অবিদ্যা-বিদ্যা: ২৮



এই আবরণ অপসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মধ্যে থাকা সমস্ত প্রক্ষেপণ বা বিভ্রম ভেঙে পড়ে। আমরা ভুল ধারণা, ভুল ব্যাখ্যা এবং মিথ্যা বিশ্বাস থেকে মুক্ত হই। এটি এক নতুন দৃষ্টির উন্মোচন, যেখানে আমরা সত্যকে তার বিশুদ্ধ রূপে দেখতে পাই এবং আমাদের অন্তরের জ্ঞান প্রস্ফুটিত হয়। এই মুক্তি কেবল জ্ঞানীয় নয়, বরং আত্মিকও, যা আমাদের অস্তিত্বের গভীরে শান্তি ও স্বচ্ছতা নিয়ে আসে।

কিন্তু যতক্ষণ না আবরণ দূর হয়, ততক্ষণ বিক্ষেপ-শক্তি সক্রিয় থাকে। এটি প্রক্ষেপণ-দোষ (Vikṣepa-doṣa)—যা মনের অন্তর্গত যন্ত্রণা তৈরি করে। এর থেকেই অহং (Ahaṅkāra), মন (Manas), বুদ্ধি (Buddhi), চিত্ত (Citta) এবং অন্যান্য অন্তঃকরণ-অঙ্গ উদ্‌ভূত হয়। এই বিক্ষেপের ফলেই চেতনা নিজেকে ভাবনা, স্মৃতি ও আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে, এবং জন্ম নেয় “আমি ভাবি”, “আমি জানি”, “আমি কষ্ট পাই”—এই মিথ্যা স্ব-অভিজ্ঞতা।

আসলে শুদ্ধ সাক্ষী-চৈতন্য (Sākṣī-Caitanya) সর্বদা অপরিবর্তিত, কিন্তু আবরণ ও বিক্ষেপের জালে আটকে পড়ে যেন দর্শক নিজেই নাটকের চরিত্রে পরিণত হয়েছে। তমোগুণের অন্ধকারে জন্ম নেয় মোহ (ভ্রম), রজোগুণের তাড়নায় জন্ম নেয় আকাঙ্ক্ষা (বাসনা), আর সত্ত্বগুণের আলোয় অবশেষে জাগে বোধ (বোধচেতনা)। যখন সত্ত্ব পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়, তখন জ্ঞান নিজের দীপ্তিতে অন্ধকার ছিন্ন করে দেয়, আবরণ ভেঙে যায়, এবং বিক্ষেপের সমস্ত প্রক্ষেপণ বিলীন হয়—যেন আলো জ্বলে উঠলে ছায়ার সমস্ত খেলা হারিয়ে যায়।

এভাবে, মায়া একদিকে ব্রহ্মের অলৌকিক প্রকাশশক্তি, অন্যদিকে বিভ্রমের কারিগর—যিনি অনন্তকে বহুতার বুননে রূপ দেন। কিন্তু জ্ঞানীর দৃষ্টিতে এই সমগ্র তাঁত কেবল চৈতন্যের এক স্বপ্নমাত্র, যেখানে সব কিছুই তার নিজের আলোয় বোনা, আবার সেই আলোয়ই লয়প্রাপ্ত।

