আজ তোমাকে কিছু কথা বলব। অনেকদিন হলো ভাবছি বলব বলব, কিন্তু বলে উঠতে সাহসটা ঠিক পাচ্ছিলাম না। আবার যা নিয়ে বলতে চাইছি, সেটা আমার ভীষণ অপছন্দের একটা বিষয়। আমি আসলে আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় কারও কাছে শেয়ার করি না কখনও। আমার এক আমি নিজে ছাড়া আর কোনও বন্ধুও নেই। আজকে যে কথাগুলো বলব, আমি জানি না সেগুলো জেনে তুমি কী ধরনের রিঅ্যাক্ট করবে, সম্পর্কটা আর আগের মতো থাকবে কি না, তুমি আমাকে একদিন আগেও যতটা ভালোবাসতে, এসব জানার আর ততটা ভালোবাসতে পারবে কি না। এজন্যই এসব ভেবে এতদিন বলি বলি করেও চুপ করে ছিলাম। ভেবেছিলাম, বেশ তো আছি, আবার এসব বলে যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি, তোমার কাছ থেকে পাওয়া এই মুহূর্তগুলো হারিয়ে ফেলি, তখন? এর চেয়ে বরং আর কটা দিন পর বলি, আর কটা দিন একটু ভালো থেকে নিই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আর কটা দিন দেরি করতে করতে আর বলাই হবে না। তুমি বাইরের কারও কাছ থেকে ভুলভাল কিছু একটা শুনে আমাকে ভুল বুঝলে আমার তখন আর কিছু করার সময় থাকবে না, কেননা ততদিনে আমি তোমার কাছে সম্পূর্ণভাবে অবিশ্বাসী হয়ে উঠব। আমি আগে বাইরের মানুষের কোনও কথায় কান দিতাম না, এখনও দিই না। কিন্তু কিছুদিন আগে রফিক ভাইয়ের সাথে যে ঘটনাটা ঘটে গেল, আমি তারপর থেকে সত্যিই শকড, কারণ আমি এখনও জানি না, আমার আশেপাশে এরকম ঠিক কতজন বন্ধুরূপী সাপ ফণা তুলে আছে আমাকে শেষ করে দেওয়ার জন্য। রফিক ভাইয়ের সাথে আমার আসলে খুব আন্তরিকতার সম্পর্ক ছিল, আর এটা থেকেই আমি এমনটা আশা করিনি।
আমি জানি, আমার বিষয়ে বাইরের যে যা-কিছুই বলুক, তুমি কখনও সেগুলো বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তাই বলে আমি চুপ করে বসে থাকতে পারি না। কারও পুরোটা জেনে তাকে ভালোবাসা, আর না জেনে ভালোবাসার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আমার সত্যিটা লুকিয়ে রেখে অথবা সত্যি সামনে এসে গেলে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলব, এই ভয়ে সত্যিটা সামনে না আনলে সত্যিটা কখনও মিথ্যে হয়ে যাবে না। আবার আমার ব্যাপারে জানার পর যদি আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা কমে যায়, অথবা আস্তে আস্তে ‘নেই’ হতে থাকে, তা হলে এটা তো আজ হোক কাল হোক, হবারই ছিল, হলে আমি সেদিন কী করতাম? অবশ্যই বাধ্যতা থেকেই হোক অথবা হোক লজ্জাবোধ থেকে, আমাকে সেটা মেনে নিতেই হতো। তা হলে আজই আসুক সেই দিন। কেননা আমার পিছে কিছু অযাচিত আর ফালতু শত্রু আছে, যারা সব সময় আমার দিকে নজর রাখে কী করে আমার কোনও ক্ষতি করা যায়। তুমি প্রায়ই বলো, বোবার নাকি শত্রু হয় না, অথচ আজ এতগুলো বছর আমি কেবল চুপ করে আছি, তবুও আমার যারা ক্ষতি করার, তারা তাদের কাজ চালিয়েই যাচ্ছে। আসলে একটা কথার সাথে অনেক অনেক কথা অনেক ঘটনা জড়িয়ে থাকে। এজন্য একটা বলতে গেলে আর একটা না বললে হয় না। এজন্যই এত দিন কিছুই বলিনি তোমাকে। জানি, সব কিছু খুলে না বললে তোমার মনে অনেক অনেক প্রশ্ন থেকে যেতে পারে, আর আমি সেটা চাইনি। আমি জানি, একদিন হয়তো তুমি একটু একটু করে সব জানতে চাইবে, কিন্তু আমি চাই, তোমার আমার কাছে কিছু জানতে চাইতে না হোক।
আমার বিয়েটা আসলে হয়েছিল অনেক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে, আর কিছুটা জোরপূর্বক। আমার যখন যে বয়সে বিয়ে হয়, সে সময় আমি কোনওভাবেই বিয়ের জন্য রাজি ছিলাম না। তার আগে আমার ফ্যামিলির ব্যাপারে একটু কিছু তোমাকে জানাতে চাইছি। আমি মোটামুটি একটা বংশীয় ঘরের মেয়ে। আমার বাবার দাদা মরহুম আজগর আলী মজুমদার বগুড়া সরকারি রাবেয়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং আমাদের তিনটি বিশাল বড়ো পরিসরের মসজিদ ও দুইটি এতিমখানা রয়েছে এই নামেই। বগুড়া পৌরসভা, বগুড়া জেলাকারাগার, বগুড়া মজুমদারঘাট, বগুড়া চারমিনার পার্কসহ বগুড়া সদরের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা আমাদের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত এবং আমার বড়োবাবা মরহুম কায়সার আলী মজুমদার তাঁর গুণধর পুত্রদের নয়ছয়ের আশঙ্কায় এই সব জমি সরকারিভাবে ওয়াকফ করে রেখে গিয়েছিলেন, যাতে তাঁর পুত্ররা সেগুলো অন্তত বিক্রয় করতে না পারেন। কেননা তিনি মৃত্যুর আগেই অন্তত এটা জেনে গিয়েছিলেন যে তাঁর সন্তানদের তিনি মানুষের মতো মানুষ করতে পারেননি এবং এ নিয়ে তিনি শেষপর্যন্ত খুব চিন্তিত ছিলেন। আমার বড়োবাবার এতো জায়গা, এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তাঁর শেষজীবনটা তাঁকে তাঁর ছোটমেয়ের বাড়িতেই কাটাতে হয়েছিল।
আমার বড়োবাবার আদিবাড়ি পাকিস্তানের পেশাওয়ারে। তিনি ওখান থেকে এখানে তাঁর বংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, এর পেছনের আরও কিছু কারণ আছে, কিন্তু আমি আপাতত অত দূরে যাব না। আমার বড়োবাবা তাঁর কোনও শিক্ষিত সুযোগ্য পুত্র রেখে যাননি এবং আমার বাবা চাচাদের পুরো বংশে কেবল তিনজন উচ্চশিক্ষিত, মানে অনার্স মাস্টার্স পাস গ্রাজুয়েট আছেন। একজন আমার ছোট চাচা রায়হান আলী মজুমদার, উনি এশিয়া গ্রুপের জিএম হিসেবে আছেন। এরপর আমার আর এক চাচাতো চাচা শফিকুর আলী মজুমদার ওয়ালটনের সিওও হিসেবে আছেন। বাকি জন শামসের আলী মজুমদার তাঁরই ছোট ভাই, উনি মোটরপার্টসের ব্যবসা করেন। এর পরের প্রজন্মের কেবল আমরা দুই ভাই-বোন গ্রাজুয়েট। অন্যান্যরা কতদূর কী পড়াশোনা করতে পারে, পারলেও করবে কি না, সেটা নিয়েও অনেক সন্দেহ আছে। আমাদের বংশের কোনও ছেলেকেই আসলে তেমন পড়াশোনা না করলেও চলে, কেননা তাদের বাবারা তাদের একেক জনের জন্যে যথেষ্ট সম্পদ গুছিয়ে সযত্নে রেখে যাচ্ছেন। তাই তাদের কোনও চিন্তা নেই।
