অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: পঁচানব্বই



অদ্বৈত বেদান্তে অখণ্ডাকার-বৃত্তি বা ব্রহ্মাকার-বৃত্তি এমন এক বিশেষ জ্ঞান-অবস্থা, যেখানে মন ব্রহ্মের মতো অখণ্ড ও নিরাকার রূপ ধারণ করে। সাধারণভাবে মন বা অন্তঃকরণ সর্বদা পরিবর্তনশীল ও বিষয়-নির্ভর; কোনো বস্তুকে জানার জন্য মন তার বৃত্তিকে সেই বস্তুর আকারে পরিণত করে—যেমন ঘড়া জানার সময় “ঘটাকার-বৃত্তি”, কাপড় জানার সময় “পটাকার-বৃত্তি”। কিন্তু ব্রহ্ম কোনো আকার বা গুণবিশিষ্ট বস্তু নয়; তাই ব্রহ্ম-জ্ঞান লাভের সময় মন এমন এক অনির্বচনীয় রূপ ধারণ করে, যা আকারহীন অথচ সচেতন—এটাই অখণ্ডাকার-বৃত্তি।

ঘটাকার-বৃত্তি আর পটাকার-বৃত্তি—দুটোই অদ্বৈত বেদান্তে “বস্তুর-আকৃতি ধারণ-করা মনের পরিবর্তন” বোঝাতে উদাহরণ। ঘটাকার-বৃত্তি: যখন আমরা “ঘট/পাত্র” দেখি, তখন অন্তঃকরণ (মন-বুদ্ধি) ওই ঘটের মতো আকৃতি নেয়—এই ঘট-রূপী মানসিক পরিবর্তনটাই ঘটাকার-বৃত্তি। (ধাপ এখানে দুটি: আগে বস্তুর উপর থাকা অজ্ঞতার আচ্ছাদন ভাঙে—vṛtti-vyāpti; তারপর চেতনার প্রভা সেই বৃত্তিকে আলোকিত করে—phala-vyāpti—তখুনি “এটা ঘট”, জ্ঞান জাগে।) একই কথা “পট/বস্ত্র” দেখার সময়ে—মন পটের আকৃতি নেয়; সেই পট-রূপী মানসিক পরিবর্তনই পটাকার-বৃত্তি। (বস্তু বদলালে বৃত্তির ‘রূপ’ বদলায়, নীতিটা একই থাকে।)

যাকে দেখছি, মনের বৃত্তি তারই ākāra নেয়—ঘট হলে ঘটাকার-বৃত্তি, পট হলে পটাকার-বৃত্তি; এই বৃত্তিকেই চিদ্‌-আলো (chidābhāsa) আলোকিত করলে প্রত্যক্ষ-জ্ঞান ঘটে। এই বৃত্তিই অবিদ্যার পর্দা ছিন্ন করে। যতক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞান-জ্ঞাতা-জ্ঞেয় এই তিনের ভেদ থাকে, ততক্ষণ অবিদ্যা বিদ্যমান। কিন্তু যখন অন্তঃকরণ ব্রহ্মাকার ধারণ করে, তখন এই ভেদ বিলুপ্ত হয়; জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয় একাকার হয়ে যায়। তখন আর কোনো প্রেক্ষাপট বা দ্বিতীয়তা থাকে না। তাই অখণ্ডাকার-বৃত্তি মানে এমন এক অন্তর্মনস্ক আলো, যা ব্রহ্মের চেতনা-সত্তার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশে যায়, এবং জ্ঞান-প্রক্রিয়া নিজেই সেখানে লীন হয়ে যায়।

অখণ্ডাকার-বৃত্তি উৎপন্ন হয় শ্রবণ, মনন ও নিধিধ্যাসনের পরিণতিতে—যখন মন সমস্ত দ্বৈত বিভ্রম ত্যাগ করে, “অহং ব্রহ্মাস্মি” এই জ্ঞানে স্থিত হয়। এই বৃত্তির কার্য হচ্ছে অবিদ্যার সম্পূর্ণ নাশ; জ্ঞান উদিত হলে অবিদ্যা বিলুপ্ত হয়, যেমন সূর্যোদয়ে অন্ধকার নিজে থেকেই লীন হয়। এরপর এই বৃত্তি নিজেও আর টিকে থাকে না; কারণ জ্ঞান সম্পূর্ণ হলে বৃত্তির কোনো প্রয়োজন থাকে না। যেমন প্রদীপের আলোয় জিনিস দেখা গেলে প্রদীপের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তেমনি অখণ্ডাকার-বৃত্তি জাগ্রত হলে তা নিজেই ব্রহ্মে লীন হয়।