মায়ার সূক্ষ্ম ক্রিয়ায় যখন সৃষ্টি আরম্ভ হয়, তখন তা কোনো বস্তুগত উৎপত্তি নয়—এটি “অব্যাকৃত” (Avyakta) অবস্থায় পদার্থের সম্ভাব্য রূপে বিদ্যমান থাকে। এই অবস্থাটি এমন এক দশার প্রতি ইঙ্গিত করে, যেখানে সকল বৈচিত্র্য এবং প্রকাশ্য রূপ অব্যক্ত রূপে সুপ্ত থাকে, যেন একটি বীজের মধ্যে বিশাল বৃক্ষের সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। এটি সৃষ্টির প্রাথমিক স্পন্দন, যেখানে জগতের সমস্ত উপাদান একটি সুপ্ত, অবিচ্ছিন্ন এবং অবিনশ্বর একত্বের মধ্যে স্থিত। এই অব্যক্ত অবস্থা প্রকৃতির এক অপরিহার্য দিক, যেখানে সবকিছু অসীম শক্তির আকারে বিদ্যমান থাকে, কিন্তু এখনও প্রকাশিত হয়নি। এটিকে মহাবিশ্বের অব্যক্ত উৎস বা Cosmic Unmanifested Source হিসেবেও দেখা যেতে পারে, যা সমস্ত প্রকাশের মূল। এই অবস্থাটি শুধুমাত্র পদার্থগত নয়, বরং চেতনাস্বত্তারও সূক্ষ্ম স্তরকে ধারণ করে, যা থেকে আমাদের সকল অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধি উদ্‌ভূত হয়। এটি এক গভীর এবং রহস্যময় প্রক্রিয়া, যা সৃষ্টির রহস্যকে উন্মোচন করে।

মায়া যেন এক মহাজাগতিক গর্ভ—যেখানে সব উপাদান সূক্ষ্মভাবে নিহিত, কিন্তু পৃথক হয়ে ওঠেনি। ঈশ্বরের ঐশ্বরিক সঙ্কল্প বা ইচ্ছাশক্তি (Īśvara-Saṅkalpa) এই স্থিত সম্ভাবনাকে আলোড়িত করে তোলে। তখন ‘মায়া’-র অন্তর্গত সূক্ষ্ম শক্তি রূপ নিতে শুরু করে—প্রথমে জন্ম দেয় পাঁচটি সূক্ষ্ম উপাদান বা তন্মাত্র (Tan-mātra)—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ। এই সূক্ষ্ম উপাদানগুলিই পরে পরিণত হয় পাঁচটি স্থূল উপাদান বা পঞ্চ-মহাভূত (Pañca-Mahā-bhūta)—আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও ভূমি।

অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, যা প্রথাগত সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে ভিন্ন। শাস্ত্রে এই প্রক্রিয়াকে 'সৃষ্টি' (Sṛṣṭi) নামে অভিহিত করা হলেও, অদ্বৈতবাদীরা এটিকে কোনো বাস্তব সৃষ্টি বা পরিণাম (Pariṇāma-vāda) হিসেবে দেখেন না। তাঁদের মতে, এটি চেতনার একটি আপাত প্রকাশ মাত্র, যাকে 'বিবর্ত' (Vivarta) বলা হয়।

'বিবর্ত' শব্দের অর্থ হলো—একটি বস্তুর ভিন্ন রূপে প্রতিভাত হওয়া, কিন্তু বস্তুর নিজস্ব সত্তার কোনো বাস্তব পরিবর্তন না হওয়া। এর একটি সুন্দর উদাহরণ হলো স্বপ্ন। যেমন, মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে, তখন সে একটি সম্পূর্ণ নতুন জগৎ অনুভব করে—ব্যক্তি, স্থান, ঘটনা—সবই অত্যন্ত বাস্তব মনে হয়। কিন্তু ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই সেই স্বপ্নের জগৎ বিলীন হয়ে যায়, কারণ তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না; সেটি ছিল কেবল মনের একটি বিবর্ত।

একইভাবে, এই মহাবিশ্ব বা জগৎকেও অদ্বৈত দর্শন অবিদ্যার প্রতিফলিত রূপ হিসেবে দেখে। অবিদ্যা হলো অজ্ঞান বা অজ্ঞতা, যা ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপকে ঢেকে রাখে এবং মিথ্যা দ্বৈততার জন্ম দেয়। আমাদের সীমিত বুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা এই জগৎকে বাস্তব বলে মনে করি। কিন্তু আত্মজ্ঞানের উদয় হলে, যখন ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধ হয়, তখন এই মহাবিশ্বের আপাত বাস্তবতা বিলীন হয়ে যায়, ঠিক যেমন স্বপ্ন জাগরণের পর লয় পায়।

