কুঞ্জ (১)


আজ ২৩ মে ২০১৪।

শেষরাতের খানিকটা এখনও বাকি . . .
বাতাসের মনটা আজ ভারী; কেন, তা ভাবার সময় এখনও আসেনি। কী ভীষণ বর্ষণে
আকাশের হৃদয়ক্ষরণ ঝিরিঝিরি হাওয়াতে মেশে চুপচাপ, চাঁদের জ্যোৎস্না ছিড়ে গেলে একটা রাত গোছাবার আয়োজন . . .
এখানে গভীর রাতে তক্ষক ডাকে, এ-গাছে ও-গাছে তার নিঃসঙ্গতার বন্দনা পাতায় পাতায় বাজে!

২৫ মে ২০১৪।

ভোর ছয়টা থেকে সন্ধে ছয়টা, আলো-হাওয়ায় আমার ক্ষীণ জীবনের আরেকটা দীর্ঘ দিন।
কাঁধের ঝোলাটা আমার কখনও ভারী মনে হয়নি, বরং মাথাটা সবসময় হালকা থাকত; কারণ ওরা শুধু বই-খাতা নয়, ঝোলাভর্তি আমার ভালোবাসা!

ভালোবাসা কখনও ভারী হয় না, ভালোবাসা শুভ্র পালকের মতো; যার ছোঁয়া আদর দিয়ে যায়, উন্মাদনা নয়।

পয়লা জুলাই ২০১৪

উঃ, আজ আর সময়ের সঠিক ঠিকানাটা লিখব না।
সময়…সময় বড্ড বেয়াড়া অসময়—মাছের মুড়ো কি ছাই, কুমড়োর ঘ্যাঁট!
…সময়ের বন্দনা অকারণ যন্ত্রণা হয়ে উঠছে ক্রমশ।
সময়ের ঠিকানা আজ অসময়ের গহ্বরে তলিয়ে গেছে।

দিনক্ষণ, তারিখ, ফোননম্বর…এককথায়, সংখ্যাজাতীয় কোনো কিছুই আমি মনে রাখতে পারিনে।
এ বড্ড ক্লান্তিকর মানসিক শ্রম মনে হয় আমার কাছে!
বন্ধুরা এ নিয়ে প্রায়শই হাসিঠাট্টায় মাতে। সহাস্যে ওরা বলতেও ছাড়ে না,
তোর কখনও কারও সঙ্গে প্রেম হবে না রে…প্রেম করতে হলে, প্রিয়-তম বা তমার জন্মদিন, প্রথমদেখা হবার দিন, প্রেম নিবেদনের দিন, এসব মনের ফটকে সাইনবোর্ডের মতন যত্নে ঝুলিয়ে রাখতে হয়।

এ কী জ্বালা! অত দায় মাথায় নিয়ে বাঁচা যায়!
জীবনে কখনও রুলস পড়ে গ্রামার শিখিনি, আর এবেলায় এসে রুলস মেনে প্রেম করব!
উচ্ছে ভাজায় কেউ ঘি ছেটায় না রে, বাবা! আমি বরং পালাই...

প্রেম করা একটা অকাজ বই আর বিশেষ কিছু নয়।...হ্যাঁ, এটা একান্তই আমার নীতি।
প্রেম—যার যার দর্শনে তার তার ব্যঞ্জন। এ নিয়ে আমার স্বাদ-বিস্বাদ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।
অমন প্রেম তো আমি করব না; আমি বরং ভালোবাসব…আদর, স্নেহ মাখিয়ে গড়াগড়ি খেয়ে ভালোবাসব।

বরং দূর থেকে ভালোবাসব। ভালোবাসার মানুষের খুব কাছে যেতে হয় না, শুধু গোপনে তার গহিনে লুকিয়ে থাকতে হয়।
তখন দেখবে, আজন্মের প্রেমে কখনও দাঁড়ি পড়বে না।
ভালোবাসি বলে ভালোবাসার মানুষটাকে চেপে ধরতে নেই, আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাকে আনন্দে বাঁচতে দিতে হয়;
দেখবে, ভালোবাসা কেমন আজন্ম অবিচ্ছিন্নতার গান শোনাবে, সুর জাগাবে।
মানুষ হারায় না, কেবল মনটাই হারিয়ে যায়।

