অবিদ্যা-বিদ্যা: ২১




জন্মান্তরের সূত্রেও সূক্ষ্ম শরীরের ভূমিকা বোঝা যায়। গীতা বলে, দেহত্যাগের কালে জীব “মন ও ইন্দ্রিয়” সঙ্গে নিয়েই নতুন দেহে প্রবেশ করে—যেমন পবন আশ্রয় থেকে গন্ধ বহন করে। অর্থাৎ, স্থূল দেহ পড়ে থাকলেও অন্তঃকরণ-ইন্দ্রিয়-প্রাণ-সমেত সূক্ষ্ম গঠনই সংস্কার-বহন করে এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে সঞ্চারিত হয়।


তবে সূক্ষ্ম শরীর নিজে চেতনা নয়—এটি কেবল উপকরণ; চেতনা এর প্রত্যক্ষকারী। কেন উপনিষদ সরাসরি বলে, যা “মনে ধরা পড়ে না, কিন্তু যার কারণে মন জ্ঞান করে”—তা-ই ব্রহ্ম; একইভাবে “প্রাণে শ্বাস নেয় না যে, কিন্তু যার কারণে প্রাণ চলমান”—সেই চৈতন্যই সব ইন্দ্রিয়-প্রাণ-মানসকে আলোকিত করে। জ্ঞানের দ্বারা প্রতিটি বোধের ভিতর সেই চৈতন্যকে যিনি উপলব্ধি করেন, তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন—এ কথা এই উপনিষদই শেখায়।


মন-প্রাণ-দেহের এই সমগ্র বিন্যাসের নায়ক ও নিয়ন্তা হিসেবে মুণ্ডক উপনিষদ ২.২.৭-এ আত্মাকে চিহ্নিত করেছে—“মন-নিবদ্ধ, প্রাণ-শরীরের নেতা, হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত”—অর্থাৎ, মন-প্রাণ-দেহ আত্মার ওপর নির্ভরশীল; আত্মা তাদের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। ফলে সূক্ষ্ম শরীরকে আমরা অভিজ্ঞতার বাহন হিসেবে বুঝি, আর আত্মাকে সেই অভিজ্ঞতার স্বয়ংপ্রকাশ আলোকরূপে ধরি।


এভাবে সূক্ষ্ম শরীরের প্রতিটি উপাদান—অন্তঃকরণ, ইন্দ্রিয়সমূহ এবং প্রাণ-পঞ্চক—জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি তিন অবস্থায় ভিন্ন ভিন্নভাবে কাজ করে; কিন্তু সকল কাজের সাক্ষী থাকে চৈতন্য। তাই স্বপ্নের জগত মানসে গঠিত হলেও অভিজ্ঞতা সত্যবৎ অনুভূত হয়, জন্মান্তরে সংস্কার বহমান হলেও বহনকারী আসলে চেতনার প্রতিফলনে চলা সূক্ষ্ম গঠন, আর যিনি সবসময় অপরিবর্তনশীল—তিনি আত্মা।


কারণ শরীর বা কারণ দেহ হলো আত্মাকে আচ্ছাদিত-করা অবিদ্যার সূক্ষ্মতম ও গভীরতম স্তর। এটি সেই স্তর, যেখানে সমস্ত অভিজ্ঞতা, চিন্তা ও জ্ঞান লীন অবস্থায় থাকে—যেমন বীজে একটি গাছ অদৃশ্যভাবে সঞ্চিত থাকে। কারণ শরীরকে বলা হয় অবিদ্যার মূল রূপ, যা আত্মার সত্য স্বরূপকে ঢেকে রাখে কিন্তু নিজে কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নয়।


এই অবস্থার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা আমরা গভীর নিদ্রায় পাই। যখন কেউ ঘুম থেকে জেগে বলে—“আমি কিছুই জানতাম না, কিন্তু ভালো ছিলাম”—এই “অজ্ঞাতসুখ” বা blissful ignorance-ই কারণ শরীরের প্রকাশ। এখানে জ্ঞান নেই, কিন্তু দ্বন্দ্বও নেই; শোক, দুঃখ, আনন্দ, চিন্তা—সবই অদৃশ্য। তাই এটি মুক্তি নয়, বরং অজ্ঞানতার ঘন স্তর।


বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৩.১৯) বলেছে—“গভীর নিদ্রায় সমস্ত চেতনা একীভূত হয়; তখন কেউ কিছু কামনা করে না, কিছু অনুভবও করে না।” অর্থাৎ, গভীর নিদ্রায় মন, ইন্দ্রিয় ও সূক্ষ্ম শরীর লীন থাকে, কিন্তু আত্মা সেই নিদ্রারও সাক্ষী। এই অবস্থায় জীব স্বয়ং নিজের স্বরূপ ভুলে থাকে, কারণ অবিদ্যার আবরণ সর্বাধিক ঘন।


