এই শ্লোকটি করুণা এবং অভেদের ভিত্তিতে একজন যোগী বা ভক্তের নৈতিক ও মানসিক স্থিতাবস্থা তুলে ধরে—
অভেদ জ্ঞান: "অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং"—এর অর্থ হলো, যখন ভক্ত সমস্ত জীবে এক ব্রহ্মকে দেখতে পান (অভেদ জ্ঞান), তখন তাঁর পক্ষে কারও প্রতি দ্বেষ বা ঘৃণা পোষণ করা সম্ভব হয় না।
করুণা ও মৈত্রী: দ্বেষহীনতা থেকে মৈত্রী (বন্ধুত্ব) এবং করুণা (দয়া বা সমবেদনা) স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসারিত হয়। এটি বেদান্তে করুণার যে-ধারণা—অর্থাৎ, অন্যের দুঃখকে নিজের দুঃখ মনে করা—তাকেই প্রতিষ্ঠা করে।
বন্ধনমুক্তি: নির্মমো নিরহঙ্কারঃ—অর্থাৎ, 'আমি' (অহঙ্কার) এবং 'আমার' (মমতা) এই দুইটি ভাবের বিনাশ। এই অহঙ্কার ও মমতার বিলুপ্তিই কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্তি দেয়।
সমতা: সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী—শ্রেষ্ঠ ভক্ত সুখ বা দুঃখ কোনোটিতেই বিচলিত হন না, কারণ তিনি জানেন, এগুলি অনিত্য। তিনি ধৈর্যশীল এবং সর্বদা ক্ষমাশীল থাকেন।
এই শ্লোকটি হলো জ্ঞান (অহঙ্কারহীনতা), ভক্তি (ঈশ্বরে আসক্তি) এবং কর্ম (নিঃস্বার্থ করুণা) —এই তিনের সমন্বয়ে গঠিত পূর্ণাঙ্গ যোগীর জীবনদর্শনের প্রতিচ্ছবি।
ভগবদ্গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের (আত্মসংযমযোগ) ৩২তম শ্লোকটি হলো যোগের মাধ্যমে অর্জিত পরম সমতা এবং করুণার চূড়ান্ত প্রকাশ—
আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোঽর্জুন।
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ।।
অর্থাৎ, হে অর্জুন! যিনি নিজের সঙ্গে তুলনা করে (আত্মৌপম্যেন) সর্বত্র (সর্বত্র) সব কিছুকে সমানভাবে দেখেন (সমং পশ্যতি), তা সুখই হোক অথবা দুঃখই হোক (সুখং বা যদি বা দুঃখম্)—সেই যোগীই শ্রেষ্ঠ (স যোগী পরমো মতঃ) বলে বিবেচিত হন।
এই শ্লোকটি করুণা (Compassion) এবং অদ্বৈত চেতনার ব্যাবহারিক প্রয়োগের মূল সূত্র—
আত্মৌপম্যেন (নিজের সঙ্গে তুলনা): এটি এই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, একজন যোগী অন্য জীবের সুখ-দুঃখকে কেবল তত্ত্ব হিসেবে দেখেন না, বরং সেটিকে নিজের সুখ-দুঃখের মতো অনুভব করেন। অর্থাৎ, তিনি জানেন যে, অন্য জীবের মধ্যে যে-আত্মা, সেটি তাঁর নিজের আত্মার সঙ্গে অভিন্ন।
সমতা (Samam Paśyati): এই আত্ম-তুলনার মাধ্যমে যোগী সুখ ও দুঃখের দ্বন্দ্বে সমতা অর্জন করেন।
সুখে সমতা: অন্যের সুখ দেখলে তিনি হিংসা না করে আনন্দিত হন।
দুঃখে সমতা: অন্যের দুঃখকে তিনি নিজের দুঃখের মতোই অনুভব করেন এবং করুণার বশে তার নিবৃত্তির চেষ্টা করেন।
