অবিদ্যা-বিদ্যা: ৪



অহংকারের তিনটি অংশ আসলে তার তিনটি গুণভিত্তিক রূপ—সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। এই তিন গুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) প্রকৃতির অন্তর্গত মৌলিক শক্তি, আর অহংকার সেই শক্তিগুলির প্রভাবে ভিন্ন ভিন্ন ফল প্রকাশ করে।

সাত্ত্বিক অংশ হলো স্বচ্ছ, আলোকময় ও জ্ঞানোদ্দীপক। অহংকারের এই অংশ থেকে জন্ম নেয় জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয় ও মন। অর্থাৎ, জানার, করার ও চিন্তার শক্তি এখান থেকেই প্রকাশিত হয়। এই অংশই চেতনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, কারণ সত্ত্বগুণ প্রকৃতিকে ভারসাম্য ও স্বচ্ছতা দেয়, ফলে চেতনা সহজে প্রতিফলিত হতে পারে।

রাজসিক অংশ হলো গতিশীল, শক্তিশালী ও ক্রিয়াপ্রবণ। এটি অহংকারের সেই অংশ, যা সব ইন্দ্রিয়কে কর্মক্ষম করে, অর্থাৎ ক্রিয়ার শক্তি জোগায়। যেমন—চোখ দেখার, কান শোনার, মুখ বলার, হাত ধরার ও পা চলার শক্তি রাজসিক অহংকারের প্রভাবে সক্রিয় হয়। রজোগুণের স্বভাবই হলো গতি ও কর্ম, তাই এটি চেতনার স্থির জ্ঞানকে কার্যরূপ দেয়।

তামসিক অংশ হলো আচ্ছাদনকারী, ভারী ও জড়। অহংকারের এই অংশ থেকেই জন্ম নেয় পাঁচ তন্মাত্র—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ। এই তন্মাত্রগুলো সূক্ষ্ম উপাদান হিসেবে পরে স্থূল জগতের ভিত্তি তৈরি করে। তমোগুণের স্বভাব হলো অন্ধকার ও আচ্ছাদন, তাই এখান থেকেই জড় বস্তুজগতের উৎপত্তি ঘটে।

অহংকারের সাত্ত্বিক অংশ চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে জ্ঞান ও মনকে প্রকাশ করে, রাজসিক অংশ গতি ও কর্মশক্তি প্রদান করে, আর তামসিক অংশ পদার্থজগতের কারণ হিসেবে সূক্ষ্ম উপাদান সৃষ্টি করে। এই তিন রূপ একত্রে সৃষ্টি করে জীবের সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা—জ্ঞাতার, কর্তার ও ভোক্তার সমগ্র কাঠামো।

এভাবে দেখা যায়, জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের উৎস অহংকার নিজেই। “আমি দেখি”, “আমি শুনি”, “আমি বলি”, “আমি চলি”—এসব অভিজ্ঞতার মূল কেন্দ্র হলো সেই “আমি”-বোধ। অহংকার না থাকলে অভিজ্ঞতা থাকত, কিন্তু “আমার অভিজ্ঞতা” বলে কিছু থাকত না। তাই অহংকার হলো সেই সেতু, যা আত্মাকে জগতের সঙ্গে যুক্ত করে, আবার বন্ধনেও ফেলে।

যখন অহংকার আত্মাকে ভুলে নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে ভাবতে শুরু করে, তখনই সৃষ্টি হয় বন্ধন। তখন মানুষ ভাবে “আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি কাজ করি”, “আমি সুখী”, “আমি দুঃখী”—এসব ধারণাই অহংকারের ফল। কিন্তু আত্মা কখনও কর্তা নয়, সে শুধু সাক্ষী; ইন্দ্রিয়, মন ও অহংকারই কর্ম করে, আত্মা কেবল তাদের আলোকিত করে।

জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয় উভয়ই অহংকার থেকে উদ্ভূত—কারণ জানার ও করার দুই শক্তিই “আমি”-বোধের প্রকাশ। অহংকার থেকেই ব্যক্তি-সত্তার সূচনা, আর সেই সত্তা থেকেই শুরু হয় জগতের সঙ্গে সম্পর্ক, অভিজ্ঞতা ও বন্ধনের সমগ্র নাট্যপ্রবাহ।

এই তত্ত্বগুলির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, সৃষ্টি আসলে এক ধারাবাহিক বিকাশ—অব্যক্ত সূক্ষ্ম প্রকৃতি থেকে শুরু করে সূক্ষ্ম তন্মাত্র ও স্থূল মহাভূত পর্যন্ত। সব কিছুই প্রকৃতির পরিণতি, কিন্তু পুরুষ বা আত্মা এই সমস্ত ক্রিয়ার নিস্পৃহ সাক্ষী।

