অবিদ্যা-বিদ্যা: ৩২




এই বাধক-জ্ঞান যখন উদিত হয়, তখন ঘটে আবরণ-ভঙ্গ (Āvaraṇa-bhaṅga)—অর্থাৎ, আত্মার উপর অজ্ঞানের যে-আবরণ ছিল, তা ছিন্ন হয়। তখন আত্মা আর প্রতিফলনের মাধ্যমে নয়, নিজের স্বরূপে নিজেকে প্রকাশ করে। চেতনা, যা আগে মনের বিকারে প্রতিফলিত হয়ে সীমাবদ্ধ বলে মনে হচ্ছিল, এখন নিজের অবিকৃত আলোয় উদ্‌ভাসিত হয়।


আত্মা বা ব্রহ্মকে অন্য কোনো আলো বা জ্ঞানের দ্বারা আলোকিত করার প্রয়োজন নেই। তিনি স্বয়ং জ্যোতিঃস্বরূপ। ব্রহ্ম শুধু জ্যোতিঃস্বরূপই নন, তিনি "জ্যোতিরও জ্যোতি"। এর অর্থ হলো—সূর্য, চন্দ্র, বিদ্যুৎ বা মন, বুদ্ধি—যা-কিছুকে আমরা জ্ঞানের উৎস বা প্রকাশক হিসেবে দেখি, ব্রহ্ম হলেন তাদেরও প্রকাশক। তিনিই তাদের মধ্যে প্রকাশ করার ক্ষমতা সঞ্চার করেন। আত্মা হলেন সকল প্রকার জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞানের ঊর্ধ্বে অবস্থিত চরম সত্তা। জ্ঞানীরা যখন এই আত্মাকে উপলব্ধি করেন, তখন তাঁরা অমৃতত্ব লাভ করেন।


এই অবস্থাকে উপনিষদে বলা হয়েছে—“তৎ স্বয়ং জ্যোতিষা জ্যোতি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৪.৪.১৬)— আত্মা নিজের আলোতেই জ্যোতির্ময়। যেমন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত আলোকের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তেমনি আত্ম-জ্ঞান উদিত হলে সব প্রমাণ, যুক্তি, ও ধারণা মুছে যায়; কেবল আত্মার নিজের জ্যোতি স্থিত থাকে।


অবিদ্যা কোনো চিরন্তন বাস্তব নয়; এটি অনাদি, কিন্তু অনন্ত নয়। তার বিলোপের কারণ বিদ্যা নিজেই—যেমন ঘন অন্ধকারে একটি প্রদীপ জ্বালালেই অন্ধকারের পরম্পরা ভেঙে যায়। যখন চেতনার উপর থাকা মায়ার পর্দা বিদ্যার আলোয় ছিন্ন হয়, তখন আত্মা আবার নিজে নিজেই জ্বলে ওঠে—স্বয়ংপ্রকাশ, স্বতন্ত্র, মুক্ত, অনাদি ব্রহ্মস্বরূপে।


অদ্বৈত বেদান্তে অধ্যারোপ-অপবাদ (Adhyāropa-Apavāda) হলো জ্ঞানপ্রদানের এক বিশেষ দার্শনিক পদ্ধতি—যা মনের সীমিত ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তাকে সীমার ঊর্ধ্বে তুলতে শেখায়। বেদান্ত স্বীকার করে, চূড়ান্ত সত্য (ব্রহ্ম) কোনো ধারণার দ্বারা ধরা যায় না; তাই শিক্ষক প্রথমে একটি অস্থায়ী ধারণা আরোপ করেন, তারপর সেই ধারণাকেই ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করেন, যেন শিষ্যের মন ধারণার আশ্রয় থেকে নির্ধারণহীন চৈতন্যে উত্তীর্ণ হয়।


অধ্যারোপ মানে “অর্পণ” বা “আরোপ”—অর্থাৎ, যা আসলে নেই, তাকে সাময়িকভাবে সত্য ধরে নেওয়া। আর অপবাদ মানে “নিরাসন” বা “প্রত্যাহার”—অর্থাৎ, সেই সাময়িক ধারণাকে নিজ হাতে ভেঙে ফেলা, যেন মন তার আসল ভিত্তি চিনে নিতে পারে।


