অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: সাতানব্বই



বেদান্তে “তত্ত্বমসি”-এর ব্যাখ্যায় এই লক্ষণা-বৃত্তি প্রয়োগ হয়, বিশেষ করে এর একটি বিশেষ রূপ ভাগত্যাগ-লক্ষণা নামে পরিচিত। “ভাগত্যাগ-লক্ষণা” মানে—“অপ্রাসঙ্গিক অংশ ত্যাগ করে, প্রাসঙ্গিক অংশ গ্রহণ করা”। এখানে ঈশ্বর ও জীব—উভয়ের আক্ষরিক অর্থে কিছু গুণ বা উপাধি (conditionings) আছে, যা তাদের আপাত ভিন্ন করে তোলে। যেমন, “তৎ” বা ঈশ্বরের উপাধি—সর্বজ্ঞতা, সর্বশক্তি, মায়া-উপাধি। “ত্বম্” বা জীবের উপাধি—অজ্ঞতা, সীমাবদ্ধতা, দেহ-মন-ইন্দ্রিয়াদি।

এখন এই উপাধিগুলি যদি আমরা তাদের সঙ্গে রাখি, তবে সমতা অসম্ভব। তাই “ভাগত্যাগ”-এর মাধ্যমে উভয়ের উপাধি-সংলগ্ন অংশ ত্যাগ করা হয়, আর গ্রহণ করা হয় তাদের সাধারণ সত্তা—চৈতন্য, সৎ-চিদ্-আনন্দ স্বরূপ। তখন দেখা যায়—উভয়ের অন্তর্নিহিত আত্মা এক এবং অভিন্ন।

অতএব, “তত্ত্বমসি” বাক্যের লক্ষিত অর্থ হয়—“যে-চৈতন্য ঈশ্বররূপে প্রকাশিত, সেই চৈতন্যই ত্বম্ বা জীবরূপে প্রকাশিত”—তাদের পার্থক্য কেবল উপাধিজনিত। এইভাবে “তৎ” ও “ত্বম্”-এর আংশিক অংশ (ভাগ) ত্যাগ করে অবশিষ্ট চৈতন্যরূপটি গৃহীত হয়—এটাই ভাগত্যাগ-লক্ষণা।

এই প্রক্রিয়াই ব্রহ্মজ্ঞানের ভাষাগত ভিত্তি। এতে শব্দের মাধ্যমে এমন একটি অনির্বচনীয় সত্য উদ্‌ভাসিত হয়, যা কোনো আক্ষরিক ব্যাখ্যায় প্রকাশ করা যায় না। তাই শাস্ত্র বলে—“বাক্ তস্য বৈ পরাম্”—বাক্যও যেখানে থেমে যায়, সেইখানেই ব্রহ্ম। লক্ষণা-বৃত্তি সেই সীমার সেতু—যার মাধ্যমে সীমিত শব্দ অসীম অর্থের দিকে ইঙ্গিত করে।

বৃত্তি-ব্যাপ্তি (vṛtti-vyāpti) এবং ফল-ব্যাপ্তি (phala-vyāpti)—এই দুটি ধারণা অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞান-উৎপত্তির প্রক্রিয়াকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এগুলি বিশেষভাবে আলোচিত হয় “দৃষ্টান্তরূপ” হিসেবে—যেমন কোনো বস্তুর জ্ঞান কীভাবে উদিত হয়, এবং আত্ম-জ্ঞান সেই তুলনায় কীভাবে ভিন্ন।

অদ্বৈতমতে, জ্ঞান মানে কোনো বস্তুর প্রতি চেতনার প্রকাশ। সাধারণ জগতে আমরা কোনো বস্তু জানি তখনই, যখন মন বা অন্তঃকরণ সেই বস্তুর দিকে প্রবাহিত হয়ে তাকে নিজের আকারে ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, ঘড়া দেখলে মন “ঘটাকার-বৃত্তি” গ্রহণ করে, অর্থাৎ মনের একটি বৃত্তি ঘড়ার রূপে প্রসারিত হয়। এই মুহূর্তে দুটি ব্যাপার ঘটে—একটি বৃত্তি-ব্যাপ্তি, অন্যটি ফল-ব্যাপ্তি।

