এই Metaphysics-এর প্রধান লক্ষ্য ছিল সেই মৌল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা—“Being qua Being”, অর্থাৎ “অস্তিত্ব হিসাবে অস্তিত্ব” কী। অন্য সব শাস্ত্র কোনো নির্দিষ্ট বস্তুর অস্তিত্ব অধ্যয়ন করে—যেমন পদার্থবিজ্ঞান বস্তু, জীববিদ্যা প্রাণী, গণিত সংখ্যা—কিন্তু Metaphysics অনুসন্ধান করে অস্তিত্বের নিজস্ব প্রকৃতি: কেন কিছু আছে, কিছুই কেন নেই?
অ্যারিস্টটল বলেন, “অস্তিত্ব” বহু অর্থে ব্যবহৃত হলেও এর কেন্দ্রে থাকে “সত্তা” (ousia)—যে সারবস্তু বা মূল রূপ কোনো কিছুকে, যা, তা করে তোলে। এভাবেই তিনি প্রথম গড়ে তোলেন অস্তিত্বতত্ত্বের ভিত্তি।
এই গ্রন্থে তিনি “চার aitia” বা “চার কারণ”-এর তত্ত্ব দেন—উপাদান (material), রূপগত (formal), প্রবর্তক বা দক্ষ (efficient), এবং উদ্দেশ্য (final)—যা দিয়ে বোঝানো হয় কোনো বস্তু বা ঘটনার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা। উদাহরণস্বরূপ, একটি মাটির হাঁড়ির উপাদান কারণ ‘মাটি’, রূপগত কারণ ‘তার আকৃতি’, প্রবর্তক কারণ ‘কুমোর’, এবং উদ্দেশ্য কারণ ‘জল রাখার প্রয়োজনে তৈরি হওয়া’। এই চার aitia মিলেই গড়ে ওঠে কোনো কিছুর “কেন”-এর পূর্ণাঙ্গ জবাব।
অ্যারিস্টটল আরও বলেন, প্রতিটি বস্তুর ভেতর দুই নীতি একসঙ্গে ক্রিয়াশীল—রূপ (form) ও পদার্থ (matter)। পদার্থ (hylē) হলো বস্তুর সম্ভাবনা, আর রূপ (morphē) হলো সেই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন। অর্থাৎ, পদার্থ দেয় অস্তিত্বের উপাদান দিক, আর রূপ দেয় তার সুনির্দিষ্ট পরিচয়, সংগঠন ও উদ্দেশ্য। কোনো বস্তুর রূপ ও পদার্থ আলাদা জগতে নয়, বরং একত্রে বিদ্যমান; উভয়ের সমন্বয়েই সৃষ্টি হয় “বাস্তব সত্তা” (substantial being)—এই ধারণাই অ্যারিস্টটলের বিখ্যাত Hylomorphism তত্ত্ব।
এই তত্ত্বের গভীর তাৎপর্য হলো—জগতের প্রতিটি পরিবর্তন আসলে সম্ভাবনা থেকে বাস্তবায়নের যাত্রা। যেমন কাঠের মধ্যে টেবিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু সেই সম্ভাবনা তখনই বাস্তব হয়, যখন কাঠ নির্দিষ্ট রূপে গঠিত হয়। তাই কোনো সৃষ্টি নিছক “শূন্য থেকে উৎপত্তি” নয়, বরং বিদ্যমান সম্ভাবনার পরিণতি। এইভাবে পদার্থ হলো স্থায়ী ভিত্তি, আর রূপ হলো জীবন্ত শক্তি, যা পদার্থকে নির্দিষ্ট সত্তায় রূপান্তরিত করে।