সুতরাং, অদ্বৈতবাদীরা তাঁদের এই সৃষ্টিতত্ত্বকে 'অবিদ্যা-বিবর্ত-সৃষ্টি' নামে অভিহিত করেন। এর মূল অর্থ হলো—জগৎ ব্রহ্মের কোনো বাস্তব পরিবর্তন বা রূপান্তর (যেমন দুধ থেকে দই হওয়া) নয়, বরং এটি অবিদ্যার প্রভাবে সৃষ্ট একটি আপাত মিথ্যা প্রতীয়মানতা। ব্রহ্ম চিরকাল এক ও অপরিবর্তিত থাকেন; জগতে যা-কিছু পরিবর্তনশীল বা দৃশ্যমান, তা কেবল দৃষ্টির অবস্থান বদলানোর কারণে আমাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়। প্রকৃত সত্য হলো, ব্রহ্মই একমাত্র পরম সত্তা, আর এই দৃশ্যমান জগৎ তাঁরই একটি অবিদ্যাপ্রসূত প্রতিভাস।

ব্যাবহারিক-সত্তা (Vyāvahārika-Sattā) স্তরে, এই প্রপঞ্চ জগৎ অভিজ্ঞতাগতভাবে বাস্তব এবং সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। এটি এমন একটি স্তর, যেখানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সকল অভিজ্ঞতা, বস্তু এবং সম্পর্ক বিদ্যমান। এই স্তরকে জাগতিক বাস্তবতা হিসাবে দেখা হয়, যেখানে কর্মফল, সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি ঘটনাগুলি সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু পারমার্থিক (Pāramārthika) স্তরে, এই জাগতিক বাস্তবতা কেবল একটি প্রতিচ্ছবি বা মায়া। এই স্তরে, একমাত্র ব্রহ্মই পরম সত্য, যা অপরিবর্তনীয়, অসীম এবং সর্বব্যাপী। ব্রহ্মই সকল অস্তিত্বের মূল ভিত্তি এবং চূড়ান্ত বাস্তবতা। উপনিষদ এবং বেদান্ত দর্শন অনুসারে, এই পারমার্থিক সত্যকে উপলব্ধি করাই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

এই দুটি স্তরের মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে "সত্তা-ত্রয়" (Sattā-traya) ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাস্তবতার তিনটি স্তরকে নির্দেশ করে:

জাগ্রত (Jāgrat): এটি আমাদের সচেতন বা জাগ্রত অবস্থার বাস্তবতা, যেখানে দেহ ও ইন্দ্রিয় সক্রিয় থাকে। এই অবস্থায় আমরা বাহ্যিক জগৎকে অনুভব করি এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর সাথে মিথস্ক্রিয়া করি। এই অভিজ্ঞতাগুলি বস্তুনিষ্ঠ এবং সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ হয়। যেমন, একটি গাছকে দেখা, একটি গান শোনা বা কোনো বস্তুকে স্পর্শ করা। এই স্তরে আমরা বিশ্বাস করি যে, আমরা যা দেখছি বা অনুভব করছি তা বাস্তব।

স্বপ্ন (Svapna): এটি স্বপ্নের বাস্তবতা, যেখানে মন তার নিজস্ব সংস্কার (পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা এবং ছাপ) থেকে একটি জগৎ সৃষ্টি করে। এই স্বপ্নের জগৎ সম্পূর্ণভাবে মানসিক এবং ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সৃষ্টি। যদিও স্বপ্নের অভিজ্ঞতাগুলি জাগ্রত অবস্থার মতো বস্তুনিষ্ঠ নয়, স্বপ্নের সময় সেগুলি খুব বাস্তব বলে মনে হয়। যেমন, স্বপ্নে উড়ে যাওয়া বা পরিচিত কারও সাথে কথা বলা, যা জাগরণে অসম্ভব। এই স্তরটি প্রমাণ করে যে, বাস্তবতা কেবল বাহ্যিক নয়, মানসিকও হতে পারে।

