মাণ্ডূক্য উপনিষদ (মন্ত্র ৫) প্রাজ্ঞ আত্মাকে বর্ণনা করেছে এভাবে—“এষ একীবূতঃ প্রাজ্ঞ একীবূতঃ আনন্দভুক চেতোমুখঃ প্রাজ্ঞঃ।” অর্থাৎ, প্রাজ্ঞ একতাস্বরূপ (সমস্ত অভিজ্ঞতার সমবেত রূপ), আনন্দভোগী (সুষুপ্তির আনন্দের ভোক্তা), এবং চেতনার মুখে অবস্থানকারী (চেতনার সম্ভাবনাময় স্তরে অবস্থিত)। এই অবস্থায় সমস্ত দ্বৈত ভেদ মুছে যায়; আনন্দ থাকে, কিন্তু জ্ঞান থাকে না। তাই প্রাজ্ঞ শান্ত হলেও মুক্ত নয়—কারণ সে এখনও অবিদ্যা দ্বারা আচ্ছন্ন।
বেদান্তে আত্মার চারটি অবস্থা বর্ণিত হয়েছে—জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয়। জাগ্রতে আত্মা বৈশ্বানর নামে পরিচিত—বাহ্যজগৎ ও ইন্দ্রিয়সংযোগে ব্যস্ত; স্বপ্নে আত্মা তৈজস নামে পরিচিত—অন্তর্মনস্ক, সংস্কার-নির্মিত জগতে অবস্থানকারী; সুষুপ্তিতে আত্মা প্রাজ্ঞ নামে পরিচিত—অবচেতন আনন্দে লীন, কিন্তু অবিদ্যা-আবৃত; আর চতুর্থ বা তুরীয় অবস্থায় আত্মা নিজ শুদ্ধ স্বরূপে অবস্থিত—চৈতন্যমাত্র, অদ্বিতীয়, শান্ত ও শিবময়।
শঙ্করাচার্য তাঁর মাণ্ডূক্য-ভাষ্যে (মন্ত্র ৫)-এ প্রাজ্ঞ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন—প্রাজ্ঞ সেই আত্মা, যিনি অবিদ্যার উপাধির প্রভাবে একীভূত (অদ্বৈত) প্রতীয়মান। সুষুপ্তিতে ব্যক্তি-চেতনা জগৎ-চেতনার পার্থক্য ভুলে যায়; কিন্তু এই একত্ব জ্ঞানজনিত নয়, অবিদ্যাজনিত—কারণ সেখানে জ্ঞানের আলো নিভে আছে।
সুষুপ্তি অবস্থায় মানুষ ঘুমিয়ে থাকে—মন, ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি তখন সম্পূর্ণ নিস্তরঙ্গ। তাই সে কিছু দেখে না, কিছু জানে না, কিন্তু শান্ত থাকে। এই অবস্থায় আত্মা অবিদ্যা দ্বারা আচ্ছন্ন; অচেতন নয়, তবু জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে না। সেজন্য সেখানে যে-আনন্দ অনুভূত হয়, তা প্রকৃত জ্ঞানের আনন্দ নয়, বরং অচেতনতাজনিত শান্তি—অবিদ্যা-আবৃত সুখ। শঙ্করাচার্য একে বলেছেন, “অবিদ্যা–উপাধিনিমিত একীবূতাভাসঃ প্রাজ্ঞঃ”—অর্থাৎ প্রাজ্ঞ সেই আত্মা, যিনি অবিদ্যার কারণে একীভূতভাবে প্রতীয়মান (মাণ্ডূক্য ভাষ্য, মন্ত্র ৫)। এখানে আনন্দ আছে, কিন্তু জ্ঞান নেই।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৩.৩২) এই অবস্থার বর্ণনায় বলে—“এষ হ্যনন্দয়াতি, আনন্দভুক হ্যেষ।” অর্থাৎ, এই আত্মা সুষুপ্তিতে আনন্দভোগ করে এবং আনন্দে থাকে। কিন্তু এই আনন্দ কোনো জ্ঞানজনিত নয়, এটি অবিদ্যা-আবৃত অবস্থা—অচেতন শান্তি। যেমন কেউ গভীর ঘুমে বিশ্রাম পায়, কিন্তু জানে না, সে বিশ্রাম পাচ্ছে, ঠিক তেমনি প্রাজ্ঞ আত্মা তখন বিশ্রামে থাকে, কিন্তু জ্ঞানের আলো প্রকাশ পায় না।