মাণ্ডূক্য উপনিষদ (৫) সুষুপ্তির এই অবস্থাকে ‘প্রজ্ঞা’ হিসাবে ব্যাখ্যা করে, যেখানে আত্মা গভীর ঘুমে থাকে। এই অবস্থায়, আত্মা হলো ‘সুষুপ্তির অধিষ্ঠাতা,’ অর্থাৎ ঘুমের নিয়ন্ত্রক, এবং ‘অভ্যন্তরস্থ চেতনা’—ভেতরের সচেতনতা, যা ঘুমের গভীরেও বিদ্যমান। উপনিষদ আরও বলে যে, এই প্রজ্ঞাবস্থায় আত্মা ‘আনন্দভোগী’ এবং ‘জ্ঞানের আধার।’ এর অর্থ হলো, এই অবস্থায় আত্মা একধরনের নিবিড় শান্তি বা আনন্দ অনুভব করে, যা বাইরের কোনো উদ্দীপনা বা দুঃখ দ্বারা প্রভাবিত হয় না। একই সাথে, এটি জ্ঞানের মূল উৎস, যদিও সেই জ্ঞান সুপ্ত থাকে।


তবে, এই আনন্দকে শঙ্করাচার্য তাঁর ভাষ্যে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এই আনন্দ মুক্তির পরম আনন্দ নয়, যা ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মাধ্যমে লাভ হয়। বরং, এটি এক ধরনের ‘অবিদ্যার শান্তি।’ এখানে ‘অবিদ্যা’ মানে অজ্ঞানের অবস্থা—যেখানে আত্মা তার প্রকৃত স্বরূপ বা পরমাত্মার সঙ্গে তার সংযোগ সম্পর্কে সচেতন নয়। এই শান্তি নিছকই বাহ্যিক কোনো বিঘ্ন না থাকার ফল, কিন্তু এটি আত্ম-উপলব্ধির অভাবকে নির্দেশ করে।


শঙ্করাচার্যের মতে, এই আনন্দ মুক্তির আনন্দ নয়, কারণ এই অবস্থায় ‘আত্মা নিজের দীপ্তি অনুভব করে না।’ আত্মার প্রকৃত দীপ্তি হলো আত্মজ্ঞান, যেখানে আত্মা তার চিরন্তন, বিশুদ্ধ এবং অসীম সত্তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থাকে। সুষুপ্তির অবস্থায় আত্মা ‘অজ্ঞানের আচ্ছাদনে নিদ্রিত’ থাকে। অর্থাৎ, অজ্ঞানের একটি আবরণ আত্মাকে ঢেকে রাখে, যার কারণে সে তার প্রকৃত মহিমা ও শক্তি সম্পর্কে অবগত থাকে না। এটি নিছকই একটি বিশ্রামাবস্থা, যেখানে মনের সকল কার্যকলাপ থেমে যায়, কিন্তু এটি ব্রহ্মের সঙ্গে পূর্ণ মিলনের অবস্থা নয়। এই কারণে, প্রজ্ঞার আনন্দ একধরনের প্রাথমিক বা সাময়িক শান্তি হলেও, এটি মোক্ষের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। এটি আরও উচ্চতর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির একটি ধাপ মাত্র, যেখানে আত্মার জেগে ওঠার এবং প্রকৃত জ্ঞান লাভ করার সম্ভাবনা থাকে।


এই কারণ শরীরই অবিদ্যার মূল পর্দা। এটি আত্মাকে তার স্বরূপজ্ঞান থেকে পৃথক রাখে—যেমন ঘন মেঘ সূর্যের আলো পুরোপুরি ঢেকে দেয়, অথচ আলো নষ্ট হয় না। যখন জ্ঞানের সূর্য উদয় হয়, তখন এই অবিদ্যার পর্দা মিলিয়ে যায়, আত্মা তার স্বরূপে উদ্ভাসিত হয়। তখন বোঝা যায়—কারণ শরীর কখনও সত্য ছিল না; এটি কেবল অজ্ঞানতার ঘন ছায়া, যা জ্ঞানের উদয়ে লয় পায়।


বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৪.৩.১৯ মন্ত্রে একটি রূপকের মাধ্যমে আত্মা তথা অনন্ত সত্তার অনন্ত যাত্রার কথা বলা হয়েছে। একটি শ্যেন বা বাজপাখি যেভাবে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ক্লান্ত হয়ে নিজের বাসায় ফিরে যায়, ঠিক তেমনি অসীম এই সত্তাটি তার গন্তব্য প্রাপ্তির জন্য যাত্রা করে। এই শ্লোকটি অনন্ত সত্তার স্বরূপ এবং তার অনন্ত যাত্রার একটি কাব্যিক বর্ণনা প্রদান করে।


মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও গৌড়পাদ কারিকার ভিত্তিতে জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থার তুলনামূলক বিচার এবং তুরীয় অদ্বৈততত্ত্বের স্বরূপ ব্যাখ্যা করছি।


আত্মার চতুঃপাদ এবং চেতনার বিশ্লেষণ: মাণ্ডূক্য উপনিষদকে বৈদিক দর্শনের অদ্বৈত বেদান্ত শাখার একটি অত্যাবশ্যকীয় ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি উপনিষদগুলির মধ্যে ক্ষুদ্রতম হলেও, মাত্র বারোটি শ্লোকের মাধ্যমে এটি সমগ্র উপনিষদের সারবস্তুকে তুলে ধরে। এই শাস্ত্রের প্রধান আলোচ্য বিষয়বস্তু দুটি: ব্রহ্মের প্রতীক স্বরূপ ওঁকার (AUM) এবং আত্মার চারটি অবস্থা (Catuṣpāt Ātman)। প্রথম শ্লোকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, দৃশ্যমান জগৎ, যা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ দ্বারা আবদ্ধ, তা সবই ওঁকার। এমনকি যা এই ত্রিকালের অতীত, তা-ও ওঁকার। এই ওঁকারই ব্রহ্মের প্রতীক, যা কার্য এবং কারণ উভয়ই।


দ্বিতীয় শ্লোকে ঘোষণা করা হয়, সমগ্র জগৎই ব্রহ্ম, এবং এই জীবাত্মা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন। আপাতদৃষ্টিতে এই আত্মার চারটি অবস্থা বা পাদ রয়েছে। এই চারটি পাদ হলো জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি এবং তুরীয়। অদ্বৈত বেদান্তের পদ্ধতি অনুসারে, এই চারটি পাদকে চেতনার স্বরূপ অনুধাবনের জন্য একটি কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো প্রথম তিনটি পাদকে (ত্রিপাদ) আত্মার উপর উপাধিজনিত আরোপ (Adhyaropa) হিসেবে চিহ্নিত করা এবং এরপর চতুর্থ পাদকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে সেই উপাধিগুলির নিবৃত্তি (Apavada) করা। এই বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রমাণ করে যে, প্রথম তিনটি অবস্থা মূলত অবিদ্যার সৃষ্টি বা বিভ্রম (Avidyā-kṛta)।


গৌড়পাদ কারিকা—অদ্বৈতের পদ্ধতিগত ভিত্তি: মাণ্ডূক্য উপনিষদের ১২টি শ্লোকের উপর রচিত গৌড়পাদ কারিকা অদ্বৈত সিদ্ধান্তের পদ্ধতিগত ভিত্তি স্থাপন করে। গৌড়পাদ, যিনি আদি শঙ্করাচার্যের পরমগুরু ছিলেন, তাঁর কারিকায় চেতনার এই তিনটি অবস্থার বিশ্লেষণকে দার্শনিক যুক্তির মাধ্যমে সুসংবদ্ধ করেছেন। এই কারিকা চারটি প্রকরণে বিভক্ত; এর মধ্যে দ্বিতীয় প্রকরণটি, যেটি 'বৈতথ্য প্রকরণ' নামে পরিচিত, সেটি জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থার মিথ্যাত্ব যুক্তিসহ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গৌড়পাদ এই প্রকরণে অভিজ্ঞতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাশ্চাত্য দর্শন ও ফেনোমেনোলজির সমগোত্রীয়, কিন্তু বহুলাংশে সূক্ষ্মতর এক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন।


বৈতথ্য প্রকরণ (Vaitathya Prakarana) হলো অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি মূলত আচার্য গৌড়পাদের রচিত ‘মাণ্ডুক্য কারিকা’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের চারটি প্রধান অধ্যায়ের মধ্যে দ্বিতীয়টি। গ্রন্থের অন্যান্য অধ্যায়গুলি হলো—আগম প্রকরণ (প্রথম), অদ্বৈত প্রকরণ (তৃতীয়) এবং অলাতশান্তি প্রকরণ (চতুর্থ)। গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য কারিকার চারটি প্রকরণের বিষয়বস্তু নিম্নরূপ:


আগম প্রকরণ (প্রথম অধ্যায়) মাণ্ডুক্য উপনিষদের ১২টি মন্ত্রের ব্যাখ্যা। এই অধ্যায়ে শাস্ত্রের বাণীকে অনুসরণ করে আত্মার চারটি অবস্থার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই চারটি অবস্থা হলো—প্রথমত, বিশ্ব বা আত্মার জাগ্রত অবস্থা, যেখানে আত্মা বাহ্যিক স্থূল জগৎকে ভোগ করে; দ্বিতীয়ত, তৈজস বা আত্মার স্বপ্নাবস্থা, যেখানে আত্মা সূক্ষ্ম জগৎ ভোগ করে; তৃতীয়ত, প্রাজ্ঞ বা আত্মার সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রার অবস্থা, যেখানে সমস্ত অভিজ্ঞতা একীভূত হয়ে যায় এবং কেবল আনন্দ অবশিষ্ট থাকে। সবশেষে, এই তিনটি অবস্থার ঊর্ধ্বে চতুর্থ অবস্থাটি হলো তুরীয়, যা একমাত্র পরম সত্য বা অদ্বৈত ব্রহ্ম। এটি অনাদি, অব্যক্ত, শান্ত এবং সবরকম দ্বৈততা থেকে মুক্ত। এই চারটি অবস্থার সঙ্গে পবিত্র শব্দ 'ওঁ'-এর (A+U+M + অনামাত্র) সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে।


বৈতথ্য প্রকরণে (দ্বিতীয় অধ্যায়) জগতের মিথ্যাত্ব বা অবাস্তবতা প্রমাণ করা হয়েছে। (‘বৈতথ্য’ অর্থ মিথ্যাত্ব বা অবাস্তবতা) এই অধ্যায়ে যুক্তি ও দৃষ্টান্তের মাধ্যমে দেখান হয়েছে যে, জাগ্রত অবস্থায় আমরা যে দ্বৈত জগৎকে সত্য মনে করি, তা চরম সত্য ব্রহ্মের তুলনায় মিথ্যা বা ভ্রমমাত্র। ঠিক যেমন স্বপ্নাবস্থায় দেখা বস্তুগুলি মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তেমনই জাগ্রত অবস্থায় দেখা দৃশ্যমান জগৎও চূড়ান্ত সত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে অবাস্তব। এর মাধ্যমে অদ্বৈত বেদান্তের মূল তত্ত্ব—একমাত্র ব্রহ্মই সত্য, আর জগৎ মিথ্যা—এই মতকে প্রতিষ্ঠা করার প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করা হয়।


অদ্বৈত প্রকরণ (তৃতীয় অধ্যায়) হলো অদ্বৈত প্রকরণ, যেখানে শাস্ত্রীয় প্রমাণ এবং যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জীব (ব্যক্তিগত আত্মা) ও ব্রহ্ম (পরম আত্মা)-এর ঐক্য এবং অদ্বৈতবাদকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেহেতু দ্বিতীয় অধ্যায়ে দ্বৈত জগৎকে মিথ্যা প্রমাণিত করা হয়েছে, তাই এখানে দাবি করা হয়েছে যে, শুধুমাত্র এক ও অদ্বিতীয় আত্মাই সত্য। ব্যক্তিগত সত্তা বা জীবের সঙ্গে ব্রহ্মের কোনো ভেদ নেই। এই অধ্যায়েই 'অজাতিবাদ'-এর প্রথম আলোচনা শুরু হয়, যা সৃষ্টি বা উৎপত্তির ধারণাকে অস্বীকার করে এই বক্তব্য রাখে যে, ব্রহ্ম চিরকালই স্ব-রূপে বিদ্যমান, তাই জগৎ বা জীবের পৃথক সৃষ্টি বলে কিছু নেই। যারা ব্রহ্মকে সৃষ্টিকর্তা বা উপাসনার বস্তু মনে করে, তাদের ধারণাকে এখানে দুর্বল বলে সমালোচনা করা হয়েছে।


অলাতশান্তি প্রকরণ (চতুর্থ অধ্যায়) সবচেয়ে দার্শনিক ও জটিল। এখানে 'অলাত' বা জ্বলন্ত উল্কার দৃষ্টান্তের মাধ্যমে অজাতিবাদকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেমন একটি জ্বলন্ত কাঠখণ্ডকে দ্রুত ঘোরালে আগুনের একটি চক্রের ভ্রম সৃষ্টি হয়, কিন্তু আসলে কোনো চক্রের সৃষ্টি হয় না, তেমনই মায়ার কারণে জগৎ সত্য বলে প্রতিভাত হয়। এই প্রকরণে সমস্ত কারণ-কার্য সম্পর্ককে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা হয়েছে এবং জগৎ বা বস্তুর উৎপত্তির ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়েছে। এই অধ্যায়ের মাধ্যমে সেই চরম জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেখানে মন বা চিত্তের সমস্ত কল্পনা বন্ধ হয়ে যায় (চিত্তের নিবৃত্তি) এবং দ্বৈততার ভ্রম দূর হয়ে চিরন্তন শান্ত অস্পর্শ যোগ-এর অবস্থা লাভ হয়।