সুষুপ্তি (Suṣupti): এটি গভীর ঘুমের অবস্থা, যেখানে সকল প্রপঞ্চ বা জাগতিক প্রকাশ লীন হয়ে যায়। এই অবস্থায় কোনো স্বপ্ন বা বাহ্যিক অভিজ্ঞতার জ্ঞান থাকে না, কেবল অজ্ঞানতা বা অজ্ঞতা অবশিষ্ট থাকে। এটি একটি নিরালম্ব (অবলম্বনশূন্য, নিরাশ্রয়) অবস্থা, যেখানে মন, বুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয়গুলি নিষ্ক্রিয় থাকে। এই স্তরে কোনো দ্বৈততা থাকে না, এবং ব্যক্তি কেবল অস্তিত্বের একটি অস্পষ্ট অনুভূতিতে থাকে, যাকে প্রায়শই আনন্দময় বলে বর্ণনা করা হয়, যদিও সেই আনন্দের প্রত্যক্ষ জ্ঞান জাগ্রত অবস্থায় ফিরে আসার পরেই হয়।

আত্মা এই তিন অবস্থারও সাক্ষী, তাকে বলা হয় "আত্ম-অবস্থা-ত্রয়-বিবেক"। এটি এমন একটি বিশ্লেষণ, যা অভিজ্ঞতার তিনটি স্তরকে পরীক্ষা করে দেখায় যে, যা দেখা যায় বা অনুভব করা হয়, তা পরিবর্তনশীল ও ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু যে দেখে বা অনুভব করে, অর্থাৎ আত্মা, সে অপরিবর্তনীয় ও শাশ্বত। আত্মা হলো এই সকল অভিজ্ঞতার মূল সাক্ষী, যা কোনো অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয় না। এটি জন্ম, মৃত্যু, জাগ্রত, স্বপ্ন বা সুষুপ্তির ঊর্ধ্বে। বেদান্ত দর্শন মতে, আত্মা এবং ব্রহ্ম অভিন্ন; আত্মা হল ব্যক্তিগত চেতনা এবং ব্রহ্ম হল সর্বজনীন চেতনা। এই জ্ঞান লাভ করাই মুক্তি বা মোক্ষ। এই বিবেক আমাদের জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্ত করে এবং পরম সত্যের উপলব্ধি ঘটায়।

এই দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হলো দৃক্-দৃশ্য-বিবেক (Dṛk-Dṛśya-Viveka)—দ্রষ্টা ও দৃশ্যের পার্থক্য। এখানে “দৃক্” বা সাক্ষী হলো আত্মা, আর “দৃশ্য” বা প্রতিফলন হলো জগৎ। বস্তু, চিন্তা, ও অভিজ্ঞতা—সবই দৃশ্য; এদের অস্তিত্ব সাক্ষীর ওপর নির্ভরশীল। বস্তুগুলি তাই চিরন্তন নয়, তারা মিথ্যা (Mithyā)—কারণ তারা পরিবর্তনশীল; অথচ সাক্ষী, যা তাদের আলোয় দেখায়, সেটিই একমাত্র বাস্তব। এই উপলব্ধিই দৃশ্য-মিথ্যাত্ব (Dṛśya-Mithyātva)—যেখানে বোঝা যায়, সমস্ত উপলব্ধিযোগ্য ঘটনা আসলে অপরিবর্তনীয় চেতনারই ক্ষণস্থায়ী প্রতিফলন।

দৃক্-দৃশ্য-বিবেক হলো অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি মৌলিক তত্ত্ব, যার অর্থ হলো দ্রষ্টা (দৃক্) এবং দৃশ্য (দৃশ্য) বস্তুর মধ্যে পার্থক্য বা বিচার (বিবেক)। এই তত্ত্বটি জীবাত্মা বা আত্মাকে দৃশ্যমান জগৎ থেকে আলাদা করে দেখার ওপর জোর দেয়।

দৃক্ (Drk—The Seer/Subject): যা-কিছু দেখছে, জানছে, বা যার চেতনা আছে—সেটিই হলো দৃক্। এটি হলো আমাদের চৈতন্যময় আত্মা বা দ্রষ্টা। দ্রষ্টা নিজে অপরিবর্তনীয় এবং চিরন্তন। এটি হলো বিষয়ী।