তুরীয় অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি কোনো নিদ্রা নয়, কোনো আচ্ছাদন নয়। এখানে আত্মা সম্পূর্ণ জাগ্রত—নিজের চৈতন্যে, নিজের দীপ্তিতে স্থিত। মাণ্ডূক্য উপনিষদ (৭) বলে—“নান্তঃপ্রজ্ঞং, ন বহিঃপ্রজ্ঞং, ন উভয়তঃপ্রজ্ঞং, ন প্রজ্ঞানঘনম্… একাত্মপ্রত্যয়সারম্, প্রপঞ্চোপশমম্, শান্তম্, শিবম্, অদ্বৈতং, স ঐষ তুরীয়ঃ।” এই অবস্থায় চেতনা না অন্তর্মুখ, না বহির্মুখ; সে সমস্ত অভিজ্ঞতার সীমা পেরিয়ে এক নিখাদ অস্তিত্বে স্থিত। “শান্তম্” শব্দটি এখানে নিদ্রার শান্তি বোঝায় না, বরং চৈতন্যময় অবিচল শান্তি—যেখানে আর কোনো বিকার নেই, কোনো অভাব নেই।
শঙ্করাচার্য ব্যাখ্যা করেছেন—“তুরীয়ং ব্রহ্ম, ন তু অভাবঃ”—অর্থাৎ তুরীয় ব্রহ্ম, কোনো অচেতনা বা অভাব নয়। গৌড়পাদাচার্যও বলেছেন—“প্রবুদ্ধো হি তুরীয়ো হি, স্বপ্নতুর্যৌ ন দৃষ্টভৌ।” (কারিকা ৩.৩৪)—তুরীয়ই প্রকৃত জাগরণ; এটি স্বপ্ন বা সুষুপ্তির মতো নিদ্রিত নয়।
তাই সুষুপ্তিতে শান্তি আছে, কিন্তু সেটি অবিদ্যা-জনিত অচেতন শান্তি; তুরীয়ে শান্তি আছে, কিন্তু সেটি জ্ঞানের দীপ্তি থেকে উদ্ভূত সচেতন শান্তি। সুষুপ্তির শান্তি অবিদ্যার পর্দার নিচে; তুরীয়ের শান্তি অবিদ্যা অপসারিত ব্রহ্মচৈতন্যে।
উপনিষদ এই পার্থক্যই নির্দেশ করে—“যো বৈ ভূমাতত্ত্বং বেদ, সুখম্ অনন্তম্, অমৃতম্।” (ছান্দোগ্য, ৭.২৩.১)—যে অনন্ত ব্রহ্মকে জানে, সে-ই প্রকৃত সুখ পায়। এই সুখ অচেতনতাজনিত নয়, বরং জ্ঞানের পরম আনন্দ—সৎ, চিত্, আনন্দের অভিন্ন সত্তা।
অতএব সুষুপ্তি হলো অচেতন শান্তি—অবিদ্যা-আবৃত প্রাজ্ঞের বিশ্রাম; তুরীয় হলো সচেতন শান্তি—অবিদ্যা-শূন্য ব্রহ্মের জাগরণ। সুষুপ্তিতে আত্মা বিশ্রামে, তুরীয়ে আত্মা মুক্তিতে।
ধরুন, আপনি একটি অন্ধকার সিনেমা হলে বসে আছেন। বিশাল পর্দায় এক চলমান ছবি—রং, শব্দ, হাসি, কান্না, প্রেম, যুদ্ধ—সব যেন বাস্তব। আপনি তাতে সম্পূর্ণ নিমগ্ন, ভুলে যাচ্ছেন আপনি দর্শক, ভাবছেন—এটাই সত্য। এই অবস্থাই জাগ্রত অবস্থা। এখানে আত্মা, অর্থাৎ চেতনা, ইন্দ্রিয় ও মন-বুদ্ধির মাধ্যমে বাহ্য জগতে নিজেকে ছড়িয়ে দেয়; অভিজ্ঞতা ঘটে, কিন্তু আসলে আত্মা কেবল আলোকদাতা—পর্দা নয়, আলো।