বৃত্তি-ব্যাপ্তি মানে হলো, মনের বৃত্তি বা মানসিক তরঙ্গটি যে-বস্তুকে জানার উদ্দেশ্যে প্রবাহিত হয়েছে, সেটির উপর বিস্তৃত বা ব্যাপ্ত হওয়া। যেমন চোখ খোলা হলে আলোকরশ্মি যে-বস্তুতে পড়ে, সেটিকে স্পর্শ করে, তেমনি মনের বৃত্তি ঘড়ার দিকে গিয়ে ঘড়াটিকে “আবৃত” করে। তখন ঘড়ার প্রতি একটি মানসিক প্রত্যক্ষতা ঘটে, কিন্তু এখনও জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়নি; কারণ শুধুই মনের স্পর্শ যথেষ্ট নয়, তাতে চেতনার প্রতিফলন প্রয়োজন।

চেতনা (সাক্ষীচৈতন্য) সব বৃত্তির মধ্যেই উপস্থিত, কিন্তু যখন কোনো নির্দিষ্ট বৃত্তির উপর তা প্রতিফলিত হয়, তখনই প্রকৃত জ্ঞান উৎপন্ন হয়—এই মুহূর্তটিকেই বলে ফল-ব্যাপ্তি। অর্থাৎ, সাক্ষীচৈতন্য যখন ওই বিশেষ বৃত্তিতে প্রতিফলিত হয়ে সেই বস্তুকে আলোকিত করে, তখন “আমি ঘড়া দেখছি”, এই জ্ঞান জন্মায়।

বৃত্তি-ব্যাপ্তি হলো মনের দ্বারা বস্তু-স্পর্শ, আর ফল-ব্যাপ্তি হলো সেই মনের বৃত্তিতে চেতনার প্রতিফলনের ফলে জ্ঞানোদয়। অদ্বৈত বেদান্ত এই প্রক্রিয়াটিকে আত্ম-জ্ঞানেও প্রয়োগ করে, তবে সেখানে পার্থক্য হয়। আত্মা (ব্রহ্ম) নিজেই চৈতন্য, সে অন্য কোনো বস্তুর মতো বাইরে নেই। তাই আত্ম-জ্ঞান জন্মানোর সময় মনের বৃত্তি “ব্রহ্মাকার” রূপ ধারণ করে—অখণ্ডাকার-বৃত্তি হয়ে যায়। সেই বৃত্তি যখন উদিত হয়, তখন বৃত্তি-ব্যাপ্তি মানে মনের নিজস্ব প্রকাশ; আর ফল-ব্যাপ্তি মানে সেই বৃত্তিতে ব্রহ্মচৈতন্যের প্রতিফলন। কিন্তু যেহেতু ব্রহ্ম স্বপ্রকাশ, তাই ফল-ব্যাপ্তি সেখানে কার্যত একরকম প্রতিফলন নয়, বরং নিজেরই প্রকাশ।

সাধারণ জ্ঞানে বস্তু বাইরে থাকে—তাই বৃত্তি-ব্যাপ্তি ও ফল-ব্যাপ্তি পৃথক; আত্মজ্ঞান ক্ষেত্রে বস্তু (আত্মা) ও চেতনা অভিন্ন—তাই উভয় ব্যাপ্তি একত্রে ঘটে। তখন আর কোনো জ্ঞেয় অবশিষ্ট থাকে না; কেবল থাকে স্বপ্রকাশমান চৈতন্য, যা বলে—“অহং ব্রহ্মাস্মি”।

নিবৃত্তি-লক্ষণ-জ্ঞান (Nivṛtti-lakṣaṇa-jñāna) অদ্বৈত বেদান্তে এক অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও গভীর জ্ঞানধারণা, যা বোঝায় এমন এক জ্ঞান, যার প্রকৃতি “কোনো নতুন কিছু উৎপন্ন করা নয়”, বরং “অবিদ্যা ও বিভ্রমের নিবৃত্তি বা নাশ সাধন করা”।

অদ্বৈতমতে, মুক্তি কোনো নতুন অবস্থা নয়, বরং যা সর্বদা বর্তমান—সেই ব্রহ্মস্বরূপ আত্মারই উদ্‌ভাস, কিন্তু অজ্ঞানের আচ্ছাদনের কারণে তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় না। জ্ঞান-উৎপত্তির অর্থ তাই কোনো নতুন সত্তা সৃষ্টি নয়; বরং সেই আচ্ছাদন বা অবিদ্যার নিবৃত্তি। যে-জ্ঞান এই নিবৃত্তি ঘটায়, তাকেই বলে নিবৃত্তি-লক্ষণ-জ্ঞান।