সাংখ্য দর্শনের মূল ভাবনা হলো দ্বৈততত্ত্ব—পুরুষ ও প্রকৃতি চিরকাল পৃথক। পুরুষ হলো শুদ্ধ চৈতন্য, জ্ঞাতা ও সাক্ষী; সে কর্ম করে না, কেবল দেখে (দ্রষ্টা)। প্রকৃতি হলো জড়, কিন্তু তার তিন গুণ—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—যখন চৈতন্যের সংস্পর্শে আসে, তখন ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং প্রকাশ শুরু হয়। এই প্রকাশই সৃষ্টি। পুরুষ প্রকৃতির প্রতিফলনে জগৎকে দেখে, কিন্তু নিজে অপরিবর্তনীয় থাকে।

যখন পুরুষ প্রকৃতিকে দেখে, তখন প্রকৃতি “নাচতে শুরু করে”—এটাই সৃষ্টি। কিন্তু যখন পুরুষ উপলব্ধি করে যে, সে প্রকৃতি নয়, তখন প্রকৃতির নৃত্য থেমে যায়। এই আত্মবোধই মুক্তি—যাকে সাংখ্যে বলা হয় “কৈবল্য”।

সাংখ্য কারিকা কেবল দর্শন নয়, যুক্তির এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এতে কারণ-কার্য সম্পর্ক, জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়ের ভূমিকা, মানসিক বিকার, কর্মফল ও মুক্তির ব্যাখ্যা এমনভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যা ভারতীয় চিন্তাধারায় এক নতুন যৌক্তিকতা এনে দেয়।

এই তত্ত্বের প্রভাব অসীম—যোগ দর্শন (পতঞ্জলির যোগসূত্র) সাংখ্যের এই তত্ত্বকে গ্রহণ করে সাধনার পদ্ধতিতে প্রয়োগ করেছে; বেদান্ত দর্শন একই কাঠামো ধরে পুরুষ-প্রকৃতির পরিবর্তে ব্রহ্ম-মায়া তত্ত্বে রূপ দিয়েছে; এমনকি বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনও সাংখ্যের কারণ-কার্য সম্পর্ক ও চেতনা বিশ্লেষণ থেকে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে।

‘সাংখ্য কারিকা’ ভারতীয় দর্শনের প্রথম পদ্ধতিগত ও বিশ্লেষণাত্মক গ্রন্থ, যেখানে সৃষ্টি, চেতনা, দুঃখ ও মুক্তির সম্পর্ক যুক্তি, পর্যবেক্ষণ ও গভীর দার্শনিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একে বলা যায়—ভারতীয় চিন্তায় বৈজ্ঞানিক দর্শনের প্রথম রূপরেখা, যেখানে প্রকৃতি ও চেতনার পারস্পরিক সম্পর্কের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে দুঃখের কারণ ও মুক্তির পথ স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে।

পাঁচটি তন্মাত্র হলো—শব্দ তন্মাত্র, স্পর্শ তন্মাত্র, রূপ তন্মাত্র, রস তন্মাত্র, এবং গন্ধ তন্মাত্র। প্রত্যেক তন্মাত্র একটি করে স্থূল উপাদানের কারণ—শব্দ তন্মাত্র থেকে আকাশ, স্পর্শ তন্মাত্র থেকে বায়ু, রূপ তন্মাত্র থেকে অগ্নি, রস তন্মাত্র থেকে জল, গন্ধ তন্মাত্র থেকে পৃথিবী।

বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শন উভয়েই সৃষ্টি-প্রক্রিয়াকে সূক্ষ্ম থেকে স্থূলের ক্রমোন্নতি হিসেবে ব্যাখ্যা করে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই তন্মাত্র থেকে মহাভূতের জন্ম ঘটে। তন্মাত্র মানে হলো সূক্ষ্ম উপাদান বা গুণ—যা এখনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, কিন্তু যার মধ্যেই সমস্ত স্থূল জগতের সম্ভাবনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। সেই তন্মাত্রগুলো ধীরে ধীরে মিশে ও বিকশিত হয়ে দৃশ্যমান উপাদানরূপে প্রকাশ পায়।