অ্যারিস্টটলের মতে, এই পরিবর্তনশীল জগৎ—যেখানে পদার্থ (hylē) ও রূপ (morphē) ক্রমাগত রূপান্তরের নৃত্যে আবর্তিত হচ্ছে—তার ভেতরে গতির কারণ থাকে, কিন্তু সেই গতি চিরস্থায়ী হতে পারে না, যদি না তার পেছনে কোনো চূড়ান্ত, অপরিবর্তনীয় নীতি থাকে, যা নিজে অচল থেকেও সব কিছুকে চালনা করে। এই নীতিকেই তিনি বলেন Unmoved Mover—অর্থাৎ, এমন এক “অচল প্রবর্তক”, যিনি নিজে গতিশীল নন, কিন্তু সমস্ত গতি ও পরিবর্তনের মূল অনুপ্রেরণা।
এখানে “অচল” (unmoved) শব্দের অর্থ নিস্তব্ধতা নয়; বরং এটি বোঝায় এমন এক পরম সত্তা, যিনি নিজের মধ্যে পূর্ণ, তাই কোনো অভাব বা অসম্পূর্ণতা থেকে কিছু সৃষ্টি করেন না। জগৎ তাঁর প্রতি আকর্ষণবশতই চলমান—যেমন প্রিয় বস্তু প্রেমিককে টানে, কিন্তু নিজে বদলায় না। অর্থাৎ, Unmoved Mover কোনো বাহ্যিক শক্তি দিয়ে জগৎকে ঠেলে দেন না, বরং অভ্যন্তরীণ আকর্ষণের শক্তি দিয়ে সব কিছুকে তার পূর্ণতার দিকে টানে।
অ্যারিস্টটল যখন বলেন “চিন্তার চিন্তা” (thought thinking itself), তখন তিনি মানবীয় চিন্তার সীমিত রূপ নয়, বরং এক অসীম আত্ম-চেতনা-র কথা বোঝান। মানুষের চিন্তা সাধারণত কোনো বাহ্যবস্তু বা ধারণার দিকে নিবদ্ধ থাকে—অর্থাৎ, চিন্তক (subject) এবং চিন্তার বিষয় (object) আলাদা থাকে। কিন্তু অ্যারিস্টটলের এই “চিন্তার চিন্তা” এমন এক অবস্থা, যেখানে চিন্তার কোনো বাহ্য বিষয় নেই; চিন্তা নিজেকেই জানে, নিজেকেই অনুধাবন করে।
এটি হলো চেতনার পরিপূর্ণ স্বরূপ, যেখানে জানা, জানা-যাওয়া এবং জান্তা—জ্ঞান, জ্ঞেয় এবং জ্ঞাতা—এই তিনটি অবিচ্ছেদ্যভাবে একত্রিত। এই চেতনা কোনো বাহ্য ক্রিয়া করে না, কোনো পরিবর্তন ঘটায় না; কারণ পরিবর্তন মানে অসম্পূর্ণতা, আর এই চেতনা সম্পূর্ণ—অতএব, তার কোনো কিছু অর্জনের প্রয়োজন নেই। তাই এটি স্থিত, তবু প্রাণবন্ত; অচল, তবু সর্বচালক।
অ্যারিস্টটল স্পষ্টভাবে বলেন, এই “চিন্তার চিন্তা” কোনো ব্যক্তিক ঈশ্বর নয়, যিনি মনুষ্য-রূপে ভাবেন বা ইচ্ছা অনুযায়ী সৃষ্টি করেন। বরং এটি এক চিরস্থায়ী আত্মচেতনা (eternal self-consciousness), যা নিজেই নিজের মধ্যে পূর্ণ। এই চেতনা সমস্ত অস্তিত্বের চূড়ান্ত আদর্শ—কারণ সমস্ত কিছুই তার দিকে আকৃষ্ট হয়, তার মধ্যে পূর্ণতা খোঁজে।
এইভাবে “চিন্তার চিন্তা” আসলে এক গভীর সত্তাতাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি—এটি এমন এক চেতনা, যেখানে জ্ঞান ও অস্তিত্বের মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই; জ্ঞান মানেই অস্তিত্ব, আর অস্তিত্ব মানেই চেতনা।