সাধারণ জগতে জ্ঞানের প্রকৃতি বৃত্তি-লক্ষণ; অর্থাৎ, মন কোনো বস্তুর দিকে গিয়ে সেই বস্তুর আকার গ্রহণ করে, চেতনা তাতে প্রতিফলিত হয়, আর আমরা জানি—“এটা ঘড়া”, “এটা গাছ”। এই জ্ঞান কোনো বস্তু প্রকাশ করে—অর্থাৎ কিছু উৎপন্ন করে। কিন্তু আত্মজ্ঞান তার ঠিক বিপরীত প্রকৃতির—এখানে কিছুই সৃষ্টি হয় না; বরং যা মিথ্যা-আবৃত, তা মুছে যায়।

যেমন অন্ধকার দূর হলে আলো নতুন করে তৈরি হয় না, কেবল আচ্ছাদন বিলুপ্ত হয়; তেমনি ব্রহ্মজ্ঞানে আত্মা নতুনভাবে প্রকাশিত হয় না, বরং অবিদ্যার নাশের ফলে তার চিরন্তন স্বপ্রকাশ রূপ ফুটে ওঠে। এই কারণেই বলা হয়—ব্রহ্মজ্ঞান হলো নিবৃত্তি-লক্ষণ, কারণ এর কার্য “নিবৃত্তি” (অবিদ্যার বিলোপ), “প্রকাশ” নয় (নতুন জিনিস সৃষ্টি নয়)।

শঙ্করাচার্য এই ধারণা স্পষ্ট করেছেন ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে—জ্ঞানের ফলে কিছুই সৃষ্টি হয় না; কেবল অবিদ্যার নিবৃত্তিই ফল। জ্ঞান এখানে একটি বিলোপক কারণ (nivartaka-hetu), উৎপাদক কারণ (utpādaka-hetu) নয়।

নিবৃত্তি-লক্ষণ-জ্ঞান মানে—এমন জ্ঞান, যার কার্য হচ্ছে মিথ্যা-বৃত্তি ও অবিদ্যার সম্পূর্ণ নাশ সাধন। এই জ্ঞান কোনো ক্রিয়া নয়, কোনো ফল সৃষ্টিকারীও নয়; এটি আত্মস্বরূপ চৈতন্যেরই স্ব-প্রকাশ, যা উদিত হলে সকল দ্বৈততা, ভেদ, ও মায়ার প্রকল্প নিজে থেকেই লীন হয়ে যায়। এই অবস্থায় জ্ঞান আর কর্ম পৃথক থাকে না; জানার সঙ্গেই মুক্তি ঘটে। তাই শাস্ত্র বলে—জ্ঞানই মুক্তি, কারণ সেই জ্ঞানই অবিদ্যার নিবৃত্তি।

যে-জ্ঞান নিজ আশ্রয়ের মধ্যে অবস্থিত অজ্ঞতাকে নিশ্চিহ্ন করে, তা কেবল ‘অভাবের অভাব’ নয়, বরং একটি সক্রিয় ও কার্যকর তত্ত্ব। এর দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, যখন যজ্ঞদত্ত সম্পর্কে জ্ঞান উদিত হয়, তখন ‘যজ্ঞদত্তকে আমি চিনি না’—এই ম্লানতা বা অজ্ঞানতা আর থাকে না। ঠিক তেমনি, যখন আত্মা-ব্রহ্ম-জ্ঞান উদিত হয়, তখন ‘আমি দেহ’—এই ভ্রান্তিমূলক আচ্ছাদন সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে এবং আত্মস্বরূপের উপলব্ধি ঘটে।

এখানে হেতু ও দৃষ্টান্তের মাধ্যমে এই বিষয়টি স্পষ্ট করা হয় যে, ‘অজ্ঞতা-নিবারকত্ব’-ই জ্ঞানের প্রকৃত লক্ষণ। অর্থাৎ, যে-শক্তি অজ্ঞানতাকে দূর করে, তা-ই প্রকৃত জ্ঞান। এই নিবৃত্তির প্রক্রিয়াটি ঠিক প্রদীপ জ্বালানোর মতো, যেখানে প্রদীপ জ্বালালে যেমন অন্ধকার লোপ পায়, তেমনই জ্ঞান উদিত হলে অজ্ঞতা দূর হয়।

