গীতা আরেক জায়গায় বলছেন—
জ্ঞানেন তু তদ্ জ্ঞানং যেষাং নাশিতমাত্মনঃ।
তেষামাদিত্যবজ্ জ্ঞানং প্রকাশয়তি তৎ পরম্।। (ভগবদ্গীতা, ৫.১৬)
অর্থাৎ, কিন্তু জ্ঞান দ্বারা সেই অজ্ঞান (অবিদ্যা) বিনাশপ্রাপ্ত হয়—জ্ঞান দ্বারা অবিদ্যা নাশ হয়, আর অবিদ্যা-নাশই মুক্তি। “জ্ঞানের প্রভাবে যাঁদের অজ্ঞান বিনষ্ট হয়েছে, তাঁদের সেই জ্ঞান অপ্রাকৃত পরমতত্ত্বকে প্রকাশ করে, ঠিক যেমন দিনমানে সূর্যের উদয়ে সব কিছু প্রকাশিত হয়।”
বক্তব্যটির অর্থ এরকম:
অজ্ঞানের বিনাশ: যাঁদের অজ্ঞান (অবিদ্যা) বা আত্মাকে দেহ-মন বলে মনে করার ভ্রান্তি বিনষ্ট হয়েছে, তাঁরা হলেন জ্ঞানযোগের পথে স্থিত ব্যক্তি। এই বিনাশ ঘটে আত্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমে। যে-জ্ঞান লাভ হয়, তা অজ্ঞানের (তমঃ বা অন্ধকার) আবরণকে দূর করে দেয়। এখানে 'অজ্ঞান' বলতে সেই ভ্রমকে বোঝানো হয়েছে, যার কারণে জীব নিজেকে দেহ এবং কর্মের কর্তা বলে ভুল করে।
জ্ঞানের প্রকৃতি (সূর্যের সঙ্গে তুলনা): জ্ঞান হলো সূর্যের আলোর মতো। সূর্য যেমন অন্ধকারের আবরণ দূর করে তার নিজস্ব আলোয় সমস্ত কিছু প্রকাশ করে, জ্ঞানও ঠিক তেমনি। যেমন সূর্য উদিত হয়ে অন্ধকারকে দূর করে সব কিছু প্রকাশিত করে, ঠিক তেমনই জ্ঞান সমস্ত অজ্ঞতা দূর করে পরম সত্য (ব্রহ্ম)-কে প্রকাশিত করে।
পরমতত্ত্বের প্রকাশ: জ্ঞান, অজ্ঞানকে দূর করার মাধ্যমে সেই অপ্রাকৃত (জাগতিক গুণ থেকে মুক্ত), পরম তত্ত্বকে (ব্রহ্ম বা আত্মা) প্রকাশ করে। এই পরম তত্ত্ব সর্বদা বিদ্যমান থাকলেও, অজ্ঞানের অন্ধকারে তা আমাদের কাছে অপ্রকাশিত থাকে।
মোক্ষ লাভের মাধ্যম: এই উক্তিটি অদ্বৈত বেদান্তের সেই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে যে, মোক্ষ হলো কোনো বস্তু অর্জন নয়, বরং অজ্ঞানের বিনাশ। এই বিনাশ কেবল জ্ঞান দ্বারাই সম্ভব। জ্ঞান লাভ হলে জীব তার প্রকৃত স্বরূপ অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদত্ব উপলব্ধি করে।
এখানে ব্রহ্মকে কোনো নতুন বস্তু হিসেবে সৃষ্টি করা হয় না, কিংবা কোথাও নিয়ে আসা হয় না। বরং, জ্ঞান কেবল আবরণ দূর করে (অজ্ঞান নাশিত হয়), ফলে যা আগে থেকেই ছিল (ব্রহ্ম), তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়। এটিই মোক্ষ বা মুক্তি। এই শ্লোকটি জ্ঞানকেই মোক্ষের একমাত্র সরাসরি কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং জ্ঞানকে অন্ধকার দূরকারী আলোকশিখার মতো এক অপরিবর্তনীয় শক্তি হিসেবে বর্ণনা করে।
