এই উপলব্ধিই শেষপর্যন্ত মুক্তির জ্ঞান এনে দেয়। যখন জানা যায়—“ব্রহ্ম সত্যম্ জগন্মিথ্যা; জীবো ব্রহ্মৈব ন অপরঃ।” তখন কারণ-কার্য, ঈশ্বর-জগৎ, আত্মা-ব্রহ্ম—সব বিভাজন লয় পায়, থাকে কেবল এক অনন্ত চেতনা, চিন্মাত্র ব্রহ্ম—যিনি একই সঙ্গে সৃষ্টির উৎস, ভিত্তি ও পরিণতি। এভাবেই অভিন্ন-নিমিত্ত-উপাদান কারণবাদ শুধু একটি সৃষ্টিতত্ত্ব নয়, বরং এক গভীর দার্শনিক উপলব্ধি—যেখানে ব্রহ্মই সব কিছুর কারণ, কার্য ও চিরন্তন চেতনার স্বরূপ।
অ্যারিস্টটলের aitia এবং ভারতীয় কারণতত্ত্ব আসলে এক অনন্ত অনুসন্ধানের দুই ভাষা—একটি বিশ্লেষণের, অন্যটি উপলব্ধির। অ্যারিস্টটলের aitia বিশ্বকে বোঝার এক rational ontology, অর্থাৎ এমন এক অস্তিত্বতত্ত্ব যা যুক্তি, পর্যবেক্ষণ ও রূপগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাস্তবতার গঠন উন্মোচন করতে চায়। তিনি প্রকৃতিকে এক বুদ্ধিসম্পন্ন বিন্যাস হিসেবে দেখেছেন, যেখানে প্রতিটি বস্তুর কারণ তার রূপ, উপাদান, প্রবর্তক ও উদ্দেশ্যের মধ্যে নিহিত। এই চারটি aitia মিলে বিশ্বকে একটি বোধগম্য, নিয়ম-নির্ধারিত কাঠামো হিসেবে ব্যাখ্যা করে—এখানে কারণ মানে মূলত ‘কীভাবে জিনিস কাজ করে’।
অন্যদিকে, ভারতীয় দর্শনের কারণতত্ত্ব—বিশেষত উপনিষদ, সাংখ্য ও বেদান্তের ধারায়—কারণকে কেবল বস্তুগত প্রক্রিয়ার নয়, বরং চেতনার প্রকাশ হিসেবে বোঝে। এখানে কারণতত্ত্ব এক spiritual ontology, যেখানে “কীভাবে জিনিস কাজ করে” নয়, বরং “কেন ও কোন চেতনা থেকে কাজ করে”—এই প্রশ্নটি মুখ্য। উপনিষদের ভাষায়, কারণ ও কার্য পৃথক নয়; কার্য কারণেরই প্রকাশ, যেমন তরঙ্গ সমুদ্রেরই রূপ। তাই ব্রহ্ম বা পুরুষ কেবল বিশ্বের প্রবর্তক নয়, তিনিই তার অন্তর্নিহিত সত্তা—যিনি জগতের মধ্যে রূপ নেন, কিন্তু নিজে অপরিবর্তিত থাকেন।
অ্যারিস্টটলের aitia যেখানে বাস্তবতাকে বস্তুর পরিমণ্ডলে ধরে রাখতে চায়, ভারতীয় কারণতত্ত্ব সেখানে বাস্তবতাকে আত্মস্বরূপ চেতনার বিকাশ হিসেবে দেখে। একদিকে যুক্তির জগৎ, যেখানে কারণ ব্যাখ্যা; অন্যদিকে অন্তর্দৃষ্টির জগৎ, যেখানে কারণ উপলব্ধি। অথচ উভয়ের অন্তরস্থ সত্য এক—বিশ্বের বহিরঙ্গে যা দেখা যায়, তা কোনো অন্তঃস্থ এক উৎসের প্রকাশ; একটি বলে, “form gives matter its being,” অন্যটি বলে, “চেতনা থেকেই সব প্রকাশিত।” এভাবে aitia ও কারণতত্ত্ব একই সত্যের দুই উচ্চারণ—একটি চিন্তার স্বরে, অন্যটি ধ্যানের নীরবতায়।
