অবিদ্যা-বিদ্যা: ৪৪




সাধনচতুষ্টয়ের এই চারটি আবশ্যক গুণ মিলে চিত্ত-শুদ্ধি (Citta-Śuddhi) ঘটায়—মন তখন অশান্তি, আসক্তি ও দ্বন্দ্বমুক্ত হয়ে এক দীপ্ত স্বচ্ছতায় স্থিত হয়। এই চিত্ত-শুদ্ধিই আত্মজ্ঞান অর্জনের পূর্বশর্ত। যেমন তরঙ্গিত জলে আকাশের প্রতিবিম্ব দেখা যায় না, তেমনি অশান্ত মনে আত্মার দীপ্তি প্রতিফলিত হয় না।


চিত্ত-শুদ্ধির পরই সাধক প্রবেশ করেন শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন (Śravaṇa-Manana-Nididhyāsana)-এর পথে—যা আত্ম-উপলব্ধির ত্রিস্তরীয় প্রক্রিয়া। শ্রবণ—শ্রুতি থেকে সত্য শোনা ও গ্রহণ করা; মনন—যুক্তি ও চিন্তার দ্বারা সন্দেহ দূর করা; নিদিধ্যাসন—গভীর ধ্যানের মধ্য দিয়ে সেই সত্যে স্থিত হয়ে থাকা।


এভাবেই সাধক কর্মের অগ্নি দ্বারা মনকে পবিত্র করেন, এবং জ্ঞানের অগ্নি দ্বারা অবিদ্যার অবসান ঘটান। এই দুই অগ্নি যখন একীভূত হয়, তখন তার অন্তর জ্বলে ওঠে। আর সেই দীপ্তিতেই আত্মা নিজের স্বরূপে প্রকাশিত হয়—চিরপ্রকাশ, চিরশান্ত, চিরমুক্ত।


এই প্রস্তুতির পর জ্ঞান-অগ্নি (Jñāna-Agni) জ্বলে ওঠে—যে-অগ্নি অজ্ঞানতার মূল পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলে, যেমন সূর্যোদয়ের আলো ঘন অন্ধকারকে নিঃশেষে বিলীন করে। এটি কোনো সাধারণ জ্ঞান নয়; এটি আত্ম-সাক্ষাৎকার (Ātma-Sākṣātkāra)—যেখানে জানা ও জ্ঞেয়ের পার্থক্য লুপ্ত হয়, আর আত্মা নিজের দীপ্তিতেই জ্বলে ওঠে।


গীতার ৪.৩৭ শ্লোক অদ্বৈত বেদান্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি জ্ঞান-কর্ম-বিরোধ তত্ত্বের এক প্রতীকী ঘোষণা—

যথৈধাংসি সমিদ্ধোহগ্নির্ভস্মসাৎ কুরুতেহর্জুন।

জ্ঞানাগ্নি সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা।।

অর্থাৎ, “হে অর্জুন! যেমন প্রজ্বলিত অগ্নি কাঠকে ভস্ম করে দেয়, তেমনি জ্ঞানরূপী অগ্নিও সমস্ত কর্মকে সম্পূর্ণরূপে ভস্ম করে দেয়।”


এই শ্লোকের মূল ভাব হলো—যেমন বাহ্য-অগ্নি স্পর্শ করামাত্র কাঠকে ছাইয়ে পরিণত করে, তেমনি অন্তরের জ্ঞান-অগ্নি (Ātma-Jñānāgni) স্পর্শ করামাত্র সমস্ত সংসারধর্মী কর্ম ও তাদের সংস্কার-বাসনাকে নিঃশেষে দগ্ধ করে ফেলে।


অগ্নি এখানে পরম চৈতন্যে উদিত জ্ঞানের প্রতীক, যা অজ্ঞানকে আলোকিত করে এবং সমস্ত কর্ম-সংস্কারের শিকড় ছিন্ন করে দেয়। কর্মের অস্তিত্বই থাকে না, কারণ কর্মের মূল হলো কর্তা-ভাব, আর জ্ঞানে সেই কর্তা-ভাবই বিলীন হয়।