আমাদের বংশের সব মেয়েই মোটামুটি অশিক্ষিত এবং সমস্যাগ্রস্ত। তবে আমাদের বংশের মেয়েদের আত্নঅহংকার খুব কম, বলার মতো কম। এদের মন খুবই বিশাল আকৃতির, এজন্যই ওদের কেউই বিশেষ ভালো নেই সংসারজীবনে। কেননা ওরা শ্বশুরবাড়িতে যাবার পর ওদের শ্বশুরবাড়ির সবাই মনে করেন যে এই মেয়ে এখানে থাকবে না, এত বড়ো বংশের মেয়েরা কখনও সংসার করে না, সুতরাং শুরু হয়ে যায় অহেতুক সন্দেহ আর অত্যাচার। অবশেষে বেচারিরা উপায়ান্তর না দেখে হয় মুখ বুজে সহ্য করে যায়, নয়ত আমার মতো নিজের ঘরে বাবার ঘাড়ে ফিরে আসে। আমি একটু বেশি মডার্ন, এজন্যই সংসারটা করতে পারিনি। যদিও আমার এতে কোনও অনুশোচনা নেই। আমি অবশ্য অনেক সময়ই বাইরে নিজেকে এই বংশের মেয়ে বলে পরিচয় দিই না, কেননা দিলে তখন সেখানে আমার সকল ক্ষুদ্র পরিচয় ঢাকা পড়ে যায়, আর আমাকে আগে ভালোভাবে না জেনেই আমার বংশের নামে সবাই জাজ করুক, এটা আমি চাই না। তোমার মনে আছে, তুমি যেদিন প্রথম বগুড়ায় এসেছিলে, তখন রাবেয়া কলেজের নাম শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলে, এ কলেজটা তেমন কেউ চেনে না কেন? আমি তখন তোমার সামনেই ছিলাম কিন্তু কিছু বলতে পারিনি, কারণ আমি তোমার সামনে আমার ওই পরিচয়টা নিয়ে আসতে চাইনি।
যা-ই হোক, আমার বড়োবাবা মরহুম কায়সার আলী মজুমদার ১৯২৯ সালে বগুড়া মুসলিম হাই স্কুল নাম দিয়ে সর্বপ্রথম এই কলেজের স্থানে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে আমার দাদারা ১৯৬১ সালে এই স্কুলের জায়গায় আমার বড়োমায়ের নামে রাবেয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে এটি সরকারিকরণ করা হয়। তার আগ পর্যন্ত আমাদের খরচেই কলেজটি চলত। আমাদের তিনটি মসজিদ ও দুইটি এতিমখানাও ১৯২৯ সালেই আমার বড়োবাবা একসাথেই প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও কলেজটি সরকারি, কিন্তু এখনও কলেজটিতে রাজনৈতিকভাবে আমাদের প্রভাব রয়েছে। এজন্যই কলেজটি নিজের ইচ্ছানুযায়ী এগুতে পারছে না। সরকারি আজিজুল হক কলেজের সুপরিচিতির অনেক আগে থেকেই পুরো বগুড়াসহ বগুড়ার আশেপাশের অনেক অনেক ছাত্রছাত্রী এই কলেজ থেকেই লেখাপড়া করেছে এবং এটিই ছিল তখনকার একমাত্র উল্লেখযোগ্য কলেজ। এই কলেজে একসময় অনার্স, মাস্টার্স, ডিগ্রি কোর্স ছিল, কিন্তু এইচএসসি’র স্টুডেন্ট অত্যধিক হবার ফলে স্থানস্বল্পতার কারণে শুধু এইচএসসি কোর্সটিই চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই যে আমি তোমাকে আমার পুরো ফ্যামিলির সব কিছু বলছি, আসলে এসব কেন বলছি? কারণ তুমি যদি আমার পেছনের ইতিহাস না জানো, তা হলে সামনের কিছু বিষয় মেলাতে পারবে না।
আমার যার সাথে বিয়ে হয়, তার সাথে আমার দীর্ঘ ৭ বছরের চেনাজানা ছিল। চেনাজানা মানে কেবলই চেনাজানা, অন্য কিছুই নয়। বগুড়ায় আমাদের এখনও সবাই মোটামুটি একনামেই চেনে। এই বংশের মেয়ে হিসেবে জন্মে আমি যে বাড়তি ফলটুকু পেয়েছি সেটা হচ্ছে, অহেতুক আমার বাবা-দাদাদের রেখে যাওয়া কিছু পাপের ভাগিদার হয়েছি, আর আমার ইচ্ছেস্বাধীন চলাফেরার অধিকারটা জন্মগতভাবেই হারিয়ে ফেলেছি। তার উপর আমার পূর্বসূরিদের করে-যাওয়া কিছু অকাজের ফসল অবধারিতভাবে আমাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তা কেমন? এই যেমন ধরো, আমার দাদারা কেউই একটা বিবাহ করে ক্ষান্ত ছিলেন না। আমার দাদার তিন বিয়ে, তৃতীয় জন মারা যান বিয়ের কিছু পরেই। আমি আমার দাদার প্রথমঘরের নাতনি। আমার দাদার অন্যঘরেরও অনেক সন্তান এবং নাতি-নাতনি আছে। এমনিভাবে সবার ঘরেই কম-বেশি আছে। আমার নানার কথা শুনেছি, তিনি নাকি সব জায়গায় টাকা ধার দিয়ে বেড়াতেন, আর ওঁর টাকা শোধ না করতে পারলে উনি সেই ঘরের একটা মেয়ে সুদ হিসেবে বিয়ে করে নিয়ে চলে আসতেন। এমনভাবে উনি ১১টা বিয়ে করেছিলেন এবং আমি আমার জন্মের পর আমার নানু ছাড়াও আরও সাতজন নানুকে দেখতে পাই। তো বিয়ে নিয়ে এই পুরনো বীজ কিন্তু তাঁরাই বপন করে গিয়েছিলেন।
অবশ্য আমার বাবা-চাচারা কয়েকজন বাদে সবাই একটা করেই বিয়ে করেছেন। আমি এর কারণ হিসেবে যা খুঁজে পেয়েছি, সেটা হচ্ছে, আমার বাবাদের কারও আমার দাদা-নানাদের মতো সম্পদ ছিল না। এই কারণেই তাঁরা একটার অধিক বিয়ে করতে পারেননি, সামর্থ্য থাকলে অবশ্যই করতেন। তো আমাদের বংশের মানুষদের নিয়ে অন্যদের ধারণা, এরা শুধু ধরে ধরে বিয়ে করে। এজন্যই আমাদের বংশের মেয়েদের বিয়ে করতে আসলে এমন একটা ভয় নিয়েই বিয়ে করতে আসে যে হয়তো আমরা সংসার করব না। তারপরও কিন্তু আমাদের বংশের মেয়েদের একটু বয়স হলেই, অর্থাৎ কোনও রকমে ১৭/১৮ পার হলেই লোকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যায়। এর কারণ আর যা-ই হোক, আমাদের কোনও বিশেষ গুণ বা রূপ কিন্তু অবশ্যই না। আমাদের বিয়ে করতে আসে বংশ দেখে। এই বংশের সাথে যে করেই হোক, সম্বন্ধ করে একটা নাম তো পাওয়া যাবে, সেটা দিয়ে যদি বাইরে কিছুটা হলেও দাপট খাটিয়ে চলা যায়, এই লোভে। এটা আমরা খুব ভালো করেই বুঝি। এই কথাগুলো বলার কারণ মূলত এটাই যে, তোমাকে আমি বলেছি আমাকে অনেক ছেলে বিরক্ত করে, পিছে লেগেই থাকে, কোনওভাবেই হাল ছাড়ে না, কিছুই না পারলে অবশেষে ক্ষতি করার চেষ্টা করে, দুর্নাম রটানোর চেষ্টা করে, এইসব কেন বললাম, বুঝাতে।
আসলে এরা যে এসব করে, এরা কেউ কিন্তু আমার চেহারা দেখে এমন করে না। তুমি ভালো করেই জানো, আমি কোনও সুন্দরী বা রূপসী মেয়ে না যে এত অপমান সহ্য করেও আমার পিছে ছেলেরা পড়ে থাকবে। তো এসব অসভ্য ছেলেগুলি কিছুই না পেরে অবশেষে যেটা করে সেটা হচ্ছে, অহেতুক উল্টাপাল্টা মিথ্যা বানিয়ে বলে। এই বংশের মেয়েরা সব খারাপ, এরা একশোটা বিয়ে করে, একশো জনের সাথে এদের সম্পর্ক, হেনতেন বাইরে ছড়াতে থাকে। যদিও এসবের একটারও কোনও প্রমাণ নেই। আমার বিয়েটা যখন হয়, তখন আমার প্রাক্তনের বাবা-মা এভাবেই উঠেপড়ে লেগেছিলেন। প্রথমে তারা এটা ছড়ান যে, তাঁদের ছেলের সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক আছে। তাদের ছেলে থাকতো খুলনায়, বছরে দুই ঈদ ছাড়া কখনও বগুড়ায় আসত না, তা হলে আমি প্রেমটা করলাম কখন? তারা যখন আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আমি তখন একবাক্যে ‘না’ করে দিয়েছিলাম যে আমি এখন পড়াশোনা করব। তখন ওঁরা আমার বাবা-মাকে বোঝাতে থাকেন, আমরা আপনার মেয়ের পড়াশোনার কোনও ক্ষতি করব না, আপনারা শুধু আংটি পরিয়ে রাখেন, তা হলেই আমরা নিশ্চিত হতে পারব যে আপনারা আপনাদের মেয়েকে আমাদের দেবেন। আর কিছুই আমরা চাই না। ওর অনার্স শেষ হলেই আমরা ওকে তুলে নেব, তার আগে আমরা আর কিছু করব না। আমার বাসার মানুষ দেখল, ছেলে ডাক্তার, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে সরকারি চাকরি করে, তার উপর একই শহরে বাড়ি, ছেলেদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো, সুতরাং তাঁরা বিনাবাক্যে সব মেনে নিলেন।
