তরু একটি শ্যামলা ও মিষ্টি মেয়ের নাম। তরু একটি একহারা তন্বী মেয়ের নাম। ওর অদ্ভুত সুন্দর দুটি চোখ, চিবুকের কাছের কালো তিল, মুখের মিষ্টি লাবণ্য সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কিন্তু তরুর সবচেয়ে যা আকর্ষণীয়, তা হচ্ছে ওর আজানুলম্বিত, ঢেউ-খেলানো একগুচ্ছ কালো চুল। লম্বা চুল তো অনেকেরই থাকে। কালো কোঁকড়া চুলও যে সচরাচর চোখে পড়ে না, তা নয়; কিন্তু তরুর চুলের মতো সুন্দর চুল বোধ হয় আর কারও হয় না। ওর হাঁটার ভঙ্গিটিও এত সুন্দর যে, হেঁটে যাবার সময় পেছন থেকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে করে যতক্ষণ পর্যন্ত না ও দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। লম্বা সুন্দর বেণিটা ওর সে সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এককথায়, ও হচ্ছে ঐশ্বর্যময়ী।
সবার কাছে প্রশংসা শুনে শুনে তরু নিজেকে নিয়ে কম গর্বিত নয়; তবে অহংকারিণীর অপবাদ ওকে দেওয়া যায় না। অমায়িক ব্যবহারের জন্যে ও সবারই প্রিয়। তবে ছেলেদের ব্যাপারে ভীষণ স্ট্রিক্ট তরু। ও যেমন কোনো ছেলের সাথে কোনোদিনই কথা বলে না, কোনো ছেলেও তেমনি ওর দিকে অগ্রসর হবার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারেনি, যদিও সকলেরই একটা গোপন ইচ্ছে ছিল ওর সাথে আলাপ করার, আর সেই সাথে ঘনিষ্ঠ হবার। এ কথাটা বুঝতে পেরেই হোক আর নিজের আত্মমর্যাদাবোধের কারণেই হোক, তরু সবসময়ই কেমন একটা গাম্ভীর্য নিয়ে থাকে। এ কারণে ওকে যেমন অনেক বিদ্রূপবাণ সহ্য করতে হয়, তেমনি ছেলেরা আড়ালে আড়ালে বিরক্তও ভীষণ করে তরুকে। এই বিরক্তি আর ফাজলামি একদিন চরম রূপ নিয়ে এল তরুর সামনে, যার জন্যে হারাতে হলো ওর আজীবন সাধনার ধন—মহামূল্যবান ওই একগুচ্ছ কালো চুল। ঘটনাটা যেমন অভাবনীয়, তেমনি আশ্চর্যজনকও বটে।
ঘটনার উৎপত্তি হয় এইভাবে: একদিন ক্লাসে বসে মনোযোগ দিয়ে পড়া শুনছে তরু, হঠাৎ পেছনে চুলের গোছায় ঈষৎ টান অনুভব করল। পর পর দু-বার এমন হওয়াতে ও বিরক্ত হয়ে চুলগুলোকে সামনে নিয়ে এল। পেছনের ছেলেগুলো চাপাশব্দে হেসে উঠল। ও বুঝতে পারল না, কে এই ঘটনার নায়ক।
পরের দিন। স্যার তখনও ক্লাসে আসেননি। তরু বসে বান্ধবীদের সাথে কথা বলছে। এমন সময় আবার চুলে মৃদুটান পড়ল। ও পেছনে মুখ ঘুরিয়ে দেখতে পেল, নাসিম ওর চুলগুলোকে দু-হাতের অঞ্জলিতে তুলে ধরেছে। কী উদ্দেশ্য, কে জানে! পাশের বন্ধুবান্ধবেরা হাসাহাসি করছে। ইশারায় কথা বলছে। এ দৃশ্য দেখে তরুর সব রক্ত যেন মাথায় গিয়ে উঠল। লজ্জা, অপমান আর ঘৃণায় ওর চোখমুখ লাল হয়ে গেল। এ কী কাণ্ড! এতগুলো ছেলেমেয়ের মাঝে ছেলেটা এত বড়ো কাজ কী করে করতে পারল? এ সাহস সে কোথায় পেল? সহসা তরু যেন দিয়াশলাইয়ের কাঠির মতো ফুঁসে উঠল! “এত বড়ো সাহস আপনাকে কে দিয়েছে? কোন অধিকারে আপনি আমার চুল ধরেছেন? কেন আপনি আমার চুলে হাত দিয়েছেন?” তরুর এ মূর্তি কেউ কখনও দেখেনি। সবাই একেবারে চুপসে গেছে। বন্ধু-বান্ধবী’রা এসে ওদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে।