পরম যোগী: যিনি এই অভেদ জ্ঞান এবং সমতার ভাবকে সম্পূর্ণরূপে নিজের আচরণে ও অনুভবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ যোগী (পরমো মতঃ)।
এই শ্লোকটি জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ এবং ভক্তিযোগ—এই তিনের সমন্বয়ে গঠিত এক সম্পূর্ণ মানবতা-বোধকে তুলে ধরে, যেখানে চূড়ান্ত জ্ঞান সামাজিক দায়িত্ব ও করুণার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। করুণার উৎস তাই দ্বৈতনাশী অভেদ-দৃষ্টিতে নিহিত।
দ্বিতীয়ত, করুণা মুক্তির পথে এক অনিবার্য সহচর। যদিও মোক্ষ (Mokṣa) অর্জিত হয় কেবল জ্ঞান দ্বারা—
ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে।
তত্ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি।। (গীতা, ৪.৩৮)
“ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে” অর্থ—এই পৃথিবীতে (ইহ) জ্ঞানের (আত্মজ্ঞান) মতো পবিত্র (শুদ্ধতা দানকারী) আর কিছুই বিদ্যমান নেই।
“তত্ স্বয়ম্ যোগসংসিদ্ধঃ কালেন আত্মনি বিন্দতি” অর্থ—সেই জ্ঞান যোগী (বা যোগসংসিদ্ধঃ) যথাসময়ে (কালেন), স্বয়ং তার নিজের মধ্যেই (আত্মনি) লাভ করেন (বিন্দতি)।
এই শ্লোকটি হলো জ্ঞানযোগের একটি চূড়ান্ত ঘোষণা, যা মোক্ষলাভে জ্ঞানের অদ্বিতীয় স্থানকে প্রতিষ্ঠা করে—
জ্ঞানই পরম পবিত্রতা: জ্ঞানকে পবিত্রতার চূড়ান্ত মানদণ্ড হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জ্ঞানই একমাত্র যা কর্মের সমস্ত কলুষতা (বন্ধন সৃষ্টিকারী পাপ-পুণ্য) দূর করতে পারে (যেমন ৪.৩৭ শ্লোকে জ্ঞানাগ্নির কথা বলা হয়েছে)।
কর্ম নয়, জ্ঞানই সাধন: এটি জ্ঞান-কর্ম বিরোধ-এর অদ্বৈতবাদী অবস্থানকে সমর্থন করে—যা বলে যে, কর্ম নয়, বরং জ্ঞানই মোক্ষের একমাত্র সরাসরি কারণ।
অভ্যন্তরীণ উপলব্ধি: জ্ঞান কোনো বাহ্যিক বস্তু নয়, যা অর্জন করতে হয়। এটি স্বয়ং (নিজের চেষ্টায়), দীর্ঘ অনুশীলন (যোগসংসিদ্ধঃ) এবং সময় (কালেন) সাপেক্ষে নিজের মধ্যেই (আত্মনি) আবিষ্কৃত হয়। অর্থাৎ, জ্ঞান হলো আত্মার স্বরূপের অভ্যন্তরীণ উপলব্ধি, যা যোগসাধনার মাধ্যমে মনকে প্রস্তুত করার পর আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়। আর করুণার সাধনা সেই জ্ঞানের উপযুক্ত ভূমি প্রস্তুত করে।
অদ্বৈত সাধনায় প্রথম শর্ত চিত্ত-শুদ্ধি (Citta-śuddhi)—অর্থাৎ মন ও বুদ্ধির শুদ্ধতা। করুণা-প্রসূত নিঃস্বার্থ কর্ম ও সহানুভূতি মন থেকে রাগ, দ্বেষ, অহংকার দূর করে; মনকে করে শান্ত ও নিবেদিত। শুদ্ধ মনেই ব্রহ্মজ্ঞান প্রতিফলিত হয়, যেমন নির্মল আয়নায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়। তাই শমাদি ষট্সম্পত্তি—শম, দম, তিতিক্ষা, শ্রদ্ধা, সমাধান, এবং উপরতি—এই ছয় গুণের সঙ্গে করুণা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, কারণ করুণার মাধুর্য ছাড়া মন কখনও শান্ত হয় না।
