আমি যদিও একদমই স্বাভাবিক ছিলাম না, তা-ও বললাম, ‘আমি স্বাভাবিক আছি, তুমি বলো।’ ও বলল, ‘দেখো, আমাদের রিলেশনটা বাসা থেকে মানবে না।’ আমি বললাম, ‘কেন?’ ও বলল, ‘কারণ আমরা সেইম এইজের।’ আমি বললাম, ‘তুমিই তো বলেছিলে যে এটা কোনও ব্যাপারই না। তুমি সব ঠিক করে নেবে।’ ও বলল, ‘হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু আমার ফ্যামিলিতে যারাই প্রেম করে বিয়ে করেছে, তাদের কেউই সুখে নেই।’ আমি বললাম, ‘এতদিন সুখে ছিল, যেই তুমি ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে যাবে, ঠিক তখনই সব অসুখী হয়ে গেল?’ ও তো তখন রেগে মেগে আগুন! বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি এইভাবে বলছ আমাকে? দেখো, এটা মেইন কারণ না। আরও আছে অনেক কারণ।’ আমি বললাম, ‘কী কী কারণ, বলো।’ ও বলল, ‘তুমি শুনলে সহ্য করতে পারবে না।’ আমি বললাম, ‘এত মাস যখন এত কিছু করেছি, এখন যা শুনলাম, তারপরও আমি স্বাভাবিক আছি, তো আমি বাকিটা শুনলেও পারব সহ্য করতে। বলো তুমি।’ ও বলল, ‘দেখো, তুমি অনেক বেশি চিকন। তুমি নিজের যত্ন একদমই নাও না। তুমি ভালো করে পড়াশোনা করো না। তুমি ভালো করে খাও না। তুমি কারও সাথে মিশো না। তুমি শহরের মেয়ে, তুমি গ্রামে গিয়ে তাল মিলাতে পারবে না। তুমি তো ননীর পুতুল, যাকে শুধু শোকেসে সাজিয়ে রাখা যায়, কিন্তু তাকে নিয়ে সংসার করা যায় না।’ আমি বললাম, ‘আমি তো সব কাজই করতে পারি। হুম, আমি ননীর পুতুল, কিন্তু তোমার জন্য, আমি রান্না ও বাকি সব কাজ শিখেছি, আর তুমি বলছ এখন এই কথা? ঠিক যা যা কারণ বললে, ঠিক এই এই কারণগুলির জন্য একদিন তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে, আর আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে, এখন কেন এইসব কথা?’ আমি কথা বলছিলাম স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু আর ও আরও তিন-চার গুণ বেশি রেগে গিয়ে বলে, ‘এখন ভালো লাগছে না আমার, ব্যস! তোমার প্রবলেম?’ আমি বললাম, ‘না না, প্রবলেম হবে কেন?’ আসলে আমার আর কিছু বলার ছিল না। ও বলল, ‘আমি লম্বা, আর তুমি আমার চেয়ে খাটো, ঠিক পারফেক্ট ম্যাচিংটা হয় না।’ এসব আমার নিজের কানে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছিল। একে তো অসুস্থ শরীর, তার উপর এইসব, আমি কিছুতেই তাল মিলাতে পারছিলাম না। ও ফোনটা কেটে দিল। আমি চুপ করে বসে রইলাম। আর এই সেই ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, কীভাবে সম্ভব এইসব? সারাদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম। তারপর আমি আর কল দিইনি, যদিও ইচ্ছা করছিল খুব দিতে; এমনকি মেসেজও দিইনি। তার দুই দিন পর ও নিজেই কল দিল। আর বলল, ‘সরি। আমার মাথা গরম ছিল, তাই আমি উলটা-পালটা বলেছিলাম।’ এটা শুনে আমার তখন কেমন আনন্দ হচ্ছিল, আমি বলে বোঝাতে পারব না। ও কী কী বলেছে, তা আমার মাথায় নেই, আমার মাথায় একটাই জিনিস, আর সেটা হলো, ও ফিরে এসেছে! নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষটি মনে হচ্ছিল! আমি ঠিক দুই দিন পর যেন বুক ভরে নিশ্বাস নিয়েছিলাম! তারপর আগের মতো আবার কথা শুরু হলো। এই স্বপ্ন সেই স্বপ্নে ভরে উঠতে লাগল আমাদের জীবন। কথা হতো, ও যদি ভার্সিটিতে চান্স পায়, তখন কীভাবে দেখা হবে আমাদের? ও খুব মিস করবে আমার হাতের রান্না, ভার্সিটিতে গেলে কে এইসব করে খাওয়াবে…এইসব কথাবার্তা। ও পাস করার পর জব নিবে। আমাকেও জব নিতে বলত। এই একটা কথা যেন আমার সব খুশি উড়িয়ে নিয়ে যেত। যা-ই হোক, আস্তে আস্তে ও আবার ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে লাগল। তারপর হঠাৎ একদিন বুঝতে পারলাম যে ওর আবার মন খারাপ। আমি জানতে চাইলে বলতে চাইছিল না। তারপর বলল, ভার্সিটিতে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যে টাকাটা আমি ওর জন্য জোগাড় করেছিলাম, সেটা শেষ। তখনও অ্যাডমিশন টেস্ট বাকি। তাই ওর আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। আর ওর চান্সও হবে না। আর ও চাইত না যে, ও ন্যাশনালে পড়বে। তাহলে ওর এক ইয়ার ড্রপ যাবে। এরকম আরও অনেক ইমোশনাল কথা বলে কেঁদে দিল। আমার খুব খারাপ লাগল। আমি ওকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। ওকে বললাম, ‘তুমি টেনশন কোরো না। তুমি পড়তে থাকো। আমি দেখব।’ ও বলল, ‘কী দেখবে তুমি?’ আমি বললাম, ‘আমি হেল্প করব।’ ও বলল, ‘না না। আমি অনেক নিয়েছি, আর নেবো না হেল্প।’ আমি বোঝালাম। ও আর কিছু বলল না। ও হয়তো মনে মনে এটাই চাইছিল যে আমিই বার বার সেধে টাকাটা দিই। আমার কাছে কিছু টাকা জমানো ছিল। আমি সেইগুলি দিয়ে দিলাম তাকে। তারপর সে পরীক্ষা দিল। হলো না চান্স। এরপর একটাতে দিল, ওটাতে ওর চান্স হলো। তারপর ও ভার্সিটিতে চলে গেল। আমি বলেছিলাম দেখা করতে, কিন্তু ও বলেছিল, ওর যেতেই হবে। কারণ ওর তখনকার ভর্তির টাকা ওর মামা দিয়েছিলেন। ওর মামা আর তেমন হেল্প করেননি। যতটা করছিলেন, তাতে ওর চলছিল না। যা-ই হোক, এইরকম সময় ওর প্রেজেন্টেশনের জন্য ফরমাল ড্রেস লাগবে। কিন্তু তখন এত বেশি খরচ হয়ে গিয়েছিল যে, ও আর ওর ফ্যামিলির কাউকে বলেনি। আমাদের রিলেশন ছিল, তাই সব কথাই হতো। জানতে পেরে আমি ওকে ফরমাল ড্রেস কেনার টাকা দিলাম। এর মাঝে ওর বড়ো আপু বিয়ে করল। ও বলত, ওদের পরিবারে রিলেশন করে বিয়ে মানবে না, কিন্তু আপু ঠিকই রিলেশন করেই বিয়ে করেছিলেন। তখন ও বাসায় এসেছিল। ও খুব বিজি ছিল বিয়েতে, তাই আমার কল ধরার বা আমাকে টেক্সট করার সময় পেত না। সারাদিনে এক-দুই মিনিটের মতো কথা হতো। তারপর আমি একদিন কল করাতে ওর কাজিন ধরেছিল। ওর অনেক কাজিন আমাদের ব্যাপারটা জানত। কিন্তু যে ধরেছিল, সে জানত না। আমি অন্য ভয়েস পেয়ে কেটে দিয়েছিলাম। এটা ও জানতে পেরে খুব বেশি ক্ষেপে যায়। আমার সাথে দুই দিন নরমাল টোনেই কথা বলে। কিন্তু হঠাৎ একদিন বলে, ‘তোমার সাথে আমার একটু জরুরি কথা আছে, আমি রাতে বলব।’ আমি তো অপেক্ষায় ছিলাম কখন রাত হবে, আর আমি শুনব। রাতে কল দিয়ে বলে, ‘আজ আমি খুব বেশি টায়ার্ড, কাল বলব।’ আমি আর কিছু বলিনি। নেক্সট ডে’তে আমার জন্য কী আসতে যাচ্ছিল, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। পরের দিন ও কল করে বলল, ‘দেখো, এইভাবে রিলেশন রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কারণ আমার নিজের পায়ে দাঁড়াতে আরও সময় লাগবে। তোমাকে বাসা থেকে এতদিন বিয়ে না দিয়ে রাখবে না।’ আমি বললাম, ‘রাখবে কি রাখবে না, সেটা তো আমি বুঝব। তোমার সেটা না বুঝলেও চলবে।’ ও বলে, ‘দেখো, তোমাকে আমি একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতে টেনে নিয়ে যেতে পারি না। আর আমার ফ্যামিলি কনডিশন একদমই ভালো না। তুমি পারবে না মানাতে।’ আমি বললাম, ‘আমি তো সব জানিই। কিছুদিন পর পর একই কথা কেন বলো তুমি?’ ও বলে, ‘আমার বাসায় প্রেমের বিয়ে মানবে না।’ ও তখনও জানে না যে আমি জানি, ওর আপুর প্রেমের বিয়ে হচ্ছে। ওর এক কাজিন আমাকে বলেছিল এই কথাটা। আমি বললাম, ‘আপু তো প্রেম করে বিয়ে করছে, আর তুমি করলে প্রবলেম?’ ও বলে, ‘এইসব কে বলেছে তোমাকে?’ আমি বলি। ‘যে-ই বলুক, এটা কিন্তু সত্যি।’ ওরা আবার এমন ছিল যে প্রেম করে বিয়ে করতে পারবে, কিন্তু লোকে জানলে ওদের মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। ও আমাকে বলে, ‘তুমি আমার বোনের নামে অপবাদ দিচ্ছ কিন্তু! খবরদার!’ আমি বললাম, ‘প্রেমের বিয়ে অপবাদ হয় কী করে? এটা তো ভালো। দুজন মানুষ পরস্পরকে ভালো করে চিনে জেনে বুঝে তারপর বিয়ে করছে। তো খারাপ কীসের?’ ও বলল, ‘দেখো, কে কী করছে, তা আমি জানি না। কিন্তু আমার বোন এমন কাজ করতে পারে না।’ আমি বললাম তখন, ওর যেই কাজিন আমাকে বলেছিল, তার নাম নিয়ে যে, অমুক আমাকে বলেছে। ও তখন চুপ করে থাকল। তারপর লাইন কেটে দিল। তার কিছুক্ষণ পর ও আবার কল দিল। বলল, ‘হুম, আমার আপুর প্রেমের বিয়ে, কিন্তু আপুর যোগ্যতা আছে, তাই হয়েছে বিয়েটা।’ আমি বললাম, ‘তা-ই? তা ঠিক কী কী যোগ্যতা আছে আপুর, বলো।’ তখন ও চুপ হয়ে গেল। ও বলল, ‘দেখো, আপুর যা হওয়ার হয়েছে, সে পরের বাড়ির বউ, কিন্তু তুমি হবে আমার বাড়ির বউ। আর এটা গ্রাম, শহর না। এখানে বউ হতে হলে কিছু যোগ্যতা লাগে।’ এরকম আরও অনেক কিছুই বলল ও। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু শুনছিলাম। এখন যেটা ভাবি, আসলে এটা আমার অহংকার না। কিন্তু ভাবনাগুলি এসে যায় মানুষের স্বভাবের কারণে। সেটা হলো, যার এত এত প্রবলেম, যাকে আমি ফাইনাশিয়াল প্রবলেম থেকে দূরে রাখার জন্য নিজের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, তার সবই করেছি, সে আমার সাথে এমন করল? আমি নিজেকে তৈরি করছিলাম তার জন্য, যার পারিবারিক অবস্থা কিনা আমার বাসার কাজের খালার চেয়েও খারাপ? আবার তার বাসার বউ হতে গেলেও নাকি আমার যোগ্যতা লাগবে! কেন? শুধু সে ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে, আর আমি পাইনি, আমি ন্যাশনালে পড়ি, তাই? হায় রে ভার্সিটি! ভালোবাসায় কিন্তু কোনও যোগ্যতা হয় না। আমার একজনকে ভালো লাগে, আপনার চোখে ভালো না-ও লাগতে পারে। কাউকে ভালো যে কেন লাগে, আমার তো মনে হয়, যারা প্রেম করে বিয়ে করে সুখে আছে, তারাও বলতে পারবে কি না সন্দেহ! আর আশেপাশের লোকের কাজই তো উলটা পালটা মন্তব্য করা। তারা মন্তব্য করে এমন কিছু একটা নিয়ে, যাতে তাদের ঠিক ওই ব্যাপারটা নিয়ে আপনি কিছু না বলেন। তো যা-ই হোক, প্রেম করার আগে, এইসব কিছুই ব্যাপার ছিল না। কিন্তু ও ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর, লোকে কী বলবে, এটা খুব বড়ো একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। তখন আমার অনেক যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে! এদিকে আমি ছিলাম প্রেমে অন্ধ। তাই সব উপায়ে নিজেকে প্রমাণ করার জন্যই আমি প্রস্তুত ছিলাম। আমি বললাম, ‘বলো, ঠিক কী কী যোগ্যতা লাগবে? আমি প্রমাণ দিতে রাজি।’ ঠিক এই কথা শোনার জন্য ও নিজেও প্রস্তুত ছিল না। কারণ ও ভেবেছিল, আমি হয়তো পিছিয়ে যাব। ও আমার এই কথা শুনে আরও বেশি হতাশ হলো। আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, ‘তুমি এত ডেসপারেট কেন?’ আমি বললাম, ‘তুমি এইসব বাদ দাও, যোগ্যতার কথা বলো।’ ও তখন কিছু খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করাল। ও বলল, ‘নামাজ পড়তে হবে তোমাকে। তুমি তো রোজা থাকো না, কিন্তু রোজা থাকতে হবে। তোমাকে ধর্মীয় বিধিনিষেধ সব মানতে হবে। চাকরি করতে হবে, ঘরের কাজ করতে হবে। গ্রামের মা-বোনরা যা যা করে, তা-ই তা-ই করতে হবে।’ আমি শুধু শুনছিলাম। কিছু বলিনি। তারপর ও কল কেটে দিল। আমি বসে পড়লাম আর ভাবছিলাম, ‘কীভাবে সম্ভব এইভাবে বলা!’ যখন কেউ বুঝে ফেলে যে একটা মানুষ তাকে ভালোবেসে ফেলেছে এবং তাকে ছাড়া বাঁচা সে মানুষটার পক্ষে সম্ভব নয়, তখন সে ওই মানুষটাকে মুখে যা আসে, তা-ই বলে ফেলে। প্রায় মানুষই সুযোগ পেলে ছোটোলোক হতে ছাড়ে না। অথচ, আমিই ওকে অনেক বলতাম, ‘তুমি নামাজ পড়ো।’ আমি নিজেও তখন নামাজ পড়তাম। কিন্তু চার ওয়াক্ত। ওদিকে ও কিন্তু এক ওয়াক্তও পড়ত না। শুক্রবারের জুম্মার নামাজটা পর্যন্ত কখনও পড়েছে কি না সন্দেহ! যে ধর্ম বানান করতে আদৌ জানত কি না আমি সন্দিহান, তার মুখেও এইসব শুনতে হলো! হায় রে ভণ্ড! আর ও ওর বোনের সাথে তুলনা করল আমাকে! যদিও কাউকে নিয়ে বলা বা তাকে ছোটো করার মতো ইচ্ছা আমার নাই, কিন্তু তখন ভাবতে লাগলাম অনেক কিছু। ওর বোন ছিল আমার থেকে কালো, খাটো, পড়ালেখায়ও অষ্টরম্ভা! জীবনে একমাত্র প্রেমটাই সে মনোযোগ দিয়ে করেছে, গ্রামের মেয়ে হয়েও কাজকর্ম তেমন কিছুই পারত না সে। আর ফাইনানশিয়াল অবস্থার কথা তো বললামই। এইসব কি যোগ্যতার মাঝে পড়ে? তা ছাড়া আমি কখনও এইসব যোগ্যতার মাপকাঠিতে চলতাম না। আমি দেখতাম একটা মানুষের মনটা কেমন। আমাদের কলেজে যদি আমি এখনও যাই, স্যার-ম্যামরা এখনও বলেন, তোমাদের ব্যাচে একটা ছেলে ছিল না…জাহিদি? ও কিন্তু অনেক ভালো একটা ছেলে। ওর খবর কী? যেই যাক, তাদেরই ওর কথা বলেন স্যার-ম্যামরা। হ্যাঁ, আমি ওর মন দেখেই ওকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু ওর আপুর তো সেই মনটাও ছিল না। কুটিলতা, অহংকারে ভরা একজন মানুষ সে। কীসের এত দেমাক তার, আমার সেটাও মাথায় আসে না। অবশ্য মেয়েরা যে কী নিয়ে দেমাক করে, তা ওরা নিজেরাও বোঝে না। আর যাকে সে বিয়ে করেছিল, সে ভাইয়া ছিলেন যেমন শিক্ষিত, তেমন সুন্দর, তেমন বড়োলোক। মানে সমাজ এবং আবেগের চোখে যাকে পারফেক্ট বলা যায়, ভাইয়া ছিলেন সেটা। ভাইয়া কী দেখে পছন্দ করেছিলেন আপুকে, আমার জানা নেই। যা-ই হোক, ভাইয়া অত্যন্ত ভালো মনের একজন মানুষ। ওদের দুজনের বিয়ে নিয়ে ভাইয়ার পরিবারে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। ভাইয়া সেইসব সামলেছিলেন। আর শেষে কিনা হয়ে গেল এইসবই আপুর যোগ্যতা, যা আমার ছিল না! আসলে খতিয়ে দেখতে গেলে বলতে হয়, যোগ্যতা কি ওর নিজের ছিল না? না কি আমার ছিল না? আমার এই প্রশ্নের জবাব তখনও পাইনি, এখনও পাই না। আমি ভাবছিলাম ওর কথা শুনে, ও কি ঘরে বউ চায়, না কি কাজের লোক? একটা মানুষ ভালোবাসলে কীভাবে বলতে পারে এইভাবে? আর এই মানুষটা কে? যাকে আমি চিনতাম, যে সবার চোখে ভালো, সে কি? আমি খুব কাঁদলাম সারাদিন এইসব ভেবে। দুই-তিন দিন আমি আর কল দিইনি, আর সেও দিল না। আরও দুই-তিন দিন পর সে কল দিল। তখন আমার টু জি সেট ছিল। ওখানে ইউটিউব চালানো যেত না। তো সে আমাকে বলল, তুমি ইউটিউবে যাবে, আর সুশান্ত পাল ভাইয়ের কিছু ক্যারিয়ার আড্ডার ভিডিও আছে, সেগুলি দেখবে। ভালো করে দেখবে। একদম মুখস্থ করবে। আমি কিছু প্রশ্ন করব। উত্তর দিতেই হবে। আর তোমাদের ক্যাম্পাসের যেসব সংগঠন আছে, ওগুলির সাথে কালই গিয়ে যুক্ত হবে। বাইরে তো মিশো না। সারাদিন প্রেম আর প্রেম। এবার একটু সামাজিক জীব হও। এত প্রেম প্রেম নিয়ে থাকলে চলে না। আমি তখন ইউটিউব চিনতাম না। কারণ আমার ফোনটা তো সেই লেভেলের ছিলই না। আমি ওকে কিছু বলিনি। চুপ করে শুনলাম। ওইটুকু বলেই সে ফোন কেটে দিল। আমি তখন কলেজে ছিলাম। আমার কলেজে অ্যাকাডেমিক পরীক্ষা চলছিল। আমি পরীক্ষা দিয়ে কিছুক্ষণ গাছের নিচে বসে ছিলাম আর ভাবছিলাম, কী হচ্ছে এইসব! একটা সময় ছিল যখন আমি যে কারও সাথে তেমন মিশতাম না, সেটাই তার ভালো লাগত। আমি ছেলেদের সাথে মিশলে খারাপ হব, এটাই সে বলত। এইসব সংগঠন আমি করতে চাইতাম, কিন্তু সে চাইত না। আর আজ, আমাকে সে সামাজিক জীব বানাতে চাইছে। সে বলেছিল, ভিডিও না দেখা অবধি যেন আমি তাকে কল না করি। কিছু শিখে এরপর যেন কল করি। কিন্তু আমার ফোনে তো দেখা সম্ভব না। আর ইউটিউব বলে যে কোনও জিনিস পৃথিবীতে আছে, সেটাই আমি তখন প্রথম শুনলাম। আমি আর কল দিইনি। আমি পরীক্ষায় মন দিলাম। কিন্তু আমার অনেক বেশি মন খারাপ থাকত। খুব কাঁদতাম, আর পড়তাম। আমি জোরে একবার পড়লেও কোনও জিনিস মনে রাখতে পারি। কিন্তু জোরে পড়লে আমার টনসিল ফুলে যায়, গলা বসে যায়। কিন্তু কথা বললে তেমন কোনও সমস্যা হয় না। তা-ও হয় মাঝে মাঝে অনেক সমস্যা, কিন্তু পড়লেই বেশি হয়। তাই যে-কোনও কিছুর পেছনেই আমার সময় বেশি লাগে। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে। আমার যদি এই সমস্যা না থাকত, আমিও পারতাম আরও ভালো করে পড়তে। কিন্তু আমি আগে এমন ছিলাম না। আমার এই সমস্যাও ছিল না। হয়ে গিয়েছে। কেন, সেটা গল্প এগোলে বুঝবেন। ভাবতে আরও বেশি খারাপ লাগে, যখন আমি পারতাম পড়তে, তখন পড়তাম না। কিন্তু এখন ওইভাবে পারি না, আল্লাহ সেই ক্ষমতা আমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছেন। আমার অনেক বেশি সমস্যা, যেগুলি বলতে নিজেরই লজ্জা লাগে খুব। ভালো লাগে না কাউকে বলতে। নিজের কষ্ট নিজের কাছেই রাখি। কষ্ট শেয়ার করতে হয় না। কষ্ট যার-তার সাথে শেয়ার করলে কষ্টের দাম কমে যায়। পৃথিবীতে যে নিজের কষ্টের দাম কমিয়ে ফেলে, তার চাইতে বেশি দুঃখ আর কেউ পায় না। ধরুন, আমি ম্যাথ ভালো পারি। আর ম্যাথ করতেও আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু আগে যে চ্যাপটারটা করতে আমার ৪৫ মিনিট লাগত, সেটা রিভিশন দিতেই আমার এখন সারাদিন কেটে যায়। হাঁপিয়ে যাই আমি খুব এখন। আমি জোরে পড়লে কোনও কিছু মনে রাখতে পারছি চট করে, কিন্তু পড়লে গলা ভেঙে যাচ্ছে। তখন সেই জিনিস মনে মনে পড়তে গেলে আমাকে ১৫/১৬ বার পড়তে হচ্ছে। সময় অনেক নষ্ট হচ্ছে। আবার সারাদিন থাকি ঘরে। এমনিই লাগে পাগল পাগল, তার উপর আমার চারপাশে এত বেশি বাধা যে আমি চাইলেও অনেক কিছু করতে পারছি না। তা-ও চেষ্টা করছি আমার সেরাটা দেওয়ার। আমার গলাটা ভালো হলে কোনও বাধাই আর মানতাম না। আমার খুব ঠান্ডার প্রবলেম। এর জন্য আমাকে ডেইলি ২১০ মিলিগ্রাম ওষুধ খেতে হয়। আমার ঘুমও হয় কম। এইগুলির কারণে তো দুর্বলতা বাড়ে। খুব খারাপ লাগে আমার। এত যে কষ্ট হয় সারাদিন আমার! কিন্তু আমি কাউকেই এসব বুঝতে দিই না। আবার ভাবি, আমি এইসব ডিজার্ভ করি। প্রেমের কয়েক মাস আমি যে পরিমাণ খারাপ ব্যবহার করেছি বাবা-মায়ের সাথে, তা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু তাঁদের কোনও অভিযোগ নেই আমার প্রতি। তারপরও পাপ তো পাপই হয়, তাই না? ভাবতে অবাক লাগে, আমি পাপ করলে সাথে সাথেই এর শাস্তি পাই, আর পুণ্য করলে এর কোনও পুরস্কার পাই কি আদৌ নিজেও জানি না। হ্যাঁ, এটা আমার পরীক্ষা হিসেবেই আমি ভেবে নিয়েছি। কিন্তু যারা আরও বেশি পাপ করে, তারা তো দেখি দিব্যি থাকে! এটাই বাস্তবতা!! তবে সবকিছুর পরেও, নিজেকে এগিয়ে ও সুখী রাখার জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। যা-ই হোক, আমি গল্পে ফিরে আসি। তারপর আমার পরীক্ষা শেষ হলে আমিই ওকে কল দিই। এই কয়দিন ও একদমই কল দেয়নি। আমি কল দিলে ও জিজ্ঞেস করে, আমি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছি কি না। আমাদের ক্যাম্পাসের যত সংগঠন ছিল, তার হর্তাকর্তা ছিল ওর ছোটো বোন। আমি যদিও জানাইনি, কিন্তু সে জানত আমাদের ব্যাপারটা, তার কাজিনরা বলেছিল। ওই মেয়ে এমন ছিল যে, তার যার উপর রাগ থাকত, তাকে দিয়ে সে অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ করাত। তো আমি তাকে বললাম, ‘…এইসব কারণে আমি ওখানে যাইনি।’ এটা শুনে ও তো আরও দ্বিগুণ রেগে গেল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমি দেখেছি কি না ইউটিউবে ভিডিও। আমি বললাম, ‘আমার ফোনে তো দেখা যায় না।’ ও বলল কারও ফোন দিয়ে দেখতে। আমি বললাম, ‘কে দেবে ফোন?’ ও বলল, ‘বাহ্! আজ পর্যন্ত এমন কোনও ফ্রেন্ড পাতাতে পারো নাই, যে ফোনটা একটু দিবে ইউটিউব দেখার জন্য? আসলেই তুমি একটা অসামাজিক মেয়ে!’ আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা এমন নয়। আসলে আমি চাই না কাউকে বিরক্ত করতে।’ তারপর ও বলল, ‘দেখো, আমরা সেইম ইয়ার। তুমি এখনই আমার কথা শুনো না, তো বিয়ের পরে শুনবে কী! আর যতই বলো শুনবে, কিন্তু এইভাবে হয় না। আর আমার এখনও দাঁড়াতে অনেক বছর লাগবে, আমি পারব না, এত বছর তোমাকে ওয়েট করাতে।’ আবার শুরু করল সেই একই সব পুরনো কথা। আমার আর ভালো লাগছিল না এসব শুনতে। আমি বললাম, ‘তুমি কী চাও সোজাসুজি বলো।’ ও বলল, ‘এখন আমরা আলাদা থাকি, মানে ব্রেকআপ যাকে বলে। আমাদের মাঝে কোনও কমিটমেন্ট থাকবে না। জাস্ট ফ্রেন্ড হয়ে থাকব। তোমার বিয়ের প্রপোজাল এলে তুমি বিয়ে করে নেবে। আর না এলে ওয়েট করবে। আমি দাঁড়াতে দাঁড়াতে তোমার বিয়ে না হলে তারপর ভেবে দেখব।’ আমি অবাক হয়ে ওর কথা শুনছিলাম। আমি বললাম, ‘এত বছর রিলেশন থাকার পর জাস্ট ফ্রেন্ড হয়ে থাকা কি যায়? আর বিয়ের প্রপোজাল তো এসেছিল, তোমার জন্যই আমি তখন মানিনি। আর এখন এইসব বলছ?’ ও আবার রেগে গেল। ‘দেখো, প্রতিদিন এক ঘ্যানঘ্যান আমার ভালো লাগে না। তুমি যদি এই শর্তে রাজি থাকো তো বলো। নইলে আমাকে আর কল বা মেসেজ করে না জ্বালালে আমি খুশি হব। কোনটা চাও তুমি?’ আমি বললাম, ‘দ্বিতীয়টা বেছে নিলাম আমি।’ ও বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ! দেখো, আমি ভালো না। তুমি আমার থেকে ভালো কাউকে পাবে। আর যা-ই করো, কখনও প্রেম কোরো না। প্রেম জিনিসটা আসলে ভালো না, বুঝতেই তো পারছ। ভালো থেকো।’ আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়েই ও কলটা কেটে দিল। আমি কিছু বলতে চাইছিলাম। কিন্তু ও আমাকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিল। আমার পুরো জীবনটাই যেন ধসে পড়ল। অনেক মাস আমি আয়নায় নিজেকে দেখিনি। আমার চুল ছিল সবার কাছে ঈর্ষা করার মতো। যে কেউই আমার চুলের প্রশংসা করত। যেমন লম্বা, তেমন সিল্কি, তেমন ঘন কালো। বেশ কিছুদিন ধরে দেখছিলাম চুল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঝরে পড়ছে। আমি ফরসা বা কালো ছিলাম না, উজ্জ্বল শ্যামলা ছিল গায়ের রং। আমার মুখে কোনও রকম দাগ বা ব্রণ ছিল না। সবাই আমার চুল আর স্কিনের প্রশংসা করত। সেইদিন প্রথম অনেক মাস পর আমি আয়নার সামনে গেলাম। সবাই বলছিল, আমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। কানে নিইনি। আয়নার