সাংখ্য দর্শনে কার্যকারণ সম্পর্ককে দ্বৈত সত্তা দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়—প্রকৃতি ও পুরুষ। প্রকৃতির তিনটি গুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) পুরুষের সংস্পর্শে এসে জগতের বৈচিত্র্যময় রূপ সৃষ্টি করে। পুরুষ এখানে নির্লিপ্ত দ্রষ্টা, আর প্রকৃতিই সৃষ্টির মূল চালিকা শক্তি। এই দর্শন অনুযায়ী, জগতের সমস্ত বস্তু ও ঘটনার মূলে দুটি মৌলিক কারণ বিদ্যমান।
ন্যায় দর্শনে কারণের ধারণা আরও বিস্তৃত ও বহুমুখী। এখানে কারণকে তিন প্রকারে বিভক্ত করা হয়েছে—সমবায়ী, অসমবায়ী ও নিমিত্ত কারণ। একটি ঘট তৈরির উদাহরণ দিলে, মাটি হলো ঘটের সমবায়ী কারণ (যার মধ্যে কার্য সমবেত বা অবিচ্ছেদ্যভাবে থাকে)। মাটির সংযোগ হলো অসমবায়ী কারণ (যা সমবায়ী কারণের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কার্য উৎপন্ন করে)। আর কুমোর, তার চক্র ও দণ্ড ইত্যাদি হলো নিমিত্ত কারণ (যা কার্য উৎপাদনে সহায়ক)। ন্যায়মতে, কোনো কার্য উৎপন্ন হতে গেলে এই তিন প্রকার কারণের সমন্বয় আবশ্যক।
অন্যদিকে, অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে কারণের ধারণা অত্যন্ত সরল ও এককেন্দ্রিক। অদ্বৈতমতে, জগতের একমাত্র চরম ও পরম কারণ হলো ব্রহ্ম। এই বিশ্বচরাচর ব্রহ্মেরই বিবর্তন বা মিথ্যা প্রতিভাস মাত্র। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা—এই মৌলিক ধারণার উপর ভিত্তি করে অদ্বৈতবাদ সমস্ত বৈচিত্র্যের মূলে এক অভিন্ন সত্তা, অর্থাৎ ব্রহ্মকে স্থাপন করে। এখানে কার্যকারণ সম্পর্ক মায়ার অধীন, যেখানে ব্রহ্মই একমাত্র বাস্তব সত্তা।
এই ভারতীয় দার্শনিক মতবাদগুলোর পাশে অ্যারিস্টটলের কার্যকারণ তত্ত্ব (aitia) একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে। অ্যারিস্টটল কারণকে একরৈখিক না দেখে বহুস্তরীয় হিসেবে দেখেছেন। তিনি কার্যকারণকে চারটি ভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন, যা বাস্তবতাকে সামগ্রিকভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করে:
উপাদান কারণ (Material Cause): কোনো বস্তু কী দিয়ে তৈরি, তা হলো তার উপাদান কারণ। যেমন, একটি মূর্তির উপাদান কারণ হলো পাথর বা ব্রোঞ্জ। এটি ন্যায় দর্শনের সমবায়ী কারণের সঙ্গে তুলনীয়।
রূপ কারণ (Formal Cause): কোনো বস্তুর আকৃতি, গঠন বা সারবস্তু কী, তা হলো তার রূপ কারণ। যেমন, একটি মূর্তির রূপ কারণ হলো শিল্পীর পরিকল্পনা বা সেই মূর্তির বিশেষ আকৃতি। এটি বস্তুর অপরিহার্য ধর্মকে নির্দেশ করে।
প্রবর্তন কারণ (Efficient Cause): কীসের দ্বারা কার্যটি সম্পাদিত হয় বা কে কাজটি করে, তা হলো প্রবর্তন কারণ। যেমন, একটি মূর্তির প্রবর্তন কারণ হলো ভাস্কর যিনি এটি তৈরি করেছেন। এটি ন্যায় দর্শনের নিমিত্ত কারণের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
