এক।
কফিবার। রোববার। ধোঁয়া—সিগ্রেটের, কফির। মোজার্ট আর আলাপ।
: আমার লাইফে কিছু ট্র্যাজেডি রয়েছে।
: কীরকম?
: অন্য সবার মত আমার লাইফটা অতো স্মুথ নয়।
: স্মুথ লাইফ খুব বোরিং, জানোতো?
: আমার জীবন গুড গার্লদের জীবনের মতোও না।
: আই ডোন্ট লাইক গুড গার্লস। দে আর সো কালারলেস। ইউ আর নট অ্যামাং দেম, ইট মিনস্ ইয়োর লাইফ মাস্ট বি কালারফুল! আই লাভ কালার! তোমার গল্পটা বলো, শুনবো।
: অনেক অন্য রকম। আপনি ভাবতেও পারবেন না!
: কেমন? ইউ গট ম্যারেড অ্যাট অ্যা ভেরি আর্লি এইজ। এই টাইপের কিছু? অর ওয়াজ রেইপড্? অর মেট সাম পার্সোনাল অ্যাক্সিডেন্ট?
: খুব টিপিক্যাল ওয়েতে ভাবছেন। ওরকম কিছুই না। একটা কষ্টের কথা এই যে, আমি বহুকাল ধরে আমার মা-বাবা’কে খুঁজছি, বিশেষ করে, আমার বাবাকে। আই ওয়ানা মিট দ্যাট গাই! আমি যাঁদের কাছে থাকি, তাঁরা আমার পালক বাবা-মা, তবে আমার প্রতি তাদের ভালোবাসার ঋণ শোধ করা যাবে না।
: আচ্ছা। এরপর?
: আমার বাকি কথা আমি পরে একদিন বলব।
: তোমার গল্পটা আমাকে মেইল করতে পারো চাইলে। এসইউএসএইচঅ্যাএনটিঅ্যাডটসিইউএসটিওএমএসঅ্যাটজিমেইলডটকম। আমি জীবনের গল্প জানতে ভালোবাসি।
: আমার নিজের ইমেইল আইডির পাসওয়ার্ড মনে নেই। তবে একসময় আমি পুরোটাই লিখে দেবো। আচ্ছা, একসময় না, আজকে রাতেই লিখে দেবো। আজ একটু উঠতে হচ্ছে।
: সময় নাও, তাড়া নেই কোনো।
: আসি। রাতে নক করবো। ভাল থাকবেন।
: তুমিও।
রাতে মেসেঞ্জারে নক এল।
: আমি মোটামুটি জানি আমার সব কিছু।
: আজকেই সব কিছু লিখে দিতে হবে না। সময় নাও।
: না, আজকেই। কোনো ব্যাপারে মানুষের আবেগ হারিয়ে গেলে সে ব্যাপারটা বলার আগ্রহও কমে যায়। পরে হয়ত আর বলতেই ইচ্ছে করবে না। আপনি সহ আমি মোট দুইজনকে ব্যাপারটা নিজ থেকে শেয়ার করছি। আমি কারো সাথে আমার গল্প শেয়ার করি না। আমার এলাকার মানুষ সবাই কমবেশি জানে। আমি ময়মনসিংহ থাকার পেছনে আমার এই কারণটাও আছে।
: আচ্ছা। তুমি তোমার গল্পটা আমাকে বলো। বলে হাল্কা হও, অবশ্য এতে যদি তোমার আপত্তি না থাকে আরকি! তোমার অরিজিনাল বাড়ি কোথায়?
: কলকাতায়। বারাসাত।
: আচ্ছা। তারপর?
: আমি আপনাকে লিখে পাঠাচ্ছি। একটু সময় লাগবে।
: লাগুক। নো প্রবলেম। লিখ।
: আমার মায়ের বাসা গফরগাঁও উপজেলায়। গ্রামের নাম জানা নাই আমার। মায়েরা দুই ভাই আর মা। আমার মায়ের নাম সার্বণী ইসলাম। মায়ের মা, মানে আমার নানি মারা গেছেন অনেক আগেই। নানা আবার বিয়ে করেছিলেন। আর্থিক অবস্থা যে খুব ভাল ছিল, তা নয়। চলে একরকম, এমন ছিল, এখনো একই অবস্থাই আছে। আমার নানা গরুর ব্যবসা করতেন। তো ইন্ডিয়াতে যাতায়াত ছিল আরকি! এমন-কী ওখান থেকেও মানুষজন এসে নানার বাসায় থাকত অনেক দিন করে। এভাবে চলছিল। মা তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে সম্ভবত। দেখতে যে খুব সুন্দরী ছিল, তা কিন্ত নয়। তবে কথাবার্তায় অনেক চঞ্চল ছিল। নানারা খুব গরীব ছিল, তার উপর নানা সৎ মানুষ ছিলেন। তখন নানা এক গরুর ব্যবসায়ীর কাছে আমার মাকে বিয়ে দেন। তারপর বাবা মাকে নিয়ে ইন্ডিয়া চলে যান। শুনেছি, আমার দাদুর বাসা বারাসাতে। এর বেশি কিছু জানি না। মায়ের খুব ছোট বয়সে বিয়ে হয়, ১২/১৩ বছর হবে হয়ত। বিয়ের কিছুদিন পরই আমি পেটে চলে আসি। এক সময় আমি হলাম। আমার বয়স যখন ১৭ দিন, তখন বাবা মাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন, মানে আমার নানার বাসায়। তারপর মাকে বাবা বলে গিয়েছিলেন, তুমি থাকো, আমি কিছু দিন পর নিতে আসব। দিন, মাস, বছর এভাবে যেতে থাকে, কিন্ত কী জানেন, আমার বাবা কখনোই আর আমাদের খোঁজ নেননি। আমার বাবার নাম আজাদ আব্দুল কাসেম। ওহ্ হ্যাঁ, আমার নামও রাখা হয়েছিল নানার বাড়িতে। আমার নাম দেয়া হয়েছিল মুহূর্ত ইসলাম সন্ধ্যা। জানি না সন্ধেবেলায় হয়েছিলাম কি না। তারপর আমার বয়স যখন ৬ মাস, তখন আমার নানি আমার মাকে বলে দিলেন যে তাঁরা দুইজনের দায়িত্ব নেবেন না। মানে, আমার দায়িত্ব উনারা নিতে পারবেন না। উনারা আমাকে সেই সময় খেতে দেননি ঠিকমত। শুনেছি, আমাকে বিছানার নিচে লুকিয়ে মা খাওয়াতেন। আর সেই সময় আমি অনেক রোগা ছিলাম, অনেক অসুস্থ থাকতাম, শরীরে অনেক ক্ষত আর ঘা ছিল। পরে আমার নানি আমার জন্য মাকে আরো বেশি কষ্ট দিতেন। তখন আমার মা, উনার নিজের মা যিনি ছিলেন, তার ভাইয়ের কাছে চলে আসেন, মানে আমার মায়ের মামার কাছে আসেন আমাকে নিয়ে। মায়ের ওই মামার বাসা গৌরিপাড়ায়। উনারাও অনেক গরিব ছিলেন। তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, আমাকে এতিমখানায় দিয়ে দেয়া হবে।
ঘটনাচক্রে আমার বর্তমান বাবা সে সময় একটি মেয়েবাচ্চা খুঁজছিলেন। আমার এই বাবার খালাত বোনের বিয়ে হয়েছিল আমার নিজের মায়ের মামার বাসার কাছে। তো ফুফু তখন আমার এই বাবা-মা’কে আমার খোঁজ জানাতে আসেন। তখন আমার বর্তমান বাবা বাসায় ছিলেন না, মা ছিলেন, ফুফু এসে যখন বললেন, “একটা মেয়েবাচ্চা পাওয়া গেছে, ভাবী; আপনি নেবেন? অনেক ফুটফুটে বাচ্চাটা।” তখন মা বলেছিলেন, নিয়ে আয়-তো, দেখি! তখন আমায় খুব করে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, জানেন—কোরবানির গরুকে যেমন করে সাজিয়ে হাটে নেয়া হয়! আমাকে কালোটিপ পরানো হয়েছিল, চোখে কাজলও দেয়া হয়েছিল। আমার বয়স তখন ৯ মাস। একটা ৯ মাস বয়সি জ্যান্ত পণ্যকে নিয়ে যাওয়া হল সে বাসায়।
হয়ত আমার কপাল ভাল, তাই এতিমখানাতে যাওয়ার সব কিছু যখন প্রায় ঠিকঠাক, সে সময়ই আমার বর্তমান মা আমাকে গ্রহণ করলেন। হয়ত এটাই আল্লাহ্র ইচ্ছা ছিল। সেদিন ছিল ২০ মার্চ ১৯৯৫, সোমবার। তারিখটা আমি জেনেছি আমার মায়ের কাছে, বড় হবার পর।
শুনেছি, আমার জন্ম ২০ জুন ১৯৯৪। তারিখটা কীভাবে এতটা মিলে গেল, আমি জানি না। যা-ই হোক, সেখানে আমার নতুন নামকরণ, আকিকা, সবই করা হল ২ দিনের মধ্যেই। আমার নতুন নাম হল দেহলী জারিন দূর্বা। পদবি হল হাকিম। দেহলী নামটা বাবার দেয়া আর দূর্বা নামটা আমার ছোটফুফুর দেয়া। ছোটফুফু উনার মেয়ের নাম ঠিক করে রেখেছিলেন দূর্বা, অথচ উনার হল ছেলে, তো তার ভাইয়ের মেয়ে আমি হয়েছি দেখে খুশি হয়ে দূর্বা নামটা রেখেছেন। নতুন নাম রাখার ব্যাপারে উনার উৎসাহ ছিল সবচাইতে বেশি। উনি বারবার বলছিলেন, আমাদের মেয়ে, নামও আমরা রাখবো। আমার মা নাম আমার নাম দিয়েছিলেন চৈতালি মারজিয়া স্নিতি। তখন আমার খাওয়াপরা আর আরামআয়েশের কোনো শেষ নাই, কেবল সুখ আর আদর। আমার এই বাবারা ৯ ভাই। আমার বাবা চতুর্থ। যা-ই হোক, যত্নেই আমার দিন কাটছিল। হেসেখেলে আস্তেআস্তে বড় হয়ে গেছি। একসময় আমাকে স্কুলে ভর্তি করানো হল; প্লে-তে। প্লে শেষে আমি প্রাইমারিতে ভর্তি হলাম, ক্লাস ওয়ানে।