অখণ্ডাকার-বৃত্তি বা ব্রহ্মাকার-বৃত্তি এমন এক পরম অন্তর্মুখী চৈতন্য-জাগরণ, যেখানে মন আর মন থাকে না, জ্ঞান আর প্রক্রিয়া থাকে না, কেবল থাকে ব্রহ্মের স্বরূপ—এক, নিরাকার, অবিভক্ত চেতনা। এই অবস্থাই জীবনমুক্তির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, যেখানে জানা, জানানো ও জানা-যাওয়া—সব এক হয়ে যায়।

ওঁ ধ্বনি আর ব্রহ্মের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে? এই আলোচনায় যাবার আগে নির্যাসটা পরিষ্কার করি—ব্রহ্ম (পরম, নির্গুণ, নিরাকার, জ্ঞান-স্বরূপ) আর “ওঁ” (প্রণব)—ধ্বনি/চিহ্ন—তত্ত্বগতভাবে এক জিনিস নয়; কিন্তু “ওঁ”-এর অর্থবোধ (বাচ্য) যাকে নির্দেশ করে, সেটাই ব্রহ্ম। কাজেই ধ্বনি-রূপ “ওঁ” সরাসরি ব্রহ্ম নয়; তবে “ওঁ”-উপাসনার সদর্থক ব্যবহার ঠিকই ব্রহ্ম-স্মরণ/ব্রহ্ম-নিষ্ঠায় পৌঁছাতে পথ দেখায়। কোনো গুরু-প্রবর্তিত “ওঁ”-সাধনা হলো ওই চিরন্তন প্রণব-উপাসনারই একটি শৈলী—উপায় (upāya); লক্ষ্য একটাই।

‘প্রণব’ শব্দের মূল ধাতু “নু” অর্থাৎ স্তব বা প্রার্থনা করা। “প্র” উপসর্গ যুক্ত হলে অর্থ দাঁড়ায় সর্বোচ্চ স্তবযোগ্য ধ্বনি। তাই প্রণব মানে সেই চিরন্তন শব্দ যা সমস্ত স্তবের মূল। এর ধ্বনিরূপ “ওঁ”—তিনটি অক্ষরে গঠিত: অ, উ, ম। “অ” জাগ্রত অবস্থা নির্দেশ করে, “উ” স্বপ্ন অবস্থা, “ম” সুষুপ্তি অবস্থা, আর এই তিনের পরের ‘নিঃশব্দ অংশ’ নির্দেশ করে তুরীয় বা পরম চেতনা।

উপনিষদ বলে, “ওঁ” ব্রহ্মের নাম, কিন্তু ব্রহ্ম নিজে কোনো শব্দ নয়; “ওঁ” কেবল সেই ব্রহ্মকে ইঙ্গিত করে, এমন প্রতীকধ্বনি। ধ্বনি-রূপ “ওঁ” ব্রহ্ম নয়, কিন্তু “ওঁ”-এর অর্থবোধই ব্রহ্ম।

ধ্যান বা জপে “ওঁ” উচ্চারণে চেতনা একাগ্র হয়, মন স্থির হয়। বেদের পাঠেও প্রতিটি মন্ত্রের আগে “ওঁ” বলা হয়, যাতে সেই মন্ত্র চিরন্তন সত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। যোগসূত্রে পতঞ্জলি বলেছেন—“তস্য বাচকঃ প্রণবঃ”—ঈশ্বরের প্রকাশধ্বনি প্রণব। অদ্বৈত বেদান্তে “ওঁ” হল ব্রহ্মস্মৃতির উপায়—ব্রহ্মের স্মরণে পৌঁছানোর সেতু। ধ্বনি নয়, ধ্বনির ইঙ্গিতই এখানে সত্য। অতএব, প্রণব একাধারে ধ্বনি, প্রতীক, উপাসনা ও তত্ত্ব—সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের চিরন্তন প্রতীক; আত্মা, জগৎ ও পরমাত্মার ঐক্যের এক শব্দময় সংকেত।