তৃতীয়ত, করুণা হলো জীবন্মুক্ত (Jīvanmukta)-র চিহ্ন। আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি দেহে অবস্থান করেও দেহাত্মবোধে আবদ্ধ নন। তিনি জানেন—“আমি কর্তা নই, আমি সাক্ষী মাত্র; সব কর্ম প্রকৃতির গুণ দ্বারা সম্পন্ন হয়।” কিন্তু জগতের দুঃখ তাঁর কাছে উপেক্ষণীয় নয়, কারণ তিনি সমস্ত জীবের মধ্যে নিজেরই চেতনার প্রতিফলন দেখেন। তাঁর কর্ম তখন কোনো ব্যক্তিগত প্রেরণার ফল নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ত করুণার প্রবাহ। গীতা (৩.২৫) বলে—“কুর্যাদ্বিদ্বান্ তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্ লোকসংগ্রহম্”—অর্থাৎ, জ্ঞানী ব্যক্তি অনাসক্ত থেকেও জগতের কল্যাণে নিযুক্ত থাকেন। এই কর্মই Ārādhita-Karma—চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত আরাধনা।
জীবন্মুক্তের করুণা “দয়া” নয়, কারণ তিনি জানেন কেউ প্রকৃত অর্থে দুঃখী নয়, কেউ ভিন্ন নয়—সবই অবিদ্যার প্রকাশ। তাঁর করুণা হলো জ্ঞানেরই প্রকাশ—যেখানে সাহায্য করা ও সাহায্যপ্রাপ্ত হওয়া, দুটিই মায়ার খেলা; আর চেতনার অখণ্ড স্বরূপই একমাত্র সত্য। তবু তিনি দেহধারী অবস্থায় লোকসংগ্রহার্থে কাজ করেন—মানবমুক্তির পথ আলোকিত করতে।
অদ্বৈত বেদান্তে করুণা কোনো নৈতিক কর্তব্য নয়, বরং ব্রহ্মজ্ঞানের অবধারিত ফল। যখন জ্ঞানী উপলব্ধি করেন যে—
সর্বভূতস্থিতং আত্মানং সর্বভূতানি চ আত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।। (ভগবদ্গীতা, ৬.২৯)
“সর্বভূতস্থিতং আত্মানং সর্বভূতানি চ আত্মনি” অর্থ—যিনি যোগযুক্তাত্মা (যোগে স্থিত মন), তিনি সকল প্রাণীতে (সর্বভূতস্থিতম্) আত্মাকে (পরমাত্মা বা ব্রহ্ম) এবং সকল প্রাণীকেও (সর্বভূতানি চ) সেই আত্মাতে (ব্রহ্মে) দেখেন।
“ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ” অর্থ—তিনি সর্বত্র সমদর্শন (সব কিছু সমানভাবে দেখেন)।
এই শ্লোকটি অদ্বৈত জ্ঞান এবং সমত্বের চরম অবস্থাকে নির্দেশ করে—
অভেদের দৃষ্টি: যোগী কেবল নিজের মধ্যে আত্মাকে দেখেন না, বরং তিনি দেখেন যে, প্রতিটি জীবের মধ্যে সেই একই আত্মা বা ব্রহ্ম বিরাজমান। এটিই হলো অভিন্নতা বা অদ্বৈত জ্ঞান।
সৃষ্টির জ্ঞান: শুধু তা-ই নয়, তিনি বুঝতে পারেন যে, সকল জীব ও জগৎ সেই এক আত্মার মধ্যেই অবস্থিত। অর্থাৎ, আত্মা বা ব্রহ্ম এই জগৎ থেকে পৃথক নন, বরং তিনি এই জগতের আধার ও সারবস্তু।
