ঐতিহ্য-চেতনা

ঐতিহ্য-চেতনা সভ্য মানুষের জীবনে অপরিহার্য। এই চেতনাই তাকে করে আত্মসচেতন এবং আত্মমর্যাদাশীল। ব্যক্তিমানুষ যতই স্বাধীন আর স্বতন্ত্র হোক, তাকে ঐতিহ্যের বুনিয়াদের উপর জীবন গড়তে হয়। যেখানে মানুষ আপন জাতীয় বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহ্য সম্বন্ধে উদাসীন, সেখানে পরানুকরণের আতিশয্য দেখা না দিয়ে পারে না। কিন্তু ময়ূরের পাখায় কাকের রূপ বৃদ্ধি পেলেও মর্যাদা বাড়ে না কোনদিনই—শেষে একদিন অমর্যাদার ভারে রূপ তলিয়ে যায়, তখন তাঁতিকুল বৈষ্ণবকুল উভয়ই খোয়াতে হয়।

সমাজে একরকম মানুষ দেখা যায়, যাদের বিদ্যাবুদ্ধি, টাকাপয়সার প্রাচুর্য থাকলেও চলনে-বলনে এমন অসংগতি ও অসামঞ্জস্য দেখা যায়, যা রুচিকে পীড়া দেয়, শালীনতাবোধকে আহত করে। এদের বলা যায় উৎকেন্দ্রিক। নীতিকথার নীলবর্ণ শেয়ালের সঙ্গে তুলনা চলে তাদের। দুর্ভাগ্য, আমাদের সমাজে এই নীলবর্ণ শেয়ালের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দেশপ্রেম এবং স্বজাতি ও স্বধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার অভাবই এই মেকি জীবনের প্রতি আকর্ষণের কারণ।

দেশ এবং জাতির কল্যাণের জন্য দেশপ্রেমের বাড়া আর কিছু নেই, একথা আমরা সকলেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি। কিন্তু দেশপ্রেম যে কী জিনিস, সে সম্বন্ধে আমাদের ধারণা খুবই অস্পষ্ট। দেশ একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড মাত্র নয়। দেশের মানুষ, তার ইতিহাস, ভূগোল, তার সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য, তার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ—এসবের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বের নিগূঢ় সংযোগের উপলব্ধিই দেশপ্রেম। আমরা আমাদের সন্তানকে ভালোবাসি, কারণ তার মধ্যে আমরা নিজেকে অনুভব করি। কিন্তু আমরা দেশকে কতটুকু জানি! দেশকে জানতে হলে চাই দেশের ইতিহাস, দেশের সাহিত্য।

আমাদের ইতিহাস খণ্ডিত, সাহিত্য অসম্পূর্ণ। বিগত দু-শো বছরে যে-সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে, তার বেশিরভাগই একপেশে; সেগুলির মধ্যে আমাদের জীবন প্রতিবিম্বিত হয়নি। আর দেশের যে-ইতিহাস আমরা পড়ি, তা রাজরাজড়ার উত্থান-পতনের কাহিনি, কাটছাঁট করে লেখা ইতিহাস—সাধারণের নাড়ির স্পন্দন তাতে অনুভব করা যায় না। বর্তমান গণতন্ত্রের যুগে প্রয়োজন সাধারণ মানুষের ইতিহাস। ব্যক্তির জীবনে যেমন তার স্মৃতিশক্তি, জাতির জীবনে তেমনি তার ইতিহাস। যে-ব্যক্তি স্মৃতিশক্তি হারিয়েছে, সে উন্মাদ; আর যে-জাতির ইতিহাস নেই, সে বিভ্রান্ত ও দিশেহারা। ইতিহাসের মহাশিক্ষাই জীবনের দুর্গম পথের একমাত্র পাথেয়।
কিন্তু চাইলেই গাছের পাকাফলের মতো ইতিহাস টুপ্ করে হাতে এসে পড়বে না। তার জন্যও চাই সাধনা—জ্ঞানপিপাসুর সাধনা ও সত্যদৃষ্টি। কোনোরকম গোঁজামিল তাতে চলবে না। বীর্যের সঙ্গে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী আমরা। শুধু মহেঞ্জোদারো আর হরপ্পায় নয়, আমাদের অতীত গৌরবের ঐতিহাসিক স্বাক্ষর আর্যবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। দেশের ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে কেবল স্রোতে গা ভাসাব, এমন নির্বোধের মতো কথা কোনো বাংলাদেশিই বলতে পারবে না। বিশেষ করে, ঐতিহ্যের দাবির স্বীকৃতির জন্য পরের কাছে যেতে হবে না; এ আমাদের জন্মগত অধিকার।

বেদ ব্রাহ্মণ রামায়ণ মহাভারত আমাদের এ কথা বললে আমাদের পূর্বপুরুষদের পৌত্তলিকতা ধরা পড়ে যাবে। তা যাক না। যে-কোরেশরা হজরতকে হত্যা করতে প্রস্তুত ছিল, নিজের নামের পেছনে কোরেশী লিখে তাদের সঙ্গে রক্তের বন্ধনের স্বীকৃতি দিতে তো আমরা গৌরবই বোধ করি। তবে এখানে উলটো ব্যবস্থা কেন? দিনশেষে, যা সত্য, তা ঢেকে রাখলেও সত্যই থেকে যায়। সত্যের বিকৃতি ভালো কিছু বয়ে আনে না।

আসল কথা, আমাদের বিচারবুদ্ধির অভাব। পৃথিবীর মানচিত্রে দেশের সীমান্তরেখা বারে বারে বদল হবার নজির আছে, কিন্তু ইতিহাসের উপর পরিবর্তনের কোনো সূত্রই খাটে না। ইতিহাসকে আমরা অস্বীকার করতে পারি, কিন্তু তাকে ওলটাতে পারি না। তাই আজ হোক, কাল হোক, একদিন-না-একদিন সত্যসাধকের তপস্যায় অতীতের গুহা থেকে আমাদের প্রকৃত ইতিহাস বের হয়ে আসবেই। তবে তার আগে মিথ্যার অভিনয়ে আমাদের অনেকগুলি মূল্যবান দিন নিঃশেষ হয়ে যাবে।

তাই ইতিহাসের সত্যকে সাহসের সঙ্গে স্বীকৃতি দেবার সাহস এখনই আমাদের সঞ্চয় করা দরকার। এ স্বীকৃতির দ্বারা আমাদের স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধ ক্ষুণ্ণ হবে, এ কথা ভুল। ভাগীরথী আর গঙ্গা সম্পূর্ণ আলাদা নদী, যদিও হিমালয়ের বরফগলা জলেই উভয়ের পুষ্টি। ক্রমবিবর্তনের ধারায় মানুষের ইতিহাস নতুন নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করছে, এর কোনো অধ্যায়ই তুচ্ছ নয়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এ দেশের ইতিহাসের যে নাড়ির যোগ, তা শত শত বৎসরের নয়, সহস্র সহস্র বৎসরের—এ সত্যকে স্বীকার করে যেদিন আমরা ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে তৎপর হব, সেদিন এক বিরাটতর ঐতিহ্যের পটভূমিকায় আমাদের জীবনযাত্রা শুরু হবে।


Content Protection by DMCA.com