উদাহরণস্বরূপ, শুরুতে বলা হয়—“ব্রহ্মই সৃষ্টিকর্তা”, “ঈশ্বরই জগতের নিয়ন্তা।” এটি অধ্যারোপ, একটি প্রাথমিক মানসিক সোপান—যাতে মন প্রথমে কোনো নির্দিষ্ট ভাবনায় স্থির হতে পারে। কিন্তু পরে শাস্ত্র নিজেই বলে—“ব্রহ্ম না কর্তা, না ভোক্তা; তিনি কার্যকারণতার ঊর্ধ্বে, গুণ-রূপ-নাম-সব সীমার বাইরে।” এটাই অপবাদ, অর্থাৎ আরোপিত ধারণার বিলোপ। ফলে বোঝা যায়, ব্রহ্ম সৃষ্টির কারণ নয়—তিনি চিরনির্বিকার, সব অভিজ্ঞতার অধিষ্ঠানমাত্র।


এই পদ্ধতির দার্শনিক চরিত্র অ্যাপোফ্যাটিক বা নেতি-নেতি—অর্থাৎ অস্বীকৃতিমূলক। উপনিষদ বলে—“নেতি, নেতি”—“এ নয়, ও নয়”—এভাবে সমস্ত সীমাবদ্ধ ধারণাকে নাকচ করতে করতে মনকে এমন অবস্থায় আনা হয়, যেখানে আর কিছুই নির্ধারণযোগ্য নয়; কেবল নিরাকার, নির্বিশেষ, স্বপ্রকাশ চেতনা অবশিষ্ট থাকে।


এই শিক্ষাকে স্পষ্ট করতে শাস্ত্র নানা দৃষ্টান্ত দেয়। যেমন—রজ্জু-সর্প-ন্যায় (Rajjū-Sarpanyāya): অন্ধকারে দড়িকে ভুল করে সাপ বলে ধরা। শুক্তি-রজত-ন্যায় (Śukti-Rajatanyāya): ঝিনুককে রুপা বলে ভুল করা।


এই দুই বিভ্রমই অনির্বচনীয়-খ্যাতি (Anirvacanīya-Khyāti)-র উদাহরণ—যেখানে বিভ্রমিত বস্তুটি পুরো সত্যও নয়, পুরো মিথ্যাও নয়। সাপ দেখা যায়, অনুভব হয়, কিন্তু বাস্তবে দড়ি ছাড়া কিছুই নেই। তেমনি জগৎও দেখা যায়, কিন্তু তার অস্তিত্ব স্বতন্ত্র নয়—এটি ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল।


অনির্বচনীয়-খ্যাতি (Anirvacanīya-khyāti) হলো অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি তত্ত্ব, যা ভ্রান্ত জ্ঞান বা ভ্রমের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে। এই মতবাদ অনুসারে, যখন আমাদের কোনো ভ্রান্তি বা ভ্রম হয় (যেমন, অন্ধকারে দড়ি দেখে সাপ বলে মনে হওয়া), তখন ভ্রান্তির বিষয়বস্তুটি—অর্থাৎ 'সাপ'—তাকে সৎ (বাস্তব) বা অসৎ (সম্পূর্ণ অবাস্তব/অভাব) কোনোটিই বলা যায় না।


এই মতবাদ অনুযায়ী, ভ্রমের বিষয়বস্তুটি হলো অনির্বচনীয় (Anirvacanīya)। 'অনির্বচনীয়' শব্দের অর্থ হলো 'যাকে বচন বা ভাষা দিয়ে সঠিকভাবে বর্ণনা করা যায় না'। একে সৎ (বাস্তব) বা অসৎ (অবাস্তব) কোনোভাবেই নির্দিষ্ট করা যায় না।


