অবিদ্যা-বিদ্যা: ৪৮



এরপর আত্মা-ব্রহ্মের ঐক্যকে বোঝাতে উপনিষদ এক অপূর্ব উপমা দেয়—“ওঁ ধনুক, আত্মা তীর, আর ব্রহ্ম লক্ষ্য।” অর্থাৎ, ধ্যানই সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সাধক ওঁ-ধনুক টেনে আত্মার তীরকে ব্রহ্মের লক্ষ্যে ছোড়ে, এবং যখন মন সম্পূর্ণ একাগ্র হয়, তখন আত্মা সেই ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যায়। এটি সেই মুহূর্ত, যখন সাধক জানেন—“আমি ব্রহ্ম”, এবং সমস্ত দ্বৈততার সীমা বিলীন হয়। এই প্রতীকী চিত্র অদ্বৈত অভিজ্ঞতার সারাংশ—ধ্যানের তীক্ষ্ণ একাগ্রতা ও জ্ঞানের দীপ্তি মিলে আত্মা-ব্রহ্ম-অভেদ উপলব্ধি।

“অয়ম্‌ আত্মা ব্রহ্ম” উপনিষদের এই ঘোষণা কেবল একটি দার্শনিক মত নয়, এটি এক সরাসরি অন্তর্দৃষ্টি। আত্মা কোনো ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত চেতনা নয়, বরং সেই অসীম চেতনার প্রতিবিম্ব, যা সমগ্র জগতে বিরাজমান। যেমন আয়নায় প্রতিফলিত সূর্যের আলো আসলে সূর্যেরই আলো, তেমনি জীবের চেতনা ব্রহ্মচেতনারই প্রতিফলন। জীব ও ঈশ্বর—ব্যষ্টি ও সমষ্টি—দুই-ই এক চৈতন্যরূপে অবিচ্ছিন্ন।

এই মহাবাক্যটি বেদান্তের চারটি প্রধান মহাবাক্যের একটি—“প্রজ্ঞানম্‌ ব্রহ্ম” (ঋগ্‌বেদ), “তৎ ত্বম্‌ অসি” (সামবেদ), “অহং ব্রহ্মাস্মি” (যজুর্বেদ), এবং “অয়ম্‌ আত্মা ব্রহ্ম” (অথর্ববেদ)। এই চারটি বাক্যের মর্ম এক—ব্রহ্মই আত্মা, আত্মাই ব্রহ্ম। এরা মিলিতভাবে প্রকাশ করে যে, মুক্তি কোনো অর্জন নয়; এটি কেবল নিজের স্বরূপে প্রত্যাবর্তন, নিজের প্রকৃত চেতনা অনুধাবন। আত্মা ও ব্রহ্মের মধ্যে যে-বিভেদ মনে হয়, তা কেবল অবিদ্যার আচ্ছাদন; জ্ঞান উদিত হলে দেখা যায়, বিভেদ কখনও ছিলই না।

“অয়ম্‌ আত্মা ব্রহ্ম”—এই ঘোষণা আমাদের জানায় যে, যা-কিছু আমরা ‘আমি’ বলে জানি, তা সীমিত দেহ বা মন নয়, বরং সেই অসীম চৈতন্য, যা সর্বত্র ও সর্বকালে অভিন্ন। মুক্তি মানে নতুন কিছু প্রাপ্তি নয়, বরং সেই আচ্ছাদিত জ্ঞানের পুনর্জাগরণ। যখন সাধক ধ্যান ও জ্ঞানের মধ্য দিয়ে এই সত্য উপলব্ধি করেন, তখন তাঁর ভেতর-বাহির, আত্মা-ব্রহ্ম, জগৎ-ঈশ্বর—সব দ্বৈততা নিঃশেষে বিলীন হয়। তখন যা থাকে, তা কেবল এক অখণ্ড চেতনা, চির-নির্বাণ, চির-আলোকিত সত্য—ব্রহ্ম, আর সেই ব্রহ্মই নিজের অন্তরে দীপ্ত—অয়ম্‌ আত্মা ব্রহ্ম।