দৃশ্য (Drishya—The Seen/Object): যা-কিছু দেখা যায়, জানা যায়, বা অনুধাবন করা যায়—সেটিই হলো দৃশ্য। এর মধ্যে কেবল বাহ্যিক বস্তু নয়, আমাদের দেহ, মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয় এবং চিন্তাভাবনাও অন্তর্ভুক্ত। দৃশ্য সব সময় পরিবর্তনশীল ও ক্ষণস্থায়ী। এটি হলো বিষয়।

বিবেক (Viveka—Discrimination): এই দুটির মধ্যে পার্থক্য বা বিচার করাই হলো বিবেক। এই বিচারের মাধ্যমে সাধক উপলব্ধি করেন যে, তিনি নিজে দ্রষ্টা (দৃক্), দৃশ্য জগৎ বা মনের কোনো অংশ নন।

অদ্বৈত বেদান্তে মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করার জন্য এই বিবেক অপরিহার্য। যতক্ষণ মানুষ দৃশ্য (দেহ, মন, জগৎ) নিজেকে বলে ভুল করে, ততক্ষণ সে বন্ধনে থাকে। এই পার্থক্য অনুধাবন করতে পারলেই মানুষ নিজেকে দেহ ও মনের বন্ধন থেকে মুক্ত চৈতন্যস্বরূপ আত্মা রূপে জানতে পারে।

মিথ্যা ও সত্যের পার্থক্য—এটি চরম সত্য (ব্রহ্ম) এবং আপেক্ষিক মিথ্যা (জগৎ) এর মধ্যে বিভেদ তৈরি করে। দৃশ্য বস্তুসমূহ মিথ্যা বা অনিত্য, কিন্তু দ্রষ্টা (আত্মা) হলো একমাত্র সত্য ও নিত্য।

দৃক্-দৃশ্য-বিবেক মূলত জ্ঞানযোগের একটি ভিত্তি। এই পথে সাধক আত্ম-অনুসন্ধানের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তিনি কেবল সাক্ষী বা দ্রষ্টা (আত্মা) এবং দৃশ্যমান জগৎ বা নিজের মানসিক প্রক্রিয়া তাঁর আসল স্বরূপ নয়।

দৃক্‌-দৃশ্য-বিবেক মানে “দ্রষ্টা ও দৃশ্যের পার্থক্যবোধ।” বেদান্তের মতে, মুক্তির প্রথম ধাপ হলো এই বোঝা—যা দেখা যায় (দৃশ্য) তা পরিবর্তনশীল, আর যে দেখে (দ্রষ্টা) সে অপরিবর্তনীয় চেতনা। “বিবেক” মানে পার্থক্যজ্ঞান, অর্থাৎ দ্রষ্টা ও দৃশ্যের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করা।

‘দৃক্‌-দৃশ্য-বিবেক’ নামে একটি ছোটো কিন্তু অত্যন্ত গভীর গ্রন্থ আছে, মোট ৪৬টি শ্লোক নিয়ে। শ্রীমদ্‌ভারতীতীর্থের লেখা এই গ্রন্থের মূল তত্ত্ব হলো—দেহ, ইন্দ্রিয়, মন সবই দৃশ্য; আর চেতনা বা আত্মা একমাত্র দ্রষ্টা।

প্রথম শ্লোকেই এই সত্যটি ব্যক্ত হয়েছে—“রূপং দৃশ্যং লোচনং দৃক্‌ তদ্‌ দৃশ্যং দৃক্‌ তু মানসম্‌।” অর্থাৎ—রূপ চোখে দেখা যায়, কিন্তু চোখও মন দ্বারা উপলব্ধ; মনও চিন্তার দ্বারা ধরা পড়ে। তবে যিনি এই সব দেখা-জানার সাক্ষী, যিনি নিজে কখনও দেখার প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়েন না—তিনিই আত্মা, চিরচেতনা।