অবিদ্যা-বিদ্যা: ৩৩



চতুর্থ স্তর বিজ্ঞানময়-কোষ (Vijñānamaya Kośa)—বুদ্ধির স্তর। এটি বিচার, উপলব্ধি ও সিদ্ধান্তগ্রহণের আসন। এখানেই প্রকাশিত হয় “আমি জানি”—এই জ্ঞানবোধ। বিজ্ঞানময়-কোষই মনকে নিয়ন্ত্রণ করে, নৈতিক বোধ ও বিবেকের জন্ম দেয়। কিন্তু এটিও আত্মা নয়, কারণ এর জ্ঞান প্রতিফলিত চেতনা—চিদাভাস। যেমন আয়নায় সূর্যের প্রতিফলন দেখা যায়, তেমনি বুদ্ধিতে আত্মার প্রতিফলন দেখা যায়; কিন্তু প্রতিফলন সূর্য নয়। তাই বিজ্ঞানময়-কোষও আত্মা নয়; এটি আত্মার প্রতিবিম্বমাত্র।

পঞ্চম ও অন্তিম স্তর আনন্দময়-কোষ (Ānandamaya Kośa)—আনন্দের আবরণ। এটি কারণ শরীরের সঙ্গে যুক্ত, যা গভীর নিদ্রার অবস্থায় প্রকাশিত হয়। তখন মন, ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি লীন থাকে, শুধু অবিদ্যা-আচ্ছন্ন প্রশান্তি অনুভূত হয়। এই সুখ অজ্ঞানের মধ্যকার স্বস্তি; এটি চৈতন্যের স্বরূপানন্দ নয়, বরং অবিদ্যার আবরণে মোড়া আনন্দ। এখানে শান্তি আছে, কিন্তু জ্ঞান নেই; তাই এই স্তরও আত্মা নয়।

যখন সাধক একে একে এই পাঁচটি আবরণ অতিক্রম করেন—“আমি দেহ নই, আমি প্রাণ নই, আমি মন নই, আমি বুদ্ধি নই, আমি আনন্দময়ও নই”—তখন তিনি আত্মার প্রকৃত রূপে স্থিত হন। তখন প্রকাশিত হয় সেই মহাবাক্য—“অহং ব্রহ্মাস্মি”—আমি ব্রহ্ম, আমি চেতনা নিজে।

এই আত্মা জন্ম-মৃত্যুর ঊর্ধ্বে, দেহ বা মন দ্বারা স্পর্শিত নয়। যেমন সূর্য মেঘে ঢাকা পড়লেও মেঘের ওপারে সর্বদা দীপ্ত, তেমনি আত্মা কখনও আচ্ছন্ন হয় না; কেবল উপাধির কারণে তার দীপ্তি অদৃশ্য মনে হয়। যখন এই সব উপাধি—অন্ন, প্রাণ, মন, বুদ্ধি, আনন্দ—সব ভেদ অতিক্রম করা যায়, তখন জ্ঞানী হন কোষাতীত (Kośātīta)—অর্থাৎ, সমস্ত কোষের অতীত আত্মায় প্রতিষ্ঠিত। তখন তাঁর অভিজ্ঞতা একমাত্র এই—“আমি চিরচেতনা, আমি চিরনির্বিকার, আমি স্বয়ং আনন্দ।”


আত্মসন্ধানের সাধক ধীরে ধীরে এগিয়ে যান আত্ম-অনাত্ম-বিবেক (Ātma-Anātma-Viveka)-এর পথে—অর্থাৎ, “যা আত্মা নয়, তা থেকে নিজেকে পৃথক করা”। এটি বেদান্তের মূল অনুশীলন। এখানে অনুসন্ধানকারী আত্মাকে আচ্ছন্ন করে থাকা প্রতিটি কোষ বা আবরণকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং যুক্তি ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দ্বারা বুঝতে থাকেন—“এ আমি নই”। এই বিচারবোধই নেতি-নেতি (Neti-Neti)—“এ নয়, ও নয়”—যার মাধ্যমে সমস্ত সীমাবদ্ধ উপাধি ঝরে পড়ে।