জীব ও জগতের মধ্যে কোনো প্রকৃত ভেদ নেই। ব্যষ্টি (individual) ও সমষ্টি (cosmic)—দুটোই একই চেতনার ভিন্ন প্রকাশ। তৈত্তিরীয় উপনিষদের ভৃগু-বল্লী (তৃতীয় অধ্যায়), দশম অনুবাকে বলা হয়েছে—
স যশ্চায়ং পুরুষে। যশ্চাসাবাদিত্যে। স একঃ। স য এবংবিৎ। অস্মাল্লোকাৎপ্ৰেত্য। এতমন্নময়মাত্মানমুপসংক্রামতি। এতং প্রাণময়মাত্মানমুপসংক্রামতি। এতং মনোময়মাত্মানমুপসংক্রামতি। এতং বিজ্ঞানময়মাত্মান মুপসংক্রামতি। এতমানন্দময়মাত্মানমুপসংক্রামতি।

অন্বয়: সঃ যঃ চ অয়ং পুরুষে (যিনি এই দেহের মধ্যে); যঃ চ অসৌ আদিত্যে (এবং যিনি ওই সূর্যের মধ্যে); সঃ একঃ (তিনি অভিন্ন); যঃ এবংবিৎ (যিনি এ কথা জানেন); সঃ (তিনি); অস্মাৎ লোকাৎ প্ৰেত্য (এই জগৎ ত্যাগ করে); এতম্ অন্নময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রামতি (স্থূলদেহের আত্মার সঙ্গে একত্বলাভ করেন); এতং প্রাণময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্ৰামতি (প্রাণরূপ আত্মার সঙ্গে একত্বলাভ করেন); এতং মনোময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রামতি (মনরূপ আত্মার সাথে অভিন্ন বোধ করেন); এতং বিজ্ঞানময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রামতি (বুদ্ধিরূপ আত্মার সাথে অভিন্ন বোধ করেন); এতম্ আনন্দময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রামতি (আনন্দময় আত্মার সাথে অভিন্ন বোধ করেন)

ব্রহ্ম কখনো ব্যক্ত, কখনো অব্যক্ত। যখন তিনি নিজেকে জগৎরূপে প্রকাশ করেন, তখন সৃষ্টির প্রতিটি কণাতেই তাঁর উপস্থিতি; আর যখন অব্যক্ত, তখনও তিনি চিরন্তন, অনন্ত আনন্দরূপে সর্বত্র বিরাজমান। উপনিষদ এই অবস্থাকে বোঝাতে সূর্য ও মানুষের দৃষ্টান্ত দিয়েছে—দূর আকাশে যে বিশাল সূর্য জ্বলছে, সেই একই চেতনা মানুষের ক্ষুদ্র দেহেও বিদ্যমান। আমাদের ভেতরে যিনি, সূর্যের মধ্যেও তিনিই। একই আত্মা, একই ব্রহ্ম সর্বত্র বিরাজিত। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন—যেমন নানারকম বালিশের আকৃতি ভিন্ন, কিন্তু ভেতরে একই তুলো থাকে, তেমনি ব্রহ্মও নানা নাম, রূপ ও অবস্থায় একই থেকে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।

আচার্য শঙ্কর এই তত্ত্ব বোঝাতে ঘটের উপমা দিয়েছেন। ঘটের ভেতরে যে-আকাশ (ঘটাকাশ), বাইরে সেই একই আকাশ (মহাকাশ)। ঘটটি যেন আকাশকে দু-ভাগ করেছে, অথচ প্রকৃতপক্ষে আকাশ এক ও অভিন্ন। আমরাও তেমনি—প্রত্যেকে এক-একটি ঘট, নামরূপে পৃথক, কিন্তু স্বরূপে এক। ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত, চেতন ও জড় সবই সেই ব্রহ্মেরই প্রকাশ। ব্যষ্টি ও সমষ্টি—জীব ও জগৎ—আসলে এক ও অভিন্ন, এটাই বেদান্তের সিদ্ধান্ত।