এদিকে এই ছেলে আমাকে ক্রমাগত ভয় দেখাচ্ছে, তুমি আমাকে বিয়ে না করলে আমি তোমাকে তুলে নিয়ে যাব। ওই বয়সে আমার মাথায় এটা আসেনি যে আমাকে তুলে নেওয়া ওর চৌদ্দগুষ্টির কারও পক্ষেই সম্ভব না, তেমন করলে আমার বাবা-চাচারা ওকে যা করার করে দিত। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার মাথায় ওসব কিছুই আসেনি যে, ও যে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, এটা বাসায় বলি। এদিকে আমাকে যেদিন আংটি পরাবার কথা ছিল, সেদিন আগে থেকে কিছু না জানিয়ে সে আমাদের বাসার সবাইকে কাবিনের জন্য জোরাজুরি শুরু করল, ওদিকে আমার কোনও কথাই কেউ শুনল না। আমার, ওই মুহূর্তে পারলে পালিয়ে বাঁচি, এমন অবস্থা। ওদিকে ওই ছেলে আবার কান্নাকাটি করে সবার সামনে নাটক জুড়ে দিয়েছে। সেদিন সবাই আসার পর যখন কাজিসাহেব বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে যাবেন, তখন উনি দেখলেন, আমার বয়স আঠারো হতে তখনও সাড়ে চার মাস বাকি। আমি মনে মনে একটু শান্তি পাচ্ছিলাম যে হয়তো আগামী সাড়ে চার মাসে আমি বিয়ে না করার অন্য কোনও অজুহাত বের করে ফেলব। কিন্তু এই ছেলে ওই দিন ওই মুহূর্তে আর এক নাটক শুরু করে দিল। সে সবার সামনে কান্না জুড়ে দিয়ে বলল, এই বিয়ে যদি এখন না হয়, তা হলে সাড়ে চার মাস পর আর হবে না। আমার বাসার মানুষের আরও বেশি মনে ধরে গেল, ছেলে তো খুবই ভালো, আমার মেয়েকে বিয়ের জন্য কান্না জুড়ে দিয়েছে! এই ছেলে আমার মেয়েকে অনেক ভালো রাখবে, ভালোবাসবে, সুতরাং সবাই মিলে তাকে বোঝাল এবং সাড়ে চার মাস পর যেদিন শুধুই বাগদান হবার কথা, সেদিন প্রায় জোর করেই আমার গলায় বিয়ের মালা পরিয়ে দেয়া হলো। কেননা আমি এরই মধ্যে বাসায় বলে দিয়েছিলাম, আমি এখন বিয়ে করব না। আমার বাসার মানুষ আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল, আমাকে ওরা কেবল আংটি পরিয়ে যাবে। সেই কথার ভিত্তিতেই আমি রাজি হয়েছিলাম।
ওরা যখন আমার বাসায় প্রস্তাব পাঠায়, তার সাড়ে চার মাসের মাথায় আমার কাবিন হয়, এই সময়ে কম হলেও একশোবার ওদের কাছে বায়োডাটা চাওয়া হয়েছে। ওরা বারবারই বলেছে, এত কাছে বাসা, ছেলে জানাশোনা, আমরা সবাই জানাশোনা, বায়োডাটা দিয়ে কী করবেন? এখানে বায়োডাটা চাওয়া মানেই আমাদেরকে অপমান করা। আমার আব্বুকে আমি অনেক বুঝিয়েছি ভালো করে গুরুত্ব দিয়ে ওদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে, আমার বাবা-চাচারা কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। আমার চাচা কেবল ওর জেলার সিভিল সার্জনের সাথে দু-একবার ফোনে কথা বলে এটা নিশ্চিত হয়েছেন যে, ওই ছেলে ওখানেই চাকরি করে। আমার পরিবারের সবার এমন বোকামি আর অবহেলার কারণে আমি আজও ওদের উপর কেন যেন ভেতরে ভেতরে রেগে থাকি, যদিও এই দোষটা আমি সম্পূর্ণ আমার ঘাড়েই নিই, কেননা ওদের উপর যদি আমি আবার আমার দায়িত্ব ছেড়ে দিই, তা হলে আবারও ওরা এলোমেলো একটা কিছু আমার গলায় ঝুলিয়ে দেবে।
আর এতদিনে অন্তত এটা বুঝেছি যে, যার জীবন, কেবল সে-ই সাফার করে, পরিবারের অন্য কোনও সদস্যেরই কিচ্ছু এসে যায় না। নিজের কান্না একা নিজেকেই কাঁদতে হয়। উল্টা সুযোগ পেলে আমাকে আঘাত করে কথা বলতে আমার বাবা-মা পর্যন্ত ছাড়ে না। একে তো ওরা ওদের দোষ দেখেও না, স্বীকারও করে না, তার উপর আমাকে যা-তা বলে টর্চার করে। এজন্য এই সুযোগ আমি দ্বিতীয়বার আর কাউকে দেবো না বলেই কষ্ট হলেও এখন সবার সব কথা শুনি, সহ্য করি। আগে ভাবতাম, পৃথিবীতে আর যে যেমন হোক, নিজের বাবা-মা কখনও তাদের সন্তানকে এলোমেলো কথা শোনাতে পারে না। কিন্তু আমি ভুল, আমার ধারণা ভুল। তারপরও আমি তাদের সম্মান করি, কেননা এটা আমার দায়িত্ব সন্তান হিসেবে। তারা যা খুশি বলতেই পারে, আমি সব গিলে ফেলি। আসলে আমার ডিভোর্সের পেছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছিল, তার কঠিন রকমের সন্দেহবাতিক ছিল, আর সেটা এমন একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি যদি আর কয়েকটা মাস সহ্য করতাম, তা হলে হয় আমি আত্নহত্যা করতাম, নয়তো পুরোপুরিই মানসিক রোগী হয়ে যেতাম। আমার যেদিন কাবিন হলো, সেদিন আমি কিছুতেই ওর সাথে রাতে থাকতে চাইনি, কারণ আমি মানসিকভাবে অনেক অনেক ভেঙে পড়েছিলাম।
আমি বিয়ের জন্য, সংসার করার জন্য, অন্য আর একটা সম্পর্কে জড়াবার জন্য কোনওভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ওদের অনেক বুঝিয়েছি পর্যন্ত, কিন্তু ওরা বলেছে, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। যাকে আমি তখনও মন থেকে মেনেই নিতে পারিনি, তার সাথে সব কিছু কেবল শারীরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে কী করে ঠিক হয়, সেটা আমি জানতাম না। ওদের ধারণা ছিল, কেবল শারীরিক সম্পর্ক হলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যায়। বিয়ে নিয়ে আমার যা যা ধারণা, যা যা স্বপ্ন ছিল, সব কিছু মুহূর্তের মধ্যেই নোংরা হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন শারীরিক সম্পর্কের চাহিদা বুঝতে পারিনি, আর ওভাবে কিছু ফিল করতাম না, কারণ ওটা আমার ওসব ফিল করার বা ওসব বোঝার বয়স ছিল না। আমি সব কিছু শুরুই করেছিলাম জোর করে। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেবল আমার পরিবারকে খুশি করতে। আমার মনে আছে, আমি তখন বলতাম, আমার কাছে আমার বাবা-মা, আমার পুরো পরিবারই সব। আমার পুরো পরিবার বলতে আমার চাচা-চাচি, ফুপা-ফুপু সবাইকে নিয়ে যে পরিবার, ওটার কথা বলছি। আমরা মোটামুটি যৌথপরিবারের মতোই ছিলাম তখন। এখন সবার ছেলে-মেয়ে বড়ো হচ্ছে, এখন তাঁরা তাঁদের যার যার নিজের ছেলে-মেয়ের প্রয়োজনের কথা বোঝেন, অথচ আব্বু কখনও তাঁর ভাইবোনদের বাদ দিয়ে নিজের ছেলেমেয়ের কথা আগে বুঝতেন না।