সৎ কেন নয়? যদি দড়ির ওপর দেখা সাপটি সৎ বা বাস্তব হতো, তবে আলো আনার পরেও তার অস্তিত্ব থাকত এবং তা দড়ি বলে প্রমাণিত হতো না। যেহেতু ভ্রমটি পরে বাতিল হয়ে যায়, তাই সেটি সৎ হতে পারে না।


অসৎ কেন নয়? যদি দড়ির ওপর দেখা সাপটি অসৎ বা সম্পূর্ণ অবাস্তব হতো (যেমন শূন্যে ফুল, খরগোশের শিং), তবে ভ্রমের সময় এটিকে 'সাপ' বলে কেউ দেখত বা অনুভব করত না এবং ভয় পেত না। যেহেতু ভ্রমের সময় এর একটি আপাত-অস্তিত্ব থাকে এবং ফলও দেয় (যেমন ভয় সৃষ্টি করে), তাই এটি অসৎও হতে পারে না।


মায়ার সৃষ্টি: অদ্বৈত বেদান্ত ব্যাখ্যা করে যে, ভ্রমের সময় এই অনির্বচনীয় বস্তুটি (যেমন দড়ির ওপরের সাপ) তৈরি হয় অজ্ঞান বা অবিদ্যা-র প্রভাবে। এটি ক্ষণিকের জন্য বর্তমানের (দড়ির) ভিত্তিতে উৎপন্ন হয় এবং ভ্রান্তি দূর হলেই বিলীন হয়ে যায়।


অদ্বৈত বেদান্ত এই অনির্বচনীয়-খ্যাতি তত্ত্বটিকে বিশ্বজগতের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করে। অদ্বৈতবাদীরা মনে করেন, এই দৃশ্যমান জগৎ ব্রহ্মের তুলনায় অনির্বচনীয়। জগৎ সম্পূর্ণ অসৎ নয়, কারণ আমরা এটিকে অভিজ্ঞতা করি; আবার এটি সৎও নয়, কারণ ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পর এই দ্বৈত জগৎ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এই জগৎ তাই মায়া-র ফল, যা অনির্বচনীয়।


অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, জগৎ হলো অবিদ্যার প্রক্ষেপণ। ব্রহ্ম কখনও পরিবর্তিত হন না, কিন্তু অবিদ্যার কারণে তাঁরই উপর “নাম” ও “রূপ”-এর প্রতিফলন পড়ে—যেন আয়নায় প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তাই জগৎ অভিজ্ঞতায় আছে, কিন্তু স্বতন্ত্র বাস্তব নয়; এটি “ব্রহ্মাশ্রিত মিথ্যা”—যেমন সাপ দড়ির উপর নির্ভর করে আছে।


যখন বাধক-জ্ঞান (Bādhaka-Jñāna)—অর্থাৎ, সত্য-জ্ঞান উদিত হয়, তখন এই ভুল আরোপণ ভেঙে যায়। সেটিই বাধা (Bādha)—অবস্তব ধারণার বিলোপ। জ্ঞানী তখন বোঝেন, জগৎ মিথ্যা অর্থে নেই—বরং “অসত্যরূপে প্রতীয়মান সত্য।” দৃষ্টান্তের ভাষায়, দড়ি দেখা গেছে, তাই আর সাপের ভয় নেই; কিন্তু সাপ যে প্রতীয়মান হয়েছিল, সে অভিজ্ঞতা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।


এইভাবে অধ্যারোপ-অপবাদ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো—মনের স্তরে আরোপ করে তাকে সত্যের দিকে পরিচালিত করা, তারপর সেই আরোপকেই বিলোপ করে মনের সমস্ত নির্ভরতা ভেঙে দেওয়া। অবশেষে জ্ঞানী উপলব্ধি করেন—“নেতি নেতি”—এই নেগেশনের শেষে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, কেবল এক চৈতন্য—যে নিজে আলো, নিজেই প্রতিফলন, আর কিছু নয়।