শঙ্করাচার্য এই তত্ত্বকে তাঁর ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্যে (৩.৪.২৬) ব্যাখ্যা করেছেন—“জ্ঞানং তু কৈবল্য-হেতু, ন তু কর্মসমুচ্চয়ঃ”—অর্থাৎ, কেবল জ্ঞানই মুক্তির কারণ, কর্মের সহচর নয়। তিনি জ্ঞান-কর্ম-সমুচ্চয়-বাদ, অর্থাৎ “জ্ঞান ও কর্ম মিলে মুক্তি দেয়”—এই ধারণাকে তীব্রভাবে খণ্ডন করেছেন। কারণ যেখানে জ্ঞান আসে, সেখানে কর্তা-ভাব থাকে না; আর কর্তা-ভাব ছাড়া কর্মের স্থানই নেই।
এটি হলো আদি শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক সূত্র। এই উক্তিটি শঙ্করাচার্যের দ্বারা তাঁর ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য এবং অন্যান্য টীকাগুলিতে মীমাংসা দর্শনের (যা জ্ঞান ও কর্মের মিশ্রণ বা সমুচ্চয়বাদ সমর্থন করে) মত খণ্ডন করার সময় ব্যবহৃত হয়েছে।
এই সূত্রটি জ্ঞান-কর্ম বিরোধের (Jñāna-Karma Virodha) অদ্বৈতবাদী সমাধানকে সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করে:
কৈবল্য-হেতু জ্ঞান: অদ্বৈত বেদান্তে কৈবল্য (Kaivalya) হচ্ছে মোক্ষ বা পরম মুক্তি। শঙ্কর বলেন, একমাত্র জ্ঞান বা আত্মোপলব্ধিই হলো মোক্ষের হেতু বা কারণ। কারণ মোক্ষ হলো অজ্ঞানের অপসারণ, যা কেবল জ্ঞানের আলো দ্বারাই সম্ভব।
কর্মসমুচ্চয় বাতিল: ‘কর্মসমুচ্চয় (Karmasamuccaya)’ হচ্ছে জ্ঞান এবং কর্মকে একসঙ্গে মিশিয়ে মোক্ষ লাভের চেষ্টা। শঙ্কর দৃঢ়ভাবে বলেন যে, কর্মসমুচ্চয় মোক্ষের পথ নয় (ন তু)।
যেহেতু জ্ঞান অভেদের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং কর্ম ভেদের (কর্তা-কর্ম-ফল) ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাই এরা পরস্পর বিরোধী। জ্ঞান আলো, কর্ম হলো সেই অন্ধকারের ফল। আলো এবং অন্ধকার কখনোই একসাথে থাকতে পারে না বা মিশে যেতে পারে না। তাই মোক্ষের জন্য জ্ঞানই একমাত্র প্রত্যক্ষ উপায়।
জ্ঞানের উদয়ে সঞ্চিত (Saṃcita) ও আগামী (Āgāmī) কর্ম দগ্ধ হয়; কেবল প্রারব্ধ (Prārabdha)—অর্থাৎ, যে-কর্মের ফল ইতিমধ্যেই দেহধারণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে—তা দেহপতন পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে। তাই জ্ঞানী ব্যক্তি দেহে অবস্থান করেও দেহে আবদ্ধ নন। তাঁর কর্ম থাকে, কিন্তু কর্ম তাঁকে স্পর্শ করে না। তিনি কাজ করেন, কিন্তু কর্তার মতো নয়—বরং সাক্ষীচেতনার মতো। তাঁর কর্ম ব্যক্তিগত নয়, বরং বিশ্বকল্যাণের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি।
এই অবস্থাকে বলে জীবন্মুক্তি। জীবন্মুক্ত ব্যক্তি জানেন—কর্ম, ভোগ, সুখ, দুঃখ—সবই প্রারব্ধের ফল; তিনি কেবল দ্রষ্টা, কখনও কর্তা নন। তাঁর দেহ—যেমন পাখা বন্ধ করার পরও কিছুক্ষণ ঘুরে যায়, তেমনি দেহের গতিও কেবল প্রারব্ধের গতি। দেহপতনের সঙ্গে সঙ্গে, প্রারব্ধ শেষ হলে ঘটে বিদেহমুক্তি—যেখানে আর কোনো কর্ম, কোনো অবিদ্যা, কোনো ভোগ অবশিষ্ট থাকে না।