এখন পর্দার আলো নিভে গেছে, বাইরের জগৎ মিলিয়ে গেছে, কিন্তু আপনি ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। সেখানে এক নতুন জগৎ গড়ে উঠেছে—বন্ধু, শত্রু, বাড়ি, দেশ, ভয়, আনন্দ—সবই আপনার মনের তৈরি। এখানে কোনো বাহ্য বস্তু নেই, কিন্তু অভিজ্ঞতা আছে, কারণ চেতনা নিজের সংস্কার থেকে জগৎ রচনা করছে। এটিই স্বপ্ন অবস্থা। আপনি ভাবছেন, জগৎ বাস্তব, কিন্তু পরক্ষণে জেগে বুঝবেন—সবই মনের প্রতিচ্ছবি।
এরপর গভীর নিদ্রা আসে। পর্দা এখন সম্পূর্ণ অন্ধকার, কোনো আলো নেই, কোনো দৃশ্য নেই। তবু আপনি আছেন—শুধু জানেন না যে, আছেন। পরে জেগে উঠে বলেন, “আমি ভালো ঘুমিয়েছিলাম, কিন্তু কিছু জানতাম না।” এই অবস্থাই সুষুপ্তি বা প্রাজ্ঞ অবস্থা। এখানে আত্মা নিস্তরঙ্গ, সব কামনা ও চিন্তা লীন, তবু অচেতন নয়—অবিদ্যার আবরণে আচ্ছাদিত। এই নিদ্রার শান্তি গভীর, কিন্তু জ্ঞানের নয়, কারণ আলো আছে, তবে মেঘে ঢাকা।
এখন কল্পনা করুন—মেঘ সরে গেছে, আকাশ পরিষ্কার, সূর্য নিজে জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু আলো আর কোনো কিছুর উপর পড়ছে না—নিজেই নিজের দীপ্তিতে উজ্জ্বল। এটি তুরীয় অবস্থা, যেখানে আত্মা নিজের শুদ্ধ চেতনা রূপে প্রতিষ্ঠিত। এখানে জানার কিছু নেই, দেখার কিছু নেই, কারণ জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—তিনটি ভেদই লুপ্ত। আপনি জানেন, এই সিনেমা—জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি—সবই সেই এক পর্দার প্রতিফলন, আর সেই পর্দাই চেতনা, আপনি নিজেই।
আবার ধরুন, আপনি সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। সূর্য ডুবে যাচ্ছে, জলে প্রতিফলিত হচ্ছে আলো, আর ঢেউয়ের উপর সেই আলো নেচে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে মনে হচ্ছে—জলের উপর যেন আগুন জ্বলছে, কিন্তু বাস্তবে সেই আলো সূর্যের, জলের নয়। এই উদাহরণেই আত্মার চার অবস্থাকে গভীরভাবে বোঝা যায়।
জাগ্রত অবস্থায় আপনি জলের উপর সেই প্রতিফলিত আলোর মতো। সূর্য (চেতনা) ঠিকই আকাশে আছে, কিন্তু আপনি মন, দেহ ও ইন্দ্রিয়ের ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে সেই আলোকে নিজের ভাবছেন। আপনি জগৎকে ছুঁয়ে, শুনে, দেখে, চিনে, কাজ করছেন; কিন্তু সবই প্রতিফলনের স্তরে—চেতনার আসল উৎসে নয়।
স্বপ্ন অবস্থায় ঢেউ থেমে যায় না, কিন্তু বাইরের আলো মিলিয়ে যায়। তখন জলের ভেতর নিজের জ্যোতি দিয়ে প্রতিফলন তৈরি হয়—যেন সূর্য নিজেই জলের ভেতর থেকে আলো দিচ্ছে। আসলে সেই আলোও সূর্যেরই প্রতিফলন, কিন্তু এখন তা বাহিরে নয়, অন্তরে। এই অবস্থায় মনই সৃষ্টি করে নতুন জগৎ—সবই চেতনার নিজের প্রতিচ্ছবি।