নাসিম চুপ করে রইল না, ধীর-শান্ত গলায় বলল, “কোন অধিকারে যখন জানতে চাইছেন, তাহলে সে কথা বলার আগে বলুন আপনি আমাকে সে অধিকার দেবেন কি না?” তরু আরও জ্বলে উঠে বলল, “কী বললেন? লজ্জা করল না আপনার একথা বলতে?” নাসিমের কোনো ভাবান্তর হলো না। পূর্বের সুরেই সে আবার বলল, “না, লজ্জার মাথা খেয়েই বলছি, আমি আপনাকে ভালোবাসি। তার চেয়েও ভালোবাসি আপনার ওই কালো চুলগুলোকে।” কথাটা শেষ হবার সাথে সাথেই নাসিমের গালে সজোরে একটি চপেটাঘাত পড়ল।
চিরদিনের শান্ত-সংযত মেয়ে আজ নিজেকে সামলাতে পারল না। রাগে থরথর করে কাঁপছে তরু। বান্ধবীরা ওকে শান্ত করতে চেষ্টা করল। কেউবা সাহসের বহর দেখে টিপ্পনি কাটল আর ছেলেরা বন্ধুর অপমানে চটে গিয়ে বিষম হইচই শুরু করে দিল। নাসিম কিন্তু কিছুই না বলে চুপচাপ ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। আর স্যার ক্লাসে আসাতে ব্যাপারটা সেদিনের মতো ওখানেই চাপা পড়ে থাকল।
কয়েক দিন বেশ নির্ভাবনায় কাটল। যথারীতি ক্লাস হয়, ফাজলামো-হাসি-ঠাট্টা-গল্প সব হয়, কিন্তু নাসিম আর তরুর যে-রেশারেশি, তা রয়েই গেছে। তা-ই চরম পর্যায়ে চলে গেল আরেক দিন।
ক্লাসে স্যার লেকচার দিচ্ছেন। স্যারটি নূতন এসেছেন; তরুর ভাষায় ‘সুদর্শন স্যার’। পাশ করেই চাকুরিতে ঢুকেছেন। তাঁকে নিয়ে সবার মধ্যে আলোচনাও হয় প্রচুর। স্যারের ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে পড়া কেউ শোনে না। সবাই তাঁর অঙ্গভঙ্গি, পড়ানোর কায়দা ইত্যাদি নিয়ে টিপ্পনি কাটে কিংবা নিজেদের মধ্যে গল্প করে। তবে সামনের বেঞ্চের মনোযোগী কয়েক জন এ দলে পড়ে না। সেদিনও তরু অন্যদিনের মতো চুপচাপ পড়া শুনছে, হঠাৎ ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হওয়াতে পেছন ফিরে তাকাল। আশেপাশের সকলের দৃষ্টিও ওকে অনুসরণ করল।
তরুর মুখটা হঠাৎ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। ভীষণ অসহায় মনে হলো ওকে। হাত-পা অবশ হয়ে গেছে, কিন্তু তা একমুহূর্তের জন্যেই। একঝটকায় উঠে দাঁড়াল ও রাগে। রাগে-উত্তেজনায় তরু দিশাহারা। ওদের অমনোযোগিতা, অসংগতি আর চাপা ফিসফিস লক্ষ করেছেন স্যার; এবার তরুকে দাঁড়াতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বলবে?” “স্যার, নাসিম আমার…” আর বলতে পারল না। হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