উদ্দেশ্য কারণ (Final Cause): কোনো বস্তুর চূড়ান্ত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কী, তা হলো তার উদ্দেশ্য কারণ। যেমন, একটি মূর্তির উদ্দেশ্য কারণ হতে পারে সৌন্দর্য বৃদ্ধি, উপাসনা বা কোনো বিশেষ স্মৃতিকে ধারণ করা। অ্যারিস্টটলের মতে, প্রতিটি বস্তুর একটি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য থাকে, যা তার অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।
অ্যারিস্টটলের এই চতুর্মুখী কার্যকারণ তত্ত্ব বিভিন্ন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করে। এটি বোঝায় যে, বাস্তবতার গভীরতা উপলব্ধির জন্য শুধুমাত্র একটি বা দুটি কারণ নয়, বরং কারণের এই বহুস্তরীয় বিন্যাসকে একসঙ্গে বিচার করা অপরিহার্য। এটি উপাদানগত দিক, কাঠামোগত দিক, উৎপাদক শক্তি এবং চূড়ান্ত উদ্দেশ্য—সব কিছুকে একত্রিত করে একটি সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে, যা ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন কারণতত্ত্বের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণে সহায়ক।
aitia ও কারণতত্ত্ব—দুটি শব্দ, দুটি সভ্যতা, কিন্তু একই ধারার জিজ্ঞাসা—কেন কিছু আছে, কিছু নেই, কেন নয়? অ্যারিস্টটল এর উত্তর খুঁজেছিলেন বিশ্লেষণ ও যুক্তিতে; ভারতীয় ঋষিরা খুঁজেছিলেন অন্তর্দর্শন ও চেতনায়। কিন্তু দু-জনেই শেষপর্যন্ত এসে দাঁড়ান একই উপলব্ধিতে—জগৎ বোঝা মানে তার বহুস্তরীয় কারণের মধ্যে ঐক্যকে চিনে নেওয়া, যেখানে পদার্থ, রূপ, ক্রিয়া ও চেতনা—সব মিলেমিশে এক সংগীতের মতো বাজে।
উপাদান কারণ (Material Cause) বলতে বোঝায় সেই মৌল পদার্থ বা উপাদান, যার দ্বারা কোনো বস্তু গঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, মাটির হাঁড়ির উপাদান কারণ হলো মাটি, সোনার আংটির উপাদান কারণ হলো সোনা, কাঠের টেবিলের উপাদান কারণ হলো কাঠ। এটি বস্তুর ভৌত উৎস বা পদার্থগত ভিত্তি—অর্থাৎ, “কীসের দ্বারা” কোনো কিছু অস্তিত্ব লাভ করেছে। ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে, বিশেষত অদ্বৈত বেদান্তে, এই ধারণাটি গভীর আধ্যাত্মিক রূপ পায়: ব্রহ্মই জগতের উপাদান কারণ (upādāna kāraṇa)। জগৎ ব্রহ্ম থেকে প্রকাশিত, যেমন হাঁড়ি মাটির এক রূপ, তেমনি সমগ্র সৃষ্টি ব্রহ্মেরই প্রকাশ। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ব্রহ্ম জগৎ থেকে আলাদা কোনো পদার্থ নয়; বরং জগৎ তারই এক আকারান্তর, তারই প্রতিফলন।