এই ভাবনা ভারতীয় দর্শনের “চিন্মাত্র ব্রহ্ম” ধারণার সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলিত—যেখানে ব্রহ্ম সম্পর্কে বলা হয় “স্বপ্রকাশ”, “স্বয়ংচেতনা”, “যা জানে না জেনেই, থাকে জানার মধ্যেই”—অর্থাৎ, চেতনা নিজের মধ্যেই জেগে থাকে। অ্যারিস্টটলের “thought thinking itself” এবং উপনিষদের “চিন্মাত্র ব্রহ্ম” — উভয়ের মধ্যেই আমরা পাই সেই নীরব, আত্মনির্ভর, চিরজাগ্রত চেতনা, যা কোনো ক্রিয়ার উৎস নয়, বরং সকল ক্রিয়ার অস্তিত্বকে সম্ভব করে তোলে।
চিন্মাত্র ব্রহ্ম বা “শুদ্ধ চেতনা হিসেবে ব্রহ্ম” অদ্বৈত বেদান্তের এমন এক দার্শনিক উপলব্ধি, যা বলে—চূড়ান্ত বাস্তবতা কোনো বস্তু নয়, কোনো দেবতা নয়, এমনকি কোনো চিন্তার বিষয়ও নয়; বরং চেতনা নিজেই, যা সমস্ত জানার পেছনের জাননশক্তি। “মাত্র” শব্দটি এখানে সীমারেখা টানে—যা-কিছু চেতনা নয়, তা ব্রহ্ম নয়। তাই “চিন্মাত্র ব্রহ্ম” মানে সেই পরম সত্য, যিনি কেবল জানেন না, বরং জ্ঞানই তিনি নিজে।
মানুষ সাধারণত চেতনা বোঝে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে—আমি দেখি, আমি ভাবি, আমি জানি। কিন্তু এই “আমি” যখন নিজেকেই জানে, তখন জানা ও জানার বিষয়ের মধ্যে যে-ফাঁক, সেটিই মায়া। চিন্মাত্র ব্রহ্ম সেই ফাঁক মুছে দেয়; সেখানে জানা আর জানার বিষয় একাকার। এই চেতনা কোনো পরিবর্তনশীল ভাব নয়, বরং সেই অচল ভিত্তি, যার ওপর সমস্ত অভিজ্ঞতা ওঠানামা করে।
উপনিষদে এই ভাবনা নানা-ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে—
“প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম”—জ্ঞানই ব্রহ্ম (ঐতরেয় উপনিষদ, ৩.১),
“নেহ নানাস্তি কিন্চন”—এখানে কোনো বহুত্ব নেই (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৪.৪.১৯),
এবং “সচ্চিদানন্দ স্বরূপম্” (ভাগবতের মঙ্গলাচরণ; তেজোবিন্দু উপনিষদ, ৩.১১ পদ)—ব্রহ্ম সত্য, চেতনা ও আনন্দের অবিচ্ছেদ্য ঐক্য।
এসব উক্তি ঘোষণা করে যে, যা-কিছু বিদ্যমান, তার বাস্তবতা কেবল চেতনার মধ্যেই নিহিত; চেতনা ছাড়া কিছুই নেই।
অ্যারিস্টটলের “thought thinking itself” ধারণার সঙ্গে এর আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে। তাঁর “Unmoved Mover” যেমন বিশুদ্ধ আত্মচেতনা—যিনি চিন্তার মধ্যে নিজেকেই চিন্তা করেন, তেমনি অদ্বৈতের চিন্মাত্র ব্রহ্ম সেই চেতনা, যিনি জানেন না জেনে, বরং নিজের মধ্যেই জাগ্রত। তবে পার্থক্য হলো—অ্যারিস্টটলের চেতনা ভাবনামাত্র স্তরে স্থিত; ব্রহ্মচেতনা ভাবনাকেও অতিক্রম করে, যেখানে চিন্তা, চিন্তার বস্তু, ও চিন্তক—সব এক হয়ে যায়।
