋতু; কঠিন সেই ধ্যানের আলোকে আবার বহির্মুখ সেবার পথে ফেরা—করুণার কাজ, ধর্মপ্রচার, জীবের উপকারে প্রব্রজন। যেন নিস্তব্ধ জলের তলে জমে থাকা আলোর ভাণ্ডার হঠাৎ উদ্‌ভাসিত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

এই চক্রে একটি পারস্পরিক গতি আছে—ভিক্ষুর নীরবতা থেকে কর্মে, আর গৃহীর কর্ম থেকে নীরবতায়। ভিক্ষু বর্ষাবাসে যে নীরব শক্তি সঞ্চয় করেন, কঠিন-পরবর্তী যাত্রায় তা সমাজে সেবারূপে বিকশিত হয়। আবার গৃহী, যিনি বছরে ভোগ-ব্যস্ততায় ছুটেছেন, কঠিন-দানে অংশ নিয়ে কর্মের মাঝখানে নীরবতার স্বাদ পান—দান, সহযোগিতা ও শৃঙ্খলার অভ্যাস তাঁকে অন্তর্মুখ করে। এভাবে দুই ধারাই—সন্ন্যাসী ও গার্হস্থ্য—এক অপরকে পরিপূর্ণ করে চক্র পূর্ণ করে।

চীবর এখানে কেবল দেহঢাকা কাপড় নয়; এটি শীলের আবরণ—মনকে অশুভ থেকে আচ্ছাদিত রাখার এক দৃঢ় সংকল্প। যেমন বস্ত্র শরীরকে রক্ষা করে, তেমনি শীল চিন্তা-ভাবনা-আচরণকে রক্ষা করে—লোভ, ক্রোধ, অহংকারের বাতাস থেকে। কঠিন-চীবর তাই পরিধানের বস্তু হওয়ার আগে মননের প্রতিজ্ঞা: “আজ থেকে আমি সংযমে থাকব, করুণায় জড়াব, সত্যে স্থির হব।”

প্রতীকটি আরও গভীর হয় চীবরের প্যাঁচওয়ালা নকশায়—ক্ষেতখণ্ডের মতো খচিত প্যাটার্ন, প্রাচীন রীতিতে টুকরো-টুকরো কাপড় জুড়ে গড়া। বার্তা স্পষ্ট: জীবনের অভিজ্ঞতা আলাদা আলাদা টুকরো—সুখ-দুঃখ, সাফল্য-বিরতি, ভুল-শুদ্ধি। আলাদা থাকলে সেগুলি খসখসে, অসংলগ্ন; কিন্তু সংযোগের সুতায় (সহযোগ, করুণা, শীল) জুড়ে দিলে সেগুলি মিলেমিশে এক সমগ্র বস্ত্র হয়ে ওঠে। ধর্মের কাজই এটা—বিচ্ছিন্নতাকে সংযোগে, বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলায়, অস্থিরতাকে স্থিরতায় রূপান্তর করা।

কঠিনের দিনভর শ্রম—কাপড় কাটা, জোড়া লাগানো, সেলাই, ধোয়া, রং—সব এক দিনে সম্পন্ন করার শৃঙ্খলা স্মরণ করায়, আলোকের কাজ সমবায়েই সিদ্ধ হয়। কেউ একা পুরো চীবর বানাতে পারে না; যেমন কেউ একা সমাজ গড়ে না, একা মুক্তিও পায় না। শীল (নৈতিকতা), সমাধি (মনোসংযম) ও প্রজ্ঞা (দর্শন)—এই তিনটিও তেমনি সমবায়ী গুণ; একটির ঘাটতি অন্য দুটিকেও দুর্বল করে। কঠিন-আচার সেই ত্রিবিধ সাধনাকে এক দিন, এক কর্ম, এক সংকল্পে গাঁথে।