জ্ঞান-কর্ম বিরোধের সারসংক্ষেপ এই—কর্ম দ্বৈত, জ্ঞান অদ্বৈত; কর্ম অবিদ্যার ফল, জ্ঞান অবিদ্যার নাশ; কর্ম বন্ধন আনে, জ্ঞান মুক্তি দেয়। দুটি তাই একই সঙ্গে থাকতে পারে না। জ্ঞান উপস্থিত হলে কর্মের প্রয়োজন থাকে না, কারণ কর্তার ধারণাই মুছে যায়। তখন থাকে কেবল এক চিরন্তন সত্য—আত্মা, যা কখনও কর্ম করে না, কখনও ফল ভোগ করে না; সে কেবল নিজেই নিজের আলোয় জ্বলে—চিরজাগ্রত, স্বয়ংপ্রকাশ, কর্মাতীত, চিরমুক্ত।
শ্লোক ২২: শাস্ত্রের লক্ষ্য
তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, কর্ম কেবল চিত্তকে শুদ্ধ (Purify) করতে পারে, কিন্তু এটি সরাসরি মোক্ষ প্রদান করতে পারে না। মুক্তি বা মোক্ষ আসে কেবল বস্তুর স্বরূপ জ্ঞান (বস্তুস্বরূপ-জ্ঞান) থেকে।
শ্লোক ২৩: বস্তুর স্বরূপ জ্ঞান
শঙ্কর বলেন, বস্তুর স্বরূপ জ্ঞান কেবল বিবেক বা যথাযথ বিচার (Right Discernment) দ্বারাই সম্ভব, তা কোটি কোটি কর্ম দ্বারাও সম্ভব নয়। অর্থাৎ, মোক্ষের জন্য একমাত্র জ্ঞানই প্রয়োজন।
শ্লোক ২৪: সাধন-চতুষ্টয়ের আবশ্যকতা
মোক্ষের জন্য অপরিহার্য জ্ঞান বা বিচার লাভ করতে হলে, প্রথমে সাধন-চতুষ্টয় (চারটি যোগ্যতা) সম্পূর্ণ করতে হবে। এই সাধন-চতুষ্টয় অর্জিত না হলে, বিচারে সফলতা আসে না।
শ্লোক ২৫: মোক্ষের কারণ
এই শ্লোকটি সাধন-চতুষ্টয়ের গুরুত্বকে চূড়ান্ত করে। যিনি সঠিকভাবে এই চারটি সাধনে দক্ষ, তিনিই ব্রহ্মতত্ত্বের বিচার (অনুসন্ধান) করে মোক্ষ লাভের অধিকারী হন।
এই অংশটি মোক্ষার্থীকে শেখায় এবং উৎসাহিত করে যে, জীবনের উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান লাভ করা এবং সেই জ্ঞানের জন্য মনকে প্রস্তুত করতে সাধন-চতুষ্টয় অবশ্যই অর্জন করতে হবে।
সাধন-চতুষ্টয়ের চতুর্থটি মুমুক্ষুত্ব (Mumukṣutva)। মুমুক্ষুত্ব মানে মুক্তির জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা—যেখানে সংসারের কোনো বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকে না, কেবল মুক্তিই একমাত্র লক্ষ্য। শঙ্করাচার্য উপদেশসাহস্রী (১.১)-তে বলেন—“মোক্ষঃ ন তু কিঞ্চিদ্ভোগস্য শূন্যতা, কিঞ্চিত্ ব্রহ্মাবেদনাত্”—মোক্ষ কোনো ভোগবস্তুর শূন্যতা নয়, বরং ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা; অর্থাৎ, মুক্তি মানে কোনো ভোগশূন্যতা নয়, বরং ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। এই আকাঙ্ক্ষাই সাধনার প্রাণশক্তি—যে-হৃদয়ে মুক্তির জ্বলন্ত তৃষ্ণা আছে, সে কখনও শিথিল হয় না।
এই সূত্রটির মাধ্যমে মোক্ষ সম্পর্কে দুটি প্রধান ভুল ধারণাকে বাতিল করে সঠিক সিদ্ধান্ত স্থাপন করা হয়েছে:
“মোক্ষ শূন্যতা নয় (ন তু কিঞ্চিদ্ ভোগস্য শূন্যতা)”। এই অংশে সেই ধারণাটি বাতিল (খণ্ডন) করা হয়েছে, যা মনে করে, মোক্ষ হলো ভোগের শূন্যতা (ভোগস্য শূন্যতা), অর্থাৎ কেবল সুখ-দুঃখের অনুপস্থিতি বা বস্তুর অভাব।
বৌদ্ধিক বিরোধ: এটি বিশেষভাবে বৌদ্ধ শূন্যবাদের সেই মতের সঙ্গে বাদানুবাদ করে, যেখানে মোক্ষকে (নির্বাণ) সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীনতা বা বিলীন হওয়া বলে মনে করা হয়। অদ্বৈত বেদান্ত অনুযায়ী, ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পর চেতনার বিনাশ হয় না, বরং তার পূর্ণতা লাভ হয়।
“মোক্ষ ব্রহ্মজ্ঞান (কিঞ্চিৎ ব্রহ্মাবেদনাত্)”। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠিত হলো যে, মোক্ষ হলো ব্রহ্মাবেদন (ব্রহ্মজ্ঞান লাভ) বা আত্মজ্ঞান। মোক্ষ হলো জীবের সেই অবস্থা, যেখানে সে অজ্ঞান বা উপাধিজনিত ভ্রান্তি দূর করে নিজেকে ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন রূপে উপলব্ধি করে। এটি কোনো নতুন বস্তু অর্জন নয়, বরং আত্মার নিত্য ও শাশ্বত স্বরূপকে প্রকাশ করা।
এই সূত্রটি বোঝায় যে, মুক্তি একটি সৎ (বাস্তব) এবং আনন্দময় অবস্থা, যা কেবল নেতিবাচকভাবে ভোগের অভাব নয়, বরং ইতিবাচকভাবে ব্রহ্মসত্তার জ্ঞান।
শঙ্করাচার্য বলেন—“মুমুক্ষুত্বম্ বিনা ন কিঞ্চিদপ্যভ্যুদয়তি”, যার অর্থ—“মুমুক্ষুত্ব (মোক্ষ লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা) ছাড়া অন্য কোনো কিছুই সফলতা বা উন্নতি লাভ করে না”। এটি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি নীতিগত সূত্র।
এই বাক্যটি কোনো একক প্রাচীন উপনিষদ বা গীতার শ্লোক নয়। এটি আদি শঙ্করাচার্যের দর্শনের সাধন-চতুষ্টয়ের (চারটি আবশ্যক যোগ্যতা) একটি উপাদানের—মুমুক্ষুত্ব-এর গুরুত্বকে জোর দিয়ে প্রকাশ করা একটি সিদ্ধান্তমূলক প্রবচন। এই ভাবটি শঙ্করাচার্যের বিবেকচূড়ামণি (বিশেষত শ্লোক ১৯-২৫) এবং অন্যান্য প্রকরণ গ্রন্থগুলির মূল শিক্ষা। এই গ্রন্থগুলি মোক্ষলাভের জন্য অন্য সব জাগতিক আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে কেবল মুক্তির প্রতি তীব্র আগ্রহ থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রতিষ্ঠা করে।
এই উক্তিটি বোঝায় যে, আধ্যাত্মিক পথে সফলতা লাভের জন্য মুমুক্ষুত্বই হলো প্রধান চালিকা শক্তি। অন্যান্য সাধনের ভিত্তি—নিত্যানিত্য-বস্তু-বিবেক (নিত্য-অনিত্য বস্তুর বিচার), বৈরাগ্য এবং শমাদি-ষট্ক্-সম্পত্তি (শম, দম ইত্যাদি)—এই সমস্ত সাধন তখনই সফলতা লাভ করে, যখন এদের পেছনে মুমুক্ষুত্ব থাকে। মুমুক্ষুত্ব না থাকলে বৈরাগ্য কেবল অলসতা বা নৈরাশ্য হতে পারে।