প্রথমে ছিল আকাশতত্ত্ব—যা কেবল শব্দ তন্মাত্র বহন করে। শব্দ মানে কম্পন বা স্পন্দন। সৃষ্টি-আরম্ভে যখন চৈতন্য ও প্রকৃতির সংযোগে প্রথম কম্পন জাগে, সেই সূক্ষ্ম কম্পনই শব্দতন্মাত্র। এই কম্পন থেকেই সূক্ষ্ম “আকাশ” বা স্থান-ধারণক্ষমতা সৃষ্টি হয়—কারণ শব্দ প্রতিফলিত হতে পারে কেবল স্থানে। তাই বলা হয়, শব্দ তন্মাত্র থেকে আকাশের সৃষ্টি।

আকাশ থেকে উৎপন্ন হয় বায়ু, যার কারণ স্পর্শ তন্মাত্র। কম্পনের মধ্যে গতির অনুভব জাগলে স্পর্শের সূচনা হয়। স্পর্শ মানে গতি ও স্পর্শজনিত সংযোগ। তাই বায়ু তত্ত্বের মধ্যে আছে দুটি গুণ—শব্দ ও স্পর্শ।

এরপর বায়ু থেকে উৎপন্ন হয় অগ্নি, যার মূল রূপ তন্মাত্র। গতি যখন ঘর্ষণ সৃষ্টি করে, তখন তাপ ও আলোর জন্ম হয়—এটাই রূপ বা আকার-বোধের সূচনা। তাই অগ্নির গুণ তিনটি—শব্দ, স্পর্শ ও রূপ।

অগ্নি থেকে জন্ম নেয় জল, যার কারণ রস তন্মাত্র। তাপ যখন শীতল হয়, তখন তরলতা জন্মায়, আর তরলতাই স্বাদের আধার। তাই জলে থাকে শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস—চারটি গুণ।

শেষে জলের ঘনীকরণে জন্ম নেয় পৃথিবী, যার কারণ গন্ধ তন্মাত্র। ঘনত্ব যত বাড়ে, তত বস্তুতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়, আর সেখান থেকেই গন্ধের অনুভব সম্ভব হয়। তাই পৃথিবীতে থাকে সব পাঁচটি গুণ—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ।

এই ক্রমেই সূক্ষ্ম থেকে স্থূলের বিকাশ ঘটে—তন্মাত্র থেকে মহাভূত—সম্ভাবনা থেকে বাস্তব প্রকাশ। তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে—“আকাশাৎ বায়ুঃ, বায়োরগ্নিঃ, অগ্নেরাপঃ, অধ্যঃ পৃথিবী।” (২.১.১-২.১.২) অর্থাৎ, আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, জল থেকে পৃথিবী।

এভাবে তন্মাত্রগুলোর সূক্ষ্ম কম্পন ক্রমে ঘন হয়ে পদার্থে পরিণত হয়, আর এই বিকাশই জগতের সৃষ্টি-ধারা—যেখানে শব্দের সূক্ষ্ম স্পন্দন থেকে শুরু করে গন্ধের স্থূল প্রকাশ পর্যন্ত সবই এক অবিচ্ছিন্ন চেতনার রূপান্তর।

এইভাবে তন্মাত্রগুলি সূক্ষ্ম থেকে স্থূলের ক্রমে বিকাশ লাভ করে, যা “পঞ্চভূত-প্রপঞ্চ” নামে পরিচিত। প্রথমে আকাশে কেবল শব্দের সূক্ষ্ম কম্পন ছিল, তারপর সেই শব্দ থেকে স্পর্শের অনুভব জন্ম নেয়, স্পর্শ থেকে রূপ বা দৃশ্য, রূপ থেকে রস বা স্বাদ, এবং রস থেকে গন্ধ বা ঘনত্বের ধারণা।

তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে—“আকাশাৎ বায়ুঃ, বায়োরগ্নিঃ, অগ্নেরাপঃ, অধ্যঃ পৃথিবী।” অর্থাৎ আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, জল থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি ধাপে একটি করে নতুন গুণ যুক্ত হয়েছে—আকাশে শব্দ; বায়ুতে শব্দ ও স্পর্শ; অগ্নিতে শব্দ, স্পর্শ ও রূপ; জলে শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস; আর পৃথিবীতে পাঁচটিই—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ—অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এভাবে দেখা যায়, তন্মাত্র হলো জগতের সূক্ষ্ম কারণতত্ত্ব, যা দেখা যায় না, কিন্তু যার উপর সব স্থূল উপাদান দাঁড়িয়ে আছে। মহাভূত হলো এদের দৃশ্যমান প্রকাশ, আর তন্মাত্র হলো সেই সূক্ষ্ম শক্তি, যা মহাভূতের ভিতরে লুকিয়ে থাকে। যেমন বীজে গাছের সমস্ত রূপ লুকিয়ে থাকে, কিন্তু দৃশ্যমান নয়, তেমনি তন্মাত্রের ভিতরে জগতের সমস্ত রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ ও স্পর্শ সুপ্তভাবে থাকে—এবং সময় এলে প্রকাশ পায়।

