একজন সত্যিকারের ধর্মযাজককে কেউ কখনো ভালোবাসে না, কেবল সম্মান করে ও মান্য করে।
এই চিরন্তন সত্য কথাটি সর্বকালের সেরা দুইটি ক্যাথলিক ফিল্মের একটি ‘ডায়রি অব অ্যা কান্ট্রি প্রিস্ট (১৯৫১)’-এ বলতে শুনলাম। সবাই যাঁকে সম্মান করে, মান্য করে, কিন্তু ভালোবাসে না, তাঁকে ছুঁড়ে ফেলতে তাদের দুই মিনিটও লাগে না। প্রায়ই দেখা যায়, জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে লোকে আনন্দ পায়, তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারলে লোকে যেন স্বর্গের সুখলাভ করে, এমন-কী তাঁদের মৃত্যুতেও লোকের কিছুই এসে যায় না, বরং এক ধরনের জয়ের অনুভূতি হয়। কেন? তেমন কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। শ্রদ্ধেয় ও জনপ্রিয় কাউকে লোকে সহ্য করতে পারে না। তার উপর তিনি যদি হন পরোপকারী এবং নির্ঝঞ্ঝাট গোছের কেউ, তবে তাঁর ক্ষতি করাটাকে লোকে প্রার্থনার মতো পবিত্র কাজ মনে করে। মানুষ যাকে ভালোবাসে না, তাকে খুন করতেও তার হাত কাঁপে না; এমন নয় যে সে কারো কোনো ক্ষতি করেছে, বরং ক্ষতিকর ব্যক্তিরাই অধিক নিরাপদে থাকে।
ফিরে আসি মুভির ধর্মযাজকের কাছে। তিনি সবাইকে ধর্মের বাণী শোনান, শিশুদের সৎপথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেন, হতাশ মানুষকে বাঁচার অর্থ বোঝান। তাঁর জীবনযাপন সরল, একরৈখিক, আটপৌরে। এক নিভৃত যাজকপল্লীর গির্জার ফাদার হিসেবে তাঁর প্রতিদিনকার আন্তরিক দায়িত্বপালন। তিনি সবসময়ই এক ধরনের আধ্যাত্মিক এবং দৈহিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকেন, যা তাঁকে প্রতি মুহূর্তেই অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। তবু তিনি তাঁর কর্তব্যে অবিচল। তাঁর ইচ্ছে আর কাজগুলি সুন্দর, পবিত্র, হিতকর, তাই গ্রামের সবাই ভাবে, লোকটা অকেজো, অপদার্থ, অথর্ব।
পেটের সমস্যার কারণে তিনি কেবল রুটি এবং মদ খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করেন। সঙ্গতির অভাবে ভাল মানের মদ যোগাড় করতে পারেন না। দীর্ঘদিনের এমন খাদ্যাভ্যাসের ফলে তিনি একসময় পাকস্থলির ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। অথচ লোকের ধারণা ছিল, তিনি উন্মাদ, মাতাল। তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ, মানুষ এবং ঈশ্বরের সহানুভূতি বঞ্চিত, দুঃখী, তবু বিশ্বাসী একজন ক্যাথলিক। মুভিতে আমরা তাঁকে দেখি একজন মহিলাকে জীবনের অর্থের সন্ধান দিতে, জীবনের কাছ থেকে নানান আঘাত পেয়েপেয়ে যিনি বহু বছর হল ঈশ্বরকে ঘৃণা করে বেঁচে আছেন। সে ঘটনার পর কোনো এক কারণে সে মহিলার মৃত্যু হলে সবাই ধরে নেয়, নিশ্চয়ই যাজক উনাকে এমন কিছু বলেছেন, যার ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
পুরো মুভিতেই যাজক তাঁর সকল যন্ত্রণা ও দিনযাপনের ক্লান্তির কথা ডায়রিতে লিখে যান। এ যেন এক অনন্ত বিষাদের দিকে অবধারিত যাত্রা। সিনেমায় আমরা তাঁকে মাত্র একবারই হাসতে দেখি, সেদিন, যেদিন তিনি চিকিৎসার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহর অভিমুখী ট্রেন ধরেন। একজন মোটরসাইকেল আরোহী তাঁকে পেছনে বসিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দেন, সেসময় এক চিরদুঃখী যাজকের ভেতরের প্রাণোচ্ছল ছেলেটি যেন বেরিয়ে আসছিল! সেই হাসিই তাঁর শেষ হাসি। নিষ্ঠুর মানুষের গ্রাম ছেড়ে মৃত্যুর শহরে সেই যাত্রাই তাঁর শেষ যাত্রা। ব্রেসন এখানে ড্রেয়ারের দেখানো পথেই হেঁটেছেন। ‘দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক (১৯২৮)’ সিনেমায় শত ট্র্যাজেডি আর কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে প্রকৃত বিশ্বাসী নিষ্পাপ সত্তাটি যেমনি করে সমাজের নিষ্ঠুরতার বলি হল, ঠিক তেমনি ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের একনিষ্ঠ অনুগামীটিকেও যন্ত্রণাভোগের মধ্য দিয়ে অকালমৃত্যুর স্বাদ নিতে হল।