আমার পরিবারের আমাদের ভাই-বোনদের সবার সব সিদ্ধান্তের জন্যেই আব্বু ওদের সবার উপর নির্ভর করে বসে থাকতেন। নিজের সন্তানের প্রয়োজন নিজে কখনও বোঝার চেষ্টা করেননি, আর আমার মাকে তো আরও আগেই সবাই পাগল বানিয়ে রেখেছিলেন, সুতরাং তাঁর উপর নির্ভরতা আনার কোনও প্রশ্নই আসে না। এখন অবশ্য দেখি অনেক কিছুই, যা আমাদের সময় কেউ বুঝতে চাইত না। এখন আবার অনেকেরই মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। যা-ই হোক, যা বলছিলাম, আমার সঙ্গে ওর অনেক লম্বা সময় একসাথে কাটানো হয়নি। কাবিনের পর ও দুই-তিন মাস পর পর একবার আসত বাসায়, আমি চাইতাম না বলেই ঘন ঘন আসত না। দুই-তিন মাস পর পর জোর করেই আসত। আমি আসতে বলতাম না, কারণ আমি ওর সঙ্গে অতটা ফ্রি ছিলাম না শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে। আমার আসলে প্রথম থেকেই বর হিসেবে ওকে সহ্য হতো না, এজন্য সব সময় পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করতাম। ও খুলনায় থাকলে নানান অজুহাতে ফোনে কথা কম বলতাম। আমি অনেক খোলামনের মানুষ ছিলাম, আর ওর এটা অপছন্দ ছিল। এজন্য ওর সঙ্গে আমার কথায় বনিবনা কম হতো, কিন্তু আমি কখনও বাধ্য না হলে ওর কোনও কথার জবাব দিতাম না। আমি আগাগোড়াই তর্ক কম করি সবার সাথেই।
আমার ওর সাথে কথা কম বলাটা ওর পছন্দ হতো না, আর আমাকে পছন্দ হতে সময় দেয়ার চেয়ে জোর করে কথা বলা, গায়ে পড়ে ঝগড়া করা, অযথা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বের করা, আমার বাসা থেকে আমাকে কত টাকা খরচ দিল, সে টাকা কোথায় কোথায় খরচ করলাম, কোথায় কোথায় যাই, কাদের সাথে মিশি, কোন স্যারের কাছে পড়ি, আস্তে আস্তে সব ইনকোয়ারি করতে শুরু করল। আমি এসব ভীষণ অপছন্দ করতে লাগলাম। কারণ ফোন করলেই ওর জেরা শুরু হয়ে যেত। প্রথম প্রথম বাসার সবাই বলত, ও তো অনেক দূরে থাকে, এজন্য তোকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। ওসব নিয়ে যেন আমি পড়ে না থাকি। আস্তে আস্তে আমার ফোন নিয়ে কল ফরওয়ার্ড করে রাখা শুরু করল। আমাকে আমার যে যে বান্ধবী ফোন করত, সবাইকে ফোন করে করে খোঁজ নেয়া শুরু করল, সে কি ছেলে না মেয়ে। আমার বান্ধবীদের ফোন দিয়ে আমার খোঁজ রাখত, আমি অন্য কোনও ছেলের সাথে কথা বলি কি না, আমাদের স্যারের ব্যাচে কোনও ছেলে পড়ে কি না, এসব। একটা পর্যায়ে ওর রুচি, ওর সন্দেহ এতটাই নিচে নেমে গেল যে ও আমার বান্ধবীদের নিয়েও সন্দেহ করা শুরু করে দিল। ও যখন এদিক সেদিক সব জায়গায় খোঁজ নিয়েও আমার কোনও খুঁত ধরতে পারছিল না, আমার কোনও ছেলেবন্ধু খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন আমাকে নিয়ে ওর সন্দেহ হলো, আমার নিশ্চয়ই তা হলে মেয়েবন্ধুদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক আছে, আমি নিশ্চয়ই সমকামী।
তারপর আমার সব বান্ধবীকে ফোন করে করে অপমান করতে শুরু করে দিল, আমার সম্পর্কে ওদের কাছে বারে বারে জিজ্ঞাসা করায় ওরাও বুঝে গেল, আমার সাথে ওর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না, ও আমাকে সন্দেহ করে। আমার বান্ধবীদের কেউ কেউ ধরেই নিল, নিশ্চয়ই আমার অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে, তা না হলে কেউ অযথা সন্দেহ করে নাকি? আমি দেখছিলাম, ও এসব করে করে আমাকে সবার কাছে ছোট করছে, সবার মনে আমাকে নিয়ে একটা প্রশ্ন তৈরি করছে। আস্তে আস্তে ও আরও রুড হতে থাকল। আমার বাসার আব্বু আর ভাইয়া ছাড়া আর কারও সাথেই আমার কথাবলা নিয়ে আপত্তি করতে লাগল। আমার দুলাভাইকে নিয়ে, আমার ফুপাত আর চাচাত ভাইদেরকে নিয়েও সন্দেহ করতে শুরু করল। আমাদের বড়োই হয়েছি যৌথ পরিবারে, সেখানে ফুপাত চাচাতো ভাই-বোন সবাই একসাথে হলে সবাই মিলে অনেক অনেক মজা করতাম। ভাই-বোনদের সাথে কখনও এলোমেলো কোনও সম্পর্ক হতে পারে, এটা আমরা এখনও জানি না। কিন্তু ও এটাকে সহজভাবে নেয়নি কখনও। এদিকে আমি চাইনি এটা আমার ভাইবোনেরা জানুক, কারণ আমার কথা হচ্ছে, বিয়ে হয়ে গেলে মানুষ নিজের সংসার নিয়ে এমনিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আর আগের মতো সব সময় যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় না।
একটা সময় আমার বিয়ের পরেও বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত প্রতি ঈদেই আমাদের বাসায় ৪০-৪৫ জন মেহমান থাকত। আব্বুর সামর্থ্যের ভেতরেই আব্বু যা পারতেন, করতেন। ছোট থেকে এমনই দেখে আসছিলাম। এখন ভাই-বোনদের অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেছে, ওরা আসতে চায় একসাথে এখনও, কিন্তু এখন একসাথে ৪০-৫০ জনের দেখাশোনা করা আমার একার পক্ষে সম্ভব না বলেই আমি নিজে থেকে কখনও আসতে বলি না। আমি জানি, বললেই ওরা আসবে। তাছাড়া আব্বু এখন চাকরি করে না, আমাদের বাসাতেও আমরা অনেক সদস্য। বাসায় কোনও মেহমান এলেই সবাইকে একসাথে নিয়ে আব্বু খেতে চায়, আমার একার উপর অনেক অনেক চাপ পড়ে, আমি অসুস্থ হয়ে যাই, এজন্য আমি মেহমান অ্যালাউ করি না। কেউ এলে ইচ্ছা করেই আমি বাসা থেকে সরে যাই। আমার একার পক্ষে আর এসব সম্ভব না। কারণ আমি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে হাসপাতালে নেওয়ার মানুষ পর্যন্ত থাকে না, তা হলে আমি কাদের জন্য নিজেকে কষ্ট দেবো?
