আত্মার স্বয়ংসম্পূর্ণতা

আত্মার কান আছে, আত্মা শুনতে পায়; আত্মার চোখ আছে, আত্মা দেখতে পায়। আমাদের মন যা বোঝে না, আমাদের আত্মা তা বুঝতে পারে। আমাদের হৃদয় যে-খোঁজ কোনোদিনই পাবে না, আমাদের আত্মা সেখানেই বসতি গড়ে। মানুষের জীবন চারটা স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে: শারীরিক বুদ্ধিমত্তা, মানসিক বুদ্ধিমত্তা, আবেগজাত বুদ্ধিমত্তা এবং আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তা। এই চারটি ঘরেই আত্মার অবাধ যাতায়াত, তবে আত্মার সুষম বিকাশ হয় চতুর্থ ঘরটিতে।

আত্মার বৃদ্ধি কিংবা ক্ষয় কিছু স্বতন্ত্র নিয়মকানুন এবং বিশ্বাসের ভিত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই, কোনো কথার মাধ্যমেই একে ব্যক্ত করা যায় না। এর প্রভাব একমাত্র সে ব্যক্তিই বুঝতে ও অনুভব করতে পারেন, যাঁর আত্মার সাথে ঐশ্বরিক সত্তার সংযোগ রয়েছে। আমরা যখন কারও বাহ্যিক অবয়বকে ভালোবাসি, সে ভালোবাসা একসময় হারিয়ে যায়, কারণ অবয়বের মোহ ক্ষণিকের। আর আমরা যদি কারও আত্মার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে ভালোবাসি, তবে সে ভালোবাসা চিরস্থায়ী, কারণ কেবল আত্মার সৌন্দর্য‌ই চিরস্থায়ী। আত্মাই একমাত্র অবিনাশী সত্তা—হৃদয় একসময় বন্ধ হয়ে যাবে, শরীর একসময় ক্ষয়ে যাবে, শুধুই আত্মাই অজর অক্ষয় অমর হয়ে টিকে থাকবে। আত্মা এক দেহ ত্যাগ করে আরেক দেহে তার নতুন আশ্রয় খুঁজে নেয়। এই জায়গাবদল চিরন্তন, তাই আত্মার বন্ধনে কাউকে বাঁধলে সে বাঁধন কখনোই ছিঁড়ে যায় না। এক আত্মা যখন সাদৃশ্য বিচার করে আরেক আত্মাকে খুঁজে নেয়, সেখানে কোনো ভুল থাকে না। সতীর্থের প্রতি আত্মার এমন ভালোবাসাই একমাত্র নিখাদ ভালোবাসা। একজনের সাথে আরেকজনের নিঃশ্বাস, বিশ্বাস, ভাবনা, কাজ—এ সব কিছুই যখন একই ধরনে একই বলয়ে আবর্তিত হয়, তখন দু-জনের মধ্যে দৃঢ়তম বন্ধন রচিত হয়। জীবনের সুন্দরতম অর্থ এর মধ্যেই নিহিত।

অনেকসময় দেখা যায়, চিনি না, জানি না, এমন কাউকে প্রথম বারের মতো দেখলেও মনে হতে থাকে, আমরা যেন কত জন্মের চেনা। সেই অপরিচিতকে কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে করে, পাশে বসিয়ে গল্প করতে ইচ্ছে করে, তাকে আন্তরিক বন্ধু বানাতে ইচ্ছে করে। এরকম কেন হয়? কেন আমাদের অবচেতন মন এমন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষকেও আপন ভেবে ফেলে? আবার কখনো কখনো দেখা যায়, পরিচিত কিছু মানুষকে আমরা সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলি, তারা নিজ থেকে গল্প করতে এলেও আমরা দৌড়ে পালাই। আমরা কেন এমনটা করি? সে মানুষটি তো আমার কোনো ক্ষতি করেনি। তবু কেন?

এই দুই ধরনের ঘটনার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। প্রথম ক্ষেত্রে সেই অপরিচিতকে দেখামাত্রই কী-একটা যেন আমাদের ভেতর থেকে বার বার বলে দিচ্ছিল, এ মানুষটি দূরের কেউ নয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সেই পরিচিতকে দেখলেই আমাদের মনে হতে থাকে, এ মানুষটির সংস্পর্শে থাকলে আমি কোনভাবেই স্বস্তিতে থাকতে পারব না। দুই ক্ষেত্রেই দুটি আত্মা পরস্পরকে কাছে টানতে বা দূরে ঠেলতে চেয়েছে বলেই আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের দুইটি ভিন্ন রকমের সংকেত পাঠিয়েছে। এমনি করেই কোনো এক রহস্যময় উপায়ে দুটি আত্মা সংযুক্ত বা বিযুক্ত হয়। এক‌ই ছাদের নিচে দশ বছর একসাথে থেকেও কাউকে আপন ভাবা যায় না, আবার মাত্র দশ মিনিটের পরিচয়েই কাউকে আপন ভাবতে ইচ্ছে করে। এ এক বিচিত্র রহস্য!

কার সাথে মিশব, কাকে এড়িয়ে চলব, এটা ঠিক করার ক্ষেত্রে আত্মার এই নির্বাচন পদ্ধতি বেশ কাজের। একই ব্যক্তিকে কারও হয়তো ভালো লাগে, আবার কেউ হয়তো তাকে সহ্যই করতে পারে না। যার যাকে ভালো লাগে, তার সাথেই মিশতে সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে; অর্থাৎ দুই আত্মার মধ্যে এক অদৃশ্য সংযোগ স্থাপিত হলে তখন সে দুইটি আত্মা মিলতে চায়।

এক ছেলে হাঁটতে পারত না, কিন্তু খুব ভালো গাইতে পারত। এক মেয়ে ঠিকমতো কথা বলতে পারত না, কিন্তু বেশ শক্তসমর্থ ছিল। একদিন তাদের দেখা হয়। তাদের পরস্পরকে পছন্দ হয়ে যায় এবং তারা বিয়ে করে। ছেলেটা হুইলচেয়ারে বসে গান গাইতে থাকে, মেয়েটা সেই চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। লোকে খুশি হয়ে ওদেরকে যা দেয়, তা দিয়েই ওদের সংসার চলে। দুটো আত্মা এক হয়ে এক আত্মার স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে সুন্দরভাবে বেঁচে রইল।

আত্মার একাত্মতা মানুষকে সুন্দরভাবে ভাবতে ও ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে উদ্‌বুদ্ধ করে। কাছে আসার কিংবা দূরে সরে যাবার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। একেক জন একেক ভাবে নিজস্ব নিয়মে ভালোবাসে, নিজেকে প্রকাশ করে। যে নিয়ম যার মনে ধরে, সে ওই নিয়মের মানুষকে কাছে টানতে চায়। সচেতনভাবেই হোক, আর অবচেতনভাবেই হোক, আমাদের আত্মা আমাদেরকে যে-পথের সন্ধান দেয়, সে পথই সঠিক পথ।
Content Protection by DMCA.com