আমাকে যখন ওই পরিবারে নেয়া হচ্ছিল, তখন আমার ওই বাবার বাবা, মানে আমার দাদা বলছিলেন, কুয়ার ব্যাঙ পুকুরে পরল! আগে কথাটার মানে বুঝতাম না। বড় হয়ার পর বুঝেছি কেন উনি ওটা বলতেন। আমায় সে পরিবারের বাইরের কেউ মেনে নেয়নি ১৫ বছর। আমার সাথে কেউ মিশত না। আমি খুবই শান্ত স্বভাবের ছিলাম, একাকি থাকতে ভালোবাসতাম। মা-বাবা ছাড়া আর কারো সাথেই আমি তেমন একটা কথা বলতাম না, বাইরেও বের হতাম না। আমার এই বাবার পরিবার এলাকায় খুব নামকরা, পাশের কয়েক এলাকায়ও আমাদের সুনাম রয়েছে। আমার মায়ের বাপের পরিবারও উচ্চবিত্ত।
আমার আসল মা আমায় সেই যে দিয়ে গেছেন, তারপর আর কখনো আসেননি, উনি যে কোথায় কেউ জানতও না। সবার মত করে আমার চাচারা বলতেন, এই দূর্বা, তোমাকে তো ট্রেন থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি, তুমি খুব কাঁদছিলে, তখন নিয়ে এসেছি। আমি ভাবতাম, ওরা এসব বলেবলে আমার সাথে মজা করে। ওদের কথায় কিছুই মনে করতাম না। এর মাঝে, আমি যখন ক্লাস থ্রিতে, তখন আমার নিজের মা আমাদের বাসায় এসেছিলেন, কিন্তু আমি তখনও জানতাম না যে আমি এদের মেয়ে না। মা এভাবে প্রায়ইই আসতেন, আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আমি যদি জানতে চাইতাম, এই মহিলাটা কে, তখন আমার এই বাবা-মা বলতেন, উনি তোমার খালামণি, আমিও উনাকে খালা বলেই ডাকতাম। এভাবে একদিন দুইদিন হতেহতে আমার ছোট চাচি মুখ ফসকে বলে ফেললেন, দূর্বার মা যে এসেছিলেন, দূর্বা কি জানে? আমি তখন রুমে, কিন্তু চাচি তা জানতেন না। আমি সেদিন আমার মায়ের চোখেমুখে যে ভয় দেখেছিলাম, তা আর কখনো দেখিনি। সেই দিন আমি আর কাউকে কিছু বলিনি, মাকেও না, বাবাকেও না। আমি ছিলাম আমার মতই—কিছু শুনিনি, এই টাইপের হয়ে। প্রতিদিনের মত আমি সকালে খেয়ে স্কুলে যাই, প্রাইভেটে পড়ে বাসায় ফিরি। মন খারাপ থাকে, ক্লান্ত লাগে। মা আমায় কিছু বলেন না, জিজ্ঞেস করেন না কেন আমার মন খারাপ; ভাবেন, পড়ার চাপে ক্লান্ত হয়ত।
তবে সত্য যে কখনো চাপা থাকে না, এটা সে ঘটনার পর থেকে মানি। মায়ের সাথে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হল। বাইরের লোকজন নানান কথা বলতে লাগল, সবসময় যেমন বলে আরকি! আমাকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার? তোমার মা তোমার সাথে কথা বলে না? আমি বলি, কেন বলবে না? ওরা বলে, উনারা তো তোমার বাবা-মা না, তুমি তো উনাদের পালিত মেয়ে, এরকম আরো অনেক কথা! একদিন বাবা বাসায় ফিরলে আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করি। সেদিন বাবা আমাকে সব সত্য বলে দিলেন। জানেন, সব কিছু শুনে আমার একটুও কষ্ট লাগেনি, বরং এটা ভাবে আনন্দ হয়েছিল যে আমি এমন বাবা-মা’কে পেয়েছি! মণি রত্নমের একটা তামিল মুভি আছে, ইংরেজি নাম, অ্যা পেক অন দ্য চিক। সময় করে দেখে নেবেন। ওই মুভিতে আমার মত একটি মেয়ে আছে।
যা-ই হোক, ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেলাম। পড়াশোনায় ভালই ছিলাম, ক্লাসে ফার্স্ট বা সেকেন্ড হতাম, ম্যামরা খুব আদর করতেন। আমার পালিত হওয়ার ব্যাপারটা একসময় পাড়ার সবাই জেনে গেল। স্কুলের ম্যামরাও জেনে গেলেন। সবাই আমায় রাজ্যের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করত। সাধারণ লোকের অন্যের ব্যাপারে আগ্রহ সবসময়ই বেশি। আমি সবার প্রশ্নের উত্তর দিতেদিতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। তবু উত্তর দিতাম, কত জন কত কিছু যে বলত আমার গল্প শুনে, তবু আমি মন খারাপ না করে সবার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতাম। সবার এমন প্রশ্ন আর তির্যক মন্তব্যের ঝড় সামলে আমি বাসায় ফিরতাম হাসতে-হাসতেই। আমার একটাই কষ্ট, যে মা আমায় অন্য লোকের হাতে তুলে দিল, সে মা-ই কেন আবার সে লোকের ভাইকে বিয়ে করল প্রেম করে! আমাকে যে পরিবারে দিয়ে দিল, নিজেও কেন সে পরিবারেই থেকে গেল? হ্যাঁ, আমার নিজের মা আমার চাচি হয়ে গিয়েছিলেন। এ কেমন প্রহসন! আমি আমার মাকে ঘৃণা করি!
আমার আসল মা এখন সম্পর্কে আমার চাচি। আমি তাকে যতটা মা ভাবতে পছন্দ করি, তার চাইতে বেশি পছন্দ করি চাচি ভাবতে। আগে না জেনে তার সাথে যাও কথা বলেছি, সব কিছু জানার পর থেকে আর কখনো কথা বলিনি। উনি সবাইকে বলে বেড়ান, জানেন, আমার মেয়ে অনেক সুন্দরী দেখতে, আমার সাথে মেয়ের চেহারার কত মিল, আমিও ওর বয়সে অবিকল ওর মত ছিলাম দেখতে, এমন আরো কত কথা! আমার ‘চাচি’-‘মা’ আমাদের বাসায় যে কয়বার এসেছেন, প্রতিবারই আমি উনাকে অপমান করেছি। আমার নানি এটা দেখে খুব কেঁদেছিলেন আর বলেছিলেন, তুই জানিস না তোর মা তোকে কত ভালোবাসেন, আর তুই কিনা তোর মায়ের সাথে এমন আচরণ করিস! আমি মনেমনে বলেছিলাম, আমার আর কিছু জানতে বাকি নেই, কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা ভালোবাসা না, তা আমি খুব ভাল করেই বুঝতে শিখেছি। আমার কলেজ স্কুল, সব জায়গাতেই সবাই একটাই কথা বলে, দূর্বা, তুমি তোমার মায়ের সাথে কখনো কথা বোলো না, বললে আল্লাহ্ রাগ করবেন।
আমার চাচাদের সাথে আগে আমাদের ভাল সম্পর্ক ছিল। আমার বাবা যখন সব সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিলেন, তখন থেকে চাচাদের অনেক রাগ আমাদের উপর। সম্পত্তির লোভে মেজো চাচা উনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। আমায় দেখলেই খুব আদর করে মা বলে ডাকেন, কত মিষ্টি করে কথা বলেন, কিন্তু মনের মধ্যে অন্য কিছু। আমি কখনো এদেরকে ক্ষমা করতে পারব না। তবে হ্যাঁ, আমার এই মায়ের বাপের পরিবারের সবাই আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমার মামারা অন্য ভাগ্নে-ভাগ্নিদের চেয়ে আমাকে বেশি আদর করেন। আমার নিজের মায়ের, মানে চাচির পরের বিয়ের দুটো সন্তান আছে; এক ছেলে, এক মেয়ে।
শেষ! এটাই আমার গল্প। আমি এই গল্পটা নিয়েই বেঁচে আছি।
: খুব বেদনার। কষ্ট পেলাম।
: কষ্ট কীসের? আমার অনেক ধৈর্য, কষ্ট লাগে না।
: সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। এত কিছু মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে সাহস লাগে।
: আমার মাকে আমার চাচিরা আর এলাকার লোকজন নানান কথা বলে। বলে, দূর্বা তো একদিন চলে যাবে। অন্য রক্ত মানেই অন্য রক্ত। রক্ত কি আর আলাদা হয়! এমন অনেক কথা। আমি বলি, রক্তের বন্ধনের চাইতে ভালোবাসার বন্ধন শক্ত। আমি বাবা-মা’র ভালোবাসার কাছে রক্তের বন্ধনের শৈথিল্যকে হারিয়ে দেবো। কখনোই চলে যাবো না ওদের ছেড়ে।
: বলতে দাও। লোকের যত আনন্দই ফালতু কথা বলায়!