তৈত্তিরীয় উপনিষদ এবং ছান্দোগ্য উপনিষদ-এর মতো প্রাচীন উপনিষদগুলোতে ব্রহ্মবিদ্যার আলোচনার শেষে আসে—“সঃ যঃ এবং বেদ”—যিনি এই একত্ব জানেন, তিনিই ব্রহ্মকে জানেন। অজ্ঞানতার লক্ষণ ভেদবুদ্ধি—অর্থাৎ ‘বহু দেখা’। জ্ঞান মানে এককে দেখা, এককে অনুভব করা। কিন্তু এই জ্ঞান কেবল বুদ্ধিগত ধারণা নয়; এটি “হয়ে ওঠা”—নিজেকে সেই একত্বে প্রতিষ্ঠিত করা। প্রথমে যদিও আমরা এই তত্ত্বকে কেবল বুদ্ধি দিয়ে ধারণা করতে পারি, তবুও তাতে মনোভাবের পরিবর্তন আসে—অন্যকে আঘাত করা, ঘৃণা করা, লোভ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। তখনই শুরু হয় আত্মসংশোধনের প্রকৃত পথ।

উপনিষদীয় সাহিত্যে এবং ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যের মতো দার্শনিক গ্রন্থাবলিতে মোক্ষ বা মৃত্যুর পরের অবস্থা বর্ণনা করতে প্রায়শই ব্যবহৃত হয়—“অস্মাৎ লোকাৎ প্রেত্য”—অর্থাৎ, জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। ‘প্ৰেত্য’ মানে ‘প্রত্যাহার’ বা ‘ঊর্ধ্বগমন’। শব্দটি এসেছে “প্র + ই” ধাতু থেকে—‘ই’ মানে যাওয়া, ‘প্র’ মানে ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ, তিনি জগতের ঊর্ধ্বে ওঠেন, জগতের মোহ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করেন। শঙ্করাচার্য বলেন, এই প্রত্যাহারের মানে জগৎ ত্যাগ নয়, বরং অনাসক্তি। বৈরাগ্যের অর্থ কোনো কিছু ত্যাগ করা নয়, বরং আসক্তি ত্যাগ করা।

সংসারে আছি, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়-পরিজন, বিষয়-সম্পত্তি—সব কিছু নিয়েই আছি, কিন্তু কোনো কিছুতে আসক্তি নেই, নির্লিপ্ত—ঠিক এইরকম ছিলেন জনকরাজা। মিথিলা নগরী আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু জনকরাজা নির্বিকার। বলছেন:
অনন্তং বত মে বিত্তং যস্য মে নাস্তি কিঞ্চন।
মিথিলায়াং প্রদীপ্তায়াং ন মে কিঞ্চিৎ প্রদহ্যতে।। (মহাভারত, শান্তিপর্ব, ১৭/১৯)

—কী আশ্চর্য! আমার অনন্ত ধনসম্পত্তি, কিন্তু আসলে আমার কিছুই নেই। সমস্ত মিথিলায় আগুন লাগলেও আমার কিছুই পুড়ে যাবে না। অর্থাৎ, এই বিশাল রাজ্য, এই অগাধ ধনসম্পত্তি এসবের প্রতি আমার কোন মমত্ববোধ নেই। এসব পুড়ে নষ্ট হয়ে গেলেও আমার কিছুই নষ্ট হবে না। আমি সব অবস্থায় নির্লিপ্ত—এ-ই হচ্ছে আমাদের আদর্শ। এই উদাসীনতা, এই নির্লিপ্ততা জীবন্মুক্তির লক্ষণ।