প্রথমে তিনি অনুভব করেন—“আমি দেহ নই”—কারণ দেহ জড়, পরিবর্তনশীল এবং মৃত্যুর সঙ্গে বিলীন হয়। এরপর বোঝেন—“আমি প্রাণ নই”—কারণ প্রাণের ওঠা-নামা আমি দেখি, আমি তার সাক্ষী। তারপর মন পর্যবেক্ষণে আসে—মনও আসে যায়, তাই আমিই তাকে দেখছি; আমি মন নই। পরবর্তীতে বুদ্ধি বা বিজ্ঞানময়-কোষ বিশ্লেষণ করে বোঝেন—বুদ্ধি সিদ্ধান্ত নেয়, সন্দেহ করে, কিন্তু আমি সেই বুদ্ধিরও সাক্ষী; তাই আমিও বুদ্ধি নই। শেষে আনন্দময়-কোষের প্রশান্ত আনন্দকেও তিনি অতিক্রম করেন—কারণ সেই আনন্দ অজ্ঞান-আবৃত, অস্থায়ী ও অবিদ্যা-সংলগ্ন।

এভাবে যখন সব কোষ বা উপাধি অতিক্রান্ত হয়, তখন যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো বিশুদ্ধ চৈতন্য—যা না দেহ, না মন, না বুদ্ধি, না কোনো অনুভূতির ছায়া—বরং সব কিছুর মধ্যে অব্যাহত স্ব-সাক্ষী। এই প্রত্যক্ষ আত্ম-দর্শন (Ātma-Darśana) কোনো চিন্তা বা ধারণা নয়; এটি স্বানুভূতি—যেখানে জ্ঞাতা, জ্ঞান, ও জ্ঞেয়—এই তিনেরই ভেদ বিলীন হয়।

এই অবস্থাকেই বলা হয় তুরীয় (Turīya)—চতুর্থ অবস্থা, যা জাগ্রত (জাগ্রত অবস্থায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ), স্বপ্ন (অন্তর্চেতন জগৎ), ও সুষুপ্তি (অবচেতন প্রশান্তি)—এই তিনেরও ঊর্ধ্বে। উপনিষদে বলা হয়েছে—“ন বহিঃপ্রজ্ঞম্‌ না অন্তঃপ্রজ্ঞম্‌, না উভয়তঃপ্রজ্ঞম্‌, না প্রজ্ঞানঘনম্‌, না প্রজ্ঞম্‌, না অপ্রজ্ঞম্‌—স আত্মা স বিজ্ঞানীয়ঃ।” (মাণ্ডূক্য উপনিষদ, ৭)

এই মন্ত্রের মাধ্যমে আত্মার চতুর্থ অবস্থা বা তুরীয়কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা চরম অদ্বৈত সত্তা। মন্ত্রটি মূলত নেতিবাচকভাবে ব্রহ্মের স্বরূপকে নির্দেশ করে—অর্থাৎ, ব্রহ্ম কী নন।

১. ন বহিঃপ্রজ্ঞম্‌ (Nā bahiṣprajñam): ব্রহ্ম জাগ্রত অবস্থার মতো বহির্জগৎ-জ্ঞানী নন।
২. না অন্তঃপ্রজ্ঞম্‌ (Nā antaḥprajñam): তিনি স্বপ্নাবস্থার মতো অভ্যন্তরীণ জগৎ-জ্ঞানী নন।
৩. না উভয়তঃপ্রজ্ঞম্‌ (Nā ubhayataḥprajñam): তিনি জাগ্রত ও স্বপ্ন—উভয় জগৎ-জ্ঞানী নন।
৪. না প্রজ্ঞানঘনম্‌ (Nā prajñānaghanam): তিনি সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রার অবস্থার মতো জ্ঞানময় পিণ্ড (যেখানে সব অভিজ্ঞতা একীভূত) নন।
৫. না প্রজ্ঞম্‌ (Nā prajñam): তিনি সাধারণ জ্ঞাতা নন (যা মন ও বুদ্ধির মাধ্যমে ঘটে)।
৬. না অপ্রজ্ঞম্‌ (Nā aprajñam): তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞাতা বা অচেতন নন।