সামনে দেখলাম, চুলগুলি পাটের আঁশের মতো খসখসে হয়ে গেছে। চুল উঠতে উঠতে শতকরা আশি ভাগই পড়ে গিয়েছে। চোখ দুইটা এত কালো হয়েছে যেন কেউ ঘুসি মেরেছে। মুখে কালো ছোপ ছোপ দাগ। অসংখ্য ব্রণে ভরে গিয়েছে পুরো মুখ। কী বীভৎস সে দৃশ্য! এইগুলি ছিল কয়েক মাসের অতিরিক্ত টেনশন, মানসিক চাপ, কান্না, রাতজাগা, ভালো করে না খাওয়া, নিজের যত্ন না নেওয়ার জলজ্যান্ত সাক্ষী। এইবার আমি ভাবতে লাগলাম। কার জন্য,…কার জন্য আমি সব হারিয়ে বসে আছি আজ সব? সে কী করল এটা? কেন করল? আমার কী অপরাধ ছিল? আমি ছিলাম অনেক নরম প্রকৃতির। কোনও ধাক্কা সহ্য করতে পারতাম না। হঠাৎ করে দেখলাম, আমার বুক ভারী হয়ে আসতে লাগল। আমার নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে। তখন জানতাম না, এটাকে শ্বাসকষ্ট বলে। জানবো কী করে? আমার চৌদ্দগুষ্টি তো দূরে থাক, আমার প্রতিবেশিদেরও তো নেই এইসব। আমি ভাবলাম, বুঝি আজরাইল আমাকে নিতে এসেছে! আবার আমার হাত পা কাঁপতে শুরু হলো। আমি বসা থেকে নিচে পড়ে গেলাম। আর ফ্লোরে টাকিমাছের মতো লাফাতে লাগলাম। মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে গেল। আমার রুমে সাধারণত কেউ ঢুকে না। আর আমি সারাক্ষণই পর্দা দিয়ে রাখি বলে রুমে কী করি, তা-ও কেউ জানে না। সেইদিন হয়তো আল্লাহই আম্মুকে পাঠালেন হঠাৎ করে আমার রুমে। তিনি সেই অবস্থা দেখে চিৎকার দিলেন। কাঁদতে লাগলেন। লোক জড়ো হয়ে গেল। তারপর আমার আর জ্ঞান নেই। তবে পরে শুনেছিলাম যে, সেইদিন ছিল কুমিল্লা শহরে অবরোধ। দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। পথে কোনও যানবাহন নাই, হাসপাতালে কোনও ডাক্তার নাই। কেউ নিতে চায় না। সে কী এক মর্মান্তিক অবস্থা! তারপর এক হাসপাতালে ইন্টারনি-করা আপু-ভাইয়ারা নিলেন। আমি তাঁদের কথা কখনও ভুলব না। আমার প্রেশার কমতে লাগল। ৮০/৫০ হয়ে গেল। জ্ঞান না থাকলেও আমার কাঁপুনি কমেনি। আমার তখন ইসিজি করা হলো। হার্টবিট স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। যখন অক্সিজেন-মাস্ক দিল, অবস্থা আরও খারাপ। আমি ধীরেই নীল হতে লাগলাম। আমার মায়ের আহাজারিতে হাসপাতাল তখন ভারী হতে থাকল। আপু-ভাইয়ারা নতুন ছিলেন। তাঁরা এমন দৃশ্য প্রথম দেখছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, আমি মারা যাব। তাঁরাও কাঁদতে লাগলেন। তখন সিনিয়র কোনও ডাক্তার ছিলেন না। তাঁরা তাঁদের সিনিয়র ডাক্তারকে কল দিলেন। সব বললেন। ডাক্তার বললেন, অক্সিজেন মাস্ক খুলে দাও, আর মুখে পলিথিন চেপে ধরো। আপু-ভাইয়ারা এই রিস্ক নিতে চাইছিলেন না। তাঁরা ভাবছিলেন, মাস্ক খুলে দিলে আমি মারা যাব। তারপরও রিঙ্কি নামের একজন ইন্টারনির আপু এগিয়ে এলেন সাহস করে। তারপর পলিথিন ধরার পর আমার অবস্থা আরও খারাপ। আমি একেবারে নীল রঙের হয়ে গেলাম। তখনও আমার সেন্স নাই। আমি এইসব পরে জেনেছি। এক আপুই বলেছিলেন। কিন্তু জীবনে কোনও একটা ভালো কাজের বিনিময়ে পলিথিন ধরার কিছুক্ষণ পর আমি স্বাভাবিক হতে লাগলাম। তবে সব ঠিক হতে আরও এক ঘণ্টা লাগল। তারপর আমার হুঁশ ফিরলে তারা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। সেইদিন বাবা-মায়ের সাথে ইন্টার্ন-করা রাফিকা আপু, রিঙ্কি আপুও ছিলেন সারারাত। আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। তার দুই দিন পর আমি বাসায় ফিরলাম। তারপর আমার সিটিস্ক্যান হলো। এমআরআই হলো। আমার সবই নরমাল। তারপর আমার টিএইচএস আর আইজিই টেস্ট হলো। এইসব এর আগে আমার নরমাল রেঞ্জে ছিল। টিএইচএস-এর নরমাল রেঞ্জ ৪-৬…আমার ছিল ৪, কিন্তু তখন হয়ে গেল ২২০! আর-একটু বেড়ে গেলে আমার মাথায় ইনফেকশন হয়ে যেত। আইজিই-এর নরমাল রেঞ্জ ১০০, আমার ছিল ১১০, সেদিন বেড়ে হয়ে গেল ১৪০০! ডাক্তার আমাকে একা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমি কোনও টেনশন করছি কি না। আমি অস্বীকার করেছিলাম। কারণ সেই মুহূর্তে আমার আশেপাশে অনেকে অনেক কথা বলছিল। কেউ বলছিল আমি প্রেম করে ছ্যাঁকা খেয়েছি, কেউ বলছিল আমাকে জিনে ধরছে, কেউ বলছিল আমি অ্যাবনরমাল হয়ে গিয়েছি। এইসব কথাবার্তা। এইগুলি নিয়ে বাবা-মা অনেক আপসেট ছিল। তাই আমি চাইছিলাম না যে কেউ জানুক। তারপর বাবা মাকে ডাকলেন। আর বললেন, ও কিছু একটা নিয়ে টেনশন করে। যার কারণে ওর টিএইচএস আর আইজিই লেভেল অনেক বেশি বেড়ে গিয়ে দুইটার রিঅ্যাকশনে এইসব হয়েছে। এর সমাধান যতখানি না মেডিসিন, তার থেকে বেশি ওর হাসিখুশি থাকা। বাসায় গিয়ে জানার চেষ্টা করো ওর কী হয়েছে। তারপর আমাকে বাবা-মা জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু আমি কিছুই বলিনি। আমার রুম থেকে পর্দা এবং দরজাও খুলে ফেলা হলো, যেন আমি আর একা না থাকি। তারপরও আমার এত মেডিসিন চলছিল যে আমার এত মন খারাপ লাগা সত্ত্বেও কোনও অনুভূতি ছিল না আমার মধ্যে। আমি আমার সব ফ্রেন্ডের কাছ থেকে ডিটাচড হয়ে গেলাম। কলেজেও যেতাম না। তারপর আমি টুকটাক ফেইসবুক চালাতাম। হঠাৎ দেখলাম, আমাকে একজন মেসেজ রিকোয়েস্ট দিল। সে ছিল জাহিদির ফ্রেন্ড। সে অন্য ভার্সিটিতে পরে। কিন্তু আমাদের সাবজেক্ট একই ছিল। সে জাহিদির কাছে সব জেনে আমাকে সান্ত্বনা দিতে আমাকে নক করত। আমার আবার একটা স্বভাব আছে, কাউকে আমার ভালো না লাগলে আমি তার মেসেজ সিন করে ফেলে রাখি। সে প্রতিদিন আমাকে নক করত, আর আমাকে মোটিভেট করার ট্রাই করত। আমি রেসপন্স করতাম না। আমি এমনিতেও গায়ে পড়া ছেলে আমি পছন্দ করি না। একদিন সে বলল, একটা ম্যাথের সল্যুশন আমি করে দিতে পারব কি না। আমি সেইদিন প্রথম উত্তর দিলাম। আমি সলভ করে দিলাম। সে সালাম দিয়ে কথা শুরু করত। সে ৫০/৬০টা টেক্সট করলে আমি ২/৩টার উত্তর দিতাম। সে আমাকে মোটিভেট করত অনেক। কিন্তু মন খারাপ থাকলে ভালো কথাও বিষ বিষ লাগে। আমারও তা-ই লাগত। তাই আমি একদিন রেগে মেগে বললাম, ‘আপনি এত জ্ঞান দেন কেন? আপনি কী বুঝবেন আমার কষ্ট?’ ও একটুও না রেগে বলল, ‘দেখুন, আমারও কষ্ট আছে। আমি কাউকে বলিনি। আপনি আমাকে যেমন দেখেন, আমি তেমন না।’ সে বলল, তারও একটা রিলেশন ছিল। শুধু মেয়েটা ভালো রেজাল্ট করেছিল বলে সেই রিলেশন মেয়েটা ভেঙে দেয়। সে আরও অনেক কিছুই বলেছিল, কিন্তু সবকিছুর সারমর্ম এটাই ছিল। তার বড়ো বোন রিলেশন ভেঙে গিয়েছিল বলে সেই কষ্ট সহ্য না করতে পেরে হার্টঅ্যাটাকে মারা যান। তারপর বলল, ‘আপনাকে অনেক ডিসটার্ব করছি। সরি।’ আমি তখনও তাকে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত করিনি। কিন্তু সেইদিন করলাম। পরে দেখলাম, তার ভার্সিটিতে তার একটা ভালো সম্মান আছে। আর সে খুব হাসিখুশি থাকে সব সময়। সে টিউশনি করে নিজে চলে, আবার ফ্যামিলিকেও চালায়। আমি অবাক হয়ে যেতাম এটা ভেবে যে একটা মানুষের এত কষ্ট, তা-ও সে হাসিখুশি থাকে কীভাবে? তারপর আমি ঠিক করলাম যে, না আমাকেও ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তাকে দেখে শিখতে হবে। সে আমাকে প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় জিজ্ঞেস করত, আমি কেমন আছি। আমার ফ্যামিলি কেমন আছে, এটাও জানতে চাইত। আমি ভার্সিটিতে-পড়া ছেলে-মেয়েদের রেসপেক্ট করতাম ঠিকই, কিন্তু তখনও সে আমাকে যত টেক্সট করত, আমি তার এক ভাগও দিতাম না। সিন করে রেখে দিতাম। তবে যদি সে পড়ালেখা নিয়ে আলোচনা করত, তার উত্তর দিতাম। আমরা চাকরির বা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করতাম। সে খুব ভালো ইংরেজি পারত, আর আমি পারতাম ম্যাথ। দুজন দুজনের সব প্রবলেম সলভ করে দিতাম। বেশিরভাগ সময় আমরা পড়া নিয়েই পড়ে থাকতাম। এর মধ্যে সে চাইল দেখা করতে। আমি চাইছিলাম না দেখা করতে। কিন্তু সে খুব করে চাইল। তারপর সে একদিন কুমিল্লায় এল। দেখা করেও সেই এক পড়ালেখা নিয়ে গল্প, আর জীবনদর্শন নিয়ে কথা। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম, আমার বয়সি একজন কীভাবে পারে এত? আমি তো পারি না! আবার ভাবলাম, না না, আমি আগেও এইসব ভেবে ধরা খেয়েছি, আর না। তারপর সে চলে গেল। সে মাঝে মাঝে কিছু কথায় আমাকে জানান দিতে লাগল যে সে আমাকে পছন্দ করে ফেলেছে। আমি এড়িয়ে যেতাম। সারাদিনে আমি আমার পাস্ট নিয়ে ভাবতাম না। কিন্তু সে বললেই মনে পড়ত। আমি যেন সব মিল পাচ্ছিলাম। আমি এড়িয়ে গেলে সে বাড়াবাড়ি করেনি কখনও। তারপর সে আবার একদিন এল। আমাকে না জানিয়েই। এসে কল দিল। দেখা করতে বলল। আমি দেখলাম, ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির দিকে যাচ্ছে। তাই ওকে মিথ্যা বললাম যে আমি গ্রামে তখন। সে চলে গেল। আরও কিছু মাস সে আমাকে বোঝাতে লাগল আরও ভালো করে যে সে আমাকে পছন্দ করে। আমি তার একদিকে তো পৃথিবী আর-একদিকে। আমার নামটা ওর কঠিন লাগত তাই ও আমার নাম দিল পারু। ও ‘দেবদাস’ উপন্যাস থেকে আমার এই নামটা খুঁজে দিয়েছিল। ও কখনও আমাকে নাম ধরে ডাকেনি। নাম দেওয়ার পর সব সময় মজা করে সিসটার পারু ডাকত। উত্তমকুমার কোনও একটা মুভিতে সুচিত্রা সেনকে সিসটার বলে ডাকতেন খ্যাপানোর জন্য, সেখান থেকে সেও ডাকত আমাকে ওরকম। আর আমি ওকে ডাকতাম আমার উত্তম বলে। ওর এক ফ্রেন্ড আমাকে বলেছিল, ‘আপনার জন্য ও আমাদের সময়ও দেয় না।’ আমি অবাক হতাম শুনে। কেন এইসব করে ও? আমি চাই না এইসব আর। এনাফ ইজ এনাফ! আর কষ্ট পেতে চাই না। তারপর হঠাৎ একদিন ও আমাকে প্রপোজ করে। প্রপোজটা ছিল একটু ভিন্ন স্টাইলে। মুগ্ধ হবার বদলে আমি তখন ‘না’ করে দিয়েছিলাম ওকে। পরে আরও দুই মাস ও আমার পিছনে লেগে ছিল যেন আমি সব ভুলে আবার সামনে এগোই। আমি বললাম, আমার পাস্ট এক্সপেরিয়েন্স তো খুবই খারাপ, তুমি জানোই সেটা। ও বলল, ‘আমি কখনও কোনও অভিযোগ করতে দেবো না তোমাকে। তুমি যা চাইবে, তা-ই হবে। তোমার মতামতই আমার মতামত। আমি যে-কোনও কিছুর বিনিময়ে হলেও তোমাকে চাই।’ আমি বললাম, ‘আমি কোনও কাজ পারি না, জবও করতে পারব না। আমার অনেক শারীরিক সমস্যা।’ এইসব বলেছিলাম যাতে ও সরে যায়। কিন্তু ও বলল, ‘সবই আমি করব। কাজের লোক থাকবে। আমি তোমাকে তোমার মতো করেই মেনে নিতে রাজি।’ আমি বললাম, ‘আমার আরও ভাবতে হবে। আমি হুট করে কোনও ডিসিশন নিতে পারব না।’ ওর সম্পর্কে নানান দিক ভাবতে শুরু করলাম। দেখলাম, যেইসব গালিকে আজকালকার যুগে সবাই ফ্যাশন মনে করে, সেসব খারাপ খারাপ কথা ওর মুখে আমি কখনও শুনিনি। ও শুধু আমার না, আমার ফ্যামিলির ভালো-মন্দও ভাবে। আমার সবকিছুই কত সহজে মেনে নিচ্ছে! আমি ওকে আমার নিজের সম্পর্কে তেমন কিছুই বলিনি। কিন্তু আমার বাসার ঠিকানা পর্যন্ত ও কীভাবে যেন জেনে গেছে! আর আমার খুঁটিনাটিও সব জেনে নিয়েছে। আমি তো পুরোই ইমপ্রেসড। (আমি আসলে খুব অল্পতেই ইমপ্রেসড হয়ে যাই, এটা আমার একটা বদভ্যাস।) তারপর আমি ওকে বললাম আবার, ‘দেখো, আমি মানতে পারছি না। আমার মন সায় দিচ্ছে না। তুমি খুবই ভালো। কিন্তু…’ ও বলল, ‘দেখো, তুমি আমাকে পছন্দ না-ই করতে পারো, কিন্তু এভাবে অপমান কোরো না, প্লিজ। আমি তোমাকে ভালোবাসি, এবং এখানে কোনও ভুল নেই। তুমি আমার পবিত্র ভালোবাসাকে অপমান করতে পারো না, তাই না?’ তারপর আমি অনেক ভেবে ভেবে অবশেষে মেনে নিলাম। অনেক অনেক বেশিই ভালো যাচ্ছিল আমার সবকিছুই। ও অনেক বেশি কেয়ারিং ছিল। আমার কোনও কাজে ও কখনও বাধা দিত না, জোর করে কিছু করতে বলত না। আমাকে সব কাজেই উৎসাহ দিয়ে বলত, যখন যা ইচ্ছা হয় করবে। ইচ্ছা না হলে করবে না। তখন আমার হঠাৎ আলসার হয়। আহা, তখন আমার থেকে যেন ওর কষ্টই অনেক বেশি! আমার জন্য ডাব কিনে বোতলে ডাবের পানি ভরে ক্যুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই সেই কত জিনিস যে দিত! সবই আমার বান্ধবীকে দিয়ে পাঠাত। আর বাসায় তখন জানত, ওসব আমার বান্ধবী দিয়েছে। আমি কিন্তু খুব রেগে ছিলাম। কেন ও এমন করল, তাই। ও বলে, আমার ভালো লেগেছে, আমি করেছি। তাতে কার কী? তারপর নানান স্বপ্ন দেখতাম আমরা। ও-ই বেশি দেখাত। আমার ভালোই লাগত। আমি কোনও লাগজারিয়াস লাইফ কখনও চাইতাম না। আমি যেমন যেমন চাইতাম, তেমন তেমনই বলত ও। আমি কখনও বলিনি, আমি কেমন কী চাই। কিন্তু কেমন করে জানি ও জেনে যেত সবই। আমি বলতাম, ‘তুমি জানো কী করে?’ ও বলে, ‘আমি খুব বুঝি তোমাকে।’ আমার তখন নিজেকে খুব সুখী মানুষ মনে হতো! তারপর একদিন! ও বাড়ি গেল। আর চেইঞ্জড হয়ে গেল। একদম পুরোপুরিই! কোনও কারণ ছাড়াই, কিংবা এমন কোনও কারণে, যা আমি জানি না। আমার তখন কেমন যে লাগছিল! ও আমার সাথে কথা বলে না, কিছুই না। হঠাৎ একদিন কল দিয়ে বলে, ‘তুমি আমাকে ভুলে যাও।’ আমি তো অবাক! ‘কেন?’ ও বলে, ‘আমি তোমাকে হ্যাপি রাখতে পারব না। আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। তোমার ভালোর জন্যই আমি তোমার সাথে আর যোগাযোগ রাখতে চাই না। তুমি ভালো থেকো।’ আমি যেন আমার কয়েক বছর আগের অতীতকে দেখছিলাম। বেশ কিছুদিন আমি ওকে অনেক নক করলাম। এরপর ও আমাকে আগের জনের মতোই সব জায়গা থেকে ব্লক দিল। আমি আবার একইভাবে অসুস্থ হলাম। একই ধরনে, একই অবস্থায়। সেইদিনও একই রকম পরিস্থিতি ছিল কুমিল্লায়। আমি শুনেছিলাম, হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। কিন্তু আমার হিস্ট্রি যে এত খারাপভাবে বারে বারে রিপিটেড হবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি! পৃথিবীর সব খারাপ জিনিসগুলিই আমার সাথে ঘটে! কিন্তু কেন? আমি দেখতাম, সেইদিন থেকে এখন পর্যন্ত সে আমাকে নিয়ে অনেক আবেগি আবেগি স্ট্যাটাস দেয়। তার ফ্রেন্ডসার্কেলকেও আমার কথা অনেক বলে। এসব দেখে আমার অনেক বেশি খারাপ লাগে, কিন্তু আমি তাকে আর জ্বালাই না। আমার কখনও এত সব রোগ ছিল না। কিন্তু এইসব প্রেম-ভালোবাসা করতে গিয়ে আমার এত রোগ হয়ে গেছে। প্রথম প্রেম ভাঙার ৩ বছর পর আমার বান্ধবীর বিয়েতে আমার প্রথম প্রেমিকের সাথে দেখা। আমি উত্তেজিত হতে পারি না। আমার ঠান্ডায় শ্বাসকষ্ট হয় না, শ্বাসকষ্ট হয় আমি রেগে গেলে, কাঁদলে বা বেশি টেনশন বা মন খারাপ করলে। আমার প্রথম প্রেমিক আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কেমন আছি। বড়ো হয়েছি, তাই আর পাগলামি ভাবটা নাই। আগের পাগলামি থাকলে হয়তো কথাই বলতাম না। আমি ওর প্রশ্নের উত্তর দিলাম। কিন্তু আমি কিছুই জানতে চাইনি। তারপর বলল, আমি নাকি সুন্দর হয়ে গিয়েছি। মোটাও হয়েছি বেশ। সে জানত, আমার বয়স হলে আমি মোটা হবই। তবুও… তবে মোটা বলতে ফিনফিনে শরীরের থেকে একটু উপরে। আমি মিডিয়াম গড়নের। তারপর সে বলল, আমাদের বয়সে যেখানে সব মোটা হয়ে হাতি হয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমি নাকি নিজেকে খুব সুন্দর করে মেইনটেইন করছি। আমি হ্যাঁ না কিছুই বলিনি। রাতে বসল একটা আড্ডা। সেখানে তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, সে প্রেম করে কি না। সে বলল, ‘না। আমি একজনকে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম, কিন্তু সে করেনি, তাই আর প্রেম করিনি।’ আমি কিছু বলিনি। তারপর বাসায় ফিরে এলে সে ফেইসবুকে আমাকে নক করে। আমি উত্তর দিইনি। ভালো লাগে না আমার আর এইসব। এর দুই-একদিন পর একটা মেয়ে আমাকে নক করে। আমি উত্তর দিই না। কিন্তু সে হঠাৎ বলে, ‘আপু, আমাকে একটা হেল্প করবেন?’ আমি তো আবার কাউকে হেল্প করার কথা শুনলে লাফিয়ে পড়ি! বললাম, ‘জি বলুন।’ পরে এই সেই কথায় জানতে পারলাম, সে জাহিদির গার্লফ্রেন্ড। আমার সাথে ব্রেকআপ করার মেইন কারণ, তার নতুন রিলেশন ছিল। মেয়েটাকে বলার মতো কিছুই ছিল না আমার। শুধু ভাবলাম, ‘আহা, এক মানুষের কত রূপ!’ জানি না আমার উত্তম এমন কিছু করছে কি না। জানতে চাইও না আমি! আমি এখন লোকের কাছে পাষাণ, অহংকারী। কারণ সেকেন্ড ইয়ারের পর আমার সিজিপিএ বেড়েছে। তাই আমি ভাব নিয়ে চলি। ছেলেদের সাথে কথা বলি না, রেজাল্টের জন্যই নাকি! সবাই এমন নানান কথা বলে। আমি কাউকে হেল্প করি না, কারণ আমার মন নাই। অবশ্য আমার এত কিছু কেউই জানে না। আমি কিছু না বলে শুধু হাসি। আমি কী, হেল্প করি কি করি না, সেটা উপরে যিনি আছেন, তিনি জানলেই চলবে আমার। আর কেউ না জানুক। বাসা থেকে চায় আমাকে বিয়ে দিতে। কিন্তু আমি ভাবি, ধাক্কা খেলাম, এখন বাবা-মা আছে, তাই আমার পেট চলল। কিন্তু বিয়ের পর এমন হলে, তখন? আমি মারা যাব না ঠিকই, কিন্তু এইবার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারব না। জাস্ট পাগল হয়ে যাব। মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা খুব দরকার। একটা মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে সে এই পৃথিবীর অনেক কুৎসিত দিককে পরোয়া না করেই চলতে পারে। এটা আমি সেইদিন জেনেছিলাম, যেইদিন আমার উত্তম আমার জীবন থেকে চলে গেল। কিন্তু বয়সও বাড়ছে। ভালো কথা শুনতেও এখন আর ভালো লাগে না। আরও নানান প্রবলেম। হ্যাঁ, আমি মরে যাইনি, বেঁচে আছি। তবে এটাকে বাঁচা বলে না। শুধু বলব, ওর নতুন রিলেশনের কথা শোনার পর আমার মন খারাপ অনেকটাই চলে গিয়েছে। একটা আইসক্রিম খেলে যেমন ফিল হয়, তেমন লাগছে। এইবার আশা করি, আমি ভালো করে পড়তে পারব। শান্তি নিয়েই পড়তে পারব। আমি জানি না, এইভাবে ভাবাটা কোনও পাগলামি কি না, কিন্তু কোথাও থেকে একটুখানি শান্তি পাওয়া কী যে জিনিস আমার জন্য, তা আমি বোঝাতে পারব না। আমার দ্বিতীয় প্রেমিক আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছে, তা আমি আগের জনের কাছ থেকে পাইনি। তাই আমি ওকে আজও ভালোবাসি, আজও ভুলতে পারিনি। আমি সত্যিই জানতাম না, ও কেন চলে গিয়েছিল। কারণটা তো ও আমাকে বলেইনি। যা-ই হোক, আমি কিন্তু আজ অবধি ভাবি যে ও একদিন ঠিকই ফিরবে। আবার আমি যদি ওর আইডি ঘাঁটি তো দেখি যে, ও বেশ ভালোই আছে। ও আর ফিরবে না। আর আমাকে তো সে ভুলেই গেছে! তাই ওর আর ফেরার কোনও চান্স নাই। যা-ই হোক, এমন একটা দোটানায় আমি সব সময়ই থাকি। ওকে তো আমি ভালোবাসতেও পারি না, আবার ঘৃণাও করতে পারি না। এ এক অদ্ভুত সমস্যা, মধুর যন্ত্রণা! সে আমার এমন মানুষ, যাকে আমি ভালোও বাসি না, ঘৃণাও করি না। তাকে যে আমি এখন কী করি, আমি তা নিজেও জানি না। এটাকে মায়া বলে কি না কে জানে! যা-ই হোক, কাল আমি এক ফেইসবুক সেলিব্রেটির অনেক আগের একটা পাবলিক পোস্ট পড়ছিলাম। দেখি, আমাদের ব্রেকআপের ঠিক ৭ মাস পর ও ওই পোস্টে একটা ইমোশনাল কমেন্ট করেছে আমাকে নিয়ে। সেখানে, ও আমাকে যে নিকনেইম দিয়েছে, আর আমি ওকে যে নিকনেইম দিয়েছি, সেইগুলিই ইউজ করছে। সত্যিটা কী জানেন, আমি না আসলেই জানি না ও যে কী! হুম আমি জানি, এই বয়সে দাঁড়িয়ে এমন ভাবা জাস্ট বোকামি। কিন্তু ভাবনার তো কোনও বয়স লাগে না। কালকের ওই জিনিস দেখার পর থেকে আমার দম আটকে আসতে চাইছে। আমি কাল থেকে একটা লাইনও পড়তে পারিনি। কত মোটিভেশনাল উক্তি আমার কানে যাচ্ছেই না! মাথায় শুধু ওই একটা কমেন্ট ঘুরছে। আমি পারছি না আমার বোকা বোকা অনুভূতিগুলিকে চাপা দিতে। মনে হচ্ছে, আমাকে শক্ত হতেই হবে, কিন্তু ওই একটা কমেন্ট আমাকে দিচ্ছেই না শক্ত হতে! আবার মনে হচ্ছে, ওর যদি এতটাই ইমোশন থাকে তো ও এই কয় বছরে কেন একবারও চেষ্টা করেনি আমার সাথে যোগাযোগ করার? আমি জানি না, আমার কোনটা বিশ্বাস করা উচিত। কমেন্ট, না কি ওর ফেইসবুকের কাণ্ডগুলি, না কি ও আমাকে যা যা বলেছে। আমি আজ জানি না কিছুই। মাথায় ব্যথা করছে অনেক। আর পারছি না বলতে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কেউ নেই আমার শেয়ার করার, তাই আপনাদের বললাম বোকা বোকা অনুভূতিগুলি। হুম আমি জানি, এসব ভাবা উচিত নয়। এই বয়সে এসে এইগুলি ভাবতেও নাই। আসলে যখন আমি বেশি মেনটাল প্রেশার নিয়ে ফেলি, তখনই এমন হয়। যে মানুষটা অভিনয় করে বাঁচতে জানে, যে মানুষ অন্য মানুষকে মোটিভেট করে, তার আবেগ থাকতে নেই। ওর হয়তো কোনও আবেগই নেই! আমি মনে করি, আসলে কষ্টটাকে কক্ষনো মাথায় ওঠাতে নেই। ওঠালে সেটা মাথায় ব্যথা দেয়। কষ্টকে রাখতে হয় বুকের বাঁপাশে। তবেই সেটা শক্তিতে পরিণত হয়। আমার কষ্ট সব সময় বুকের বাঁপাশেতেই থাকে। বেশি প্রেশার নিয়ে ফেললে মাথায় চড়ে বসে। আমি তো কাউকেই বলি না, আর কাউকে বুঝতেও দিই না। আপনাদের পেলাম, তাই বোকা বোকা অনুভূতিগুলি শেয়ার করলাম। আসলে আমার মাঝেমধ্যেই মাথা কাজ করে না। আর আমার তো অনেক জেদ। আমি যদি ভাবি, কোনও কাজ করব তো ওটা করবই। আর সারাদিনই থাকি ঘরে। আমি যে পাগল হয়ে যাই না, তা-ই তো কত! তার উপর আমার নেই কেউই…শেয়ার করার একজনও মানুষ! এভাবে বাঁচা যায়! তাই বেশি বেশি ইমোশনাল হয়ে যাই আরকি! এই যে এত বোকা বোকা অনুভূতি শেয়ার করে ফেললাম, তাই নিজেকে ইম্যাচিউর ইম্যাচিউর লাগছে খুব। ভাবছি, আপনারা কত পিচ্চি ভাবলেন আমাকে! আসলে আমি মোটেও তা নই। ও আমাকে বলত, আমি নাকি ইম্যাচিউর, পিচ্চি! কিন্তু আমি নিজেকে অনেক বেশি বদলে ফেলেছি। আমি বেশি রাত অবধি ফোন চালাতে পারি না। আর চালালে, তখন আমার ঘুম আসে না। কালও তা-ই হলো। আর তার উপর ছিল আমার মন খারাপ। হলো সোনায় সোহাগার মতো ব্যাপার। ঘুম আমার ধারে কাছেও আসেনি কাল। ঘুম ঘুমিয়ে পড়ল, আর আমি রইলাম জেগে! জানালা খুলে আকাশ দেখতে দেখতে ভোর হয়ে গেল। তাই আর বেশি কিছু বলতে চাই না। মাথা এখনও খুব গরম। আবার দেখা গেল, আবোলতাবোল বকব। তবে যা-ই হোক, আশা করি, একদিন আমার কষ্টও দূর হবে, আর আমিও একদিন সুখপাখিটার দেখা পাব!