দক্ষ কারণ (Efficient Cause) বলতে বোঝায় সেই শক্তি বা প্রবর্তক নীতি, যা কোনো সৃষ্টি-প্রক্রিয়াকে চালিত করে। এটি “কে” বা “কীভাবে” প্রশ্নের উত্তর দেয়। হাঁড়ির দক্ষ কারণ হলো কুমোর, আংটির দক্ষ কারণ হলো সোনার কারিগর, টেবিলের দক্ষ কারণ হলো কাঠমিস্ত্রি। অর্থাৎ, যে সত্তা বা শক্তি কার্যকরভাবে কোনো বস্তু তৈরি করে, সেটিই তার দক্ষ কারণ। অ্যারিস্টটলের মতে, কোনো সৃষ্টি তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন উপাদান ও দক্ষ উভয় কারণ একত্রে ক্রিয়াশীল হয়—পদার্থের সাথে প্রবর্তন যুক্ত হলে তবেই রূপ জন্ম নেয়।
ভারতীয় দর্শন এই দুটি ধারণাকে নতুন জীবন দেয়। অদ্বৈত বেদান্তে, শঙ্করাচার্য বলেন, ব্রহ্মই জগতের উভয় কারণ—উপাদানও সে, দক্ষও সে। সাংখ্য দর্শনে এই কাঠামো কিছুটা ভিন্ন। এখানে প্রকৃতি হলো উপাদান কারণ, আর পুরুষ (চেতনা) হলো দক্ষ কারণ। প্রকৃতি থেকেই জগৎ বিকশিত হয়, কিন্তু সেই বিকাশের প্রেরণা আসে পুরুষের চেতন উপস্থিতি থেকে। পুরুষ নিজে কোনো কাজ করে না, কিন্তু তার সজাগ উপস্থিতিই প্রকৃতিকে জাগিয়ে তোলে—যেমন সূর্যের আলো ফুলকে ফুটতে সাহায্য করে, কিন্তু সূর্য নিজে কোনো কাজ করে না।
এই দুই কারণের পার্থক্য সহজভাবে বোঝাতে গেলে বলা যায়—উপাদান কারণ হলো “কীসের দ্বারা”, আর দক্ষ কারণ হলো “কে বা কীভাবে”। হাঁড়ির উপাদান কারণ মাটি, দক্ষ কারণ কুমোর; আংটির উপাদান কারণ সোনা, দক্ষ কারণ সোনার কারিগর; জগতের উপাদান কারণ ব্রহ্ম, আর দক্ষ কারণও সেই ব্রহ্ম, চেতন রূপে।
অদ্বৈত বেদান্তের সিদ্ধান্ত তাই এ-ই—“ব্রহ্মই জগতের উপাদানও, দক্ষও”। অর্থাৎ, সৃষ্টির উৎস এবং প্রবর্তক শক্তি দুটোই এক ও অবিভক্ত। এই দর্শনে সৃষ্টি আলাদা কোনো প্রক্রিয়া নয়, বরং ব্রহ্মের আত্মপ্রকাশ; চেতনার মধ্যেই পদার্থ রূপ নেয়, আর চেতনার দ্বারাই তা কার্যকর হয়। এভাবে “উপাদান” ও “দক্ষ” কারণ অবশেষে এক হয়ে যায় সেই এক পরম চেতনার মধ্যে, যেখানে কর্তা ও কর্ম, কারণ ও ফল—সবই ব্রহ্মের এক অবিরাম রূপান্তর।
অদ্বৈতের মতে, ব্রহ্মই বিশ্বের দক্ষ (efficient) ও উপাদান (material) কারণ উভয়। তবে, ব্রহ্ম যেহেতু অপরিবর্তনীয়, তাই তার প্রকৃত রূপান্তর সম্ভব নয়। ফলে, জগৎকে বলা হয় মায়া—এক সৃজনশীল শক্তি, যা অজ্ঞানতার ফলে সত্যের আভাস তৈরি করে। এই মায়া-তত্ত্ব থেকেই উদ্ভূত হয় বাস্তবতার তিনটি স্তর—যাকে বলা হয় সত্তাত্রয় (sattā-traya):
প্রথমত, পারমার্থিক সত্য (paramārthika sattā)—ব্রহ্ম, চিরন্তন, শর্তহীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ চেতনা। এটি কোনো দ্বৈত বোধে ধরা যায় না, কারণ সেখানে জান্তা ও জাননো উভয়ই বিলীন।