উপনিষদ বলে: স আত্মা স বিজ্ঞানীয়ঃ (Sa ātmā sa vijñānīyaḥ), অর্থাৎ—সেই সত্তাই আত্মা, তাঁকেই জানা উচিত।

এই নেতিবাচক বর্ণনার মাধ্যমে উপনিষদ প্রতিষ্ঠা করে যে, তুরীয় হলেন সকল প্রকার জাগতিক ও মানসিক অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে অবস্থিত বিশুদ্ধ চৈতন্য, যা হলো একমাত্র অদ্বৈত সত্য। অর্থাৎ, এই তুরীয় চেতনা বাহ্যজ্ঞান নয়, অন্তর্জ্ঞান নয়, নিদ্রার অচেতন ঘনত্বও নয়; এটি সর্বজ্ঞান নয়, অজ্ঞানও নয়। এটি সেই আত্মা—যে নিজে চিরজাগ্রত সাক্ষী, কিন্তু কোনো অবস্থার অন্তর্ভুক্ত নয়।

তুরীয় অবস্থায় সাধক জানেন—“আমি সেই চেতনা, যা জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্ত—এই তিন অবস্থাকে আলোকিত করে, কিন্তু নিজে কখনও পরিবর্তিত হয় না।” এই অবস্থায় তিনি স্থিত হন স্ব-স্বরূপে—অচঞ্চল, নির্বিকার, নীরব, কিন্তু জাগ্রত।

বেদান্তের মতে, এই উপলব্ধিই মুক্তি—কারণ এখানে সব দ্বন্দ্ব, সব প্রমাণ, সব প্রপঞ্চ বিলীন হয়ে যায়। থাকে কেবল সেই এক চৈতন্য, যা কখনও জন্মে না, কখনও মরে না, যা সব অভিজ্ঞতার পটভূমি, অথচ কোনো অভিজ্ঞতার অংশ নয়। তাই তুরীয়ই আত্মার পরম অবস্থান—চিরনির্বাণ, চিরসাক্ষী, চিরজাগ্রত পরম শান্তি।


এই উপলব্ধিই পরবর্তী ধাপে পৌঁছে দেয় আত্মসাধককে—যেখানে জ্ঞান, কর্ম ও মুক্তি একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। বেদান্ত এই ত্রিবিধ পথকে এক ধারাবাহিক সাধনার সোপান হিসেবে ব্যাখ্যা করে—কর্ম-কাণ্ড (Karma Kāṇḍa) মনকে প্রস্তুত করে, জ্ঞান-কাণ্ড (Jñāna Kāṇḍa) মুক্তি দেয়, আর উভয়ের সমন্বয়েই পূর্ণতা আসে।

প্রথম ধাপ কর্ম-কাণ্ড—অর্থাৎ কর্তব্য, যজ্ঞ, দান, নিয়ম, উপাসনা, ও নিঃস্বার্থ কর্ম। এর উদ্দেশ্য মুক্তি নয়, বরং চিত্ত-শুদ্ধি (Citta-Śuddhi)—মনকে পরিষ্কার, স্থির ও স্বচ্ছ করা। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি, সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।” (গীতা, ২.৪৮) অর্থাৎ, যোগে প্রতিষ্ঠিত থেকে, আসক্তি ত্যাগ করে কর্তব্যকর্ম করো। এই শ্লোকটি কর্মযোগের মূল নীতিগুলির মধ্যে অন্যতম। এই উপদেশের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কর্ম করার সময় সঠিক মানসিকতা কী হওয়া উচিত, তা বলছেন:

যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি (Yogasthaḥ kuru karmāṇi): যোগে স্থিত হয়ে কর্ম করা। এখানে 'যোগ' বলতে বোঝানো হয়েছে সমত্ববুদ্ধি বা সমতা। অর্থাৎ, সিদ্ধি (সাফল্য) এবং অসিদ্ধি (ব্যর্থতা) উভয় ক্ষেত্রেই মনকে অবিচলিত ও শান্ত রাখা।

সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয় (Saṅgaṃ tyaktvā Dhanañjaya): কর্মফলের প্রতি আসক্তি বা ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে কর্ম করতে হবে।