যা-ই হোক, ওর যখন আমার প্রতি সন্দেহ আরও বেড়ে যাচ্ছিল, তখন আমার মোবাইলে ফোন এলে ওকে লাইনে রেখে আমার সবার সাথে কথা বলতে হতো। আমার ভাইয়া আর আমার দুই চাচা ঢাকা থেকে প্রতিদিন আমাকে একবার করে ফোন দিতেন। আমার চাচাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল ভালো, এজন্য অনেক কথা হতো। কিন্তু ওর ধারণা ছিল, আমি অন্য কারও সাথে কথা বলছি। একসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন করে ফোন লাইনে রেখে দিত। আমাকে বলত, তুমি ফোন লাইনে রেখে কাজ করো। আমি বাসার কারও সাথেও আর তেমন কথা বলতে পারতাম না। আমার ফোন সব সময় লাইনে থাকলে আমি কী করে ফোন নিয়ে নিয়ে এ-জায়গায় ও-জায়গায় ঘুরি? আমার বাসায় তখন সারাক্ষণ আমার চাচাত ফুপাত ভাই-বোন, চাচিরা, ফুপুরা আসতেন। আমার সাথে সবার আগাগোড়াই ভালো সম্পর্ক ছিল, এজন্য আমাকে সবাই আদর করতেন, খোঁজ রাখতেন। অন্তত ডিভোর্সের আগ পর্যন্ত এমনই ছিল সব কিছু। আমি কখনও একা বাইরে যেতাম না, যেতাম হয় চাচি নয় অন্যান্য ফুপ্পিদের সাথে। শপিংয়ে বা বাইরে কোথাও গেলে ফোন লাইনে রেখে যেতে হতো। এর মধ্যে আশেপাশে কেউ কথা বললে ও ভাবত, আমি অন্য কারও সাথে কথা বলছি, আর বাসায় আসার পর এটা নিয়ে চিৎকার শুরু করে দিত। আমার কাছে আস্তে আস্তে এগুলো অসহ্য মনে হচ্ছিল। আমি সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম, কী করব, আবার কী হয়ে যাবে!
এদিকে এতকিছু আমি বাসায় জানালেই ওরা আমাকে বলত, তুমি বাইরে যাওয়া বাদ দাও। বন্ধুবান্ধব আত্নীয়স্বজন বাদ দাও, তা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বুঝতেই পারতাম না, আমার বাসার মানুষ কিছু বোঝে না কেন! আমার বাসার মানুষ আমাকে বলত, ওর সাথে, ওর কাছে যখন থাকবে, তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। ও চাইছিল, আমি বোরকা পরি, কারও সাথে কথা না বলি, পড়ালেখা বাদ দিয়ে দিই, এমন কিছু, কিন্তু এসব মুখে বলত না তখনও, কিন্তু জেরা করত। আমি বরাবরই পর্দানশীন বা খুব ধার্মিক কোনও মেয়ে ছিলাম না। আমার কাছে ধর্ম অর্থ ভালো কাজ করা, মিথ্যা না বলা, কাউকে ধোঁকা না দেওয়া, সৎপথে চলা, নামাজ পড়া…এটুকুই। আমার মনে হতো, মন পরিষ্কার থাকলে অন্য কিছুই আমার ক্ষতি করতে পারবে না। আর ছোটবেলা থেকেই আমাকে আমার বাসার মানুষ ছেলেদের মতো প্যান্ট-শার্ট পরিয়ে চুল ছোট করে কেটে রেখে এভাবে মানুষ করেছে। তা হলে আমি হঠাৎ কী করে ওসব ড্রেস পরব? আমাকে যখন যা যা করতে বলছে, আমি সেভাবেই চলেছি, কিন্তু আর পারছিলাম না।
আমাকে যেভাবে মানুষ করেছিল, তাদের উচিত ছিল তেমন একটা ছেলের হাতেই আমাকে দেওয়া। এখন তাদের ইচ্ছানুযায়ী আমাকে হঠাৎ করে সোজা বোরকা পরতে হবে, এটা আমার উপর রীতিমত অত্যাচার ছিল। এটা আমি মানতাম না, কারণ আমি উগ্র ছিলাম না। আমি যথেষ্ট মার্জিতভাবেই চলি। আমি বাইরে কখনও সালোয়ার-কামিজ ছাড়া বের হইনি বড়ো হবার পর। তাছাড়া আমি ঢাকায় গেলে কিছুটা প্যান্ট-শার্ট পরতাম, কিন্তু বগুড়ায় না। আমাকে সবাই আমার পোশাকের জন্য, আমার গেটাপের জন্য অনেক টর্চার করছিল, যেটা আমি কোনওভাবেই মেলাতে পারছিলাম না নিজের সাথে। কেননা আমাকে সেভাবে বড়ো করা হয়নি। আমি হঠাৎ করে কীভাবে উল্টোপথে হাঁটব? তা ছাড়া আমার ওসব ড্রেস ভালো লাগে না। আমার ওড়না সামলাতে কষ্ট হতো, আমি কয়েকবার রিকশার চাকায়, প্যাডেলে ওড়না পেঁচিয়ে জামাকাপড় ছিঁড়ে বাসায় এসেছি, তা-ও ওরা এসব আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছিল। আর বারবার আমার দিকে আঙুল উঠছিল। চারপাশ থেকে আমার উপর এমনভাবে সবাই আঙুল তুলছিল যে, আমার মনে হচ্ছিল আমার গেটাপ আর আমার মাঝেই সব সমস্যা লুকিয়ে আছে।
হ্যাঁ, একটা জিনিস আমি স্বীকার করছি যে, আমি ওর উপর ততটা মনোযোগ দিচ্ছিলাম না, ও আমার কাছ থেকে যেটা আশা করছিল, আমি ওকে সেটা দিচ্ছিলাম না, কিন্তু ওরা কেউ এটা ভেবে দেখেনি যে, আমার মানসিক পরিপক্বতা কতটুকু, আর ও আমাকে বারে বারে অন্যভাবে আটকে ফেলতে চাইছিল। ও আমাকে আমি যা নই, যা আমার পক্ষে কখনও হওয়া সম্ভব না, সেটা হওয়াতে চাইছিল। আমার মন তখন সব সময় বাইরে বাইরে থাকত। কখন বাইরে যাব, কখন ফ্রেন্ডদের সাথে মজা করব, অথবা অন্য অনেক কিছু নিয়েই আমি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতাম। ওরা আমাকে বিয়ে দিয়ে আটকে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু আমার কেবলই বাইরের জগতটার প্রতি আকর্ষণ কাজ করত। আমি কিছুতেই ওর দিকে মন ফেরাতে পারছিলাম না। আমি চাইছিলাম একজন বন্ধুর মতো মানুষ, আর ও রীতিমত আমার বাবা-মায়ের চেয়েও ভয়ংকর রেসট্রিকটেড হয়ে উঠছিল। আমি যেমন জীবনযাপনে অভ্যস্ত নই, হঠাৎ করেই বিনানোটিশে আমাকে তেমন একটা জীবন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমি বুঝেই উঠতে পারছিলাম না, আমি কী করলে এগুলো থেকে রেহাই পাব। আবার আমি প্রতিনিয়ত ওর মানসিক নির্যাতনগুলো সহ্য করে যাচ্ছিলাম।
আমি সেসময় সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম, আর খুব তুচ্ছ বিষয়গুলো লুকাতে লাগলাম। যেমন ধরো, ও আমাকে বলেছে বারান্দায় না যেতে। আমি, দেখা গেল, মনের ভুলে বারান্দায় কোনও একটা কাপড় মেলতে গেছি। তো ও ফোন দিয়ে যদি জিজ্ঞেস করত আমি বারান্দায় গিয়েছেলাম কি না, তখন ভয়ে আমার বুক ধুকপুক করতে থাকত। আমি আমতা আমতা করে বলতাম, যাইনি। তখন ও আমাকে পাল্টা ঝড়ে বক মেরে বলত, আমার এক বন্ধু তোমার বাসার সামনে দিয়ে আজকে যাচ্ছিল, তখন ও তোমাকে বারান্দায় দেখেছে। তা হলে ও তোমাকে বারান্দায় দেখল কী করে? এদিকে আমি বারান্দায় আসলেই গিয়েছিলাম কি না, সেটাই ভুলে বসে আছি। বারান্দায় যাওয়া না যাওয়া মনে রাখার মতো কোনও জিনিস না। এভাবেই ছোটো-বড়ো সব বিষয় টেনে টেনে ও আমাকে জেরা করত। অথচ এখন যখনই এসব মনে আসে, তখন প্রথম যে কথাটা মাথায় আসে সেটা হচ্ছে, আমি কেন এগুলো দিনের পর দিন সহ্য করে গেছি! আমি কেন সাথে সাথে একটা লাথি মেরে সব ছেড়ে চলে আসিনি! আমার তো অন্য কোনও সমস্যা ছিল না। আমাকে আমার বাবা-মা সারজীবন টানতে পারবেন, তা হলে কেন আমি এই অকারণ কষ্টগুলো করে গেছি!