দিনক্ষণ মেপে ভালোবাসতে হবে কেন? ওটা তো শাস্ত্রপাঠের মতন কিছু নয়!
শাস্ত্রপাঠে ভক্তি থাকে, ভয় থাকে, চাহিদা থাকে এবং বাধ্যতাও থাকে…ওতে ভালোবাসা থাকে কি?
ভালোবাসা তো সরল, স্বচ্ছ। ওতে ফর্দের কোনো প্রয়োজন নেই।
ওরা জানেই না, এক পাতে দই-লঙ্কা সবাই রাখে না।
যদি কখনো ভালোবাসি, তবে আত্মজ কাউকেই বাসব।

যাকগে!
আজ একটা বিশেষ দিন ছিল, যা চুপচাপ অজান্তেই চুপসে গেল। উঁহু, আমার জন্য এই দিনটা হয়তো এখনও সেভাবে বিশেষত্বের ছাপ রাখতে পারেনি;
মাথার ভেতরে পোকাগুলো কেমন বেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে—বুদ্ধি এত খাটিয়েও এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারিনি।

কোনো কিছু বিশেষ হয়ে ওঠা মূলত ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে।
যেমন ধরুন,
কাউকে ভালো লাগে, তার বিশেষ কোনো দিনে তার আনন্দ দেখতেও ভালো লাগে; কিন্তু সেটা আমার কাছে বিশেষত্বের ছাপ রাখে না।
বা, অমুককে আমার ভালো লাগে না, তার বিশেষ দিন আমার গণনার ভেতরেই পড়ে না।
আবার, অন্য একজন, যে আমার ভালো ও খারাপ লাগার কোনো ক্ষেত্রেই পড়ে না, তারও যে কোনো বিশেষ দিন থাকতে পারে, ওটুকুও আমার মাথায় আসে না।
আর যাকে বিশেষ ভালো লাগে, নিজের জীবনের কোনো-না-কোনো ভাঁজে বা খাঁজে তার জায়গাটা বেশ গভীর;
যে-কোনো কিছুর চাইতে যার গুরুত্বের পাল্লাটা ভারী, তার প্রত্যেকটা দিনই মনে হয় বিশেষ দিন, সে খুব সাধারণ কথা বললেও মনে হয়, এর মাঝেও বিশেষ কিছু আছে!

না, না, যা ভাবছেন...মানে এমনটা হতেই হবে, তা অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।
বিশেষ মানুষ মাত্রেই প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা নয়।
বলি, এত সরষে-মাখা ঝাঁঝালো চিন্তা আসে কীভাবে!
আবরণ সরিয়েও মাঝে মাঝে জীবনকে দেখতে হয় যে!

দেখবেন, অনেক প্রেমিক বা প্রেমিকা ওদের প্রেমিক বা প্রেমিকার কাছে বিশেষ কেউ নয়।
তার যে পোষা বেড়ালটা, কোয়েলের সদ্য-জন্মানো ছানাটা,
বাগানে নতুন অলকানন্দার কলিটা, খুব পছন্দের বইটা বরং প্রিয় মানুষের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ! এবং, এতে স্বাভাবিকত্বের সব ছোঁয়াই আছে, তাই এটা দেখতে বড়ো সুন্দর।

ভালোবাসা বরং সহজ হোক, ভালোবাসায় বরং লুকোনোর কিছু না থাকুক।
ভালোবাসার মানুষটা বরং ঘর হোক।

যা-ই হোক, এত সমীকরণ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এর আল ভেঙে হাঁটার দায়টাই-বা আমায় কে দিল!
আমি কেন তা ভাবছি, যা ভাবার মানুষই আমি ন‌ই!
আজকের বিশেষ দিনের ব্যক্তিটি, আমার বিশেষ ভালো লাগে, এমনই একজন।
লোকটা আমার…
উঁহু, লিখতে যখন বসেছি…সবচাইতে সুন্দর কিছু-একটা বা শুধুই…ঘর, তখন
বড্ড স্নেহমাখা শব্দটাই তাঁর জন্য তুলে রেখেছি…কুঞ্জ!