শঙ্করাচার্য এই শ্লোকের ভাষ্যে বলেন—“যথা কাঠদগ্ধে পুনর্জ্বালনের সম্ভাবনা নাস্তি, তথৈব জ্ঞানদগ্ধকর্মণো ন পুনরাভিবন্ধন সম্ভাবনা।” অর্থাৎ, “যেমন কাঠ দগ্ধ হয়ে গেলে তা পুনরায় জ্বলে ওঠার কোনো সম্ভাবনা থাকে না, ঠিক তেমনই জ্ঞানাগ্নিতে দগ্ধ হওয়া কর্মের পুনরায় বন্ধন সৃষ্টি করার কোনো সম্ভাবনা থাকে না” অর্থাৎ, যেমন একবার দগ্ধ কাঠ আর আগুন ধরতে পারে না, তেমনি জ্ঞানে দগ্ধ কর্ম আর পুনরায় জীবকে আবদ্ধ করতে পারে না।


এই উক্তিটি মোক্ষলাভে জ্ঞানের চূড়ান্ততা এবং কর্মের বন্ধন থেকে স্থায়ী মুক্তির প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে—


কাঠ ও অগ্নির উপমা: এখানে কাঠ হলো কর্ম বা কর্মফল এবং অগ্নি হলো জ্ঞান বা আত্মোপলব্ধি। কাঠ একবার সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হলে যেমন তার পুনরায় দাহিকা শক্তি বা কার্যকারিতা থাকে না, ঠিক তেমনই, ব্রহ্মজ্ঞান (জ্ঞানাগ্নি) দ্বারা একবার কর্মের মূল (অজ্ঞান) দগ্ধ হয়ে গেলে, সেই কর্ম আর ভবিষ্যতে নতুন করে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন তৈরি করতে পারে না।


জ্ঞানদগ্ধ কর্ম (জ্ঞানের কার্যকারিতা): ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হলে, কর্মের মূলে যে-অজ্ঞান (আমি কর্তা, আমি ভোগী—এই অহংকার) থাকে, তা সম্পূর্ণভাবে দূর হয়ে যায়। এই জ্ঞানাগ্নিতে কর্মগুলি দগ্ধ হয়ে যায়।


বন্ধনমুক্তি (পুনরাভিবন্ধন সম্ভাবনা নাস্তি): কর্ম একবার জ্ঞানাগ্নিতে দগ্ধ হলে, তার আর পুনরায় বন্ধন সৃষ্টি করার কোনো ক্ষমতা থাকে না। অর্থাৎ, জ্ঞানলাভকারী ব্যক্তি কর্ম করেন ঠিকই, কিন্তু সেই কর্ম আর তাঁর জন্য কোনো সঞ্চিত ফল বা নতুন জন্ম সৃষ্টি করে না। তিনি জীবন্মুক্ত হন। জ্ঞান স্থায়ীভাবে অজ্ঞানের সমস্ত কার্যকারিতা ধ্বংস করে দেয়, যার ফলে মোক্ষ নিশ্চিত হয়।


এই শ্লোকের মর্ম তাই একেবারে স্পষ্ট—জ্ঞান-অগ্নি সবকিছু ভস্ম করে ফেলে, কিন্তু তা ধ্বংসের মাধ্যমে নয়; বরং অবিদ্যা-নিবৃত্তির মাধ্যমে। যখন জানা যায়—“আমি কর্তা নই, আমি চিরসাক্ষী”—তখন কর্মের প্রয়োজন, ফলের আসক্তি, ও জন্ম-মৃত্যুর ভয়—সব নিজে থেকেই নিঃশেষ হয়ে যায়। গীতার ৪.৩৭ শ্লোকটি বেদান্তে এক সঙ্কেতমন্ত্রের মতো—যেখানে জ্ঞান, আগুনের মতো, সব দ্বৈত ধারণাকে দগ্ধ করে, আর থাকে কেবল ব্রহ্ম-চৈতন্যের উজ্জ্বল, নিঃস্পৃহ দীপ্তি।