জনকরাজার এই উক্তিটি বৈরাগ্য এবং আত্মজ্ঞানীর মানসিক স্থিতাবস্থা বর্ণনা করে। মিথিলা ছিল তাঁর রাজ্য এবং ব্যক্তিগত সম্পদ। মিথিলায় আগুন লাগার উপমাটি জাগতিক চরম ক্ষতি বা সর্বনাশের প্রতীক। একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে রাজ্য পুড়লে শোক হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু জ্ঞানী জনক রাজা ঘোষণা করেন যে, তাঁর কিছু পুড়ছে না। এর অর্থ হলো—তিনি রাজ্য, সম্পত্তি এবং জাগতিক বস্তুর প্রতি আসক্ত নন। তিনি জানেন যে এই বস্তুগুলি অনিত্য এবং তাঁর নিত্য আত্মস্বরূপ থেকে ভিন্ন। তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, তিনি দেহ নন, মন নন, বা সম্পত্তির অধিকারী নন। তাঁর প্রকৃত স্বরূপ হলো আত্মা বা ব্রহ্ম, যা অগ্নি বা অন্য কোনো উপায়ে ধ্বংস করা যায় না, যেমনটি গীতায় বলা হয়েছে: “নৈনং দহতি পাবকঃ” (গীতা, ২/২৩) অর্থাৎ, আগুন দহন করতে পারে না। আত্মজ্ঞান লাভকারী ব্যক্তি এভাবেই জাগতিক ক্ষতির ঊর্ধ্বে থাকেন, কারণ তিনি নিজেকে নিত্য ব্রহ্ম-এর সঙ্গে অভিন্ন বলে জানেন।

আমাদের দৃষ্টিতে জগৎই একমাত্র সত্য, কিন্তু বেদান্ত বলে—এই জগৎ অনিত্য, পরিবর্তনশীল, স্বপ্নের মতো। ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নকে আমরা বাস্তব ভাবি; জেগে উঠলে বুঝি, সবই ভ্রম ছিল। তেমনি আত্মজ্ঞান জেগে উঠলে আমরা বুঝি—এই জগৎও এক মায়াবী প্রদর্শন। তখন আমরা নিজেদের জগৎ থেকে গুটিয়ে নিই, বুঝতে পারি—বাস্তবিক, এ জগতের স্বভাবই অনিত্য।

বর্তমানে আমরা জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছি, কিন্তু সত্য উপলব্ধি হলে এই জগৎ হয়ে ওঠে—এক নাট্যমঞ্চ। শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, “সমগ্র পৃথিবী এক রঙ্গমঞ্চ, সকল নারী-পুরুষ এখানে অভিনেতা।” রঙ্গমঞ্চে যেমন প্রবেশ ও প্রস্থান আছে, তেমনি জীবনও কেবলই এক নাট্য, যেখানে আত্মা দর্শক মাত্র।

অনেকে বলেন—এই দৃষ্টিভঙ্গি পলায়নী মনোভাব, কিন্তু আসলে এটি “বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি।” জগৎকে অনিত্য বলে জেনে মানুষ ভোগলোভ, অহংকার ও আসক্তি থেকে মুক্ত হয়। স্বাস্থ্য, ধন, ক্ষমতা সবই ক্ষণস্থায়ী—যিনি এই পরিবর্তনের স্বরূপ জানেন, তাঁর কাছে দুঃখের স্থান থাকে না। পরিবর্তন অনিবার্য জেনে মানুষ অনাসক্ত হয়, এবং যখন উপলব্ধি হয় যে, এক আত্মা সর্বত্র বিরাজিত, তখন মন চিরশান্ত হয়।

এই অবস্থায় মানুষ অনুভব করে—সারাবিশ্ব তাঁরই বিস্তার। স্থূল স্তরেও সেই একত্বের অনুভূতি জন্মায়। শ্রীরামকৃষ্ণ একবার দেখলেন, কেউ ঘাসের উপর পা রেখে হাঁটছে, আর তিনি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন—তাঁর মনে হলো, লোকটি যেন তাঁর বুকের উপর হাঁটছে। আবার দু-জন মাঝির ঝগড়া দেখে তাঁর দেহে আঘাতের চিহ্ন ফুটে উঠল। তিনি সমগ্র জগৎকে নিজের দেহরূপে অনুভব করতেন।