দ্বিতীয়ত, ব্যাবহারিক সত্য (vyāvahārika sattā)—জাগতিক জগত, যেখানে কারণ-কার্য, নৈতিকতা, সুখ-দুঃখ, কর্মফল প্রভৃতি অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। এটি ব্যাবহারিকভাবে সত্য, যতক্ষণ না ব্রহ্মজ্ঞান উদ্ভাসিত হয়।
তৃতীয়ত, প্রাতিভাসিক সত্য (prātibhāsika sattā)—ব্যক্তিগত বিভ্রম বা ভুল উপলব্ধি, যেমন স্বপ্ন বা দড়িকে সাপ বলা।
এই তিন স্তরের বাস্তবতার উদ্দেশ্য কেবল দার্শনিক নয়, বরং মুক্তিমূলক (soteriological)—সাধক যেন ধীরে ধীরে বহির্মুখ বাস্তবতা থেকে অন্তর্মুখ ব্রহ্মস্বরূপে উত্তরণ ঘটাতে পারে। ব্যাবহারিক জগতের মায়া অতিক্রম করে পারমার্থিক সত্যে পৌঁছানোই মুক্তির পথ।
Soteriological (মুক্তিতত্ত্বমূলক) শব্দটি গ্রিক উৎসে ফিরে গেলে দেখা যায়—এটি এসেছে sōtēría, অর্থাৎ “মুক্তি” বা “উদ্ধার” এবং logos, অর্থাৎ “বিবেচনা” বা “তত্ত্ব”—এই দুটি শব্দের সংমিশ্রণ থেকে। সুতরাং soteriology অর্থ “মুক্তিতত্ত্ব,” অর্থাৎ মুক্তির প্রকৃতি, কারণ, প্রক্রিয়া এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কিত দর্শনীয় অনুসন্ধান।
১. অদ্বৈত বেদান্তে মুক্তিতত্ত্ব (Advaita Vedānta Soteriology): অদ্বৈত বেদান্তে মুক্তি (মোক্ষ) কোনো স্থানিক গমন নয়, বরং “অবিদ্যা”-র নাশ। মুক্তি মানে আত্মার প্রকৃত স্বরূপে স্থিত হওয়া—অর্থাৎ “আত্মা ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছু নয়।” শঙ্করাচার্য বলেন—“ব্রহ্মবিদ্যাই মোক্ষসাধনম্।” (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ১.১.৪); “জ্ঞানেনৈব তু কৈবল্যম্।” (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ৩.৪.২৬)। অর্থাৎ, মুক্তি কেবল জ্ঞানের মাধ্যমেই সম্ভব। এখানে মুক্তিতত্ত্ব epistemological (জ্ঞানসংক্রান্ত)—যে-জ্ঞান “অহং ব্রহ্মাস্মি” উপলব্ধি করায়, সেই জ্ঞানই মুক্তির কারণ।
২. বৌদ্ধ দর্শনে মুক্তিতত্ত্ব (Buddhist Soteriology): বুদ্ধের মতে—“দুঃখ” হচ্ছে অস্তিত্বের মৌলিক চিহ্ন, এবং মুক্তি (নির্বাণ) হলো দুঃখের সম্পূর্ণ নিবৃত্তি। এই মুক্তি লাভের উপায় হলো “অষ্টাঙ্গিক মার্গ” (সম্যক দ্রষ্টি, সংকল্প, বাক, কর্ম, আজীবন, ব্যায়াম, স্মৃতি, সমাধি)। ধম্মপদ (২৭৭-২৭৯)-এ বলা হয়েছে—“সর্বে সংখারা অনিচ্চা, সর্বে সংখারা দুঃখা, সর্বে ধম্মা অনত্তা।” এই উপলব্ধিই নির্বাণের পথ—অর্থাৎ সব কিছুই অনিত্য, দুঃখময় এবং স্বাতন্ত্র্যহীন। বৌদ্ধ soteriology নৈতিক (śīla), ধ্যানমূলক (samādhi), এবং জ্ঞানমূলক (prajñā) তিন স্তম্ভে প্রতিষ্ঠিত।