: জানেন, আমি অনেক বিলাসিতার মধ্যে বড় হয়েছি। এলাকায় আর কোনো মেয়ে এতটা আদরে বড় হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অনেকেই আছে, যারা আমার পেছনে আমার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে, আবার আমার সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য আমার পা ধরে। আমি জেনেশুনেই ওদের সাথে ভালভাবে কথা বলি, ওদের অভিনয় দেখে মজা পাই। ধাক্কা খেতেখেতে আমি অনেক ছোট থেকে অনেক বড় হয়ে গেছি। লোকে ধাক্কা খায় আর বড় হয়ে যায়। শরীরের বয়সের তুলনায় মনের বয়স বেড়ে গেছে অনেকখানি। জটিল অনেক ব্যাপার এখন আগে থেকেই অনুমান করে নিজেকে সেখান থেকে দূরে রাখতে পারি। এলাকার মুরুব্বিরা আমায় পছন্দ করেন, কিন্তু সমবয়সিরা আমার দিকে সবসময়ই অন্য চোখে তাকায়। কেন, জানি না।
: ওরা তোমায় ঈর্ষা করে হয়ত!
: আমার এমন দুর্ভাগ্যের পরও ঈর্ষার পাত্র হয়ে বেঁচে আছি! বাহ্! ভাল তো! আমি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বাবার কাঁধে চড়ে স্কুলে গেছি, ওদের কারো তো এতটা আদর কপালে জোটেনি। তাই ওরা আমায় একটু ঈর্ষা করতেই পারে। ওরা আমায় ঈর্ষা করে, কারণ, ওরা কেউ আমার মত নয়। আমি ওদের কাউকেই ঈর্ষা করি না, কারণ, আমি যেমন, তেমন হয়েই আমি অনেক খুশি! আমি কষ্ট পাই অসহায় শিশুদের দেখলে। আমার কেবলই মনে হতে থাকে, আহা, আমারও এমন দুরবস্থার মধ্যে জীবন কাটানোর কথা ছিল, অথচ আল্লাহ্ আমাকে কত ভাল রেখেছেন! আমি ভাল আছি, আমার একটা পরিচয় আছে, আমার চমৎকার বাবা-মা আছে। কত্ত সুখি আমি! আর কী চাই! আমাকে উনারা স্বাধীনতা দিয়েছেন, পড়াশোনা শেখাচ্ছেন। বাড়ির অন্য দশটা ছেলেমেয়ে যতটা সুযোগসুবিধা পেয়েছে, আমি তার চাইতে কম কিছু কখনো পাইনি, বরং বেশিই পেয়েছি। আমার পরিবার বাকি দুনিয়াটার চাইতে আমায় বেশি ভালোবাসে, আমিও বিশ্বাস করি, এই পরিবারই আমার পৃথিবী। স্বার্থযুক্ত রক্তের বাঁধনের চাইতে স্বার্থহীন ভালোবাসার বাঁধনের শক্তি অনেক বেশি!
দুই।
এত রাতে আপনাকে আমি আমার জীবনের কথা লিখছি। অনেকটা অসহায় হয়েই লিখছি। আমি আসলে বুঝতে পারছি না আমি কী করব বা আমার কী করা উচিত! কাউকেই বিশ্বাস করতে পারি না, তবু জীবনে ভরসা করার মত কাউকে তো লাগে, তাই আপনাকে লেখা। আমরা তো কেউ কাউকে চিনি না, তাই আমার গল্পটা লেখার পর আমি ধরেই নেবো, যা লিখেছি, তা হারিয়ে গেছে। অচেনা কাউকে খুব সহজেই মনের সব কথা বলে ফেলা যায়। মনে যা জমে আছে, তা লিখে ফেলে আমি নিজেকে হাল্কা করতে চাই, তাই লেখা।
আমি ছোটবেলা থেকেই বাবাকে একটু অন্য রকম হিসেবে দেখেছি। বদমেজাজি, রুক্ষ স্বভাবের। কারো প্রতি উনার কোনো দায়িত্ব-কর্তব্য নেই। বাবা এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ব্যবসায় নেমেছিলেন। ওই সময় থেকেই কারো কথাই কানে নেন না, নিজে যা ঠিক মনে করেন, তাই করেন। দাদুবাড়ির আর্থিক অবস্থা বেশ ভাল ছিল। মা দেখতে অনেক সুন্দরী। বিএ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। নানার মৃত্যুর পর নানিবাড়ির আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। মা একটা প্রাইমারি স্কুলে জয়েন করে মামাদের খরচ পর্যন্ত চালাতেন। মা বরাবরই খুব জেদি স্বভাবের। আমার বাবার বাড়ির এক আত্মীয় নানিবাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলেন। মা প্রথমে বিয়ে রাজি না হলেও নানির ইচ্ছেয় বিয়েটা করেন।
বিয়ের পর থেকেই বাবা-মা’র সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। সবাই বলত, বাচ্চা নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা-মা বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বাবা চেয়েছিলেন, তাঁর ছেলে হোক। তাই আমার জন্মের সময় বাবা খুশি হননি। ফলে বাবা-মা’র সম্পর্কটাও আর ভাল হয়ওনি। আমি সত্যিই বুঝি না, কেন লোকে দাম্পত্য সম্পর্ক ভাল করার জন্য সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়! বরং সম্পর্ক ভাল হওয়ার পর সন্তান নেয়া উচিত, এতে সে সন্তান কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতার হাত থেকে বেঁচে যায়।
মা তখন দিনাজপুরে চাকরি করতেন আর বাবা নওগাঁতে ব্যবসা করতেন। আমার বয়স তখন ৪। আমার দাদু মাকে নওগাঁতে বদলি হতে বললেন। বিয়েটা টিকিয়ে রাখার জন্য মা নওগাঁতে বদলি নিলেন। আমাকে রংপুরে নানিবাড়িতে রেখে গেলেন। বললেন, ওখানে ভাল স্কুল নেই, আমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে। তাছাড়া তিনি আমাকে শহরে বড় করতে চান, গ্রামের পরিবেশ থেকে দূরে রাখতে চান।
আমাকে রংপুরে রাখার একটা বড় কারণ ছিল, আমার মা নানিবাড়ির সংসার চালাতেন। বেতনের সব টাকা নানিবাড়িতে দিতে হত। আমাকে উনাদের সাথে না রাখলে সে টাকাটা দিয়ে দেয়া সম্ভব হত না। আমাকে নানিবাড়িতে রাখলে বাবাও ওই টাকা দিতে বাধা দিতে পারবেন না। নওগাঁতে দাদুবাড়িতে উনারা কিছুদিন একসাথে ছিলেন। তারপর মা বদলি হয়ে স্কুল চেঞ্জ করে নওগাঁ শহরে চলে আসেন। মা শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। আর বাবা গ্রামে দাদুবাড়িতে থাকতেন। মাঝেমধ্যে হয় বাবা শহরে মায়ের কাছে আসেন, নতুবা মা গ্রামে দাদুবাড়িতে যান। এখনো উনারা এভাবেই থাকেন।
আমি নানিবাড়িতে স্কুলে ভর্তি হই। মামা, মামি আর নানির কাছে বড় হতে থাকি। নানিবাড়িতে আমার শৈশব মোটামুটি ভালই ছিল। নানি খুব আদর করতেন, তবে মামা মারতেন। এমন-কী পরীক্ষায় ২০-এ ১৯ পেলেও বাড়ি ফিরে মার খেতাম। সবসময়ই ভয়ে থাকতাম, কখন মার খাবো! পেন্সিল, কলম, চুলের ক্লিপ, যেকোনো কিছু হারিয়ে ফেললে মামা খুব মারতেন। খুব মানে, খুব! আসলে তখন তো মামার চাকরি ছিল না, তাই সব রাগ আর দুঃখ আমার উপরেই ঝাড়তেন। মামা আমাকে মারার পর আমার কান্না দেখলে আবার নিজেই কাঁদতেন। আমার বাবা কখনোই রংপুরে আসতেন না। তবে মা আসতেন—স্কুল ছুটি হলে। মা চলে যাওয়ার সময় আমার খুব কষ্ট হত, কান্না পেত। তবু, মাকে যে আরো কিছু দিন আমার সাথে থাকতে বলব, আমার সে সুযোগ বা সাহস কোনোটাই ছিল না। খুব ইচ্ছে করত, মাকে জড়িয়ে ধরে বলি, তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, আমার কাছে থেকে যাও! দাঁতে দাঁত চেপে কান্না গিলে ফেলতাম। আমি খুব অল্প বয়সেই কান্না গিলে বাঁচতে শিখেছি।
পড়াশোনায় ভাল ছিলাম, ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হতাম। আমাকে আমার ছোটমামা পড়াতেন। উনি খুবই বদমেজাজি ছিলেন। উনিও বেকার ছিলেন, তাই আল্লাহ্র উপর উনার যত রাগ, সবই আমার উপর ঝাড়তেন। প্রায় প্রতিদিনই পড়তে বসলে আমি মার খেতাম। পড়াশোনা না করার জন্য নয়, কোনো না কোনো অজুহাতে উনি আমাকে মারতেনই। একটা সময় পড়াশোনা ব্যাপারটাই আমার কাছে ভয়ের হয়ে দাঁড়ালো। আমি ফার্স্ট সেকেন্ড থেকে ছিটকে দশের বাইরে চলে গেলাম।
আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, বৃত্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন এক হুজুরের কাছে কোরান পড়তাম। সে হুজুর আমাকে উনার কোয়ার্টারে নানান উছিলায় ডেকে বিভিন্ন সময়ে যৌন নির্যাতন করেন। এই বিষয়টা আমি ভয়ে কখনো কাউকে বলতে পারিনি। ওই লোক আমাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন, করতে পারেননি, তবে খুব বিশ্রীভাবে নির্যাতন করে গেছেন দিনের পর দিন, যা ওইসময়ে আমার ভাবনাজগতে গভীর দাগ কাটে। কাউকে বলিনি সে কথা। বলব কী, ওই বয়সে তো কিছু বুঝে উঠতেই পারতাম না। ওখানে আমাকে পড়তে যেতেই হত, আর আমি সারাক্ষণই ভয়ে কুঁকড়ে থাকতাম। এই মানসিক সমস্যার কারণে আমার বৃত্তি পাওয়া হল না। সবাই সুযোগ পেলেই অপমান করত। আমার মা ছুটি পেলেই রংপুরে আসতেন। তিনিও প্রতিবারই আমাকে কোনো না কোনো ছুতোয় অনেক মারতেন, বকাঝকা তো ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার! উনার আসল রাগ ছিল আমি কেন বৃত্তি পেলাম না! আমার দিন কাটত অপমান, অবহেলা আর বকাঝকা সহ্য করতে-করতে। পৃথিবীতে কিছু ঘটনার কারণ কাউকে বলা যায় না। অথচ সেই ঘটনাগুলিই সবচাইতে বেশি কষ্ট দেয়।
আমার বাবা আমার সাথে দেখা করতে আসতেন না। আমিই উনার সাথে দেখা করতে নওগাঁ যেতাম। তিনি কোনো না কোনোভাবে এটা বুঝাতে চাইতেন যে, শহরের স্কুলে পড়ে আমি কিছু শিখতে পারছি না। আমি একটা গাধা, সবাই আমার চেয়ে ভাল। তবে স্কুলের স্যাররা খুব ভালোবাসতেন। উনারা আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন যাতে আমি ভাল রেজাল্ট করতে পারি।
বাবা-মা’কে সবসময়ই উনাদের ইগো আর ঝগড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। আমার দিকে তাকানোর সময় উনাদের ছিল না। আমার বাবা আমার পড়াশোনার জন্য কোনো টাকা দিতেন না। মা টাকা দিতেন, তবে বাবা টাকা দিতেন না বলে এটা নিয়ে উনার মেজাজ খারাপ থাকত আর আমাকে খুব খারাপ ভাষায় গালি দিতেন। আমি ছোটবেলা থেকেই এটা বুঝে গিয়েছিলাম যে আমি তাঁদের কাছে একটা বোঝা ছাড়া আর কিছুই না। তাঁরা একটা ছেলে চেয়েছিলেন, ‘কপালের দোষে’ তাঁদের ঘরে আমি এসেছি। কোনো ভাল অংক বা ইংরেজির শিক্ষকের কাছে আমি কখনো পড়তে পারিনি। এক স্যারের ব্যাচে গিয়ে আমি সব সাবজেক্টই পড়তাম। সে স্যারের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, তবে একটা ব্যাপার আমি কখনো মেনে নিতে পারি না, তা হল, ব্যাচ শুরু হওয়ার আগে বা শেষে উনি খুবই বাজেভাবে ইচ্ছেমত আমার শরীরে হাত দিতেন। এ কাজটা উনি করে গেছেন প্রায় দুই বছর। আমি উনাকে বেতন দিতে পারতাম না বলে কখনো প্রতিবাদ করিনি। আমার জন্য একজন প্রাইভেট টিচার রাখাটা বাবা-মায়ের জন্য বিলাসিতা ছিল, ব্যাচে গিয়ে পড়তাম, সেখানেও কোনো খরচ উনারা কখনো করেননি। আমি কখনোই ভাল জামা, খেলনা, কসমেটিক্স চাইতাম না। তাঁদের কাছে আমার চাওয়া ছিল দুইটা: তাঁরা যেন আমার সাথে একটু ভাল ব্যবহার করেন আর আমার পড়াশোনাটা যেন বন্ধ না হয়।
সবার কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার পেতেপেতে আমার মধ্যে কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এমনও হত যে কেউ আমাকে এই প্রশ্ন করলে, তুমি কোন ক্লাসে পড়, সেটারও উত্তর দিতে পারতাম না, ভুলভাল উত্তর দিতাম। আবার রিকশাওয়ালাকে ডেকে বলতে পারতাম না যে কোথায় যাবো। এমন কিছু সমস্যা মাঝেমধ্যে হত।
ক্লাস এইটে ফার্স্টটার্মে ম্যাথস্-এ পাই ৯৬, সেকেন্ডটার্মে ২৯। তখন থেকেই আমার মধ্যে ম্যাথস্ নিয়ে ভয় ঢুকে যায়। একজাম হলে গেলে আমি পারা ম্যাথস্ও করে আসতে পারতাম না। একজাম হল থেকে বের হলে সেই একই ম্যাথস্ সহজেই সলভ করতে পারতাম। ম্যথস্ভীতির কারণে আমি এসএসসি’তে মানবিকে ভর্তি হই। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, টিচাররা আমাকে নিয়ে আফসোস করতেন। আমি কাউকেই কিছু বলতাম না, নির্বিকার হয়ে সব সহ্য করতাম। এসএসসি’তে আমি একাই পুলিশ লাইনস্ স্কুল থেকে হিউম্যানিটিস্ থেকে এপ্লাস পাই। ট্যালেন্টপুলে স্কলারশিপ পেয়ে রাজশাহী বোর্ডে ৩৮তম হই। রংপুর ক্যান্ট পাবলিকে চান্স পাই। ভর্তি হতে ১০ হাজার টাকা লাগবে বলে বাবা-মা আমাকে সেখানে ভর্তি করাননি। আমার বাবার কোটিকোটি টাকার সম্পদ ছিল, মা তো জব করতেন, দুইজনেরই সামর্থ্য ছিল টাকাটা দেয়ার, কিন্তু তাঁদের কেউই দিলেন না। আমার এক মামা লোকের কাছ থেকে ধারকর্জ করে আমাকে পুলিশ লাইনস্ কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন।
এইচএসসি টেস্ট পরীক্ষায় ৪৬৫ জন স্টুডেন্টের মধ্যে প্রথম হলাম। তবে ফাইনালে পেলাম ৪.৭০। খুব কনফিডেন্ট ছিলাম যে এপ্লাস পাবো, পেলাম না। এ হতাশা আমাকে প্রতিনিয়তই শেষ করে দিচ্ছিল। ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর সব জায়গায় ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, কিন্তু কোথাও চান্স পেলাম না। সেকেন্ড টাইম পরীক্ষা দেয়ার জন্য আবারো পড়াশোনা শুরু করি। জন্ডিস হওয়ার ফলে শেষের দিকে অনেক দিন পড়তে পারিনি। রাজশাহী ভার্সিটিতে ওয়েটিং-এ ছিলাম। সিরিয়াল ১১৪৩। ১১৩৭ পর্যন্ত ভর্তি করানো হল, আমি বাদ পড়ে গেলাম। দ্বিতীয়বার রাজশাহী ভার্সিটি বাদে আর কোথাও পরীক্ষাই দিতে পারিনি। মা দিতে দেয়নি। রাজশাহী কলেজে প্রথমবারে পরিসংখ্যানে ভর্তি হই, সেখান থেকেই অনার্স কমপ্লিট করি।
আমার মা-বাবা আমাকে বলেছিলেন যে উনারা আমাকে রাজশাহী কলেজে পড়াতে পারবেন না, আমি যেন নওগাঁ কলেজে ট্রান্সফার হয়ে চলে যাই। আমি তখন বাধ্য হয়ে তাঁদের কাছ থেকে টাকা নেয়া বন্ধ করে দিলাম। নিজে টিউশনি করে পড়ার খরচ চালাতাম। সপ্তাহে তিনদিন বাসে চেপে নওগাঁ থেকে রাজশাহী আসতাম ক্লাস করতে, ক্লাস শেষে আবার নওগাঁ ফিরে যেতাম। ফার্স্ট ইয়ারে পাস করব কি না সেটাই জানতাম না। ফোর্থ ইয়ার শেষে সিজিপিএ ৩.৪৩ নিয়ে ডিপার্টমেন্টে প্রথম ২০ জনের মধ্যে আছি। ২০১৭’তে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। সে বছরই পুলিশে অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে জয়েন করি। মাস্টার্সে ক্লাস করতে পারিনি। ফাইনাল একজাম দিতে দেয়া হবে কি না, তাও জানি না। টাকার অভাবে বাধ্য হয়ে চাকরি নিয়েছি। টিউশনি করলে মানসম্মান থাকে না।
এ জীবনে অপমান, গালি, করুণা ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। দিনের শেষে একটাই চরম সত্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়াই: এ পৃথিবীতে আমি নিজে ছাড়া আপন বলতে আমার আর কেউ নেই। আমার নিজের জন্য খুব কষ্ট হয়। অফিসে কাজ করতে-করতে চোখে জল জমে যায়। আমার নাম ‘নীলাক্ষি’ কে রেখেছে, আমি জানি না। তবে এইটুকু জানি, এই দুই চোখ আর নীল নেই, অনেক আগেই ধূসর হয়ে গেছে। আমি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সবসময়ই লড়াই করেছি। ভালোবেসেছি পড়াশোনাকে। তবু আজ পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার মত অবস্থা। আমি নিজের জন্য একটা সম্মানের জায়গা তৈরি করতে পারলাম না এখনো।