যোগ-বাসিষ্ঠ এই অবস্থাকে এমন এক মহাজাগতিক স্থিতি হিসেবে চিত্রিত করে, যেখানে জ্ঞানী ব্যক্তি “জগতে থেকেও জগতের নয়।” তাঁর দেহ চলে, মন চিন্তা করে, ইন্দ্রিয় কাজ করে—তবু তিনি জানেন, এ সবই কেবল চেতনার খেলামাত্র। তাঁর আত্মস্বরূপ অপরিবর্তিত, অচঞ্চল, চিরনির্মল। এই অবস্থা—না দমন, না পরিত্যাগ; বরং এক অন্তর্গত উপলব্ধি—যেখানে দেখা, জানা ও থাকা—তিনটি এক হয়ে যায়।


এই জ্ঞানী কর্ম করেন, কিন্তু আসক্ত হন না; যেমন পদ্মপাতা জলে থেকেও জলে ভেজে না। তিনি সংসারে অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু অভ্যন্তরে অদ্বিতীয় চৈতন্যে প্রতিষ্ঠিত থাকেন। তাঁর কাছে জীবন এক বিশাল মায়ানাট্য—যেখানে চরিত্র, ঘটনা, সুখ, দুঃখ—সবই চলমান, কিন্তু তিনি দর্শক মাত্র। এই দর্শনেই তাঁর স্বাধীনতা। কারণ তিনি জানেন—যা ঘটছে, তা কেবল চেতনার প্রতিফলন; আর সেই চেতনা নিজে কখনও বদলায় না।


যোগ-বাসিষ্ঠে রামকে বলা হয়—“যিনি জগতের কার্যকলাপের মধ্যেও অচঞ্চল চেতনা হিসেবে স্থিত, তিনিই সত্য যোগী।” জ্ঞানীর এই অবস্থাকে বলা হয় জীবন্মুক্তি—অর্থাৎ, দেহধারণ করেও মুক্ত থাকা। জীবন্মুক্ত ব্যক্তি বাহ্যত অন্যদের মতোই দেখতে; তিনি খাওয়া, চলা, কথা বলা—সব করেন; কিন্তু অন্তরে তাঁর মধ্যে কোনো “আমি”-বোধ নেই। তিনি কর্তা নন, ভোক্তাও নন; তাঁর মধ্যে কর্মের ফল সংযোজিত হয় না, কারণ তাঁর চেতনা সব কর্মের সাক্ষী, অংশীদার নয়।


এই জীবন্মুক্ত অবস্থায় জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়—দ্রষ্টা ও দৃশ্য—সব ভেদ বিলীন হয়ে যায়। বেদান্ত-ভাষায়, “দ্রষ্টা, দৃশ্য, দর্শন—সব এক।” এখানে আর কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই, কারণ জানা, জানার উপায়, ও জানার বিষয়—সব এক চৈতন্যে অভিন্ন হয়ে গেছে।


তখন প্রপঞ্চ (জগতের প্রকাশ) আর প্রক্ষেপণ (অবিদ্যার আরোপ)—উভয়ই অন্তরালে চলে যায়। থাকে কেবল সেই এক চিরন্তন ব্রহ্ম—যিনি নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত, স্বপ্রকাশ। তাঁকে আর কোনো জ্ঞান স্পর্শ করতে পারে না, কারণ তিনি নিজেই সব জ্ঞানের উৎস।


এই আত্ম-সাক্ষাতে সমস্ত দ্বন্দ্ব লুপ্ত হয়—জ্ঞাতা-জ্ঞেয়, কর্ম-অকর্ম, বোধ-অবোধ—সব একাত্ম হয়ে যায়। যা অবশিষ্ট থাকে, তা এক চিরজাগ্রত নিঃস্পন্দ চৈতন্য—যা কখনও জন্মায় না, কখনও বিলীন হয় না, কখনও অজ্ঞান দ্বারা স্পর্শিত হয় না। এই অবস্থাকে বলে—“যঃ স্বস্মিন্নেব বিশুদ্ধাচি তিষ্ঠতি” (বিবেকচূড়ামণি, শ্লোক ৪৯৩)—অর্থাৎ, “যিনি নিজের বিশুদ্ধ আত্মাতেই অবিচল থাকেন, যিনি না হৃষ্ট, না দুঃখিত, ন হর্ষ-বিষাদ-গ্রস্ত—তিনিই মুক্ত।”