এই শ্লোকের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ বুঝিয়েছেন যে, কর্ম ত্যাগ করা নয়, বরং আসক্তি ত্যাগ করে নির্লিপ্তভাবে কর্ম করাই হলো কর্মযোগের মাধ্যমে মোক্ষ লাভের পথ।

কর্ম অহংকার ও ফলাসক্তিকে ক্ষয় করে। এটি মনকে প্রস্তুত করে জ্ঞানের জন্য, কারণ অশুদ্ধ মন কখনো আত্মজ্ঞান গ্রহণ করতে পারে না। শঙ্করাচার্যও বলেছেন—“নিশ্চয়ই কর্ম মুক্তির কারণ নয়, কিন্তু চিত্ত-শুদ্ধির কারণ।” তাই কর্ম হলো উপায়, জ্ঞান হলো ফল।

অদ্বৈত বেদান্তে “ন হি জ্ঞানের সন্নিধৌ কর্ম বিদ্যতে”—এই উক্তি একটি মৌলিক দার্শনিক অবস্থানকে স্পষ্ট করে—মুক্তি (mokṣa) কেবল জ্ঞানের ফল, কর্মের নয়। এখানে শঙ্করাচার্যের দৃষ্টিতে “জ্ঞানের সন্নিধি” মানে আত্মজ্ঞান উপস্থিত হলে, কর্মের সমস্ত কার্যকারিতা স্বয়ং নষ্ট হয়ে যায়, যেমন সূর্যোদয়ে অন্ধকার বিলীন হয়। কারণ কর্মের উৎস হলো অবিদ্যা (অজ্ঞান), আর জ্ঞান সেই অবিদ্যার সম্পূর্ণ বিনাশ।

বিষয়টি বোঝার জন্য বেদান্ত তিনটি স্তরে এই জ্ঞান-কর্ম সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে।

প্রথমত, কর্মের ক্ষেত্র। কর্ম সবসময় দ্বৈততার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। কর্ম করার জন্য প্রয়োজন কর্তা (agent), কর্ম (action) এবং ফল (result)—এই তিনের ভেদাভেদ। এই ভেদাভেদই অজ্ঞান থেকে উৎপন্ন, কারণ আত্মাকে দেহ ও মনের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করলেই “আমি কর্তা”, “আমি ভোক্তা”, “আমি করব” এই ভাবনা জাগে। এই দেহাত্মবোধই কর্মের মূল চালিকা শক্তি। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন—
“প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ।
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহম্‌ ইতি মন্যতে।।” (গীতা, ৩.২৭)

এই শ্লোকটি আত্মা এবং প্রকৃতি-র মধ্যেকার মৌলিক পার্থক্য এবং অহংকার-এর কারণে সৃষ্ট বন্ধনকে তুলে ধরে।

প্রকৃতি ও গুণ: গীতার মতে, সমস্ত জাগতিক কর্ম প্রকৃতির তিনটি গুণ—সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—দ্বারা সম্পাদিত হয়।

আত্মার নির্লিপ্ততা: আত্মা এই সমস্ত কর্মের সাক্ষী মাত্র, তিনি স্বয়ং কর্তা নন।

অহংকার ও বন্ধন: যিনি অহংকার-এ মূঢ় হয়েছেন (মোহগ্রস্ত হয়েছেন), তিনিই মনে করেন, "আমি কর্তা" (অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে)। অর্থাৎ, যখন জীবাত্মা ভুলে যায় যে, সমস্ত কর্ম প্রকৃতির দ্বারা সম্পন্ন হচ্ছে, এবং মিথ্যা অহংকারবশত নিজেকে কর্তা বলে মনে করে, তখনই সে কর্মফলের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

এই শ্লোকটি কর্মযোগের মূল ভিত্তি স্থাপন করে—ফলের আসক্তি নয়, বরং কর্তৃত্বের অহংকার ত্যাগ করাই হলো মুক্তির পথ। প্রকৃতির গুণগণই সমস্ত কর্ম সম্পাদন করে; কিন্তু যে ব্যক্তি অজ্ঞানবশে নিজেকে কর্তা বলে মনে করে, সে মূঢ়। যতক্ষণ কর্তার অহংকার থাকে, ততক্ষণ কর্ম অব্যাহত থাকবে, এবং তার সঙ্গে থাকবে ফলের আশা, বন্ধন ও পুনর্জন্মের শৃঙ্খল।