সমদর্শন: এই উপলব্ধির ফলস্বরূপ যোগী সর্বত্র সমদর্শী হন। এই সমদর্শন থেকেই করুণা এবং অনাসক্তির জন্ম হয়, যা তাঁকে কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত রাখে।
এই শ্লোকটি সেই শ্রেষ্ঠ যোগীর দৃষ্টিকে তুলে ধরে, যিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে দ্বৈততার ভ্রম থেকে মুক্ত হয়েছেন। সব জীবের মধ্যে আত্মা, এবং আত্মার মধ্যে সব জীব—এই অবস্থায় তাঁর হৃদয় চির-করুণাময় হয়ে ওঠে। সেই করুণা আর ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়; এটি ব্রহ্মচেতনার স্পন্দন—যেখানে প্রেম ও জ্ঞান, কর্ম ও নীরবতা, সব এক হয়ে যায়।
অদ্বৈত বেদান্তে এই আরাধিত কর্মই হলো জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়ের চূড়ান্ত বিন্দু। এখানে জ্ঞান কর্মকে শুদ্ধ করেছে, আর কর্ম জ্ঞানকে প্রকাশ করেছে। জ্ঞানী ব্যক্তি আর জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন নন, বরং জগতেই চেতনার নিঃস্বার্থ প্রকাশ দেখেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি কর্ম তখন পূজা, প্রতিটি নিঃশ্বাস ধ্যান, প্রতিটি মুহূর্ত ব্রহ্মের আরাধনা।
Ārādhita-Karma হলো সেই কর্ম, যা অহংকার ও কামনা থেকে মুক্ত, ফল ও ফাঁদের ঊর্ধ্বে এবং কেবল চেতনার উজ্জ্বলতা প্রকাশের এক স্বাভাবিক প্রবাহ। এটি না পুণ্য সৃষ্টি করে, না পাপ—বরং ব্রহ্মজীবনের শান্ত দীপ্তিতে, এই কর্ম নিজেই হয়ে ওঠে নীরব উপাসনা।
লোকসংগ্রহের ভাবনা গীতার সেই চিরন্তন বার্তা স্মরণ করিয়ে দেয়—মুক্তি কোনো ব্যক্তিগত গন্তব্য নয়, বরং এক সর্বজনীন স্রোত, যেখানে আত্মজ্ঞান সমাজকল্যাণে পরিণত হয়। জ্ঞানী ব্যক্তি জানেন—“অহং ন কর্তা, ব্রহ্মাই কর্মকর।” অর্থাৎ, আমি কর্তা নই, ব্রহ্মই কর্ম করেন। এটি মূলত একজন আত্মজ্ঞানীর (তত্ত্ববিত্) জীবনের দর্শন, যা দুটি প্রধান নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত:
কর্তৃত্বের অস্বীকার (অহং ন কর্তা)—কর্তৃত্বের ভ্রমমুক্তি: অদ্বৈত বেদান্তের মতে, জীবাত্মা (ব্যক্তিগত আত্মা) হলেন বিশুদ্ধ চৈতন্য এবং সাক্ষী মাত্র। তিনি কর্তা নন। জীব যখন অজ্ঞান-বশত নিজেকে দেহ, মন ও বুদ্ধির সঙ্গে এক বলে ভুল করে, তখনই সে মনে করে যে, "আমি কর্তা" (অহম্ কর্তা)। এই ভাবটি ভগবদ্গীতার ৫.৮ শ্লোকে পাওয়া যায়: "নৈব কিঞ্চিত্ করমি ইতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিত্" (তত্ত্বজ্ঞানী মনে করেন—আমি কিছুই করছি না)।