আরও একটি স্তর আছে: বর্ষাকালে প্রাণজগতের সজীবতা বাড়ে—অজান্তে ক্ষতি এড়াতে বর্ষাবাস, শেষে কঠিন। অর্থাৎ, অহিংসা থেকে শৃঙ্খলা, শৃঙ্খলা থেকে দান—এই নৈতিক সোপান। দান এখানে কেবল দেওয়া নয়—নিজেকে দেওয়া: সময়, শ্রম, মনোযোগ, এবং অগ্রাধিকার। এই আত্মনিবেদনই চীবরের সেলাই-ছেঁড়ার ভেতর দিয়ে অন্তরকে সেলাই করে, যেখানে ফাঁক-ফোঁকর কমে, দৃঢ়তা বাড়ে।

ফলে কঠিন শুধু একটি বার্ষিক উৎসব নয়; এটি ধর্মের স্থাপত্য—ভিত (শীল), স্তম্ভ (সমবায়), ছাদ (করুণা), আর ভিতরে জ্বলতে থাকা দীপ (প্রজ্ঞা)। বর্ষাবাসের নীরব সঞ্চয়ের পর কঠিন সেই দীপটিকে দ্বার-জানালায় এনে রাখা—যেন ঘরের ভিতরের আলো বাইরে পড়ে, পথিক পথ খুঁজে পায়, আর ঘরের লোকও আলো দেখে আরও অন্তর্মুখ হয়। এই দ্বিমুখী আলোকপ্রবাহই কঠিনের রূপান্তরের হৃদয়—ভেতর থেকে বাইরে, আবার বাইরে থেকে ভিতরে—এভাবে জীবন, সমাজ ও সাধনা এক সমগ্র বস্ত্রে পরিণত হয়।

ভৌগোলিক অবস্থান ও স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাবে আচার-অনুষ্ঠানে কিছু পার্থক্য দেখা যায়, কিন্তু মূল ভাব ও উদ্দেশ্য সর্বত্র এক। শ্রীলঙ্কায় এই উৎসবকে বলা হয় কটিনা পিংকমা (Katina Pinkama), মায়ানমারে কহতাইন (Kahtein), থাইল্যান্ডে থোড কটিন (Thod Kathin), আর কম্বোডিয়া ও লাওসে প্রায় একই রূপে পালিত হয়। এসব স্থানে উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো—একদিনে চীবর (ভিক্ষুদের বস্ত্র) প্রস্তুত ও দান করার প্রথা। সেই সঙ্গে হয় শোভাযাত্রা, দীপ ও ফুলের উৎসর্গ, ঢাক-কাঁসার কোমল ধ্বনি, আর ভিক্ষুদের ধর্মদেশনা।

বাংলাদেশেও, বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চল ও সমতল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে, কঠিন চীবর দান এক বিশাল সামাজিক ও ধর্মীয় মিলনমেলা। মন্দিরের প্রাঙ্গণে তখন জেগে ওঠে পারস্পরিক সহযোগিতা, দানশীলতা ও নীরব আনন্দের অবারিত স্রোত—যেখানে ধর্ম শুধু বিশ্বাস নয়, সমাজ ও হৃদয়ের এক ঐক্যোৎসব।

কঠিন চীবর দানকে বোঝার সবচেয়ে ফলপ্রসূ উপায় হলো এটিকে কেবল এক দিনের আনুষ্ঠানিক দান হিসেবে না দেখে, বৌদ্ধ জীবনের অন্তর্নিহিত দর্শনের একটি “অনুশীলিত উপমা” হিসেবে দেখা। এখানে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ—এই তিন রত্ন কোনো বিমূর্ত বিশ্বাস নয়; প্রত্যেকটি একটি করে জীবন্ত শক্তি। বুদ্ধের অনুপ্রেরণা করুণার শ্বাসে আমাদের অহংসংকোচ শেখায়—আমি যাকে দিই, সে আলাদা সত্তা নয়; দানের ভেতর দিয়েই আমরা একে অপরের জীবনতন্ত্রীতে বোনা।