যেহেতু মোক্ষ হলো জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য (পরমার্থ), তাই এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্য সব জাগতিক আকাঙ্ক্ষা বা "অভ্যুদয়" (উন্নতি/সাফল্য) মূল্যহীন। তীব্র মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই সাধককে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে ব্রহ্মজ্ঞানে স্থিত হতে সাহায্য করে। মুক্তির আকাঙ্ক্ষা না থাকলে অন্য সব গুণ নিষ্ফল। যার মনে এই তীব্র ইচ্ছা জাগে, তার সমস্ত বাসনা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, এবং সে আত্মজ্ঞানলাভের জন্য সর্বস্ব ত্যাগে প্রস্তুত হয়।
অদ্বৈত বেদান্তের সিদ্ধান্ত—“অধিকারিণঃ সাধনচতুষ্টয়সম্পন্নঃ।” অর্থাৎ, “অধিকারী (মোক্ষ লাভের উপযুক্ত ব্যক্তি) সাধনচতুষ্টয়-সম্পন্ন হবেন।” ফলে, যে-ব্যক্তি এই চারটি যোগ্যতায় সম্পন্ন, সে-ই ব্রহ্মজ্ঞানলাভের যোগ্য। এই উক্তিটির ভাবার্থ শঙ্করাচার্যের বিবেকচূড়ামণি এবং ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য-এর মতো প্রধান গ্রন্থগুলির ভূমিকা বা উপোদ্ঘাতে পাওয়া যায়, যেখানে তিনি ব্রহ্মজিজ্ঞাসার (ব্রহ্ম সম্পর্কে জানার আকাঙ্ক্ষা) জন্য যোগ্যতার আলোচনা করেছেন।
এই সূত্রটি অদ্বৈত বেদান্তের শিক্ষণ পদ্ধতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে:
অধিকারী (Adhikāriṇaḥ): এটি সেই ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার জন্য উপযুক্ত বা যোগ্য। অদ্বৈত বেদান্ত অনুসারে, মোক্ষ বা ব্রহ্মজ্ঞান কেবল তাত্ত্বিক অধ্যয়ন দ্বারা অর্জিত হয় না; এর জন্য মানসিক ও নৈতিক প্রস্তুতি প্রয়োজন।
সাধনচতুষ্টয়সম্পন্নঃ (Sādhanacatuṣṭayasampannaḥ): এর অর্থ হলো সাধনচতুষ্টয়ের চারটি আবশ্যক গুণ (নিত্যানিত্য-বস্তু-বিবেক, ইহ-অমুত্র-ফল-ভোগ-বিরাগ, শমাদি-ষট্ক্-সম্পত্তি এবং মুমুক্ষুত্ব) দ্বারা ভূষিত বা সম্পন্ন।
এই বাক্যটি স্পষ্ট করে ঘোষণা করে যে, একজন ব্যক্তির মধ্যে যদি এই চারটি গুণ না থাকে, তবে তিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য উপযুক্ত নন, এবং তাঁর পক্ষে গুরুর উপদেশ গ্রহণ করেও মোক্ষলাভ করা সম্ভব নয়। অতএব, সাধনচতুষ্টয় অর্জনই হলো ব্রহ্মজিজ্ঞাসার প্রথম ও অপরিহার্য ধাপ।
নিত্যানিত্য-বিবেক জ্ঞান দেয়—কী স্থায়ী, কী ক্ষণস্থায়ী; বৈরাগ্য আসক্তি ভাঙে; ষট্সম্পত্তি মনকে শান্ত ও নির্মল করে; মুমুক্ষুত্ব মুক্তির দিকে টানে। এই চারটি মিলে তৈরি হয় আত্মজ্ঞানারোহণের সোপান—যার চূড়ান্ত শিখরে প্রতিভাত হয় সেই এক অখণ্ড সত্য—“অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—আমি ব্রহ্ম।