আমি যখন ইন্টারের পর জীবনযুদ্ধে নামি, সে সময় আমার পাশে আমার এক ছেলেবন্ধুকে পেয়েছিলাম, ওর নাম সাত্যকি বসু। আমাদের ধর্ম ছিল আলাদা। ও আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করত। বলত, এই যে তোমার আশেপাশে দেখছ, কত ছেলেমেয়ে তোমাকে টিটকারি মারে, ওরা কেউই জীবনে কিছু করতে পারবে না, কিন্তু তুমি পারবে। ওরা সবাই হারিয়ে যাবে, কিন্তু তুমি টিকে থাকবে। হাল ছেড়ো না, আমি তো আছি পাশে! আদৌ অনার্সই শেষ করতে পারব কি না, সেটা নিয়ে যখন ভাবতাম, তখন ও বলত, যদি রাজশাহী কলেজ থেকে একজনও অনার্স কমপ্লিট করতে পারে, সে হবে নীলাক্ষি। এই কথাটা হয়ত নেহায়েতই অত্যুক্তি, তবু ওইটুকু কথাতেই সে সময় অনেক সাহস পেতাম। আমাকে ভাল কিছু বলার মত যে কেউই ছিল না পাশে! এসব শুনলে ওকে খুব আপন মনে হত। সাত্যকি আমাকে নানাভাবে হেল্প করত। কিছু বই রাজশাহীতে পাওয়া যেত না, সেগুলি সে ঢাকা থেকে কিনে পাঠাতো।
সাত্যকির পরিবারের অবস্থা আমার পরিবারের মতই। ওর বাবা ওর মায়ের সাথে খুব নোংরা ভাষায় কথা বলত। ওকে খুব কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করে বলত, ওর মায়ের সাথে নাকি ওর শারীরিক সম্পর্ক আছে! সাত্যকি কখনো বাড়ি যেতে পারে না। ওর বাবা দয়া করে প্রতিমাসে ওকে কিছু টাকা পাঠাতো। ঢাকায় একটা হোস্টেলে থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। সুখি মানুষদের মধ্যে তেমন কোনো দৃঢ় বন্ধন গড়ে ওঠে না, যেটা দুঃখী মানুষদের মধ্যে গড়ে ওঠে। একই রকমের দুঃখ যাদের, তাদের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়ে যায়। সে বন্ধন খুব শক্ত। আমরা নিজেদের দুঃখগুলি পরস্পরের সাথে ভাগাভাগি করতে-করতে একটা সময়ে একে অন্যকে ভালোবেসে ফেলি। সাত বছর হয়ে গেল আমরা একসাথে আছি, কখনো বন্ধু, কখনো-বা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে।
আমার বাড়ি থেকে আমার ইন্টারের পরই বিয়ে দিয়ে দেয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল। তার উপর একটার পর একটা বিয়ের প্রস্তাব আসতো। সাত্যকি আমাকে বলত, একটু অপেক্ষা করো, আমার অনার্সটা শেষ হোক। আমি দিন গুনতাম। ভাবতাম, ও অনার্স শেষ করে একটা চাকরি নেবে আর আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। ওকে আমি ফার্স্ট ইয়ার থেকেই ওর ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে বলতাম। এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে খুব অশান্তি হত। আমি ওকে ফোন করে কাঁদতাম আর বলতাম, তুমি একটা চাকরি নাও। তখন ওর অনার্স শেষ। ওকে বলতাম, তুমি পুলিশের এসআই-এর জন্য পরীক্ষা দাও। ও আমার কথা শুনত না, কখনো চাকরির জন্য অ্যাপ্লাইই করেনি।
সাত্যকি আমার কথা ভাবেনি। ও আমার চাইতে ওর নিজের লাইফ, ক্যারিয়ার, এডুকেশন, রেজাল্ট, সুযোগ, সুবিধা এসবকেই সবসময় বড় করে দেখেছে। ও আমার পড়াশোনা, চাকরি এসব নিয়ে ততটা কখনো ভাবেনি, যতটা আমি ওর জন্য ভাবতাম, ওর ভাল চাইতাম। যখন ওর একটা ভাল চাকরি নেয়া দরকার, তখন ও মাস্টার্স নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কোনো চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই পর্যন্ত করেনি! আমি সব মেনে নিয়েছিলাম এ ভেবে যে ও তো বিসিএস পরীক্ষা দেবে বলছে, প্রস্তুতিও নিচ্ছে, আমার যত কষ্টই হোক, আমি ওর পাশে থাকব। আমি কেবল ওকে সাহায্য করার জন্যই একটা থার্ডক্লাশ জবে ঢুকে যাই। আমার স্বপ্ন, ও বিসিএস ক্যাডার হবে, তার জন্য যা করতে হয়, আমি করবো। ও শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিল। পরীক্ষায় পাসটুকুও করতে পারেনি। বিসিএস দিল। প্রিলিতে ওর একপেক্টেড মার্কস ছিল মাত্র ৪০%! আমি বুঝে ফেললাম, ও আসলে আমার টাকাটা নষ্ট করছে, ঠিকমত পড়াশোনা করছে না। খুব রাগ হত ওর উপর, কিন্তু ভালোবাসি বলে কখনোই ওর হাতটা ছাড়তে পারতাম না। আমার মনে হত, আমি হাত ছেড়ে দিলে কে ওকে দেখবে!
এদিকে গত ৫ বছর ধরে আমার হরমোনের সমস্যা। ৩ মাস পরপর অস্বাভাবিক হারে রক্ত যায় শরীর থেকে। ডাক্তার বলেছেন, আপনি বিয়ে করুন, বিয়ের পর এ সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে। আপনি যতক্ষণ ওষুধ খাবেন, ততক্ষণ ঠিক থাকবেন, আবার একই অবস্থা হবে। আমি সাত্যকির বিসিএস ক্যাডার হওয়ার অপেক্ষায় আছি। আমি ওর কান্না সহ্য করতে পারি না। আমার একটাই চাওয়া—সাত্যকি মাথা উঁচু করে সম্মান নিয়ে বাঁচুক। ওর মায়ের অসহায়ত্ব ঘুচে যাক। কিন্তু সাত্যকি আমাকে ধোঁকা দিয়েই যাচ্ছে। ও আমাকে বলে, ও পড়ছে। আমিও ওর কথা শুনে এই ভরসায় আছি যে ও হয়ত সত্যিই খুব চেষ্টা করছে। কিন্তু ও যখন একটাও চাকরির পরীক্ষায় পাস করতে পারে না, তখন আমার মনে হয়, এই যে আমি এত অমানুষিক পরিশ্রম করছি, আমার সব চেষ্টাই পানিতে যাচ্ছে। সাত্যকি অনার্স পাস করার পরেই কোনো চাকরিতে ঢুকে গেলে আমি অন্তত একটা সেকেন্ডক্লাস জব দিয়ে আমার ক্যারিয়ার শুরু করতে পারতাম। এখন তো আমার সব দিকই গেল!
ও আমাকে সবসময়ই বলে যে ও আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। আমি জানি, আমার মত সাত্যকিরও সত্যিকারের আপন বলতে কেউ নেই। তবু আমার প্রায়ই মনে হয়, যে ছেলে আমার এমন কষ্টের মূল্য বোঝে না, নিজের জীবন সাজানোর জন্য ঠিকমত পড়াশোনা করে না, সে ছেলের সাথে আমি কীকরে জীবনে সুখি হবো! ও এখন আবার বলছে, ও নাকি ভালভাবে চেষ্টা করেনি আগে। এখন থেকে চেষ্টা করবে। আমি ভাবছি, এর মানে কী? এতদিন তাহলে সে কী করেছে? তামাশা দেখেছে? আমার এই আত্মত্যাগের কি কোনো দামই নেই তার কাছে? আমার এত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা কিছুই কি স্পর্শ করেনি তাকে? যদি করত, তবে কেন সে এতদিন চেষ্টা না করে বসে আছে? যে গরিব, সে তার ক্যারিয়ার নিয়ে ফাজলামো করে কোন সাহসে? আর সাত্যকি তো একই সাথে গরিব আর দুঃখী মানুষ। সে কীকরে ধনী বাবার সন্তানদের স্টাইলে এমন বেহায়ার মতন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়?
আমার মাথায় কাজ করে, আমি যদি বিয়ে করি, তবে এমন ছেলেকেই বিয়ে করবো, যার রূপ থাক না থাক, গুণ আছে। যার ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ হওয়ার মতন। যার মধ্যে মানুষের মানবতা আছে। সে অনেক পড়াশোনা করবে, প্রচণ্ড পরিশ্রম করে নিজের যোগ্যতায় নিজের জায়গাটা করে নেবে। সাত্যকি তো এমন ছেলে নয়! ও সম্পূর্ণই অন্য রকমের। ও কখনোই আমার মনের মত হতে পারবে না। আমি কি ওকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরব? এসব যখন ভাবি, তখন বারবারই সাত্যকির দুঃখী অসহায় মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নিজেকে প্রতারক মনে হতে থাকে। এখন আমি কী করবো?