চিন্মাত্র ব্রহ্ম তাই কোনো কর্মকার নয়, কোনো সৃষ্টিকর্তাও নয়। তিনি অচল অথচ সর্বচালক, নির্বিকার অথচ সর্বব্যাপ্ত, নীরব অথচ পরম জাগ্রত। যেমন স্বপ্নদ্রষ্টার মন থেকে স্বপ্নজগৎ প্রকাশিত হয়, কিন্তু সেই মন স্বপ্নের ঘটনার দ্বারা পরিবর্তিত হয় না, তেমনি জগত ব্রহ্মচেতনার প্রকাশ হলেও ব্রহ্ম নিজে অচঞ্চল।
অতএব, চিন্মাত্র ব্রহ্ম হলো সেই নিঃশব্দ পরম চেতনা—যিনি সব জানার উৎস, সব অভিজ্ঞতার ভিত্তি, এবং সব অস্তিত্বের অন্তর্নিহিত আলো। এখানে জ্ঞাতা, জ্ঞান, ও জ্ঞেয় আর আলাদা থাকে না; তারা এক হয়ে যায়। যে এটি উপলব্ধি করে, তার কাছে মুক্তি আর কোনো লক্ষ্য নয়—বরং নিজের স্বরূপে জাগরণ:
“অহং ব্রহ্মাস্মি”—আমি সেই চিন্মাত্র ব্রহ্ম।
‘চিন্মাত্র’ শব্দটি সংস্কৃতের দুটি অংশ থেকে গঠিত—চিত্ (cit) অর্থাৎ চেতনা বা জ্ঞান, এবং মাত্র (mātra) অর্থাৎ কেবল, শুধুমাত্র, বা নিখাদ। তাই চিন্মাত্র মানে “শুধু চেতনা”, “চেতনা ছাড়া আর কিছু নয়”। এটি অদ্বৈত বেদান্তের একটি মৌলিক ধারণা, যা বলে—চেতনা নিজেই একমাত্র সত্য, বাকিসব তারই প্রকাশ বা প্রতিফলন মাত্র।
অদ্বৈত দৃষ্টিতে, এই জগৎ যত রূপে আমাদের সামনে আসে—বস্তু, চিন্তা, আবেগ, দেহ, সময়, স্থান—সবই চেতনার মধ্যে দেখা যায়, চেতনার বাইরে নয়। আমরা বলি “আমি জানি”, কিন্তু সেই জানা-ক্রিয়াটিও চেতনারই কাজ; এমনকি “অজানা” বলার অনুভূতিটিও চেতনার আলোয় প্রকাশিত। তাই এখানে চেতনা কোনো “জিনিসকে জানার উপায়” নয়, বরং সব জানার পেছনের মৌল আলো—যার দ্বারা জানা সম্ভব হয়।
যেমন, সূর্য নিজেকে আলোকিত করার জন্য কোনো আলো ধার করে না—সে নিজেই আলো। তেমনি চিত্ নিজেকে জানার জন্য কোনো জ্ঞান বা ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নেয় না—সে নিজেই জ্ঞানের উৎস। এই কারণেই অদ্বৈত বেদান্ত বলে, “চিন্মাত্র ব্রহ্ম”—ব্রহ্ম মানেই চেতনা, আর চেতনা মানেই ব্রহ্ম।
এই চিন্মাত্র ধারণা জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological) ও সত্তাতাত্ত্বিক (ontological) উভয় অর্থেই গভীর। জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থেকে এটি বলে—চেতনার বাইরে কোনো “অন্য বাস্তব” নেই; আর সত্তাতাত্ত্বিক দিক থেকে বলে—চেতনা কোনো গুণ বা ভাব নয়, বরং অস্তিত্বেরই স্বরূপ। অর্থাৎ, যা সত্য, তাই চেতনা; যা চেতনা, তা-ই সত্য।
উপনিষদে এই ধারণার ছাপ স্পষ্ট। অদ্বৈত বেদান্তে চারটি মহাবাক্য বা “মহান উক্তি” এমন চারটি উপনিষদীয় ঘোষণা, যা মানব-চেতনার চূড়ান্ত সত্য প্রকাশ করে—আত্মা ও ব্রহ্ম এক। এগুলি চারটি বেদের চারটি উপনিষদ থেকে সংগৃহীত, এবং একত্রে তারা বেদান্ত দর্শনের সম্পূর্ণ দর্শনকে এক বাক্যে রূপ দেয়।
