অবিদ্যা-বিদ্যা: ১১৫



দার্শনিকভাবে এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে অদ্বৈত বেদান্তের “অবাচ্য মায়া”-র ধারণার এক গভীর সাদৃশ্য আছে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে পার্থক্যও ততটাই মৌল। অদ্বৈত বেদান্ত বলে—যা না সম্পূর্ণভাবে “আছে”, না সম্পূর্ণভাবে “নেই”, সেই মধ্যবর্তী অবস্থাই মায়া। মায়া এখানে এমন এক সত্তাতাত্ত্বিক (ontological) স্তর, যা ব্রহ্মের তুলনায় অবাস্তব (mithyā), অথচ অভিজ্ঞতায় কার্যকর। এটি না পরমার্থিক (absolute reality), না সম্পূর্ণ শূন্য; বরং এক “অব্যক্ত” অবস্থান, যেখানে সত্য ও অসত্য, অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব মিলেমিশে এক অনির্বচনীয় (anirvacanīya) সত্তা হয়ে থাকে। তাই শঙ্করাচার্যের ভাষায়, “মায়া অনির্বচনীয়া”—মায়া সম্পর্কে বলা যায় না, কারণ তা না সত্য, না অসত্য।

কিন্তু জৈন দর্শনের দৃষ্টিতে এই “অবাচ্যতা” (avaktavyatā) কোনো বিভ্রম নয়, বরং বাস্তবতারই সূক্ষ্মতম রূপ। অদ্বৈতের মতো এখানে ভাষার সীমা এসে থামে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যা অব্যক্ত, তা মিথ্যা। বরং জৈন মতে, ভাষার পরেও সত্য আছে—এক এমন অঞ্চল, যেখানে বিরোধগুলো মিলেমিশে যায়, যেখানে “আছে” ও “নেই” একসঙ্গে সত্য। এই অঞ্চলের বাস্তবতা আপেক্ষিক নয়, বরং বহুমাত্রিক (anekāntika)—এখানে একাধিক দৃষ্টিকোণ একইসাথে সত্য, যদিও ভাষা সেই যুগপৎ সত্যকে ধারণ করতে অক্ষম।

অদ্বৈত তাই মায়াকে দেখে অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মধ্যে টলোমলো এক প্রতিভাস হিসেবে—যা জ্ঞানলাভে লয় পায়, ব্রহ্মে বিলীন হয়। কিন্তু জৈন দর্শন সেই টলোমলো অঞ্চলকেই দেখে বাস্তবতার জীবন্ত হৃদয় হিসেবে—যেখানে সব বিরোধ এক সুরে অনুরণিত হয়। অদ্বৈতের অবাচ্যতা হলো নিস্তব্ধ লয়, জৈনের অব্যক্তব্যতা হলো সজাগ নীরবতা। একটিতে সত্য ভাষার অতীত বলে বিলুপ্ত হয়; অন্যটিতে সত্য ভাষার সীমা পেরিয়ে নতুনভাবে স্পন্দিত হয়।

অতএব, দুই দর্শনের মিল এই যে, উভয়েই ভাষা ও যুক্তির সীমা স্বীকার করে; কিন্তু পার্থক্য এই যে—অদ্বৈত সেই সীমার ওপারে একমাত্র ব্রহ্মের নিঃশেষ একত্ব দেখে, আর জৈন দেখে বহু সত্যের সুরেলা সহাবস্থান।

“স্যাদ নাস্তি চ অবক্তব্যঃ” তাই আমাদের শেখায়—নৈরাশ্য নয়, নীরবতা; অনস্তিত্ব নয়, অনির্বচনীয়তা। বাস্তবতা কখনও সম্পূর্ণ প্রকাশিত নয়, আবার কখনও সম্পূর্ণ লুপ্তও নয়—সে চিরকাল এই দুইয়ের মাঝখানে এক অবর্ণনীয় কম্পনে স্থিত। এই উপলব্ধি মানুষকে নম্র করে, সহিষ্ণু করে, এবং শেখায়—সত্যের সেই স্তরকে সম্মান করতে, যা বলা যায় না, তবু সত্য।