তিন।
আমার এখন কিছুই আর ভাল লাগে না, বেঁচে থাকতে কষ্ট হয়। জীবনটা কেমন জানি হয়ে গেছে! নতুন কিছু করতে ইচ্ছে করে না, যে ভুলগুলি নিয়ে বেঁচে আছি, সে ভুলগুলি নিয়েই বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। আমার আপন বলতে যা আছে, তা হল আমার ভুলগুলি।
এসএসসি’তে গোল্ডেন এপ্লাস পেয়েছিলাম। ভাল স্টুডেন্ট বলেই সবাই জানে। মা, বাবা, ভাই, বোনের অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। আর একমাস পর আমার এইচএসসি একজাম। কিন্তু আমি যে রকম স্টুডেন্ট ছিলাম, সে অনুযায়ী কিছুই পড়িনি। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে, ভীষণ কান্না পাচ্ছে। একজামের রেজাল্ট খারাপ হলে আমি মরেই যাবো। এখন আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। আবার মরতেও ভয় করছে। গত তিনমাস ভয়ে পড়াশোনাই করিনি। এই একমাসে আমি কী করব, আমি জানি না। মনে হচ্ছে, আমার দ্বারা আর কিছুই করা সম্ভব না। আমি আর পারলাম না, আমি হেরে গেলাম। কিন্তু আমার অনেক স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখি, আমার হতাশাগুলি কেটে যাবে। আমি অনেক বড় হবো। ছোটবেলা থেকে সবসময়ই ফার্স্ট-সেকেন্ড হতাম। কিন্তু এখন আমি কিছুই না, একটা ধূলার সমানও না। পরিবারের সাথে কিছু শেয়ার করতে পারি না। মনে হয়, ওরা সব কিছু শুনলে অনেক ভেঙে পড়বে, আমাকে ভুল বুঝবে। আমার খুব ভয় লাগছে, নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। সামনে মাত্র একমাস। এত অল্প সময়ে আমি কী করবো, কীভাবে প্রস্তুতি নেবো, কিছুই মাথায় আসছে না। এসব ভাবলেই ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। এই ৩-৪ মাস ধরে অসম্ভব যন্ত্রণা আর কষ্ট নিয়ে জীবন কাটাচ্ছি। একটা মুহূর্তও ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে, আমার সব কিছুই শেষ, আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার সব স্বপ্ন, সব আশা, সব ভরসা শেষ। আমি দিনের পর দিন বাবা-মা’কে ঠকিয়েছি, পড়াশোনা করিনি। সামনে অন্ধকার দেখছি। কোথাও আলো নেই, আমার সামনে কোনো পথই খোলা নেই। আমার মতন ব্যর্থ মানুষের মরাই ভাল।
কেউ আমাকে একটুও হেল্প করছে না। খুব অসহায় হয়ে দিন কাটাচ্ছি। আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। সব কিছুই কেমন জানি অসহ্য লাগছে। দম আটকে আসছে যেন! জীবনটা কেমন যেন জটিল হয়ে আসছে, জীবনের একটাও সমীকরণ মিলছে না। গোল্ডেন এপ্লাস না পেলে আমি আত্মহত্যা করব। কী হবে, আমি কিছু জানি না। আমার জীবনটা কত সুন্দর ছিল, সব কিছু কত গোছানো ছিল। আজ সবই এলোমেলো। আমার এমন জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল! কী যে হবে, কী জানি! আমার পরিবারের সবাই কত শিক্ষিত, একমাত্র আমিই কিছু করতে পারব না। এত অসহায় হয়ে গেলাম আমি! আমি জীবনে বড় হতে চাই। এই কথাটা কেউ বিশ্বাস করছে না। যাকেই আমার দুঃখের কথা বলি, সেই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। একসময় আমি কত ভাল স্টুডেন্ট ছিলাম, সব কিছু মুখস্থ ছিল যেন। স্যাররা যা জিজ্ঞেস করত, তা-ই পারতাম। আজ আমি কিছুই পারি না। এখন আমি পড়াশোনা করি না, তবে আমি অনেক পড়াশোনা করতে চাই। তবু পারছি না। আমি কিছুই করতে পারছি না! আমার কেবলই ভয় লাগে। মনে হচ্ছে, এই সুন্দর পৃথিবীটা হয়ত আমার জন্য না। আমার কাছে নিজেকে বাদে সবাইকে সুখি মনে হয়। আমার জীবন থেকে সুখ, শান্তি, স্বস্তি সবই পালিয়ে গেছে!
অনেক স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে আমার, কিন্তু সাহস পাই না। আজকে বুকে অনেক শক্তি সঞ্চয় করে সব স্বপ্নের কথা একএক করে লিখে ফেলতে ইচ্ছে করছে। দুরন্ত সাহসী হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার মতো একজন নোবডির কোনো জায়গায়ই নেই এই পৃথিবীতে। হয়ত এসব লিখে কিছুই হবে না, তবু কিছুটা আত্মতৃপ্তির লোভে যা মনে আসছে, তা-ই লিখে যাচ্ছি। আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে সবাই যে কতটা ইগনোর করে চলে, এখন বুঝতে পারছি। পদেপদে অপমানিত হচ্ছি, সমাজ থেকে সরে এসে দিনদিন অনেকটা অসামাজিক হয়ে যাচ্ছি। টারজান জঙ্গলে একা একটা মানুষ হয়ে বাঁচলেও তার সাথে অনেক পশুপাখি ছিল। কিন্তু আমার সাথে এক স্রষ্টা ছাড়া আর কেউ নেই। আরেক জন অবশ্য আছেন, তিনি আমার মা। আমায় আর কেউ ভালোবাসে না। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকে আয়নার সামনে দাঁড়ালে। তাই জীবনে একটা বড় সিদ্ধান্ত নিলাম। আর কিছু হোক না হোক, ক্যারিয়ার সম্পর্কে আমি যা জেনেছি, সেইটুকু কপিপেস্ট করে দেবো আমার নিজের জীবনে। যা হবার হবে, এভাবে বেঁচে থাকার সত্যিই কোনো অর্থ নেই।
আচ্ছা, যারা বড় হয়, ওরা নিজেকে শাসন করে কীকরে? এই ধরুন, আমার ক্ষেত্রেই বলি, আমি নিজেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না মাঝেমাঝে, প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ আর হতাশা কাজ করে আর আমি আমার কাজগুলো শুরুই করতে পারি না। সামনে পরীক্ষা, কিন্তু আমি নিজেকে শাসন করতে পারছি না! নিজেকে যতবারই মোটিভেট করি, ততবারই আমার মধ্যে হঠাৎ রাগ এসে আমার সব প্লান নষ্ট করে দেয়। এই ধরুন, আজকেও সারাদিন টেবিলে বসে ছিলাম কিন্তু কোনো পড়াশোনা করিনি। আমি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। বাইরে ঠিকই আছি, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে প্রতিনিয়তই নিজের উপর চরম ক্ষোভ জেগে উঠছে। আমি বুঝতে পারছি না, কী ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার আমি নিজেকে শাসন করতে পারি…সক্রেটিসের কথাটার সাথে নিজের কিছু কথা যোগ করে বলতে ইচ্ছে করছে, “Know thyself, punish thyself, enslave thyself!” আমি জানি, আমি যা ভাবছি, তা আমার করা দরকার, কিন্তু আমি জানি না, আমি এটা কীকরে করতে পারবো! প্রায়ই মনে হয়, সব আশা শেষ! আমেরিকান হেভি মেটাল ব্যান্ড Slipknot-এর একটা মিউজিক অ্যালবাম আছে—All Hope Is Gone, আমার ফেভারিট, খারাপ লাগলে গানগুলো হেল্প করে অনেক। যা-ই হোক, নিজেকে ক্রমাগত শাস্তি দিয়ে হলেও আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই। আমি শিওর, আমি পাগলের মত কিছু বলছি না! নাকি বলছি?