এই জ্ঞান-অগ্নি তিন প্রকার কর্মের (Karma-Traya) মধ্যে দুইটি সম্পূর্ণরূপে ভস্ম করে ফেলে—সঞ্চিত ও আগামী—আর তৃতীয়টি, প্রারব্ধ, কেবল দেহধারণ অবধি অবশিষ্ট থাকে।


সঞ্চিত-কর্ম (Saṃcita-Karma) হলো অগণিত জন্মের সঞ্চিত কর্মফল—যা ভবিষ্যতে ফল দিতে প্রস্তুত ছিল। জ্ঞান উদয় হলে এই সঞ্চিত সমস্তই জ্ঞান-অগ্নিতে দগ্ধ হয়, কারণ এখন আর কর্তা নেই যার জন্য ফল রচিত হবে।


আগামী-কর্ম (Āgāmī-Karma) হলো বর্তমান জীবনের নবসৃষ্ট কর্ম—যা ভবিষ্যতে ফল দিতে পারত। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি, যিনি নিজেকে দেহ-মন নয় বলে জানেন, তাঁর কর্মফল আর তাঁকে স্পর্শ করে না।


প্রারব্ধ-কর্ম (Prārabdha-Karma) কেবল দেহধারণের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ফল দিতে শুরু করেছে—তাই তা দেহপতন পর্যন্ত চলে। যেমন পাখা বন্ধ করার পরও কিছুক্ষণ ঘুরে যায়, তেমনি দেহও প্রারব্ধের প্রভাবে কিছু সময় গতি রাখে।


এই অবস্থায় সাধক বা ঋষি হন জীবনমুক্ত (Jīvan-Mukta)—অর্থাৎ, জীবিত অবস্থাতেই মুক্ত। তাঁর দেহ আছে, কিন্তু দেহ-চেতনা নেই; কর্ম আছে, কিন্তু কর্তা নেই; ক্রিয়া ঘটে, কিন্তু ভোগের চিন্তা নেই। তাঁর দেহ প্রারব্ধের গতিতে চলে, মন স্থিত শান্ত চৈতন্যে। তিনি করেন, কিন্তু ‘করণ’ অনুভব করেন না; তিনি ভোগেন, কিন্তু ‘ভোগী’ থাকেন না।


ঈশোপনিষদের দ্বিতীয় মন্ত্রাংশটির সারসংক্ষেপ—“কুর্বন্নপি ন লিপ্যতে”, যার অর্থ হলো: “কর্ম করেও তিনি লিপ্ত হন না।” ঈশোপনিষদের এই দ্বিতীয় মন্ত্রটি কর্মযোগ এবং জ্ঞানের সমন্বয় ব্যাখ্যা করে। মন্ত্রটির পূর্ণাঙ্গ ভাবার্থ হলো:

কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ।

এবং ত্বয়ি নান্যথেতোঽস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে।।


এই উক্তিটি অদ্বৈত বেদান্তে জীবন্মুক্ত বা স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির অবস্থা বর্ণনা করে:


কর্মের অপরিহার্যতা: মন্ত্রের প্রথম অংশে বলা হয়েছে, মানুষ শত বছর বাঁচার ইচ্ছা করলে কর্ম করতে করতেই বাঁচবে (কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ)। অর্থাৎ, দেহধারণ করলে কর্ম করা অনিবার্য।


ন লিপ্ততা: তবে, সেই কর্মে তিনি লিপ্ত হন না (ন লিপ্যতে)। এখানে 'লিপ্ততা' বলতে কর্মফলের বন্ধন বা আসক্তিকে বোঝানো হয়েছে।