তরুর পাশে-বসা ওর বান্ধবী নিচে পড়ে-থাকা ওর অর্ধেক বেণিটা তুলে দেখিয়ে বলল, “স্যার, নাসিম ওর চুল কেটে দিয়েছে।” ওর হাতে অর্ধেক বেণিটা দেখে অনেকেই হেসে ফেলল। কিন্তু স্যার যেন ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গেছেন। হঠাৎ হুংকার ছেড়ে বললেন, “হু ইজ দ্যাট ননসেন্স বয়?” নাসিম আদালতের আসামীর মতো ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। “তুমি? আশ্চর্য, লেখাপড়া শিখতে এসে, জ্ঞানার্জন করতে এসে এমন অবিবেচকের মতো কাজ কী করে করতে পারলে? এই মেয়েটি তো তোমাদেরই সহপাঠিনী, বান্ধবী কিংবা বোন! ওর এত বড়ো একটা ক্ষতি করে তোমার কী লাভ হলো? তোমরা তো আর ছোটো খোকা নও। বুদ্ধি-বিবেক-বিবেচনা সবই তোমাদের আছে। ঠিক আছে, আমার কিছু বলবার নেই, তোমার রোল নম্বরটা দাও।”
নাসিমের রোল নম্বর নিয়ে স্যার চলে গেলেন। সেদিন ক্লাসটা আর হলো না। কিছুক্ষণ পরই কলেজের প্রিন্সিপাল নাসিম আর তরুকে ডেকে পাঠালেন। তরু তখনও অঝোর ধারায় কাঁদছে। ওকে সাথে করে ওর বান্ধবী প্রিন্সিপালের রুমে নিয়ে গেল। প্রিন্সিপাল স্যার সামনে দাঁড়ানো নাসিমকে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “যা শুনলাম তোমার সম্বন্ধে, তা কি সত্যি? তোমাদের ইলিয়াস স্যার, যিনি তোমার সামনে বসে আছেন, যা বলছেন, তা কি তুমি অস্বীকার করতে পারো?”
নাসিম স্যারের দিকে এক বার সলজ্জ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নিচু করল। “কেন এ কাজ করলে? বলো, ও তোমার কী ক্ষতি করেছিল?” ও আরেক বার স্যারের দিকে তাকাল। এবার আর লজ্জায় নয়—টপটপ করে ওর চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল।
“কেন করেছি, স্যার, তা নিজেও জানি না; আর তা বলতেও পারব না, শুধু এটুক বলছি, এমন কাজ আমি করতে চাইনি। হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় করে ফেলেছি।”
“বেশ তোমাকে আর বলতে হবে না। তোমার মিসকন্ডাক্টের জন্য তোমাকে টিসি দিলাম। আর এসো না তুমি কলেজে।”
“আচ্ছা স্যার, আসসালামুয়ালাইকুম।” বলে তরুর দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে ও চলে গেল।
আর তরু? সেই যে ও চোখের অবাধ্য জলকে মুছতে মুছতে বাসায় চলে গেল, কলেজে আর আসেনি; কারণ সবাই ব্যাপারটা জেনে ফেলাতে বেশ হইচই হয়েছে কলেজে। কাজেই যে এই ঘটনার নায়িকা, সেই সুন্দরী সুশ্রী তরুর পক্ষে আর কলেজে আসা সম্ভব হয়নি।
তারও কিছুদিন পর সকলে শুনতে পেল, তরুর বিয়ে হয়ে গেছে, সেই সুদর্শন ইলিয়াস স্যারের সাথে, যিনি সেই চুলকাটার ঘটনার প্রধান সাক্ষী।