ধর্মের অনুশাসন শীল, সমাধি, প্রজ্ঞার সুনির্দিষ্ট পথনকশা দেয়—সংযমে স্থিরতা, ধ্যানে শান্তি, আর প্রজ্ঞায় অন্তর্দৃষ্টির উন্মেষ। সংঘ সেই পথচলার সামাজিক দেহ—সমবায়, সহাবস্থান ও সেবাধর্মের অভ্যাসশালা, যেখানে এক জনের জাগরণ আর-এক জনের আশ্রয় হয়ে ওঠে। এক দিনে চীবর গড়ার যে “কঠিন” কাজটি, সেটি তাই আসলে একটি সহজ সত্য প্রকাশ করে—সৎকর্ম কখনোই একার নয়; ধর্মকর্মের পরিপূর্ণতা কেবল সমবায়েই সিদ্ধ হয়।

“কঠিন” শব্দের শাব্দিক সূত্র ধরলে আমরা আরও গভীরে যাই। পালি ‘কঠিন’ (Kathina) মূলত কাপড় টানটান করে ধরার একটি কাঠের ফ্রেমের নাম; এখানেই দানের রূপকটি স্পষ্ট—নরম বস্ত্রকে দৃঢ় ফ্রেমে টেনে নিতে হয়, যেমন দয়ার কোমলতা সংযমের কাষ্ঠে টান না পেলে আচরণে স্থায়ী হয় না। চীবরের নরম ভাঁজে যে-দৃঢ়তা লুকায়, তা আমাদের মনে করায়—মমতা ও নিয়ম, করুণা ও শাসন—এরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়; বরং একে অন্যের শর্ত। বর্ষাবাসে ভিক্ষুসংঘ যে-স্থিরতায় নিজেদের ধরা রাখে, সেই নিয়ন্ত্রিত “থাকা”-র পরেই আসে প্রব্রজনের অর্থপূর্ণ “চলা”—আত্মসংযমের ভিত না থাকলে করুণার গতি ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষিপ্ততায়, আর বিক্ষিপ্ত করুণা শেষত অসম্পূর্ণ কর্মে পরিণত হয়।

এ দান তাই শুধু হাতের কাজের সমষ্টি নয়; এটি মনের বিন্যাস। এক দিন ও এক রাতের মধ্যে সুতোর থেকে বস্ত্র, বস্ত্র থেকে পরিধান—এই দ্রুত রূপান্তর আমাদেরকে বর্তমান মুহূর্তের অনুশীলনে ফেরায়: কালক্ষেপ নয়, কর্তব্যে একাগ্রতা। যে-সমাজ একত্রে সুতো কাটে, রং মেশায়, সেলাই করে, ইস্ত্রি করে—তারা আসলে “সহ-অস্তিত্ব” (co-being) অনুশীলন করে। এখানে “আমি দিলাম—তুমি নিলে”—এই দ্বৈততা ধীরে ধীরে গলে যায়; থাকে কেবল কর্মের ধারাবাহিকতা, যার নাম সংঘদর্শন—পুণ্যক্ষেত্র হিসেবে সংঘের অর্থই হলো, যে-ক্ষেত্রের ভরসায় ব্যক্তিগত সীমা ছাড়িয়ে সমষ্টিগত জাগরণ সম্ভব হয়।

কঠিন চীবর দানের মধ্যে লুকিয়ে আছে বৌদ্ধ জীবনের এক সম্পূর্ণ দর্শন—যা দান, শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা, অনাসক্তি ও অনিত্যতার বোধকে এক সুতোয় গেঁথে রাখে। এখানে দান কেবল কিছু দেওয়া নয়; এটি দান-পারমিতা—অর্থাৎ দানের পূর্ণতা, এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে স্বার্থ, অহং বা প্রতিদানের প্রত্যাশা সম্পূর্ণ বিলীন হয়। দান মানে তখন আর বস্তু হস্তান্তর নয়, বরং নিজের অন্তরের আঁকড়ে-ধরা মনটিকে আলগা করে দেওয়া। যে-দান আত্মত্যাগে পরিণত হয়, সেটিই আসলে পারমিতা—যে-গুণ মানুষকে পার করে দেয় সংসার থেকে নির্বাণের তীরে।