মুক্তির পথ: এই শ্লোকটি বোঝায় যে, জ্ঞানী ব্যক্তি বা স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি ফল ত্যাগ করে এবং কর্তৃত্বের অহংকার ত্যাগ করে কর্ম করলে, সেই কর্ম তাকে আর বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে না। তিনি বাহ্যিকভাবে কর্মশীল হলেও অভ্যন্তরীণভাবে নির্লিপ্ত থাকেন। তাই, “কুর্বন্নপি ন লিপ্যতে” হলো অনাসক্তভাবে কর্ম করার নীতি এবং ঈশোপনিষদের কর্মযোগের মূল সারাংশ।


দেহপতনের সঙ্গে সঙ্গে, যখন প্রারব্ধের শেষ গতি শেষ হয়, তখন ঘটে বিদেহ-মুক্তি (Videha-Mukti)—যেখানে আত্মা সম্পূর্ণভাবে ব্রহ্মে লীন হয়। কিন্তু এই লয় কোনো গমন নয়; কারণ আত্মা কোথাও যায় না, কেবল ভুল আরোপণ বিলীন হয়। জ্ঞানীর কাছে তখন মৃত্যু মানে কেবল দেহের আবরণ ত্যাগ, আত্মার নয়—কারণ আত্মা কখনও জন্মায়নি, তাই সে কখনও মরে না।


তবে জ্ঞানীর কর্মচেতনা একেবারে বিলীন হয় না—তিনি কাজ করেন, কিন্তু কর্ম তাঁকে স্পর্শ করে না। তাঁর কর্ম ব্যক্তিগত নয়, সর্বজনীন। এটি আর ‘আমার কর্তব্য’ নয়, বরং লোকসংগ্রহ (Loka-Saṅgraha)—লোক (বিশ্ব) এবং সংগ্রহ (সুরক্ষা)—বিশ্বকল্যাণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ। এমন কর্মেই জ্ঞানীর হৃদয় প্রতিফলিত হয়—যেখানে কর্তৃত্ব নেই, অহংকার নেই, ফলের প্রত্যাশা নেই।


এই কর্মই আলোকিত কর্ম (Ārādhita-Karma)—যেখানে কার্য-কারণ সম্পর্ক মায়ার মতো ভাসমান, আর কর্মের উদ্দেশ্য কেবল চেতনার প্রকাশ। তখন তিনি দেখেন, ঈশ্বর ও জীব, ব্রহ্ম ও জগৎ, কর্ম ও জ্ঞান—সবই এক চিদ্‌রূপে অবিভক্ত। তাঁর চোখে সবই ব্রহ্ম, সবই চৈতন্য, সবই নিজেরই প্রতিফলন। তিনি বাঁচেন না ‘কারও’ জন্য, কাজও করেন না ‘কিছু’ অর্জনের জন্য—তিনি কেবল ব্রহ্মের স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়ায় প্রকাশমান চৈতন্যমাত্র।


লোকসংগ্রহ (Lokasaṅgraha) অদ্বৈত বেদান্ত ও ভগবদ্গীতার এক গভীর তত্ত্ব, যা কর্মযোগের সামাজিক ও দার্শনিক দিককে একসূত্রে বাঁধে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ কর্মকে কেবল ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য নয়, বরং সমগ্র জগতের মঙ্গল ও স্থিতিশীলতার জন্য এক সর্বজনীন কর্তব্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। লোকসংগ্রহ শব্দের আক্ষরিক অর্থ “লোকের সংহতি” বা “সমষ্টির ঐক্য রক্ষা”—অর্থাৎ সমাজ, বিশ্ব ও সৃষ্টির সামঞ্জস্য ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।


অদ্বৈত দর্শনের দৃষ্টিতে, জ্ঞানী বা মুক্ত ব্যক্তি নিজে কর্তা নন; তাঁর ব্যক্তিগত কোনো অর্জন বা লক্ষ্য অবশিষ্ট নেই। তবু তিনি কর্ম থেকে সরে যান না, কারণ তাঁর কর্মের উদ্দেশ্য আর ব্যক্তিগত নয়—এটি লোকসংগ্রহার্থে, অর্থাৎ সমাজের স্থিতিশীলতা, শৃঙ্খলা ও মঙ্গলার্থে। গীতায় (৩.২০) এই বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণ বলেন—

কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।

লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি।।


অর্থাৎ, জনক প্রমুখ রাজর্ষিরা নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন এবং তাঁরা সমাজের স্থিতিশীলতার দিকেও লক্ষ্য রেখেছিলেন। তাই লোকসংগ্রহ বা জগতের মঙ্গলের জন্য তোমারও কর্ম করা উচিত। এখানে বোঝানো হয়েছে, জ্ঞানী ব্যক্তি মুক্তি পেলেও সমাজের প্রতি তাঁর দায়িত্ব রয়ে যায়, কারণ তিনি জানেন—নিজের কর্মই অন্যের জন্য পথনির্দেশ।


শ্রীকৃষ্ণ (৩.২১) এই ভাবনাকে আরও বিস্তৃত করে বলেন—“যদ্যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ। স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।।”—অর্থাৎ, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যা-কিছু করেন, সাধারণ মানুষ সেটাকেই অনুসরণ করে; তিনি যা প্রমাণ হিসেবে স্থাপন করেন, সমাজ তদনুযায়ী চলে। শ্রীকৃষ্ণ এই শ্লোকের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন। তারা যেভাবে কাজ করেন, তার ভিত্তিতেই সাধারণ মানুষ তাদের কর্মপন্থা ঠিক করে। তাই, সমাজে ন্যায়ের স্থাপনা এবং সকলের মঙ্গল নিশ্চিত করতে হলে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের অবশ্যই আদর্শ আচরণ করা উচিত।


এই শ্লোকটি নেতৃত্বের দায়িত্ব এবং আদর্শের গুরুত্বকে তুলে ধরে:


শ্রেষ্ঠ মানুষের কর্মের প্রভাব: শ্রীকৃষ্ণ এখানে শ্রেষ্ঠ বা জ্ঞানী ব্যক্তিকে আদর্শ পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সাধারণ মানুষ (ইতরো জনঃ) নিজেরা বিচার করে কাজ করার চেয়ে সর্বদা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির আচরণ (আচরতি) এবং উদাহরণকে অনুসরণ করতে পছন্দ করে।


প্রমাণ-স্থাপন: শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি তার কর্ম ও জীবনযাপনের মাধ্যমে যা-কিছুকে প্রমাণ বা আদর্শ (প্ৰমাণম্) হিসেবে স্থাপন করেন, অর্থাৎ যা তার নৈতিক মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন, সাধারণ লোক তাকেই অনুসরণ (অনু বৰ্ততে) করে।


লোকসংগ্রহ: এই নীতিটি সরাসরি লোকসংগ্রহ (জগতের স্থিতিশীলতা রক্ষা) নীতির সঙ্গে যুক্ত। এই শ্লোকের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝান যে, জ্ঞানী হলেও তার কর্ম করা অপরিহার্য, কারণ তার কর্ম সাধারণ মানুষের জন্য আদর্শ স্থাপন করে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা আসতে দেয় না।


এই শ্লোকটি নির্দেশ করে যে, নেতার ব্যক্তিগত কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা না থাকলেও, জগতের কল্যাণের জন্য তাকে নিষ্কামভাবে কর্ম করে যেতে হবে, কারণ তাঁর কর্মই সমাজের নৈতিক ভিত্তি। তাই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শিক্ষা দেন—যদি জ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম ত্যাগ করেন, তবে সাধারণ মানুষও কর্মবিমুখ হয়ে যাবে; কর্তব্যবোধ হারিয়ে যাবে, সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সুতরাং লোকসংগ্রহের জন্য, অর্থাৎ সমাজকে সঠিক পথে রাখার জন্য, জ্ঞানী ব্যক্তির কর্ম করা আবশ্যক। তাঁর কর্ম তখন আর ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়, বরং অন্যদের অনুপ্রেরণা জাগানোর জন্য—যাতে তাঁর জীবনই আদর্শ হয়ে ওঠে।