১২ নভেম্বর ২০১৪।

পড়াশোনাটা বোধ করি মগজে-মননে গেড়ে বসেছে। সময়ের কাঁটায় কাঁটায় চলা, আমার যান্ত্রিক জীবনের অন্যতম একটা অংশ।
না, এই যান্ত্রিক জীবনটা যাপন করতে আমার কোনো অসুবিধে হয় না, বরং ভালোই লাগে।
যান্ত্রিক জীবনের বেশ কিছু ওষধি গুণাগুণ আছে;
এই যেমন ধরুন, যান্ত্রিক মানুষের আশেপাশে মানুষ খুব একটা ঘেঁষে না, মূলত ঘেঁষে তৃপ্তি পায় না।
বেশিরভাগ মানুষ যেটা চায়, সেটা হচ্ছে—নিজের ব্যক্তিগত জীবনের জঞ্জালের সঙ্গে পাড়া-মহল্লার কেচ্ছা বিশদভাবে বর্ণনা করতে এবং নিজে বিচারকের আসনটা অলংকৃত করতে; ঠিক এই জায়গাটাই তারা যান্ত্রিক মানুষের কাছে পায় না।

আপাতদৃষ্টিতে সব যান্ত্রিক মানুষ বস্তুত যান্ত্রিক নয়; তফাতটা এ-ই যে, তাদের একটা নির্দিষ্ট নিজস্ব জীবনধারা থাকে, নিভৃতে একটা জগত থাকে।
দুয়েকজন খুব আপন মানুষ থাকে, অমূল্য দুয়েকটা সম্পর্ক থাকে—যা কয়েকজনম সাধনা করেও মানুষ পায় না।
বেশ অদ্ভুত কিছু শখ থাকে, ইচ্ছেগুলোও কেমন অদ্ভুত হয়।
প্রায়শই দেখবেন, তাদের কাজকর্ম, কাজের ধরন আপনি কারুর সঙ্গে মেলাতে পারছেন না।

সবার প্রথমে যে-কথাটা আপনার মাথায় আসবে, সেটা হচ্ছে, “এ নিশ্চয়ই পাগল!”
সৃজনশীল মানুষ মাত্রেই পাগল, সৃজনশীল মানুষ মাত্রেই যান্ত্রিক, এতে কোনো দ্বিমত নেই।
তাদের চিন্তাধারা, ভাবনার স্তর বেশ স্বচ্ছ ও কুটিলতামুক্ত, তবে খানিকটা জটিলও হয় বটে!
আর তারা খুব ভালো ‘না’ বলতে পারে, এটা কিন্তু ভাবনার জন্য বিশেষ মাত্রা রাখে।

যান্ত্রিক মানুষ চেনার আরেকটা উপায় হলো, তারা খুব মেপে মেপে কথা বলতে জানে, দাঁড়ি-কমার এপার-ওপার হয় না। অসম্ভব দুর্ভেদ্য গম্ভীরতার পোস্টার চোখে-মুখে, চলনে-কথনে ছেয়ে থাকে।
তবে যে-মানুষটা তার প্রাণের মানুষ, তার কাছে সে সবচাইতে বাচাল হতে জানে; হতে জানে সবচাইতে সরল, ঠিক যেন অপ্রাপ্ত বয়সের কোনো শিশু।

এর কারণ হতে পারে—সুন্দরী মার্জারী লুনা পাস্তুরের পতিদেবতা মিস্টার স্নিফেন ব্যাটের দ্বিতীয় স্ত্রী হতে চাওয়া,
কিংবা গাছের ফাঁকে-ফোঁকরে মা পাখির লুকিয়ে তার ছানাদের বনরুটি ভিজিয়ে খাওয়ানো,
প্রেম নিবেদিত ফুলের পাপড়ি ছিড়ে, দু-দাঁতের ফাঁকে ফেলে চিবিয়ে এর স্বাদ বিশারদ হয়ে ওঠা,
চিনির সিরায় ডোবানো তুলতুলে গুটিকয়েক মিষ্টি তুলে, গ্লাসের জলে চুবিয়ে, চিনির সর্বশেষ কণা-সদস্যকেও বিদেয় করে…তবেই খাওয়া!