যখন এই সূক্ষ্ম তন্মাত্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিশে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপে প্রকাশ পায়, তখনই তারা মহাভূত নামে পরিচিত হয়। তখন সৃষ্টি দৃশ্যমান হয়—আমরা আকাশ দেখি, বায়ু অনুভব করি, অগ্নির তাপ পাই, জল পান করি, মাটিতে চলি।

অতএব ভূত হলো সূক্ষ্ম কারণ, মহাভূত হলো তার স্থূল ফল। যেমন বীজে গাছের সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু গাছ দেখা যায় যখন বীজ অঙ্কুরিত হয়ে বেড়ে ওঠে, তেমনি ভূত হলো বীজ, মহাভূত হলো প্রকাশিত গাছ।

তৈত্তিরীয় উপনিষদে (২.১.১-২) এই ক্রমটি বোঝানো হয়েছে—“আকাশাৎ বায়ুঃ, বায়োরগ্নিঃ, অগ্নেরাপঃ, অধ্যঃ পৃথিবী”—আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, আর জল থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্রমেই সূক্ষ্ম থেকে স্থূলের বিকাশ ঘটে—ভূত থেকে মহাভূতের উদ্‌ভব।

সংক্ষেপে—ভূত মানে উপাদানের সূক্ষ্ম, অব্যক্ত, কারণরূপ অবস্থা; মহাভূত মানে সেই উপাদানের স্থূল, প্রকাশিত, দৃশ্যমান অবস্থা। সৃষ্টি হলে ভূত প্রকাশ পেয়ে মহাভূত হয়, আর প্রলয়ে মহাভূত লীন হয়ে আবার ভূতে ফিরে যায়—এভাবেই প্রকৃতির অনন্ত চক্র চলতে থাকে।

পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ—এই পাঁচটি উপাদানকে বলা হয় পঞ্চ মহাভূত, অর্থাৎ, জগৎ ও দেহের মৌল ভিত্তি। এই পাঁচ তত্ত্ব থেকেই সমগ্র স্থূল বিশ্ব ও মানবদেহ গঠিত। প্রতিটি উপাদানের একটি প্রধান গুণ আছে, যা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভূত হয়, এবং প্রতিটি উপাদান পরেরটির উৎস ও ধারক। উপনিষদ, গীতা ও তত্ত্ববোধে এই তত্ত্বগুলির বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

পৃথিবী হচ্ছে সবচেয়ে স্থূল ও দৃঢ় উপাদান। এর প্রধান গুণ গন্ধ। স্থিরতা, ভার ও দৃঢ়তা পৃথিবীর প্রকৃতি। দেহে পৃথিবীর প্রকাশ দেখা যায় হাড়, মাংস, চামড়া ও অস্থিতে। এই উপাদান আমাদের স্থায়িত্ব ও আকার প্রদান করে। তৈত্তিরীয় উপনিষদে (২.১.১) বলা হয়েছে—“অন্নম্ ব্রহ্মেত্যুপাসীত”—অর্থাৎ, এই স্থূল দেহ খাদ্যনির্ভর, যা মূলত পৃথিবী-তত্ত্বের বিকাশ। ছান্দোগ্য উপনিষদে (৬.২.৪) বলা হয়েছে—“স অমুমৈতাম্ ত্রিনিভৃতিম্ অভ্যনুজ্ঞাত, ত্রিনিভৃতিঃ নাম রূপং, অন্নম্”—অর্থাৎ, রূপ ও নামের সম্পূর্ণ প্রকাশ পৃথিবীতেই ঘটে।

জল উপাদান বা অপের প্রধান গুণ রস বা স্বাদ। এটি সংযোগ, স্নিগ্ধতা ও তরলতার প্রতীক, যা জীবনের ধারাকে একত্র রাখে। দেহে জলীয় উপাদান প্রকাশ পায় রক্ত, রস, অশ্রু ও প্রস্রাবে। ছান্দোগ্য উপনিষদে (৬.২.৩) বলা হয়েছে—“অপো হ বৈ সব্ভূতানাং প্রাণা”—সব জীবের প্রাণ বা জীবন জলের উপর নির্ভরশীল। গীতায় (৭.৮) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—“রসো’হম্ আপসু কৌন্তেয়”—“আমি জলে রসরূপে বিরাজমান।” অর্থাৎ, জল জীবনে সেই সঞ্জীবন শক্তি বহন করে, যার দ্বারা সৃষ্টি স্থিত থাকে।