শেষত, সপ্তম দৃষ্টিকোণ হলো অস্ত্য-নাস্ত্য-অবক্তব্য। এখানে বলা হয়—ঘট একই সঙ্গে আছে, নেই, এবং অবক্তব্য। আছে, কারণ তার উপাদান (মাটি) বিদ্যমান; নেই, কারণ তার রূপ (পাত্র) পরিবর্তনশীল; আর অবক্তব্য, কারণ এই পরিবর্তন ও স্থায়িত্বের সম্পর্ক ভাষা বা যুক্তির সীমার বাইরে। এটি হলো সেই পূর্ণ সত্য, যেখানে বিপরীত অবস্থাগুলি একে অপরকে নস্যাৎ না করে এক সমন্বিত অভিজ্ঞতায় মিলে যায়।

“স্যাদ অস্তি চ নাস্তি চ অবক্তব্যঃ” (syād asti ca nāsti ca avaktavyaḥ)—এই সপ্তম ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি জৈন দর্শনের সপ্তভঙ্গী নয়-এর শীর্ষবিন্দু, যেখানে সমস্ত পূর্ববর্তী ভঙ্গ—“স্যাদ অস্তি”, “স্যাদ নাস্তি”, এবং “স্যাদ অবক্তব্যঃ”—একত্রে মিলিত হয়। এটি জৈন জ্ঞানতত্ত্বের সর্বোচ্চ সংহতি, যেখানে সত্যকে একই সঙ্গে অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব ও অবক্তব্যতার সমন্বয়ে দেখা হয়।

এখানে “স্যাৎ” অর্থাৎ সম্ভবত বা কোনো এক প্রেক্ষাপটে—শর্তনির্ভর সত্যের ইঙ্গিত দেয়; “অস্তি” মানে আছে, “নাস্তি” মানে নেই, এবং “অবক্তব্যঃ” মানে যা বলা যায় না, অর্থাৎ যা ভাষা ও ধারণার সীমা অতিক্রম করে। এইভাবে “স্যাদ অস্তি চ নাস্তি চ অবক্তব্যঃ” অর্থ দাঁড়ায়—“কোনো এক প্রেক্ষিতে বস্তুটি আছে, অন্য প্রেক্ষিতে নেই, এবং এই দুইয়ের যুগপৎ প্রকৃতি ভাষায় সম্পূর্ণরূপে বলা যায় না।”

এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জৈন দর্শন এমন এক দার্শনিক উচ্চতায় পৌঁছায়, যেখানে বিরোধ আর বিরোধ থাকে না, বরং সহাবস্থানের রূপ নেয়। “স্যাদ অস্তি”—বস্তুটি তার নিজস্ব অবস্থায় আছে; “স্যাদ নাস্তি”—অন্য অবস্থায় তা নেই; এবং “স্যাদ অবক্তব্যঃ”—যখন আমরা উভয় অবস্থাকে একসঙ্গে ধরতে চাই, তখন ভাষা ব্যর্থ হয়। এই তিনটি মিলিয়েই গড়ে ওঠে জৈন দৃষ্টির পূর্ণতা—এক এমন দৃষ্টি, যেখানে বাস্তবতা এক নয়, বহু; কিন্তু সেই বহুত্ব আবার এক গভীর ঐক্যের বৃত্তে আবদ্ধ।

ধরা যাক, জ্বলন্ত আগুন। বর্তমান মুহূর্তে সে জ্বলছে—স্যাদ অস্তি; আগামী মুহূর্তে যখন তা নিভে যাবে, তখন বলা যায়—স্যাদ নাস্তি; কিন্তু “আগুন”—এই চলমান প্রক্রিয়াটিকে একসঙ্গে ধরতে গেলে আমরা বলতে পারি না, “আছে” না “নেই”—তখন সেটি হয়ে ওঠে “স্যাদ অবক্তব্যঃ।” এইভাবে জৈন চিন্তা আমাদের শেখায়—বাস্তবতা কখনও স্থির নয়; তা এক বহুমাত্রিক প্রবাহ, যেখানে “আছে” ও “নেই” একসঙ্গে নৃত্য করে।