সুষুপ্তি অবস্থায় সমুদ্র সম্পূর্ণ স্থির, কোনো ঢেউ নেই, কোনো প্রতিফলনও নেই। জলের উপর আর আলো দেখা যায় না, কারণ ঢেউ থেমেছে। কিন্তু সূর্য তখনও আকাশে আছে—আলো বন্ধ হয়নি, কেবল প্রতিফলন লীন হয়েছে। এই অবস্থায় আত্মা বিশ্রামে—কোনো কামনা নেই, কোনো চিন্তা নেই, কিন্তু অবিদ্যা নামের মেঘ তার দীপ্তি ঢেকে রেখেছে। আপনি শান্ত, কিন্তু জানেন না যে, আপনি শান্ত।
তুরীয় অবস্থায় সূর্যের সঙ্গে সরাসরি মিলন ঘটে। এখন আর প্রতিফলনের প্রয়োজন নেই—না ঢেউ, না জল, না প্রতিচ্ছবি। আপনি জানেন—“আলো সবসময় আমারই ছিল, প্রতিফলনগুলো ছিল মায়া।” এটি চেতনার নিজ জাগরণ, যেখানে আত্মা নিজেকে চিনে—না বাহিরে, না অন্তরে, বরং সর্বত্র।
এখানে “আলো” মানে আত্মার চৈতন্য, আর “প্রতিফলন” মানে জগৎ, দেহ, মন, চিন্তা, অনুভূতি, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি সমস্ত অভিজ্ঞতা। যখন বলা হচ্ছে “আলো সবসময় আমারই ছিল”, তার অর্থ হলো—চেতনা কখনও জন্মায় না, কখনও নষ্টও হয় না। যেমন সূর্যের আলো নিজের মধ্যে অবিরাম জ্বলছে, তেমনি আত্মা সর্বদা জ্যোতির্ময়, স্বয়ংপ্রকাশমান। আমরা জগতকে দেখি, ভাবি, অনুভব করি এই আলোর দ্বারাই—কিন্তু সাধারণ মানুষ ভাবে, আলোটা যেন জগতের, মন বা ইন্দ্রিয়ের; অথচ বাস্তবে তারা কেবল সেই চেতনার প্রতিফলন বহন করে।
“প্রতিফলনগুলো ছিল মায়া”—এই অংশের মানে, যে-সব রূপ, নাম, অনুভূতি, চিন্তা ইত্যাদি দেখা যায়, সেগুলো আত্মার উপর পড়া অবিদ্যার ছায়া মাত্র। যেমন স্থির জলের উপর সূর্যের প্রতিফলন দেখা যায়, কিন্তু তা আসল সূর্য নয়; ঢেউ উঠলে সেই আলো ভেঙে যায়, মিলিয়ে যায়, কিন্তু সূর্যের কোনো ক্ষতি হয় না। তেমনি, আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি—সবই চেতনার প্রতিফলন; আত্মা কখনও পরিবর্তিত হয় না।
অর্থাৎ, যখন কেউ বলে—“আলো সবসময় আমারই ছিল”—তখন তার উপলব্ধি হয় যে, আমি কোনো দেহ নই, কোনো মন নই, বরং সেই চেতনা-সত্তা, যার আলোয় দেহ-মন-জগত প্রতিফলিত। আর “প্রতিফলনগুলো ছিল মায়া”—মানে, যেগুলো আমি একসময় বাস্তব ভেবেছিলাম, সেগুলো ছিল কেবল চেতনার উপর উদিত সাময়িক ছায়া।
এই উপলব্ধিই জ্ঞানের চরম ফল—যেখানে মানুষ বুঝে যায়, তার নিজের স্বরূপই ব্রহ্ম, এবং জগত কেবল সেই চেতনার অভাসমাত্র। যেমন গৌড়পাদ কারিকা (৪.৫৮) বলছে—“যদ্বিশ্বং স্বপ্নসদৃশম্”—এই সমগ্র বিশ্বই স্বপ্নের মতো প্রতীতি, আর “অহম্ ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক ১.৪.১০)—আমি সেই চেতনা, যার আলোয় সব কিছু দেখা যায়, কিন্তু যা নিজে অপরিবর্তিত ও চিরসত্য।