দ্বিতীয়ত, জ্ঞানের প্রভাব। জ্ঞান এখানে কেবল বুদ্ধিগত তথ্য নয়, বরং আত্ম-ব্রহ্ম-অভেদ উপলব্ধি—যেখানে জানা যায়, “আমি কর্তা নই, আমি চিরসাক্ষী, চিরচেতনা ব্রহ্ম।” এই জ্ঞান উদিত হলে কর্মের ভিত্তি যে-অজ্ঞান, তা ভেঙে পড়ে।

জ্ঞান আলোর মতো—যেমন প্রদীপ জ্বালালে অন্ধকারের অস্তিত্ব থাকে না, তেমনি জ্ঞান উপস্থিত থাকলে কর্তা-কর্ম-ফল-এই ত্রিভাগী কাঠামো মুছে যায়। তখন সাধক দেখে—“কর্তা, কর্ম, ফল, দেহ, মন—সবই উপাধি মাত্র; আমি নিত্য চৈতন্য, যার মধ্যে এ সব কেবল প্রতিফলন।” এই উপলব্ধিতে কর্ম আর প্রভাব ফেলে না, কারণ কর্মের কার্যকারিতা তখনই থাকে যখন অজ্ঞান জীবিত থাকে।

তৃতীয়ত, সিদ্ধান্ত। আলো এলে যেমন অন্ধকারের প্রমাণ আর থাকে না, তেমনি আত্মজ্ঞান উদিত হলে কর্মেরও প্রয়োজন থাকে না। কর্ম তখন কেবল প্রারব্ধ-দেহধারণের জন্য সীমিত থাকে—যতদিন দেহ টিকে আছে, কর্মের গতি চলবে; কিন্তু তা জ্ঞানীকে স্পর্শ করতে পারে না। গীতায় (৪.৩৭) বলা হয়েছে—
“যথৈধাংসি সমিদ্ধো’গ্নিঃ ভস্মসাৎ কুরুতে’র্জুন।
জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথাঃ।।”
এই শ্লোকটি জ্ঞান বা আত্মজ্ঞানের চরম শক্তি বর্ণনা করে।

এর ভাবার্থ: হে অর্জুন, যেমন প্রজ্বলিত অগ্নি কাঠসমূহকে ভস্মীভূত করে, ঠিক তেমনি জ্ঞানরূপ অগ্নি (জ্ঞানাগ্নিঃ) মানুষের সমস্ত কর্মকে ভস্মীভূত করে দেয়।

এই শ্লোকটি জ্ঞানযোগের চরম ক্ষমতা এবং মোক্ষ লাভের প্রক্রিয়ায় আত্মজ্ঞানের গুরুত্বকে এক শক্তিশালী উপমার মাধ্যমে তুলে ধরে:

উপমা—প্রজ্বলিত অগ্নি (সমিদ্ধোঽগ্নিঃ), কাঠ (এধাংসি): কাঠকে আমাদের কর্ম বা কর্মের ফল (বিশেষত বন্ধন সৃষ্টিকারী সঞ্চিত পাপ-পুণ্য) হিসেবে ধরা হয়। যেমন কাঠ জমা হলে তা আগুনকে আরও বাড়িয়ে দেয়, তেমনই কর্মফল জমা হলে তা জীবাত্মাকে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে (সংসার) আবদ্ধ করে।

অগ্নি (অগ্নিঃ): এখানে অগ্নি হলো ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মজ্ঞান। আগুন যেমন প্রাকৃতিকভাবেই তার সংস্পর্শে আসা বস্তুকে ভস্মে (ছাই) পরিণত করে, তেমনি জ্ঞানও স্বভাবগতভাবেই কর্মফলকে নিঃশেষ করে দেয়।

জ্ঞানের ভূমিকা—জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে: এই শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন যে, জ্ঞানরূপ অগ্নি (জ্ঞানাগ্নিঃ) মানুষের সমস্ত কর্মকে ভস্মীভূত করে দেয়।