চার।
প্রেম নিয়ে আমার পরিবার অনেক কনজারভেটিভ। প্রেম করা যাবেই না, অনেক কড়া শাসন এ ব্যাপারে। কড়া শাসনের ফ্যামিলির মেয়েরা অতি দ্রুত প্রেমে পড়ে। এত শাসন থাকার কারণেই হোক, আর অন্য কোনো কারণেই হোক, আমার দুটো রিলেশন হয়েছে। প্রথমটি ক্লাস নাইনে পড়ার সময়। ছেলেটির বাসা ছিল আমার বাসার পাশেই। বাসার পাশে হওয়ার কারণে বাসায় সব জানাজানি হয়ে যায়। এরপর মা অনেক মারধর করে, আমাকে বুঝিয়েশুনিয়ে ওই ছেলের কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে নেয়। মার খাওয়ার ভয়ে আমি আর কোনোদিনই ওই ছেলের সাথে কোনো কথা বলিনি। আমার ছোটবেলার প্রেম ওখানেই শেষ। কিন্তু ঘটনা হল, ওই ছেলে এখনো আমাকে ভালোবাসে, আমার মোবাইল নাম্বার যোগাড় করে আমাকে এখনো মাঝেমধ্যে কল দেয়। যখনই বুঝতে পারি, সেই ছেলে কল দিয়েছে, তখনই সাথেসাথে নাম্বার ব্লক করে দিই।
যা-ই হোক, সেকেন্ড রিলেশনটা ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার থেকে। ফার্স্ট ইয়ারে সে ছেলে আর আমি পরস্পরের ফ্রেন্ড ছিলাম, পরে ফ্রেন্ডশিপ থেকে রিলেশন। ও দেখতে শুনতে ভালই। আমরা একই বয়সি। সব কিছু ভালই চলছিল। ইন্টার একজাম দিলাম। আমিও, সেও। স্টুডেন্ট ভালই ছিলাম, কিন্তু প্রেম করতে-করতে কখন যে সেকেন্ড ইয়ার পার হয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি। যা-ই হোক, রেজাল্ট প্রত্যাশার চাইতে খারাপ হল। আমারও এ, তারও এ। এখন এ পাওয়াটা বলার মত কিছু না। গাধা, গরু, ছাগল, ভেড়া সকলেই এ পায়। তারপর মায়ের ইচ্ছেয় মেডিক্যাল কোচিং-এ ভর্তি হলাম। ওদিকে আর সে আইইএলটিএস করবে, অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে। আমি কোচিং করেছি শুধু নামেই, কোনো কিছুই মন দিয়ে পড়তাম না। সারাক্ষণই শুধু ওর সাথে কথা আর ঘোরা, আর রাতজেগে চ্যাটিং, রাতদিন ওর সাথে কথা বলেই সময় কাটিয়েছি। ওর নাম কৌস্তভ রহমান।
মেডিক্যাল একজাম দিলাম, হল না। বাসায় বলল, সেকেন্ড টাইম পরীক্ষা দিতে। আবারো ভর্তি হলাম কোচিং-এ। এদিকে সেও আইইএলটিএস-এর জন্য কোচিং-এ ভর্তি হল। আমার সেকেন্ড টাইমেও হল না। সে আইইএলটিএস পরীক্ষা দিল, স্কোর চলে এল ৭। সে অস্ট্রেলিয়াতে চলে যাবে, কাগজপত্র রেডি করতে যতদিন লাগে, মাত্র ততদিন বাংলাদেশে আছে।
আমার এসএসসি ১৩’তে, এইচএসসি ১৫’তে। ’১৫-এর প্রথম থেকেই তার সাথে রিলেশন, ২০১৬’তে এক বছর গ্যাপ ছিল। তার তিন বোন, আমার ফ্রেন্ড, তার ফ্রেন্ড, সবাইই জানত আমাদের রিলেশনের কথা। এমন-কী তার বাসায়ও জানত, কেবল আমার বাসায় কেউ কিছু জানত না। তার মেয়ে ফ্রেন্ড ছিল দুইজন। কুহু আর মুখর। ও আমায় বলেছিল, আমার আগে কুহুর প্রতি তার এক ধরনের ভাললাগা কাজ করত, যেটা এখন আর নেই। তো আমি এটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম। মুখরের প্রতি তার কোনো ফিলিংস নেই, কিন্তু মুখর তাকে পছন্দ করত, এটাও আমি তার কাছ থেকে শুনেছিলাম। তো আমি ভাবলাম, তার প্রতি কারো ভাললাগা থাকতেই পারে, এটা কোনো ব্যাপার না। এসব কথা সে আমায় বলেছিল আমাদের রিলেশনের শুরুর দিকে। আর এদিকে আমার ছেলেফ্রেন্ড বলতে ফেসবুকেই টুকটাক, দুইজন ছিল রিয়েল লাইফে, কিন্তু আমার রিলেশন হওয়ার পর তাদের সাথে আর অতোটা কথা হয় না, এজন্য একসময় তাদের সাথে একটা গ্যাপ তৈরি হয়ে গেছে। মানে, আমার জীবনে ছেলে বলতে এক কৌস্তভই!
এরপর ২০১৭। কোথাও চান্স পেলাম না, অগত্যা আব্বু-আম্মু ধরে নিয়ে একটা প্রাইভেটে ভর্তি করিয়ে দিল। ওদিকে তার ডকুমেন্ট রেডি হচ্ছে, সব হয়ে গেলেই সে বাইরে চলে যাবে। জানুয়ারির ৬ তারিখ আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, দুএকদিনের মধ্যে তার সব ডকুমেন্ট রেডি হয়ে গেল, তার ফ্লাইট ২৯ তারিখ। যাওয়ার দুইদিন আগে সে আমায় একটা মোবাইল ফোন উপহার দেয় যাতে আমি তার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারি, এর আগে আমি একটা নরমাল মোবাইল ইউজ করতাম। যাওয়ার আগে কয়েক মাস সে তার ফ্রেন্ডদের সাথে প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছে, আমাকে সময় দেয়নি বললেই চলে। মাঝেমধ্যে তার মোবাইলে মুখরের সাথে ছবি দেখতাম। সে মুখরের সাথে বের হয়েছে, অথচ আমি জানি না, জিজ্ঞেস করলে বলত, “আরে! আর বইলো না! হুট করে কল দিসে, আমি ফ্রি ছিলাম, তাই চলে গেসি! ভাবসি, তোমাকে পরে বলব, কিন্তু আর বলা হয় নাই।” এই জাতীয় কথাবার্তা। তো আমিও সব বিশ্বাস করতাম। ও যা বোঝাতো, তা-ই বুঝতাম।
সে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল ২৯ জানুয়ারিতে। যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে সে আমাকে বলল সে নাকি আমাকে আর ভালোবাসে না। আমি তো কোনোমতেই ওর কথা বিশ্বাস করছিলাম না! কী বলে ও! মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! আইইএলটিএস কোচিং করার সময় সে যখন অস্ট্রেলিয়ার ভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করে, তখন কী কারণে জানি তার আবেদন ভার্সিটি রিজেক্ট করে দেয়। সে ভাবল তার হয়ত আর যাওয়া হবে না, তার লাইফ শেষ, সে জীবনে আর কিছুই করতে পারবে না, সে আমাকে বিয়েও করতে পারবে না, তাই সে আমার সাথে ব্রেকাপ করতে চেয়েছিল। পরে সে নিজেই আবার ফিরে আসে এটা বলে যে আমাকে ছাড়া নাকি সে বাঁচতেই পারবে না, সে লাইফে কিছু না কিছু তো করবেই, আমি যেন তার পাশে থাকি। প্রয়োজনে আমরা দুইজন শাকভাত খেয়ে গাছতলায় একসাথে জীবন কাটিয়ে দেবো। এরপর সে আরেক ভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করে, তখন তার আবেদন অ্যাক্সেপ্টেড হয় আর সে ফাইনালি চলেও যায়।
যা-ই হোক, এ নিয়ে দ্বিতীয়বার সে আমায় বলল, ভালোবাসে না, ব্রেকাপ করতে চায়। আমি তো শুনে প্রথমে ভাবলাম, নতুননতুন বিদেশ গেছে, অনেক ঝামেলার মধ্যে আছে, তাই হয়ত এমন বলছে। আমি ওর কথা বিশ্বাস করিনি। করিনি মানে করিইনি। নানান কথা বলতেবলতে একসময় সে বলে, হ্যাঁ, ভালোবাসি তোমাকে, কিন্তু আমার একটা ব্রেক দরকার, আমি রিলেশনের রেসপনসিবিলিটি নিতে পারব না এখন, আমার দিকে আমার ফ্যামিলি তাকিয়ে আছে। আমার নিজের পড়ার খরচ আমার নিজেকে যোগাড় করতে হয়, জীবন কী জিনিস, আমি এখানে এসে বুঝতে পারছি। তোমার সামনে রেডিমেড ভাতের প্লেট চলে আসে, আমার সামনে ভাত দূরে থাক, খালি প্লেটটাও আসে না। এমন অনেক দুঃখের কথা সে আমাকে শোনালো। তো বললাম, কী চাও এখন? আমি কী করব? উত্তরে সে বলে, ভালো তো বাসিই তোমাকে, কিন্তু আমার এখন একটা ব্রেক দরকার। জিজ্ঞেস করলাম, কত দিনের ব্রেক? বলল, এক বছরের।
এক বছর শুনে আমি তো শেষ! আমি কীকরে থাকব! এতদিন কথা না বলে থাকা তো সম্ভব না! পরে ও আমাকে বলে, তুমি আমার সিচ্যুয়েশনটা বুঝতেই পারো না, কী আর ভালোবাসো আমাকে! আমি যে একটা ব্রেক চাচ্ছি, তাও দিতে পারবে না! এরপর সে আমায় আবারো বুঝালো। বলল, এক বছরই তো! দেখতে-দেখতেই কেটে যাবে। এক বছর পর আজকের দিনে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ সে বলল, ভালোবাসে না; আবার দুইদিন পরই ১০ তারিখ বলল, ভালোবাসে, কিন্তু তার একটা গ্যাপ দরকার। এই দুইদিন আমি ঘুমাতেই পারিনি। ঘুমের মাঝখানে জেগে উঠতাম, বাথরুমে গিয়ে কাঁদতাম।
