চাই এক, পাই আরেক

আপনি জীবনে যতই শক্ত শক্ত প্ল্যান করুন না কেন, বিশ্বাস করুন, জীবন কখনোই আপনার প্ল্যান অনুযায়ী চলবে না। জীবন জীবনের প্ল্যানেই চলে।
 
ছোটোবেলায় হয়তো হতে চেয়েছিলেন শিল্পী, কিংবা চষে বেড়াতে চেয়েছিলেন মাউন্ট এভারেস্ট। কখনোবা টুংটাং করে রাতবিরাতেই বাজাতেন গিটার, সুর তুলতেন বাঁশিতেও। ভেবেছিলেন এমন কত-কী!
 
স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্নের মানুষটিকে নিয়ে ঘর করবেন সারাজীবন। অথচ দেখা যাবে, বিধাতার বিধিলিপিতে মানুষটি অন্য কারও ঘর করবে সুখে, আপনিও দিব্যি ঘর করবেন অন্য কারও। দু-জনই ভালোই থাকবেন। ঠিকই মিস করবেন প্রিয় মানুষটাকে, কিন্তু জীবন তেমন খারাপ কাটবে না। মানুষ একজনকে মিস করতে করতেও আরেকজনের সাথে ভালো থাকতে পারে।
 
সরকারি বড়ো চাকুরে হতে চেয়ে হয়তো হয়ে বসবেন বড়ো কর্পোরেট লিডার।
টুংটাং করে সারাদিন গিটার বাজিয়ে সুর তুলে ব্রেথলেস-গাওয়া আপনি মানুষটা হয়তো একদিন হয়ে যাবেন ব্যস্ততম ব্যবসায়ী, যার হাতে ব্রেথ নেবার সময়টুকুও থাকবে না।
 
দেয়ালজুড়ে তুলিতে তুলিতে জীবনকে নানান রঙে রাঙিয়ে তোলা আপনি মানুষটাই হয়তো চাকরির অভাবে নিজের জীবনের রংটাই ভুলে যাবেন। ফ্যাশন-ডিজাইনার হবার স্বপ্ন-দেখা আপনি মানুষটা হয়তো নিজের ভাগ্যটা ডিজাইন করারই সুযোগ পাবেন না। বাঁচতে একটা অবলম্বন লাগেই। একটা অবলম্বন থাকলে বাঁচতে মানুষ ঠিকই পারে।
 
যত যা-ই প্ল্যান করুন না কেন, বিশ্বাস করুন, জীবন কখনোই আপনার সূত্র অনুযায়ী চলবে না—অত ভাববেন না, কারও বেলাতেই চলে না।
 
হয়তো যুগ যুগ অপেক্ষা করে পরিশ্রম করেছেন নিজের একটা বাড়ি করে সেখানে বাবা-মা’কে রাখবেন ভেবে। হয়তো বাবা-মা বাড়ি দেখার আগেই পৃথিবী ছেড়ে যাবেন, নয়তো বাড়ি হবার আগেই আপনিই ছেড়ে যাবেন এ দুনিয়া। কে কবে চলে যাবে, কে বলতে পারে!
ওরা ট্রেনে আগুন দিল; ছোট্ট পরিবারটির তিনজনই পুড়ে মরল। স্বপ্ন তো সেই মানুষটার‌ও ছিল, যাঁর নিথর দেহ ট্রেনের জানলাতে আটকে ছিল। স্ত্রী-সন্তানের সাথেই সহমরণে যেতে হলো যাঁকে, তিনি নিশ্চয়ই স্বপ্ন-দেখার কঠিন দায়ে কোথাও পালাতে চাননি! পালাতে তবু তো হলো! অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস দেখুন…ঘর‌ও গেল, ঘরের কর্তাও গেল। অমানুষের ঘর কিনা বিধাতা বাঁধে, আর মানুষের ঘর কিনা শয়তান ভাঙে! এসবের ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে সুস্থ থাকতে কিছুতেই পারি না। একটা ঘর শেষপর্যন্ত টিকে আছে—এটা পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্য। মানুষ হয়ে বাঁচতে চাওয়ার একটাই ট্র্যাজেডি: শেষমেশ মানুষেই বিশ্বাস রাখতে হয়।
 
হতে চেয়েছেন ক্রিকেটার, ফুটবলার কিংবা বিজনেসম্যান। হয়তো জীবন আপনাকে বানিয়ে দেবে দিনে ১২/১৫ ঘণ্টার শক্ত শিডিউলের ব্যস্ত কর্মজীবী মানুষ।
 
দেশ-বিদেশে ঘুড়ির মতন ঘুরে বেড়াবেন স্বপ্ন-দেখা আপনি মানুষটা হয়তো একদিন অফিস-বাসা আর বাসা-অফিস করতে করতে পাশের খেলার মাঠটাতে পর্যন্ত ঘোরার সুযোগ পাবেন না। দিন ওভাবেই কেটে যাবে, ব্যস্ততায় টের পর্যন্ত পাবেন না!
 
বিশ্বাস করুন, এমনটাই হয়। আমরা যা চাই, কখনোই তা হয় না। হয় তারও বেশি কিছু হয়, নয় তার ছিটেফোঁটাও কিছু হয় না। ঘরে আগুন, বাইরে আগুন…আপনিই বলুন, বেঁচে থাকতে তখনও ইচ্ছে করে মানুষের! তবু মানুষ বাঁচে; বাঁচলেই মানুষকে মানুষ বলে।
 
জীবনটা আদতে সাপলুডু খেলার মতন। কে যে কখন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাবে, কে যে কখন সাপের মুখে পড়ে সর্বোচ্চ জায়গা থেকে একেবারে তলানিতে নেমে যাবে, তার কোনো গাছপাথর নেই। তবুও চলবে জীবন, যেমনি করে ছুটে চলছে গতিপথ-হারানো নদীটিও।
 
যখন যা হবার হবে! যতটুক হ‌ওয়াতে পারেন, ততটুক হ‌ওয়ান—ভালোভাবেই হ‌ওয়ান। এটুকুই আপনার কাজ। অত ভেবে কী হবে! ভাবলে যদি কিছু হতোই, তাহলে তো মানুষের এত এত দুঃখ থাকত না!