কিন্তু এই দান তখনই শুদ্ধ থাকে, যখন তার ভিত মজবুত হয় শীল বা সংযমে। শীল মানে কেবল নিয়ম মানা নয়, বরং নিজের আচরণে এমন শৃঙ্খলা স্থাপন করা, যাতে লোভ, ক্রোধ, মোহ প্রাকৃতিকভাবে ম্লান হয়ে যায়। সংযমহীন দান আসলে অহংকারের অন্য রূপ; তাই শীলই দানকে স্থির ও নির্মল করে। শীল যেমন মাটিকে শক্ত করে তোলে, তেমনি দান-ফুলও সেই মাটিতেই ফুটে ওঠে।

এরপর আসে সমাধি—মনকে একাগ্র করে তোলা। সমাধি মানে স্থিরতা, যেখানে মন আর এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায় না। এই একাগ্রতা ছাড়া দান বা সংঘজীবন টেকে না; অস্থির মন অন্যের সঙ্গে একতা বজায় রাখতে পারে না। সমাধি দানের ভিতর স্থায়িত্ব আনে—যেমন ধ্যানের নিস্তব্ধতায় মন পরিষ্কার হয়, তেমনি নিঃস্বার্থ কর্মের নীরবতায় হৃদয় প্রশান্ত হয়।

কিন্তু কেবল শীল ও সমাধি যথেষ্ট নয়; তাদের দিশা দেয় প্রজ্ঞা—অন্তর্দৃষ্টির আলো। প্রজ্ঞা হলো এমন জ্ঞান, যা কেবল চিন্তার নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার। এই প্রজ্ঞা মানুষকে বুঝতে শেখায় যে, দান, গ্রহীতা ও বস্তু—এই তিনটির কোনো পৃথক মালিক নেই; সবই এক প্রবাহের অংশ। এই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় প্রকৃত নম্রতা—দান আর প্রদর্শন নয়, হয়ে ওঠে আত্মশুদ্ধির অনুশীলন।

এই দান তখন রূপ নেয় অনাসক্ত কর্মে—অর্থাৎ এমন কাজে, যার সঙ্গে ফলের দাবি জড়িত নয়। গীতায় (২.৪৭) যেমন বলা হয়েছে, “কর্ম করো, কিন্তু ফলের আকাঙ্ক্ষা রেখো না,” তেমনি বৌদ্ধ দৃষ্টিতেও দান মানে কাজের মধ্যেই আনন্দ, ফলের মধ্যে নয়। অনাসক্ত কর্ম মানে নিজের কর্তব্যকে পবিত্রভাবে সম্পন্ন করা, কিন্তু সেই কর্মকে নিজের পরিচয় বা গর্বের অংশ না করা। এমন দানই পবিত্র, কারণ তা আত্মপ্রদর্শনের নয়, আত্মবিসর্জনের।

তবুও, এই সব গুণের মূলে রয়েছে অনিত্যতার বোধ—যে-বোধ শেখায়, কিছুই চিরস্থায়ী নয়। চীবর ক্ষয় হবে, রং ফিকে হবে, সেলাই খুলে যাবে—এই সহজ সত্যই আমাদের শেখায়, দানের অর্থ স্থায়ী বস্তুতে নয়, বরং ক্ষণিক অনুগ্রহে। অনিত্যতার এই উপলব্ধি অহংকারকে গলিয়ে দেয়; দাতা বুঝতে শেখে, দান নিজেই এক প্রবাহ, যা দিয়ে দিয়ে পুনরায় ফিরে আসে নিজের ভেতর।