যত যা-ই হোক, আমার বিশ্বাস, সে আমাকে ভালোবাসেই! কারণ পরপর দুইবার সে আমার সাথে ব্রেকাপ করতে চেয়েও নিজেই থাকতে পারেনি বলে ফিরে এসেছে। তো আমাদের গ্যাপ শুরু। আমি ভার্সিটি যাই আর আসি, কোনো কিছুতেই আমার মন বসে না। তার সাথে কথাবলা বন্ধ হল ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে। তিনদিন পর ১৪ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে তার পোস্ট দেখি, সে কোথায় যেন ঘুরতে গেছে। দেখে আর থাকতে পারিনি, তাকে মেসেজ দিয়ে ফেলি। সে আমায় বলে, প্লিজ, তুমি এমন কোরো না, গ্যাপটা আমার খুব দরকার। একটু সময় দাও আমাকে, সব কিছু গুছিয়ে নিই। এরকম তিনদিন পরপর আমি মেসেজ দিতাম, চুপ করে থাকতে পারতাম না। সে বলে, এটা কী হচ্ছে? আমি তো একটা গ্যাপ চেয়েছিলাম। তুমি তো আবোলতাবোল বকেই যাচ্ছ! তখন আমি কান্না করেকরে ওকে বললাম, আমি পারি না তোমাকে ছাড়া থাকতে। আমি কী করবো! এরপর সে বলে, আচ্ছা, যাও! ১৫ দিন পরপর কথা বলব আমরা। আমি আবারো রাজি হলাম। কিন্তু ১৫ দিন পার হতে পারত না, আমি ৮-৯ দিনের মধ্যে আবারো মেসেজ পাঠিয়ে বসতাম। আমাদের কথা হত হোয়াটস্অ্যাপে। যেদিন ও বলেছিল এক বছর গ্যাপের কথা, সেদিনই ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিয়েছিল।
তো এভাবে কয়দিন পরপরই মেসেজ দিতাম আমি। এমনি করে দুইমাস কাটল। ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ সে ব্রেক নিল, মার্চ আর এপ্রিল কাটল এরকম কয়দিন পরপর মেসেজ দিয়েদিয়ে। তারপর মে’র ২ তারিখ সকালে দেখি তার আইডি আবারো অ্যাক্টিভ। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আইডি অ্যাক্টিভ করলে, একবার বললেও না? সে বলে, এটা বলার কী আছে? সব কিছু তোমাকে বলেবলে করতে হবে নাকি? তো এরকম কথা কাটাকাটি হতেহতে এক পর্যায়ে সে বলল, আমি তোমাকে আর ভালোবাসি না।…আরেকটা কথা। আগেরবার সে যখন বলেছিল যে সে আমাকে আর ভালোবাসে না, তখন আমি ওকে বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম সে অন্য কাউকে ভালোবাসে কি না। সে উত্তর করেছিল, না। কিন্তু এইবার সে বলল, হ্যাঁ, আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। আমি এটা শুনে অনেক হেসেছি। ভেবেছি, আমাকে সরানোর জন্যই ও আবার এমন বলছে। তো আমি হাসতে-হাসতেই জিজ্ঞেস করলাম, কাকে ভালোবাসো? ও বলল, মুখরকে। ‘মুখর’ নামটা শুনে আমার আরো হাসি পেল, কারণ ও আমায় বলেছিল, ওর কুহুকে ভাল লাগত একসময়, ওটা ছিল স্রেফ ভাললাগাই। আর মুখরের প্রতি তো ওর ওরকম কোনো অনুভূতি কাজ করত না, বরং মুখরই ওকে পছন্দ করত।
আমি ওর কোনো কথাই বিশ্বাস করলাম না। কিন্তু বিশ্বাস না করতে না করতে দুই-তিনদিনের মধ্যেই বুঝলাম যে ও যা বলেছে, তা সত্যি। মুখরকে মেসেজ দিলাম। ওই মেয়ে বলে, আমি অনেক আগেই জানতাম কৌস্তভ একটা মেয়েকে পছন্দ করে, এখন জানি, সে মেয়েটা আমি। তো, তোমার কী সমস্যা? আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মুখরের সাথে কিছুক্ষণ ঝগড়া করলাম। পরে ও আমাকে ব্লক করে দিল। এরপর আমি কৌস্তভের সব ফ্রেন্ডকে এটা জানাই, ওদেরকে সব কিছু খুলে বলি। ওর ফ্রেন্ডরা ওর সাথে কথা বলে আমাকে জানাল, কৌস্তভ যা বলেছে, সব সত্যি। ওর সাথে আসলেই মুখরের অ্যাফেয়ার হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার মাত্র ১৫ দিন পর থেকে যে কাহিনি শুরু হয়েছিল, তার শেষ হল মে’র ৫ তারিখ। ওকে আমি সব কিছু থেকেই ব্লক করে দিলাম। ও যাওয়ার পর যে আমি কী অবস্থার মধ্যে ছিলাম, কেউ চোখে না দেখলে সেটা বিশ্বাস করবে না। নাওয়াখাওয়া নাই, কবে যে তাকে মেসেজ দিব, তার সাথে একটু কথা বলব, এমন চিন্তায় থাকতাম সবসময়ই। কখন যে এক বছর শেষ হবে, সেটা ভাবতাম সবসময়ই। সারাক্ষণই ওর জন্য কাঁদতাম আর দোয়া করতাম।
পরে ওর এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করে ওর কাহিনি শুনলাম। কৌস্তভ দেশে থাকতেই ওদের দুইজনের রিলেশন প্রায় হয়ে গেছে। মুখরকে কৌস্তভ বলে গেছে তার জন্য অপেক্ষা করতে, যেটা সে আমাকেও বলে গিয়েছিল। সে আমাকে যা যা বলেছে, মুখরকেও তা তা বলেছে। যাওয়ার আগে কয়েকমাস ওরা দুইজন অনেক ঘোরাঘুরিও করেছে। আমি জানতাম, কৌস্তভ বন্ধুদের সময় দিচ্ছে, কিন্তু সে যে মুখরের সাথে সময় কাটাচ্ছে, তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। রিলেশনে থাকার সময় আমার কখনোই মনে হয়নি, সে আমায় ভালোবাসে না। আমার জন্য সে অনেকবারই আমার সামনে কান্নাকাটি করেছে। কৌস্তভকে দেখে বুঝেছি, ছেলেরাও খুব সহজে মিথ্যে কান্না কাঁদতে পারে। মুখরের আগেও একটা রিলেশন ছিল। অনেক ঘনিষ্ঠ ছিল ওরা। সেই ছেলে আবার কৌস্তভেরই ফ্রেন্ড। ওই রিলেশনের কথা আমরা সবাই জানতাম। আর সেই মুখরের সাথেই কিনা ও রিলেশন করছে গত এক বছর ধরে!
ওর ফ্রেন্ডরা আমাকে বলে যে মুখর কৌস্তভের সাথে রিলেশন করছে শুধু ও অস্ট্রেলিয়া গেছে বলেই। মুখরের স্বপ্ন, কৌস্তভকে বিয়ে করে সেও অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে। আমি কৌস্তভের জীবনে আসার আগে থেকেই মুখরের সাথে ওর বন্ধুত্ব ছিল। মুখর ওকে অনেক পছন্দ করত, কিন্তু ও ততটা করত না বলে তখন ওদের মধ্যে কিছু হয়নি। আমার এখন প্রায়ই মনে হয়, ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ওই যে ছেলেটাকে বাবা-মায়ের জন্য কষ্ট দিয়ে ওর জীবন থেকে চলে আসি, ওই ছেলের কষ্টের জন্যই আমি আজ সব কষ্ট সুদেআসলে ফেরত পেলাম। বাসায় এখন আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমি বারবারই নানান অজুহাতে বিয়ে ভেঙে দিই, কারণ আমি কিছুতেই কৌস্তভকে আমার মন থেকে সরাতে পারছি না। অনেক কেঁদেছি। কাঁদতে-কাঁদতে এখন আর কান্না আসে না, কেবলই আফসোস আসে। মনে হয়, সব তো আমারই দোষ! নিজের দোষেই নিজের জীবনটা শেষ হয়ে গেল! এমন একটা ফালতু রিলেশনে না জড়ালে ইন্টারের রেজাল্টটাও ভাল হত, হয়ত মেডিক্যালেও চান্স পেতাম। মেডিক্যালে না হোক, অন্তত কোনো পাবলিক ভার্সিটিতে হলেও তো পড়তে পারতাম!
বাসায় কোনো ছেলের কথা বললে কাউকেই পছন্দ হয় না আমার। কেবলই মনে হয়, ওর চাইতে বেটার কাউকে লাগবে আমার। নাহয় বিয়েই করবো না। এরকম একটা মানসিকতা হয়ে গেছে আমার। আমি কিছুই বুঝতে পারি না। কেন আমার সাথেই এমন হল? আমার তো কোনো দোষ ছিল না! আমি তো শতভাগ সৎ ছিলাম ওর প্রতি! আমার সব বিশ্বাস ভেঙে গেছে। কাউকেই আর বিশ্বাস করি না আমি। আবার কখনো-বা মনে হয়, আচ্ছা, কৌস্তভ যেমন, তেমনই তো থেকে যাবে। বিয়ের পরও ও মাল্টিপল রিলেশনে জড়াবে। আমি তো সেটা মেনে নিতে পারব না। ওকে বিয়ে করার পর যদি এসব ঝামেলা হত, তখন তো আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা থাকত না সামনে। যা হওয়ার, তা আগেই হয়ে গেল। এ-ই তো ভাল! যখন আঘাত সামলে নেয়ার সময় কিংবা সুযোগ, কোনোটাই থাকে না, তখন আঘাত পাওয়ার চাইতে বরং আগেভাগেই আঘাতটা পেয়ে যাওয়া অনেক ভাগ্যের।