প্রথম মহাবাক্য—প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম (ঐতরেয় উপনিষদ ৩.১.৩, ঋগ্বেদ)। এর অর্থ: “জ্ঞানই ব্রহ্ম।” এখানে বলা হয়েছে, চেতনা বা জ্ঞানের স্বরূপই পরম সত্য। ব্রহ্ম কোনো পদার্থ নয়, কোনো দেবতাও নয়; তিনি সেই চেতনা, যার দ্বারা সব কিছু জানা যায়, কিন্তু যাকে কিছু দিয়েই জানা যায় না। জ্ঞানই তাঁর অস্তিত্ব, আর অস্তিত্বই জ্ঞান।
দ্বিতীয় মহাবাক্য—অহং ব্রহ্মাস্মি (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৪.১০, যজুর্বেদ)। এর অর্থ: “আমি ব্রহ্ম।” এখানে জীব ও ব্রহ্মের অভেদ ঘোষণা করা হয়েছে। “আমি” যে শরীর বা মন নয়, বরং চেতনা—এই উপলব্ধি যখন ঘটে, তখন জানা যায় যে, ব্যক্তিগত আত্মা ও পরম আত্মা এক। এ জ্ঞানের মধ্য দিয়েই মুক্তি (মোক্ষ) ঘটে।
তৃতীয় মহাবাক্য—তত্ত্বমসি (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.৮.৭, সামবেদ)। এর অর্থ: “তুমি সেই।” এটি উপদেশ বাক্য—গুরু শিষ্যকে বলেন, “যে পরম সত্যকে তুমি খুঁজছ, সে তুমিই।” অর্থাৎ, জীবাত্মা ও ব্রহ্ম পৃথক নয়; জগতের বহুত্ব কেবল আপাত। এই উপলব্ধি যখন হৃদয়ে জেগে ওঠে, তখন মানুষ নিজের মধ্যেই ব্রহ্মকে পায়।
চতুর্থ মহাবাক্য—অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম (মাণ্ডূক্য উপনিষদ ২, অথর্ববেদ)। এর অর্থ: “এই আত্মাই ব্রহ্ম।” এটি অভিজ্ঞতার ঘোষণা—নিজের অন্তরের চৈতন্যই সেই পরম সত্য, যাকে ব্রহ্ম বলা হয়। অর্থাৎ, যে-আত্মাকে আমরা ‘আমি’ বলে অনুভব করি, সেই আত্মাই আসলে ব্রহ্মের প্রতিফলন নয়, বরং ব্রহ্ম নিজে।
এই চারটি বাক্য পরস্পর পরিপূরক:
“প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম”—ব্রহ্মের প্রকৃতি নির্ধারণ করে,
“অহং ব্রহ্মাস্মি”—তার ব্যক্তিগত উপলব্ধি প্রকাশ করে,
“তত্ত্বমসি”—গুরু থেকে শিষ্যে সেই জ্ঞান সঞ্চার করে,
আর “অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম”—অন্তরের অভিজ্ঞতায় তাকে দৃঢ় করে।
অতএব, সব মহাবাক্যের সারমর্ম একেই নির্দেশ করে—“চেতনা-ই ব্রহ্ম, আমি সেই চেতনা, তুমিও সেই, আর সেই আত্মাই ব্রহ্ম।” এই অভেদজ্ঞানই অদ্বৈতের মোক্ষ, যেখানে জানা, জান্তা, ও জানা-যাওয়া এক হয়ে যায় নিঃশব্দ পরম ঐক্যে। এসব উক্তি একই সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে, যে-সত্যে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—তিনের বিভাজন মিলিয়ে যায়।