এই অবস্থায় জীবন ও মুক্তি আর দুই নয়; মুক্তিই জীবন, জীবনই মুক্তি—কারণ উভয়েরই আসন এক, সেই পরম আত্মা—যিনি দৃশ্যমানেরও সাক্ষী, অদৃশ্যেরও আশ্রয়, এবং সর্বপ্রাণে জাগ্রত একমাত্র সত্য।


অদ্বৈত বেদান্তে আত্মসন্ধান বা আত্মবিচারকে বলা হয় একেক ধাপে অন্তর্মুখী যাত্রা—এ যেন এক সিঁড়ি, যার প্রতিটি ধাপ আপনাকে বহিরাবরণ থেকে গভীরতম আত্মস্বরূপের দিকে নিয়ে যায়। এই সিঁড়ির নাম পঞ্চকোষ (Pañca Kośa)—আত্মাকে আচ্ছন্ন করে থাকা পাঁচটি স্তর বা আবরণ। তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২.১-২.৫)-এ বলা হয়েছে, এই পাঁচ কোষই মানুষকে সত্য আত্মা থেকে আড়াল করে রেখেছে; আর জ্ঞান হলো এই আবরণগুলিকে একে একে অতিক্রম করা, যতক্ষণ না আত্মা নিজস্ব স্বরূপে দীপ্ত হয়।


প্রথম স্তর অন্নময়-কোষ (Annamaya Kośa)—অর্থাৎ খাদ্যনির্ভর আবরণ। এটি স্থূল দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত—মাংস, রক্ত, হাড়, মজ্জা, চর্ম ইত্যাদি, যা খাদ্য থেকে গঠিত ও খাদ্যের দ্বারা টিকে থাকে। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এটি বিলীন হয়, যেমন মাটি থেকে গঠিত জিনিস মাটিতেই ফিরে যায়। এই দেহ পরিবর্তনশীল, ক্ষয়প্রবণ, জন্ম ও বিনাশের অধীন; তাই এটি আত্মা নয়। কিন্তু অজ্ঞান মানুষ এখানেই থেমে যায়—“আমি দেহ”—এই দেহাত্মবোধই অবিদ্যার প্রথম ছায়া।


দ্বিতীয় স্তর প্রাণময়-কোষ (Prāṇamaya Kośa)—প্রাণশক্তির আবরণ। এটি সূক্ষ্ম শরীরের অংশ, যা দেহকে সচল রাখে—শ্বাসপ্রশ্বাস, হৃৎস্পন্দন, স্নায়ুর গতি, হজম, রক্তসঞ্চালন—সবই এর কার্য। নিদ্রায় এটি ক্ষীণ হয়, মৃত্যুর সময় বিলীন হয়। এটি অন্নময়-কোষের তুলনায় সূক্ষ্ম, কিন্তু তবু অনিত্য, কারণ এটি দেহের স্থায়িত্বের উপর নির্ভরশীল। আত্মা কখনও প্রাণ নয়, কারণ প্রাণ আসে যায়, আত্মা কখনও আসে যায় না।


তৃতীয় স্তর মনোময়-কোষ (Manomaya Kośa)—চিন্তা ও অনুভূতির স্তর। এখানে বাস করে ইচ্ছা, রাগ, ভয়, আকাঙ্ক্ষা, সুখ ও দুঃখ। মন ইন্দ্রিয়ের থেকে তথ্য গ্রহণ করে, তাদের ব্যাখ্যা করে, এবং “আমি সুখী”, “আমি দুঃখী”—এই ভ্রান্ত আত্মবোধ সৃষ্টি করে। কিন্তু মন পরিবর্তনশীল; তার প্রতিটি ভাব ক্ষণস্থায়ী। যা পরিবর্তনশীল, তা আত্মা হতে পারে না। তাই বেদান্ত বলে—মন দৃশ্য, আত্মা দ্রষ্টা। মন যে দেখা যায়, সেটিই প্রমাণ যে, আত্মা তার সাক্ষী—মন দৃশ্য, আত্মা দ্রষ্টা।