“স্যাদ অস্তি চ নাস্তি চ অবক্তব্যঃ”-এর মধ্যে নিহিত আছে গভীর অনেকান্তবাদ—যা বলে, কোনো এক দৃষ্টিকোণই পরম নয়; প্রতিটি দৃষ্টিকোণ আংশিকভাবে সত্য। কোনো বস্তু তার নিজস্ব স্বরূপে আছে, অন্যের স্বরূপে নেই, এবং এই দুই অবস্থাকে একত্রে ধরার মুহূর্তেই ভাষা থেমে যায়। এই নীরবতার স্থানেই জৈন দর্শন সত্যকে উপলব্ধি করে—যে-সত্যকে মুখে বলা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়।

এই সপ্তম সিদ্ধান্তই জৈন চিন্তায় পরিণত হয় এক দার্শনিক পূর্ণতায়—যেখানে জ্ঞান, সহিষ্ণুতা ও নীরবতা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। এটি আমাদের শেখায় যে, কোনো মত বা দৃষ্টিভঙ্গি একা সত্য নয়; সব দৃষ্টির মিলনেই পূর্ণতা। আর সেই পূর্ণতা কখনও বাক্যে নয়—তা কেবল নীরব উপলব্ধির বিষয়।

অদ্বৈত বেদান্তে যেমন বলা হয়—“নেতি নেতি”—‘এ নয় ও নয়’ বলে ভাষাকে অতিক্রম করা; তেমনি জৈন দর্শনের এই সপ্তম ভঙ্গ ভাষার সীমাকে ছুঁয়ে বলে—“আছে, নেই, এবং বলা যায় না”—সবই একসঙ্গে সত্য। এই উপলব্ধি মানুষকে যুক্তির শীর্ষে এবং অহংকারের নিচে স্থাপন করে—যেখানে জ্ঞান আর বিতর্ক নয়, বরং গভীর সহাবস্থান।

তাই “স্যাদ অস্তি চ নাস্তি চ অবক্তব্যঃ” কেবল এক যুক্তিবিদ্যার সিদ্ধান্ত নয়; এটি এক দার্শনিক উপসংহার, যেখানে বাস্তবতা, ভাষা ও অভিজ্ঞতা এক মহাসংলাপে মিলিত হয়। এখানে সত্য আর একক নয়; তা বহুর স্বরে প্রতিধ্বনিত, কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই সব স্বর মিশে যায় নীরবতার এক অখণ্ড সুরে।

এই সাতটি দৃষ্টিকোণ—অস্তি, নাস্তি, অস্তি-নাস্তি, অবক্তব্য, অস্ত্য-অবক্তব্য, নাস্ত্য-অবক্তব্য ও অস্ত্য-নাস্ত্য-অবক্তব্য—একত্রে জৈন যুক্তিবিদ্যার সত্যবোধের সম্পূর্ণ রূপরেখা নির্মাণ করে। জৈন দর্শন তাই শেখায় যে, সত্য কখনও একপাক্ষিক নয়; এক দৃষ্টিকোণ থেকে যা সত্য, অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে তা মিথ্যা বা অবক্তব্য হতে পারে। বাস্তবতা এই বহুমাত্রিকতার মধ্য দিয়েই উপলব্ধ। তাই স্যাদ্বাদ (syādvāda) কেবল এক যুক্তি-পদ্ধতি নয়, এটি এক গভীর দার্শনিক বিনয়—যেখানে বলা হয়, কোনো এক দিক থেকে সত্যকে সম্পূর্ণ বলা অসম্ভব; সব দিক মিলিয়েই সত্য পূর্ণ হয়।