অদ্বৈত বেদান্ত বলে, জ্ঞানের সত্যতা বা প্রামাণ্য আলাদা কোনো বাহ্যিক প্রমাণের উপর নির্ভরশীল নয়। বরং তার নিজস্ব নিবর্তন-শক্তি, অর্থাৎ অজ্ঞানতাকে দূর করার ক্ষমতাতেই জ্ঞানের সত্যতা নিহিত। এটি ‘বাধ-সম্বন্ধ’ নামে পরিচিত—যেখানে পূর্ববর্তী ভ্রান্ত জ্ঞান বা প্রতীতি পরবর্তী যথার্থ জ্ঞান দ্বারা বাধিত বা নিবৃত্ত হয়। এই নিবর্তন শক্তিই জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্যতার ভিত্তি, যা আত্ম-প্রকাশক এবং অজ্ঞানতা-বিনাশক। এই ধারণার মাধ্যমে অদ্বৈত বেদান্ত প্রমাণ করে যে, আত্মজ্ঞানই পরম পুরুষার্থ এবং অজ্ঞানতা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়।

নিবর্তন-শক্তি এমন এক বিশেষ দার্শনিক ধারণা, যা জ্ঞানের অন্তর্নিহিত নাশক ক্ষমতাকে বোঝায়—এমন এক শক্তি, যার কার্য হচ্ছে অবিদ্যা, বিভ্রম ও মিথ্যা প্রত্যয়ের সম্পূর্ণ নাশ। জ্ঞান কেবল প্রকাশ করে না; জ্ঞান অন্ধকারকেও সরিয়ে দেয়, এবং এই সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাই তার নিবর্তন-শক্তি।

অদ্বৈতমতে, জ্ঞানের দুটি দিক আছে—প্রকাশন-শক্তি ও নিবর্তন-শক্তি। প্রকাশন-শক্তি দ্বারা জ্ঞান কোনো বস্তু বা সত্যকে উদ্ভাসিত করে, তাকে প্রকাশ করে তোলে; আর নিবর্তন-শক্তি দ্বারা জ্ঞান অজ্ঞান বা অবিদ্যাকে দূর করে, তার আচ্ছাদন নিবারণ করে। পার্থিব জ্ঞানে আমরা মূলত প্রকাশন-শক্তিকে দেখি, কারণ সেখানে জ্ঞান কোনো বাহ্য বস্তু প্রকাশ করে—যেমন ঘড়া, বৃক্ষ, বা আকাশ। কিন্তু আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান ভিন্ন প্রকৃতির, কারণ আত্মা কখনোই অপ্রকাশিত নয়, বরং সর্বদা স্বপ্রকাশমান। সেখানে কোনো “নতুন” প্রকাশের প্রয়োজন নেই; কেবল অবিদ্যার পর্দা সরিয়ে দেওয়াই প্রয়োজন। এই অবিদ্যা-নাশের ক্রিয়াই জ্ঞানের নিবর্তন-শক্তি।

যেমন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার সরে যায়, কিন্তু সূর্য কোনো “অন্ধকার ধ্বংসের কাজ” করে না; তার উপস্থিতিই অন্ধকারকে বিলীন করে দেয়। তেমনি আত্মজ্ঞান উপস্থিত হলে অবিদ্যা নিজে থেকেই বিলীন হয়। জ্ঞানের যে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা এই সূর্যের আলোর মতো অন্ধকারকে সরিয়ে দেয়, সেটিই নিবর্তন-শক্তি। সূর্য আসলে ওঠে না, পৃথিবীই ঘোরে। তাই সূর্যের ‘উপস্থিতি’ বলে কিছু নেই, সূর্য উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি কিংবা দুইয়েরই ঊর্দ্ধে। এই দুই বৈশিষ্ট্য ব্রহ্মের বৈশিষ্ট্যের সাথে তুলনীয়।

শঙ্করাচার্য বলেন—“জ্ঞানের প্রকৃতি উৎপাদক নয়, নিবর্তক”। অর্থাৎ, জ্ঞান কোনো নতুন ফল সৃষ্টি করে না, বরং অবিদ্যা নাশ করাই তার একমাত্র ফল। তাই তিনি বলেন, জ্ঞান উৎপাদক কারণ নয়, নিবর্তক কারণ। এই নিবারণক্ষমতাই জ্ঞানের নিবর্তন-শক্তি।