সুষুপ্তির শান্তি হলো প্রতিফলনের অনুপস্থিতি, কিন্তু উৎসের অজ্ঞানতা; তুরীয়ের শান্তি হলো উৎসের সরাসরি প্রকাশ—অচেতন নয়, সর্বচেতন। সুষুপ্তিতে সূর্য অদৃশ্য, কিন্তু আছে; তুরীয়ে সূর্য প্রকাশিত, সর্বত্র জ্বলজ্বল করছে। এই কারণেই বলা হয়—সুষুপ্তি হলো অবিদ্যা-আবৃত আনন্দ, আর তুরীয় হলো বিদ্যা-উন্মোচিত আনন্দ। একটিতে প্রতিফলন লীন, অন্যটিতে প্রতিফলন অপ্রয়োজনীয়। একটিতে আত্মা বিশ্রামে, অন্যটিতে আত্মা মুক্তিতে।
তুরীয় অবস্থায় এই অবিদ্যা কেটে যায়, এবং আত্মা নিজের স্বরূপে প্রকাশিত হয়—“সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম।” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ২.১)। তুরীয় আত্মা প্রাজ্ঞকে আলোকিত করে, যেমন সূর্য মেঘের আড়ালে থেকেও আকাশকে আলোকিত রাখে। তাই, প্রাজ্ঞ হলো আত্মার সেই মধ্যবর্তী স্তর, যেখানে সমস্ত প্রপঞ্চ (জাগ্রৎ ও স্বপ্ন) লীন হয়েছে; আত্মা বিশ্রাম নিচ্ছে, কিন্তু এখনও চেতনার পূর্ণ জাগরণে পৌঁছায়নি। এটি একপ্রকার নিদ্রিত চেতনা—আনন্দময় অথচ অজ্ঞানাবৃত।
প্রাজ্ঞ মানে সেই চেতনা, যা সুষুপ্তিতে নিস্তরঙ্গ, শান্ত, অবিদ্যা-আবৃত ও আনন্দময়। এটি আত্মার গভীরতম নিদ্রা, যেখানে জাগ্রত ও স্বপ্ন—দুই অবস্থার সব দ্বন্দ্ব লুপ্ত, কিন্তু ব্রহ্মস্বরূপের উপলব্ধি এখনও অসম্পূর্ণ। প্রাজ্ঞ তাই একপ্রকার অন্তরবর্তী পর্ব—যেখানে চেতনা বিশ্রামে, অবিদ্যা-আবৃত শান্তিতে নিমগ্ন; এবং জ্ঞানের সূর্যোদয় ঘটলে, এই প্রাজ্ঞ আত্মাই জাগ্রত হয় নিজের স্বরূপে—তুরীয়ে, সেই এক চৈতন্যমাত্র ব্রহ্মে।
‘বৈশ্বানর’ ধারণাটি বেদান্তে যেমন গভীর, তেমনি তার দার্শনিক তাৎপর্য বহুস্তরীয়। শব্দটি এসেছে “বিশ্ব + অনর (নর)” থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ “সর্বত্র বিদ্যমান অগ্নি”—অর্থাৎ সেই এক চেতনা, যা সমগ্র বিশ্বে কর্ম, প্রাণ, তাপ ও বুদ্ধির আকারে প্রকাশিত।
গীতায় বলা হয়েছে, “অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ। প্রাণাপানসমায়ুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্।।” (গীতা, ১৫.১৪)। অর্থাৎ, “আমি বৈশ্বানর অগ্নিরূপে (জঠরাগ্নি রূপে) সমস্ত প্রাণীর দেহে অবস্থান করি, প্রাণ ও আপানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চতুর্বিধ খাদ্য হজম করি।” এখানে অগ্নি মানে কেবল শারীরিক হজমশক্তি নয়, বরং সেই সর্বব্যাপী চেতনা-শক্তি, যা জগতে প্রাণ, জ্ঞান ও ক্রিয়ার গতিবেগ সৃষ্টি করে।