তারপর আস্তে আস্তে এগুলোর মাত্রা আরও ভীষণ পরিমাণে বেড়ে যায়, সবাই আমাকে বলতে থাকে, ওর কাছে গিয়ে থাকতে, তা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এ রকম তো কথা ছিল না। আমি তখন কেবল অনার্স প্রথমবর্ষে। আমি কেবল তখন বাইরে কিছুটা একা একা যাচ্ছি। বাইরের জগতের সাথে কিছুটা পরিচিত হচ্ছি। এই মুহূর্তে আমার নিজের এই আনন্দের জীবন ছেড়ে ওরকম বদ্ধ আর গৃহবন্দি একটা জীবন আমার মতো স্বাধীনচেতা একটা মেয়ে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। তারপর ওর বাসার সবাই বিয়ের জন্য, ওর বাসায় তুলে নেয়ার জন্য প্রেশার দিতে থাকল। আমি না চাইতেও আমার সম্পর্ক বাঁচাতে সবাই আমাকে ওখানে তুলে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেল। এদিকে দীর্ঘদিন এসব মানসিক প্রেশার, বিভিন্ন উদ্ভট পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমি প্রথমবর্ষের কোনও বই-ই সেভাবে ধরেও দেখিনি। স্যারের বাসায় হঠাৎ হঠাৎ যেতাম। ওটাকে পড়াশোনা বলে না। আর আমার প্রথমবর্ষের সব বিষয় ছিল তত্ত্বীয়। পরীক্ষার খাতায় কোনও প্রকার পূর্বঅভিজ্ঞতা ছাড়া আমি কী লিখি? আমি জেনে গিয়েছিলাম, আমি রেজাল্ট ভালো করব না। আমার প্রথমবর্ষে ৩.১৭ এসেছিল এ কারণেই।
আমার মনে আছে, আমার বিয়ের অনুষ্ঠানের ১৫ দিন পরই আমার ইয়ার ফাইনালের ডেট ছিল। আমি ওদের বিয়ের ডেটটা এ কারণে পেছাতে বলেছিলাম, কিন্তু ওরা বলেছিল, অন্য সময় বিয়েতে আসার জন্য কেউ ছুটি পাবে না। তখন ঈদের ছুটি ছিল, সেই ছুটিতেই সবাই এসেছিল। আমি বাসার সবার ছোট হবার কারণে আর আমার প্রতি সবার আগে থেকেই কিছুটা ভালোবাসা থেকে সবার মনে আমার বিয়ে নিয়ে একটা আনন্দ ছিল। কিন্তু এত কিছুর ভেতরে ওরা আসলে আমাকে কোথায় দিচ্ছে, এটা দেখারই সময় পায়নি! এদিকে এতদিন আমার কাছে ওর কোনও চাহিদা ছিল না। বিয়ের সাথে সাথেই ওর নানা রকম চাহিদা শুরু হয়ে গেল। ওর ফার্নিচার লাগবে, ওর ফ্রিজ লাগবে, ঘরে এসি লাগিয়ে দিতে হবে, আমাকে কত ভরি গহনা দিল এসব হিসেব, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি দেখছিলাম, আর আশ্চর্য হচ্ছিলাম। এতদিন বিয়ের আগে সবাই কেবল ভালো ভালো করছিল, এখন বিয়ের পর সব চুপ। সবাই ভেজাবেড়ালের মতো মুখ লুকাতে থাকল। আমি বুঝে গেলাম, এই ঝামেলা একা আমাকেই টানতে হবে।
বিয়ের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ওর বাবা বলে দিল, আর কলেজ করা যাবে না, কেবল পরীক্ষা দিতে যাওয়া যাবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল! ১০ দিন পর আমার পরীক্ষা, অথচ ওরা আমাকে বাসায় যেতে দিচ্ছে না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, আমাকে পরীক্ষা দিতে দেবে তো? নাকি আটকে দেবে? আমার মনে হচ্ছিল, ওরা আমাকে পরীক্ষা দিতে দেবে না, আর এভাবে করে আমার পড়ালেখাটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবে। আমার বংশ অশিক্ষিত লোকে ভরা। ওরা এসব জেনে বলতে শুরু করে দিল, এত পড়াশোনা করে কী হবে? ওর মা আমাকে বলেছিল, তুমি তো ভালো কোনও বিষয় নিয়ে পড়ছ না যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাবে। আগে সংসার করো। মেয়েদের সংসারই সব। আমি আব্বুকে ফোন করে পরীক্ষার কথা বলে আমাকে তখনই বাসায় নিয়ে যেতে বললাম। আব্বু নিয়ে গেল, কিন্তু পরীক্ষার ভেতর প্রতিটা মুহূর্ত ও আমাকে ফোনে মানসিকভাবে প্রচণ্ড টর্চার করছিল। আমার মনে আছে, আমি কেবল কান্না করতাম আর পড়তাম। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি হুট করে কী এক উটকোঝামেলায় পড়ে গেলাম! আমার মনে হচ্ছিল, যেভাবেই হোক আমি আত্নহত্যা করি, তা হলেই বোধহয় আমি বেঁচে যাব। আমার বাঁচার আর কোনও পথ নেই।
আমি, একটা জিনিস যেটা করিনি, সেটা হচ্ছে, আমি বাসার কারও কাছে কোনও কিছু লুকাইনি। কারণ না হলে ওরা আমাকে দোষ দেবে। তারপরও অনেকের অনেক ধরনের কথা রোজই আমাকে শুনতে হচ্ছিল। দীর্ঘ এগারো মাস আমি এসব সহ্য করেছি একা। কাউকে আমার পাশে পাইনি, অন্তত মানসিকভাবেও পাইনি। আমি একটা সময় আর সংসার চাইছিলাম না। আমি কেবল বাঁচতে চাইছিলাম। আমি জানতাম, ডিভোর্স নিলে সব কিছু আগের মতো থাকবে না। আমার জীবনটা খুব কঠিন হয়ে যাবে। আমি কাউকে কোনও সময় আমার সাপোর্টে পাবো না। কোনও কিছুতেই পাবো না, বরং অন্য সবার বিরুদ্ধে গিয়েই আমাকে একা বেঁচে থাকতে হবে। আবার সাথে সাথে এটাও মনে হয়েছিল, এই পরিস্থিতিগুলো একটা সময় একটু হালকা হয়ে যাবে। এই ধাক্কাটা যেতে হয়তো চার পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে, কিন্তু ততদিনে আমি পড়ালেখাটা অন্তত শেষ করতে পারব। তার পরেরটা পরে দেখা যাবে। আপাতত আমাকে বাঁচতে হবে।
আমি সবার সব কথা উপেক্ষা করে, গিলে, খেয়ে তারপর একেকটা দিন বেঁচেছি। আমি হয়তো পারতাম সেই মুহূর্তে আমার পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে সংসারে মনোযোগ দিতে, কিন্তু আমার বারে বারে মনে হচ্ছিল, যে আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে ঘরে আটকাতে চায় সে আমাকে কখনও ভালো রাখবে না। শেষের দিকে যখন সম্পর্কটাকে আর কিছু দিয়েই টিকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না, তখন ও চেষ্টা করেছিল একটা বাচ্চা নিয়ে ফেলতে। আমাকে সে দিনগুলোতে শারীরিক সম্পর্কের জন্য অত্যধিক জোর করত, কিন্ত আমি কোনওভাবেই রাজি ছিলাম না। কারণ বাচ্চা দিয়ে জোর করে একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মানসিকতা আমার কখনওই ছিল না, এখনও নেই। আমার ঘরে দুজনের পরম ইচ্ছায়, পরম ভালোবাসায় সন্তান আসবে, এটাই সব সময় চেয়েছি। জোরপূর্বক কখনওই না। যেই মানুষটাকে আমি কোনও রকম ভালোবাসি না, শ্রদ্ধা করি না, আমার সন্তান তার অধীনে তার মতো করে মানুষ হোক, এটা আমি চাইনি, চাই না। আমার মনে হয়েছিল, তখনও সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি, তখনও আমার নিজের জীবন নিয়ে আশা ছিল।