মনস্তরেও এই একত্ব প্রকাশ পায়। যেমন হ্রদের এক প্রান্তে ঢেউ উঠলে তা সমগ্র জলে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি মনের এক তরঙ্গ অন্য মনেও প্রতিফলিত হয়। যোগীরা এই কারণেই বলেন, উচ্চ আধ্যাত্মিক অবস্থায় অন্যের মন পড়া সম্ভব। স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যেও এই শক্তি ছিল। গুডউইন যখন তাঁকে উপহাস করছিলেন, স্বামীজী তাঁর মনের সমস্ত অতীত ও বর্তমান দৃশ্য একে একে দেখতে পেলেন, যেন ছবির মতো প্রকাশ পাচ্ছে। গুডউইন বিস্মিত হয়ে তাঁর শরণ নিলেন।

‘উপসংক্রামতি’ শব্দটি নিয়ে শঙ্করাচার্য তর্ক করেছেন। এর আক্ষরিক অর্থ “ভিতরে প্রবেশ করা” বা “অন্তর্গমন”। দ্বৈতবাদীরা বলেন, এটি বোঝায়—একজন প্রবেশকারী আছেন, এবং একটি গন্তব্যও আছে; অর্থাৎ দ্বৈততত্ত্ব সত্য। কিন্তু অদ্বৈত-মতে, ব্রহ্ম সর্বত্র, তাই তাঁর পক্ষে স্থানান্তর বা গমন অসম্ভব। অজ্ঞানতার কারণে মনে হয়, ব্রহ্ম চলছেন, কিন্তু জ্ঞান হলে বোঝা যায়—ব্রহ্ম সর্বত্র অচল, অনন্ত, অভিন্ন।

শঙ্কর বলেন—এটি অভিজ্ঞতার বিষয়। যেমন চোখের অসুখে কেউ দুটি চাঁদ দেখে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চাঁদ একটাই, তেমনি অজ্ঞানতায় আমরা ‘বহু’ দেখি, কিন্তু জ্ঞান হলে দেখি—সর্বত্র এক, সর্বভূতে এক আত্মা বিরাজমান। তখন ভেদবুদ্ধি বিলীন হয়ে যায়, আর মানুষের চেতনা স্থির হয় সেই এক অখণ্ড সত্যে—যা ব্রহ্ম, যা আনন্দ, যা নিজেরই স্বরূপ।

উপসংক্রামতি (Upasaṅkrāmati) শব্দটি সংস্কৃত দর্শন-সাহিত্যে—বিশেষত অদ্বৈত বেদান্তে সূক্ষ্ম ও গভীর তাৎপর্য বহন করে। এর মূল অর্থ “নিকটে গমন করা”, “কাছে যাওয়া” বা “প্রবেশ করা”; কিন্তু বেদান্তীয় আলোচনায় এটি স্থানগত গমন নয়, বরং চেতনার অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের প্রতীক—অজ্ঞান থেকে জ্ঞানে, সীমাবদ্ধতা থেকে অসীমে, পৃথকতা থেকে অভেদে উত্তরণের ইঙ্গিত।

উপনিষদ ও ব্রহ্মসূত্রে এই শব্দটি প্রধানত দুই প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয়েছে—এক, জ্ঞানীর ব্রহ্মে অভিগমন বা ব্রহ্মে লীনতা, আর দুই, অজ্ঞানীর কর্মফলভোগজনিত স্থানান্তর।

জ্ঞানীর ক্ষেত্রে উপসংক্রামতি মানে দেহত্যাগের পর আত্মার সেই পরম চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া। যখন তিনি “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—“আমিই ব্রহ্ম”—এই সত্য উপলব্ধি করেন, তখন তাঁর আত্মা কোথাও যায় না; কারণ যেদিকে যাওয়ার কথা, সেখানেই তিনি আছেন। তথাপি উপনিষদের ভাষায় বলা হয়, “স ব্রহ্ম উপসংক্রামতি”—"তিনি (সেই ব্যক্তি) ব্রহ্মে প্রবেশ করেন" বা "তিনি ব্রহ্মে লীন হন।" (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ভৃগু-বল্লী (তৃতীয় অধ্যায়, দশম অনুবাক)-সহ বিভিন্ন স্থানে এর ভাব পাওয়া যায়।) এই প্রবেশ কোনো গতিবিধি নয়, বরং প্রতিচ্ছায়ার অবসান।