অবিদ্যা ভাবরূপ সত্তা, অর্থাৎ, এটি কিছু পরিমাণে অস্তিত্বধারী ও কার্যক্ষম, কিন্তু পরম নয়; তাই এর নাশ ঘটতে পারে কেবল তার বিপরীত সত্তা—জ্ঞান—দ্বারা। যেমন আলো ও অন্ধকার একসঙ্গে থাকতে পারে না, তেমনি জ্ঞান ও অবিদ্যাও সহাবস্থান করতে পারে না। যখন জ্ঞান উদিত হয়, তখন অবিদ্যা ও তার সমস্ত প্রক্ষেপণ, যেমন “আমি দেহ”, “আমি কর্তা”, “আমি ভোক্তা”—সবই একমুহূর্তে লীন হয়ে যায়।

অতএব, নিবর্তন-শক্তি হলো সেই জাগ্রত চৈতন্যশক্তি, যা অবিদ্যা ও মিথ্যা অভিজ্ঞতার মূলকে ছিন্ন করে, কিন্তু নিজে কোনো নতুন সৃষ্টি ঘটায় না। এটি কেবল অবিদ্যার আবরণ সরিয়ে দেয়, এবং তখন আত্মার চিরন্তন, স্বপ্রকাশমান, নিরাকার, অখণ্ড সত্তাই উদ্ভাসিত হয়। এই কারণেই বলা হয়, জ্ঞানই মুক্তি—কারণ মুক্তি কোনো নতুন অবস্থা নয়, বরং অবিদ্যার নিবৃত্তি মাত্র; এবং সেই নিবৃত্তির কারণ জ্ঞানের নিবর্তন-শক্তি। যেখানে এই জ্ঞান জাগ্রত হয়, সেখানে মায়া, বিভ্রম ও অজ্ঞতা এক বিন্দুমাত্র টিকে থাকতে পারে না; কেবল থাকে ব্রহ্ম—অখণ্ড, অব্যাহত, চিরন্তন চেতনা।

অদ্বৈত বেদান্তে বাধ-সম্বন্ধ (Bādha-sambandha) বলতে বোঝায় “এক জ্ঞানের দ্বারা অন্য জ্ঞানের নিবারণ-সম্পর্ক”। অর্থাৎ, যখন কোনো জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা পরে উদিত আরেকটি উচ্চতর জ্ঞানে অবৈধ বা অতিক্রমিত হয়ে যায়, তখন বলা হয়—দুটির মধ্যে বাধ-সম্বন্ধ আছে। যেমন, স্বপ্নে-দেখা হাতি ও ঘোড়া জাগরণের পরে অদৃশ্য হয়ে যায়; জাগরণ-জ্ঞান স্বপ্ন-জ্ঞানের বাধ সাধন করে। তেমনি ব্রহ্ম-জ্ঞানে জাগ্রত জগতের অভিজ্ঞতা লুপ্ত হয়—জগৎ তখন আর বাস্তব বলে প্রতীয়মান থাকে না, কেবল চৈতন্যই অবশিষ্ট থাকে। তাই বলা হয়, “ব্রহ্ম-জ্ঞানের দ্বারা জগতের বাধ ঘটে”।

বাধ-সম্বন্ধের মূল অর্থ হলো, কোনো নিম্নতর বা আপাত জ্ঞান উচ্চতর জ্ঞানে অতিক্রমিত হওয়া। এটি জগতের অচূড়ান্ত বাস্তবতা বোঝায়—যা যতক্ষণ না বিলুপ্ত হয়েছে, ততক্ষণ কার্যকর, কিন্তু সত্য উপলব্ধ হলে তার মিথ্যাত্ব প্রকাশিত হয়। এটি হলো সেই জ্ঞানতাত্ত্বিক সম্পর্ক, যেখানে “পরে-প্রাপ্ত সত্য” পূর্ববর্তী ভ্রান্ত ধারণাকে বিলুপ্ত করে। স্বপ্ন জাগরণে বাধিত, জাগ্রত/জাগরণ জ্ঞান আত্ম-বোধে বাধিত; আর আত্ম-বোধ চিরনিবিদ্ধ, কারণ তাকে আর কোনো উচ্চতর জ্ঞান দ্বারা বাধ দেওয়া যায় না।