উদ্‌যাপনের একঘেয়েমি

আমাকে যেন কেউ জন্মদিনে না ডাকে। জন্মদিন কি বিবাহবার্ষিকী উদ্‌যাপনের কথা শুনলেই ভয় ধরে, হাতটান হয়, অর্থনৈতিক কারণে পা পেছোয়—’যাবে না’ বলে। হয়তো আমি একান্ত সাধারণ বলে নিতান্ত সাধারণের জন্মদিন বা বিবাহদিনে আরও সাধারণ গতানুগতিকতায় হারাতে চাইনে।

সাধারণ বলেই তো এ সাধারণকে জেনেছি, চিনেছি। নিস্তরঙ্গ এঁদো-ডোবার মতো চুপচাপ পড়ে থেকে দু-একটা ঢিল, ব্যাঙের লাফ, বড়ো বেশি হলে বৃষ্টির ফোঁটায় ঢেউ আগানোর স্বাদে অভ্যস্ত জীবনকে আলোড়িত করতে চাইনে দিবস উদ্‌যাপনের একঘেয়েমিতে।

তাই অতিপরিচিতের জন্ম- বা বিবাহবার্ষিকীতে প্রশ্ন জাগে—”আহা, এ জন্ম বা বিবাহে কী মহৎ কাজটা হলো যে এত ঘটা দরকার!” বিবাদে প্রস্তুত ও-পক্ষ বলবে, “আমরা এ দিনকে প্রিয় করতে চাই প্রিয়জনদের নিয়ে। প্রিয়জনদের বেলাতেও উৎসব করি তাদের ভালোবাসি বলে। সমাজের কাছে স্বনামধন্য না হতে পারি, নিজেদের কাছে তো আছি।” হ্যাঁ, শেষাংশের বক্তব্য আমারও। নিজেদের মধ্যেই আবদ্ধ থাক এ উৎসব, প্রিয়জনদের ভিড়ে অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখির হাত থেকে অন্তত বাঁচা যায়। সে সত্য বড়ো নির্মম, নেহাতই করুণ।

হিড়িক জিনিসটা কেমন করে জানি মানুষকে হিড়হিড় করে টেনে নেবার ক্ষমতা রাখে। দড়িটানার খেলায় যেমন দু-পক্ষ নিজ নিজ দলের সম্মান বাঁচাতে প্রাণের মায়া ছেড়ে টানে, অবশেষে দুর্বল পক্ষ হুড়মুড় করে পড়ে শক্তিশালীদের ওপর—তাদের সঙ্গে নয়, বরং যারা গণ্ডির বাইরে থেকে প্রেরণা জোগায়, তাদের সঙ্গে আমার মিল পাই।

এরা মোটাসোটা জোরালোদের বেছে দেয়, দড়ি ধরিয়ে দেয়, তারপর রুমাল উড়িয়ে গায়ের শক্তিটুকু গলায় ঢেলে সে শক্তি ছড়াতে চেষ্টা করে বলবানদের হাতে; যদিও অনেক সময় চেষ্টাটাই বড়ো হয়ে দেখা দেয়, তবুও। এরা স্বপক্ষের বিজয়ে রুমালের নিশান উড়িয়ে দাপাদাপি করে, পুরস্কার নেবার সময় হাততালি দেয় কান-ফাটানো, আর ভাবটা...“ও পুরস্কার আমাদেরই।”

আর যদি হেরে যায়, তাহলে ফিরেও তাকায় না, খেলায় নামানোর ইতিহাস বেমালুম যায় ভুলে। হিড়িক এমনি করে হুজুগে মাতায়, মাতাল করে অসহায় দুর্বল মানুষকে। অনেক মানুষের মেলায় হারিয়ে যাওয়া শিশুর মতো সে তখন তার চেনামুখ খোঁজে, বুদ্ধিমান পরিণতের মতো উচ্চস্বরের যন্ত্রে ঘোষণা করে না, "আমি এখানে আছি।”

জন্ম- কি বিবাহদিনের হিড়িকে আমরা অমন‌ই—অসহায় শিশুটির মতো। উৎসবের কোনখানে আমি আছি, নিজেই জানিনে, শুধুই অন্যের চরণের নূপুর হয়ে পায়ের তালে বেজে উঠছি। নিজে বাজতে জানিনে, ক্ষমতাও নেই। হয়তো বুঝিও না যে, চরণের কেমন তালে আমার ছন্দ। ছান্দসিক নই বলে কোন জায়গায় মাত্রা টানা দরকার, তা-ও বোধে আসে না।

কেউ অষ্টাদশী হলো বা কারুর অষ্টাদশ বিবাহবার্ষিকী, এমন সব পূর্তির সংবাদে খাপছাড়া আমার ভাবনা হয়, তোমাদের জীবনে কয়েকটি বছর যোগ করা ছাড়া অন্য কিছু তো হলো না। আমার নিজের জন্মদিনে তাই জন্মদিনের বিশেষ খাদ্যটির ওপর মোমের আলো জ্বলে না। কারণ ফুঁ দিয়ে ওদের আর নেভাতে হয় না—মোমবাহী বছরগুলি কেঁপে কেঁপে নিভেই রয়েছে। আলোর উৎসবে দান করবার মতো তাদের নেই কিছু। আর যার দেবার ক্ষমতা নেই, সে নিতেই-বা যাবে কেন?

তাই এদিন আমার একার, নিজের। সত্তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে বিচার করি যাচাই-করা আলোকে—আরও একটি বছর অতিক্রান্ত এই আমি কতটুকু আলোকিত হলাম?
Content Protection by DMCA.com