নিঃসন্দেহে আমি তখনকার চাইতে লক্ষগুণ ভালো এখন আছি। আমার বিয়ের পরদিনই আমার সাথে ওর শারীরিক সম্পর্কের বিষয়গুলো ও আমার দুলাভাইকে জানায়। ও ভাইয়াকে বলে, আমার নাকি সমস্যা আছে, আমার ভেতরে কোনও সেক্সটেক্স নেই। হ্যাঁ, আমি ওকে পছন্দ করতাম না, এজন্য ও আমার কাছে এলে আমি বিরক্ত হতাম, আর মরালাশের মতো বিছানায় পড়ে থাকতাম, এটা সত্যি। কিন্তু এর বেশি ওর জন্য আমার করার ছিল না। ও আমার মধ্যে ওর প্রতি চূড়ান্ত পর্যায়ের তিক্ততার জন্ম দিয়েছিল, ওর ব্যবহারের জন্যেই ওর এসব ভোগ করতে হচ্ছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও মন থেকে কখনওই ওকে গ্রহণ করতে পারিনি। আমি কেবল আমার বাধ্যতার জায়গা থেকে যা করতে হয়, ততটুকুই মরে মরে হলেও করে যাচ্ছিলাম। আমার এক একটা রাত কীভাবে কেটেছে, সেসব আমি ছাড়া আসলে কারও বোঝার ক্ষমতা নেই। আমার মনে হচ্ছিল, কেউ আমাকে রেপ করছে। আমার দুলাভাই ওর সেই কথা শোনার সাথে সাথে আপুর কাছে নালিশ করে বলেছিল, ও তো একটা পাগল, নিজের বউয়ের সাথে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় এভাবে কেউ বলে নাকি? আমার দুলাভাই ওকে সাথে সাথেই অনেক কথা শুনিয়েছিল এবং বলে দিয়েছিল এসব কথা নিয়ে আর কখনও আমাকে ফোন করবে না। পরে আমার বাসার সবাই ধীরে ধীরে যখন এটা জেনেছিল, আমার তখন যে কী লজ্জা হচ্ছিল, আমি বলে বোঝাতে পারব না।
আমাকে ওর কোনও কিছুই লুকিয়ে রাখতে হয়নি, বিয়ের কয়েকদিনের মাথায় ও নিজেই নিজের স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছিল। আমি যখন সব শেষে চলে এলাম, তখনও আমি ভাবছিলাম, কিছুদিন যাক, কয়েকটা মাস যাক, তারপর দেখি, ও কিছুটা বদলায় কি না। মানুষ তো বদলায়। কিন্তু বাসায় আসার এক সপ্তাহের মাথায় ও আমাকে বলে বসল, তোমাকে তোমার বাসা থেকে যে গহনাগুলো দিয়েছে, ওগুলো নিয়ে আমার বাসায় এসে কিছুদিন থেকে যাও, আমি তোমাকে নিজ থেকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো। শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আমার যদি ওকে ডিভোর্স দেওয়ার থাকে, তা হলে আমি এমনিতেই দিতে পারি যখন তখন, আমার আবার ক্ষতিপূরণ কীসের? ও ভেবেছিল, আমাকে ভয় দেখিয়ে আমার সব কিছুতেই কর্তৃত্ব খাটাবে। আমার তখনই মনে হলো, আর নিজের আবেগ দিয়ে বোকার রাজ্যে চলা যায় না। আমি আর যা-ই হোক, ওর সাথে কোনও ভালোবাসার সম্পর্কে নেই, এই সম্পর্কে আমার কোনও দায়বদ্ধতাও নেই, আর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা-ও আজ এই কথার পর শেষ হয়ে গেল।
এর মধ্যে ওর বাসায় থাকার কয়েকটা দিন ওরা আমাকে অনেক রকম নির্যাতন করেছে। ও তখন বগুড়া ছিল না। ও কিছুই না দেখে, কিছুই না জেনে আমাকে ফোনে ফোনে কেবল জেরা করত। আমার ডিভোর্সটা আমি নিজে নিজে একা সিদ্ধান্ত নিয়েই করেছি। বাসায় সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি, আমি এখানে আর থাকব না, তোমরা যা যা ব্যবস্থা করার করো। আমি বাসায় বলে দিয়েছিলাম, আমার ওর দেওয়া কোনও গহনা, আমার দেনমোহরের টাকা, কিছুই লাগবে না, এমনকি আমি ওর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ কোথাও করব না। আমার সব দায় ছেড়ে আমি একতরফাভাবেই ডিভোর্স-লেটার পাঠিয়ে দিয়েছি, ওরা ওটা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।
এর মাঝে আমার মেজো মামাকে বোকা মানুষ পেয়ে ওঁকে সে বলেছে, তাকে একতরফাভাবে ছাড়তে গেলে নাকি তাকে আমার পনেরো লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অথচ আমার দেনমোহরের টাকাই এর অর্ধেকও ছিল না! আমার আর এক মামা আমাদের পাশের এলাকার কমিশনার, ওঁর কাছে সে নালিশ নিয়ে গেছে যে এটার জন্য বিচার বসাতে হবে। আমি সবাইকে খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলাম, আমি কোনও বিচার তো অনেক দূরের কথা, কোর্টে পর্যন্ত যাব না। উকিল বাসায় এসে স্বাক্ষর নিয়ে যাবে। আমার কথামতোই সব হতে বাধ্য ছিল। আমার বাসায় আমি এভাবেই কথা বলি, যখন বলি। কারণ এতদিন আমি চুপ করে ছিলাম, আর সবাইকে বলতে দিয়েছি। আমি জানি, ওরা আমাকে অযথাই ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু তখন অতটুকু শক্ত না হলে আমি কিছুই করতে পারতাম না। আমার কবে কখন ডিভোর্স হয়, এটা কেউ জানতে পারেনি, কারণ আমি কাউকে জানতে দিইনি আমার পরিবারের সদস্যদের ছাড়া। আমার সবার প্রতি খুব বিরক্তি কাজ করছিল, কারণ আমি যাদের অভিভাবক ভেবেছিলাম, তারা কারও সাথে ঠিকমতো উচিতকথাটাও বলতে পারে না।
এরপর শুরু হলো আমার নতুন জীবনের আর এক ভয়াবহ অধ্যায়। বাসার সবাই আমার সাথে অকারণেই খারাপ ব্যবহার করা শুরু করে দিল, কোনও কারণ ছাড়াই আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে দোষ দেওয়া শুরু করল। আমার জীবনটা আর এক গর্তে চলে এল। আমি বুঝতে পারলাম, আমার পাশে কেউ নেই। একেবারেই একা আমি। এ সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করল, সেই সাথে বিভিন্ন ছেলেরা প্রপোজ করতেও শুরু করে দিল। আর আমার বাসা থেকে একের পর এক চাপ আসতে লাগল বিয়ের। অনেক পরে আমি প্রায় সবার সাথে ভীষণ দুর্ব্যবহার করেই বলে দিলাম, আমার বিয়ে নিয়ে যেন কেউ কোনও কথা না তোলে। এখনও আমার আম্মু সুযোগ পেলেই আমাকে শোনায়, আমি নাকি সংসার করতে পারব না। আমাকে পড়তে বসতে দেখলেই বিভিন্নভাবে বিরক্ত করতে থাকে। আমাকে আব্বু আমাকে হাতখরচের টাকা দিলে আম্মু ঝামেলা করতে থাকে। বলে, আমাকে কেন টাকা দেয়া হচ্ছে, কী দরকার এসবের। আমি বাসা থেকে একরকম সব খরচই নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমি কারও কাছে কিছু চাই না। আমার কোনও কিছুর প্রয়োজন হয় না। একেবারে প্রয়োজনীয় কিছু ছাড়া আমি কিছুই কিনি না। আমাকে ভালো কিছু কিনতে দেখলে ওরা ঝামেলা করে। ওদের কথা, আমি কেন ভালো কিছু কিনব? আমি কেন ভালো থাকব? আমি কেন সাজব? আমার সব কিছুতেই মানা। আমি কখনও প্রতিবাদ করি না, কিন্তু আমি জানি না এর শেষ কোথায়, হয়তো কোনও একদিন আর এসব সহ্য করতে পারব না, তখন চাইলেও আমার আর এদের মাঝে, এদের সাথে থাকা হবে না।