ব্রহ্মই কর্মকর (প্রকৃতি বা ব্রহ্মের শক্তিই কর্তা) তথা ব্রহ্মই মূল শক্তি: এই উক্তির দ্বিতীয় অংশটি আরও গভীর তত্ত্বকে নির্দেশ করে। ব্রহ্ম নিজে সরাসরি কর্মে লিপ্ত হন না, কিন্তু তাঁর শক্তি মায়া বা প্রকৃতিই সমস্ত কর্ম করে।
কর্মের প্রকৃত কর্তা—গীতার ৩.২৭ শ্লোক অনুসারে: "প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ" (সমস্ত কর্ম প্রকৃতির গুণসমূহের দ্বারাই অনুষ্ঠিত হচ্ছে)। অর্থাৎ, প্রকৃতি (যা ব্রহ্মেরই শক্তি) বা ঈশ্বর (যিনি মায়ার নিয়ন্তা) হলেন কর্মের প্রকৃত চালক।
যখন কোনো জ্ঞানী বলেন, "ব্রহ্মই কর্ম করেন", তখন এর অর্থ হলো—তিনি এই জগৎকে ব্রহ্মের লীলা বা স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ রূপে দেখেন। তাঁর ব্যক্তিগত অহংকারী ইচ্ছা দ্বারা কোনো কর্ম হচ্ছে না, বরং বৃহত্তর চৈতন্য বা প্রাকৃতিক শক্তিই সব কাজ করছে।
এই উক্তিটি হলো সেই জ্ঞানীর উপলব্ধি, যিনি বন্ধন সৃষ্টিকারী কর্তৃত্বের অহংকার ত্যাগ করেছেন এবং নিজেকে সর্বব্যাপী ব্রহ্মসত্তার সঙ্গে অভিন্ন বলে জেনেছেন। এই বোধ থেকেই জন্ম নেয় নিঃস্বার্থ, অনাসক্ত, তবু সক্রিয় কর্ম—যা সমাজকে স্থিতি ও শান্তি দেয়।
লোকসংগ্রহ কেবল গীতার নৈতিক উপদেশ নয়; এটি অদ্বৈতের জীবন্ত দর্শন—যেখানে মুক্ত আত্মা কর্ম থেকে সরে যায় না, বরং কর্মের মধ্য দিয়েই ব্রহ্মের অনন্ত করুণাকে প্রকাশ করে। তাঁর কর্ম ব্যক্তিগত নয়, মহাজাগতিক; তাঁর উদ্দেশ্য নিজের মুক্তি নয়, সর্বজনের মঙ্গল। এই অবস্থায় জ্ঞান ও কর্ম বিরোধ নয়, একে অপরের পরিপূরক। জ্ঞান কর্মকে শুদ্ধ করে, আর কর্ম জ্ঞানের আলোকে বিশ্বকে সংহত রাখে। সেই কারণেই শ্রীকৃষ্ণ বলেন—জ্ঞানী কর্ম না করে থাকতে পারেন না, কারণ তাঁর নীরব অন্তর ব্রহ্মে স্থিত থাকলেও, তাঁর বাহ্যিক প্রকাশ সর্বদা লোকসংগ্রহার্থে—সমস্ত জীবের মঙ্গলের জন্য।
লোকসংগ্রহ এইভাবে জ্ঞানীর করুণার প্রকাশ, সমাজের ভারসাম্যের ভিত্তি, এবং কর্মযোগের চূড়ান্ত মহিমা—যেখানে ব্যক্তিমুক্তি রূপ নেয় বিশ্বমুক্তিতে, আর জ্ঞান পরিণত হয় জীবনের চরম সেবায়। এই অবস্থাই প্রকৃত জীবনমুক্তি—যেখানে মানুষ ব্রহ্মের মতোই নিষ্কলুষ, নিত্য, নির্লিপ্ত, অথচ অপরিমেয় করুণায় ভরা; যেখানে জ্ঞান ও কর্ম, ধ্যান ও জাগরণ, নিস্তব্ধতা ও প্রেরণা—সব এক দীপ্ত সত্তায় মিলেমিশে যায়।
এই অবস্থায় মিথ্যা প্রপঞ্চও এক গভীর প্রতিফলন হয়ে ওঠে—বাস্তবের দর্পণ, যেমন আলো ছাড়া ছায়া অস্তিত্বহীন। সাধক যখন আত্ম-সাক্ষাৎকারে (Ātma-Sākṣātkāra) প্রতিষ্ঠিত হন, তখন তিনি আর প্রপঞ্চকে অস্বীকার করেন না; বরং বুঝতে পারেন, জগৎ বা যা-কিছু দেখা যায়, সবই সেই এক চিদ্রূপ ব্রহ্মেরই প্রতিফলন। মিথ্যা তখন অন্ধকার নয়, বরং আলোর প্রকাশেরই এক ছায়া।