অদ্বৈত বেদান্ত এবং জৈন অনেকান্তবাদ—এই দুটি দার্শনিক ঐতিহ্য ধ্রুপদী ভারতীয় চিন্তাধারায় বাস্তবতা বোঝার দুটি গভীর ও বিপরীত দৃষ্টিকোণকে প্রতিনিধিত্ব করে। উভয় পদ্ধতিই মুক্তির লক্ষ্যে স্থাপিত—অদ্বৈতে সেই মুক্তি মায়ার অবসানে পরম একত্বে লয়, আর জৈনে মুক্তি আসে সমস্ত ভিন্নতার মধ্যে সুরেলা সহাবস্থানের বোধে। তবু, তাদের পথ, ভাষা ও অন্তর্দৃষ্টি ভিন্ন: একদিকে চূড়ান্ত একত্ব, অন্যদিকে বহুমাত্রিক আপেক্ষিকতা।

অদ্বৈত বেদান্তের বীজ নিহিত রয়েছে উপনিষদে—যেখানে আত্মা ও ব্রহ্মকে অভিন্ন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই চিন্তাকে সংহত আকারে রূপ দেন বদরায়ণ, তাঁর সংক্ষিপ্ত অথচ গূঢ় ‘ব্রহ্মসূত্র’ গ্রন্থে। পরে আদি শঙ্করাচার্য (৮ম শতক) এই সূত্রের ওপর রচনা করেন ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য, যা অদ্বৈতের কঠোর একত্ববাদী ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠা করে। শঙ্কর বৃহদারণ্যক, ছান্দোগ্য, কেন, মাণ্ডূক্য প্রভৃতি উপনিষদের ওপর ভাষ্য লিখে অদ্বৈত দর্শনকে পদ্ধতিগত রূপ দেন, এবং ‘নেতি নেতি’—“না এটি, না ওটি”—এই ভাষাগত পদ্ধতিকে ব্যবহার করে দেখান যে, ব্রহ্মকে কোনো নির্দিষ্ট বর্ণনায় ধরা যায় না। সমস্ত সীমিত ধারণা অতিক্রম করেই ব্রহ্ম উপলব্ধ হয়, কারণ ব্রহ্মই একমাত্র চিরন্তন সত্য; জগৎ মায়াময় ও আপেক্ষিক। তাই শঙ্করের মূল প্রতিপাদ্য—“ব্রহ্ম সত্যং, জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ”—অদ্বৈতের অমোঘ সূত্রে পরিণত হয়।

অন্যদিকে, জৈন দর্শনের অনেকান্তবাদ (anekāntavāda) বিকশিত হয় প্রায় একই সময়ে, ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীরের (খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক) শিক্ষার ধারায়। মহাবীর বাস্তবতাকে দেখেছিলেন বহুমুখী বা আপেক্ষিক হিসেবে—যেখানে কোনো বস্তুকে একমাত্রিকভাবে বোঝা যায় না, কারণ প্রতিটি বস্তুই একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে সত্য। তাঁর এই শিক্ষাকে পদ্ধতিগত রূপ দেন আচার্য উমাস্বাতি (২য় শতক) তাঁর তত্ত্বার্থসূত্র-এ, যেখানে তিনি বাস্তবতার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেন দ্রব্য (substance), ক্ষেত্র (space), কাল (time) ও ভাব (mode)—এই চার নির্ধারকের ভিত্তিতে। উমাস্বাতি বলেন: “অর্থন্যথাত্বাৎ সত্ত্বন্যথাত্বাৎ”—অর্থাৎ, অর্থ ও অস্তিত্ব উভয়ই শর্তাধীন। কোনো বস্তুর “অস্তি” (আছে) এবং “নাস্তি” (নেই) এই দুই দিকই সত্য, তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। এই দর্শন থেকেই জন্ম নেয় “সপ্তভঙ্গীনয়”—এক বহুমাত্রিক যুক্তিপদ্ধতি, যা বলে, কোনো সত্যকেই এককভাবে, চূড়ান্তভাবে বলা যায় না।

খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে ভারতীয় বৌদ্ধ, জৈন ও বৈদিক পণ্ডিতদের মধ্যে যে তীব্র বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপ চলছিল, সেই প্রেক্ষাপটেই এই দুই মতবাদ পূর্ণতা লাভ করে। অদ্বৈত বেদান্ত সেখানে এক একান্তবাদী অবস্থান নেয়—বাস্তবতা এক, বহুবচন কেবল মায়ার প্রতিফলন। জৈন দর্শন গড়ে তোলে তার বিপরীত, এক অ-পরমবাদী দৃষ্টিভঙ্গি—বাস্তবতা বহু দিক থেকে সত্য, এবং প্রতিটি দিকই আংশিকভাবে বাস্তবের প্রতিফলন। অদ্বৈতের ভাষায়, “যা বহুরূপে দেখা যায়, তা মায়া; বাস্তব কেবল এক।” জৈনের ভাষায়, “যা একরূপে দেখা যায়, তা অন্ধতা; বাস্তব কেবল বহুমুখী।”

তবু, এই দুই পথ একে অপরের পরিপূরকও বটে। অদ্বৈত যে চূড়ান্ত একত্বের কথা বলে, তা বহুত্বকে অতিক্রম করে নীরব লয়ে পৌঁছায়—যেখানে সমস্ত ভিন্নতা লীন হয়ে যায় এক ব্রহ্মসত্তায়। আর জৈন অনেকান্তবাদ বলে—ভিন্নতা লীন হয় না, বরং সুরেলা সহাবস্থানে পরিণত হয়; সেখানে বিরোধ মেটে না, মিলেমিশে ছন্দে পরিণত হয়। একদিকে অদ্বৈতের নীরবতা হলো অতিক্রমের ফল, অন্যদিকে জৈনের নীরবতা হলো সহাবস্থার পরিপূর্ণতা।

অদ্বৈতের দৃষ্টি অবশেষে এক অবিভক্ত চৈতন্যে থামে, যেখানে জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে কোনো ফাঁক থাকে না। জৈন অনেকান্তবাদ সেই একই সত্যকে অন্য দিক থেকে দেখায়—সেখানে জ্ঞান সর্বদা আপেক্ষিক, বহুবিধ দৃষ্টিভঙ্গির সমবায়ে জন্ম নেয়। অদ্বৈতের মুক্তি হলো মায়া-অতিক্রমের লয়, জৈনের মুক্তি হলো মিথ্যা-অবহেলা নয়, বরং ভিন্নতাকে জানার বিনয়ে সত্যের গভীর উপলব্ধি।

অতএব, দুই দর্শনের অভিমুখ ভিন্ন হলেও লক্ষ্য একই—মানুষ যেন সত্যকে সীমাবদ্ধ দৃষ্টিতে না দেখে, বরং জ্ঞানের পরিসর এমনভাবে প্রসারিত করে, যাতে বাস্তবতার বহুরূপতাও ধরা পড়ে এবং সেই বহুরূপতার অন্তরস্থিত ঐক্যও উপলব্ধ হয়। একটির ভাষা নীরব লয়, অন্যটির ভাষা সজাগ নীরবতা—কিন্তু উভয়ের মর্ম এক: সত্য কখনও একক নয়, এবং সত্য কখনও বহুরূপের বাইরে নয়।

অদ্বৈত বেদান্ত এবং জৈন অনেকান্তবাদের মধ্যে যে মৌলিক দার্শনিক পার্থক্য নিহিত, তা বাস্তবতার স্বরূপ সম্পর্কিত তাদের চূড়ান্ত ঘোষণাতেই প্রকাশিত। একদিকে অদ্বৈত বেদান্ত দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে যে, বাস্তবতা এক ও অবিভাজ্য—সব কিছুর অন্তরস্থিত একমাত্র সত্য হলো ব্রহ্ম। অন্যদিকে জৈন দর্শন বলে, বাস্তবতা একক নয়, বরং বহুমাত্রিক; তা বহু চিরন্তন সত্তার (দ্রব্য) সমন্বয়ে গঠিত, যাদের প্রত্যেকটিরই নিজস্ব অস্তিত্ব ও বিকাশ রয়েছে।