আমি অনেক ধৈর্যশীল মেয়ে, আবার আমি রেগে গেলে খুবই ভয়ংকর হয়ে উঠি। আমি আসলে তখন আর আমার নিয়ন্ত্রণে থাকি না। একটা অদৃশ্যশক্তি আমাকে তখন পরিচালিত করে। আমি সত্যিই অনেক কম রাগি। কথায় কথায় তোমার সাথে যে রাগ দেখাই, ওগুলো সাময়িক আর খুব ঠুনকো। কোনওটাতে হয়তো অভিমান থাকে যে তুমি জানো আমি কতটা একা, তা-ও আমাকে সময় দাও না। কিন্তু এগুলো অত সিরিয়াস কিছু না। আমি প্রতিদিন অজস্র খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাই, আবার কখনও কখনও নিজেকে ভীষণ একা লাগে, তখন আর বাঁচতে ইচ্ছে হয় না, নিজেকে বিভিন্ন কাজে ডুবিয়ে রাখি, কারণ চাইলেই মরে যাওয়া যায় না। তুমি আসার আগে আমার জীবনে আর একটা ছেলে এসেছিল। ও বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে চাকরি করে গবেষক হিসেবে। স্কলারশিপ পেয়ে স্টাডি-লিভ নিয়ে জার্মানিতে মাস্টার্স ও পিএইচডি করছিল। বগুড়াতেই বাসা। আমার এক আত্নীয়ের ফ্রেন্ড। তখন আমি একা থাকার সময় ওর সাথে আমার কথা হয়। আস্তে আস্তে ওর প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা বাড়ছিল, কেননা আমার ভেতর একটা খুব শূন্যস্থান ছিল। ও-ই আমাকে প্রপোজ করেছিল। আমি কথা বলতাম ফোনে, স্কাইপিতে। প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো। ও ২০১৬ সালের মার্চে দেশে আসে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে, কিন্তু ও আমাকে এসব জানায়নি।
এসেই ও খুব ব্যস্ত হয়ে যায়। আমার সাথে কথাবলা কমিয়ে দেয়। যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। তারপর আমি একসময় ওর কাছে ওর সিদ্ধান্ত জানতে চাই, কারণ ও আমাকে কিছুই পরিষ্কার করে বলছিল না, আবার পুরোপুরি ‘না’-ও করছিল না। পরে আমার চাপে একটা সময় ও আমাকে জানায়, ওর পক্ষে আমাকে বিয়ে করা সম্ভব না। ওর বাসা থেকে একটা বিবাহিত মেয়েকে কখনওই মেনে নিবে না, সুতরাং আমি যেন ওকে বিরক্ত না করি। ও আরও বলে, আমিই নাকি ওকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এই সম্পর্কে এনেছি, ওর আমার সাথে সম্পর্ক করার কোনও ইচ্ছাই নাকি ছিল না। ওরাও বগুড়ায় মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। আমি ওর এই কথা শোনার পর কয়েকবার রিকোয়েস্ট করেছিলাম যেন ও সম্পর্কটা অন্তত না ভাঙে। আমি বলেছিলাম, আমি অনেক অনেক একা হয়ে যাব। ও আমার কোনও কথাই শোনেনি। তারপর আমি সেইদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আর কক্ষনো ওর সাথে যোগাযোগ করিনি। ও দেশে এসেই হুট করে একটা মেয়েকে বিয়ে করে। ও তখন আমার কোনও খোঁজও আর নেয়নি।
আমার সেদিন মনে হয়েছিল, কে যেন আমাকে আমার ভেতর থেকে টেনে বের করে ফেলল! আমি ওইদিন পরপর পাঁচবার বমি করেছিলাম, প্রচণ্ড মাথাব্যথা থেকে। আমি খুব বেশি কাঁদতে পারি না। আমি কাঁদলে খুব অসুস্থ হয়ে যাই, এজন্য বেশি কাঁদতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি কষ্টটাকে গিলতেও পারছিলাম না। কারণ ওর বিষয়ে কথা বলার মতো আমার কেউ ছিল না। তারপর আমি বগুড়া থেকে দুমাসের জন্য ঢাকা চলে যাই ভাইয়ার কাছে। কারণ ভাইয়ার বাচ্চাদের সাথে থাকলে আমার ওই কথাগুলো হয়তো মনে পড়বে না। দুমাস পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে আমি বগুড়ায় ফিরে আসি। আর একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমার ডিভোর্সের পর যে ছেলেটার সাথে আমার সম্পর্ক হয়েছিল, গত সাতমাস আগে ওর একটা ছেলেসহ ওর স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়ে যায়। ওরা এখন সম্পূর্ণ আলাদা। ডিভোর্সের পর ও আমাকে অনেক অনেক ফোন দিয়েছে ওকে আমার জীবনে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য, কিন্তু আমি সরাসরি রিফিউজ করে দিয়েছি।
আমি কখনওই আর ওর সাথে যোগাযোগ রাখিনি। ও মাঝে মাঝে ফোন দেয়। আমি অনেকবার নিষেধ করেছি ফোন দিতে, তা-ও দেয়। আমি তেমন কথা বলি না। ও বলে, ওর সাথে অন্তত ফ্রেন্ডশিপটা যেন রাখি। আমি ওকে সরাসরিই বলে দিয়েছি, আমার পক্ষে ওর সাথে কোনও সম্পর্কই আর রাখা সম্ভব না। আমাকে ও বিশবার ফোন দিলে আমি একবার রিসিভ করি, তা-ও নিজে থেকে কোনও কথা বলি না। একেবারেই না বললেই না, এমন দু-একটা কথা বলে রেখে দিই। ওর প্রতি কোনও প্রকার ভালোবাসা অথবা দুর্বলতা আমার নেই, আর কখনও হওয়া অসম্ভব। আমার এই কথাগুলো তোমাকে না জানানো পর্যন্ত আমার মাথা আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল। এজন্য আমি সব বলে দিলাম। হ্যাঁ, আমি জানি, আমার অনেক অনেক ভুল আছে, কিন্তু আমি ফেইক না। কখনও হবও না। আর একটা কথা, ডিভোর্সের পর থেকে আজ পর্যন্ত, তুমি আসার পর, অন্য আর কারও সাথেই কখনও কোনও রকম রিলেশনেই আমি আর যাইনি। সামনে কী হবে, আমি জানি না। আমি কিছুই জানি না। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার আর কিছু বলার নেই।