শাস্ত্র-দৃষ্টিতে “ওঁ” কী, ব্রহ্ম কী?
উপনিষদে “ওঁ”-কে সর্ববাচক ধ্বনি বলা হয়েছে—প্রথম মন্ত্রেই মাণ্ডূক্য উপনিষদ ঘোষণা করে যে, ওঁ (প্রণব) সর্বজগতের মৌলিক ধ্বনি-প্রতীক—যে-ধ্বনি সমগ্র অস্তিত্বকে ধারণ করে। পরবর্তী মন্ত্রগুলোতে এর বিশ্লেষণ করা হয়েছে: “অ”, “উ”, “ম”—এই তিন অক্ষর দ্বারা জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি অবস্থার প্রতীক, এবং নিঃশব্দ অমাত্রা অংশ দ্বারা তুরীয়, অর্থাৎ পরম, নির্গুণ, ব্রহ্ম-স্বরূপ অবস্থা নির্দেশিত হয়েছে। তিনটি অক্ষরের শেষে আসে নিঃশব্দ বিরাম, যেখানে কোনো ধ্বনি শোনা যায় না, কিন্তু চেতনা উপস্থিত থাকে—এই নীরব, ধ্বনিহীন অংশকেই বলা হয় অমাত্রা—অর্থাৎ, “যে-অংশ ধ্বনির পরেও আছে, কিন্তু ধ্বনি নয়”। এই নীরবতা/“আমাত্রা” আগের তিনকে আধার করে, এটাই তুরীয়—ধ্বনি-অতিক্রান্ত, নিরাকার ব্রহ্ম। অর্থাৎ “ওঁ” শব্দটি চিহ্ন/দিক-নির্দেশ; আর তা যে-বাস্তবতাকে নির্দেশ করে, সেটি ধ্বনিরও পার/অতীত।

যোগসূত্র বলে, “তস্য বাচকঃ প্রণবঃ”—ঈশ্বরের বাচক/নাম রূপে প্রণব (১.২৭); গীতা (১৭.২৩) বলে, “ওঁ তৎ সৎ”—এই তিন শব্দই ব্রহ্মের নির্দেশ বলে স্মরণ করা হয়েছে। এদের দ্বারা ব্রাহ্মণগণ প্রাচীন কালে বেদ ও যজ্ঞ স্থাপন করেছিলেন। এখানে “ওঁ তৎ সৎ” ব্রহ্মের ত্রিবিধ চিহ্ন; যা সমস্ত শুদ্ধ কর্মকে পবিত্র করে—প্রণব তাই ব্রহ্ম-স্মরণের সোপান। শঙ্করাচার্য “ওঁ” বা প্রণব সম্পর্কে বহু স্থানে লিখেছেন—বিশেষত মাণ্ডূক্য উপনিষদ, গীতা এবং ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে।

মাণ্ডূক্য উপনিষদের প্রথম মন্ত্রে বলা হয়েছে—“ওঁ—এই অক্ষরই সব কিছু।” শঙ্করাচার্য এখানে ব্যাখ্যা করেছেন যে, “ওঁ” হলো ব্রহ্মের নাম; “অ”, “উ”, “ম”—এই তিন অংশ জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি অবস্থার প্রতীক, আর শেষের নিঃশব্দ অংশ নির্দেশ করে তুরীয়, অর্থাৎ পরম চেতনা। “ওঁ”-এর শব্দরূপ নয়, বরং এর অর্থবোধই ব্রহ্ম। “ওঁ”-জপ ব্রহ্মস্মরণের উপায়, কারণ ধ্বনি অতিক্রম করেই চেতনা নিজের সত্যরূপে স্থিত হয়। “A” হচ্ছে জাগ্রত/বাইরের বিশ্ব (বৈশ্বানর/বিরাট), “U” হচ্ছে স্বপ্ন/সূক্ষ্ম জগত (তৈজস/হিরণ্যগর্ভ), “M” হচ্ছে সুষুপ্তি/কারণ অবস্থা (প্রজ্ঞ/ঈশ্বর)—আর এগুলির পরের নীরবতা হচ্ছে তুরীয়/ব্রহ্ম। ফলে, ধ্বনি-জপের সিদ্ধি তখনই পূর্ণ হয়, যখন সাধকের মন ধ্বনির স্তর পেরিয়ে “আমাত্রা”-র নীরব নেত্রে স্থিত হয়—সচেতনার স্ব-প্রকাশে।

ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে শঙ্কর বলেন, প্রণব বা “ওঁ” সমস্ত বেদে ব্রহ্মের নির্দেশক শব্দ, কিন্তু ব্রহ্ম নিজে শব্দ নয়। এটি ব্রহ্মকে প্রকাশ করার প্রতীক। শব্দ ব্রহ্ম নয়, কিন্তু সেই শব্দের মাধ্যমে মন ব্রহ্মের দিকে যায়।

গীতার অষ্টম অধ্যায়ের ত্রয়োদশ শ্লোকে বলা হয়েছে—যে-ব্যক্তি দেহত্যাগের সময় “ওঁ” উচ্চারণ করে ঈশ্বরকে স্মরণ করে, সে পরম গতি লাভ করে। শঙ্করাচার্য ব্যাখ্যা করেছেন—“ওঁ-কার” ব্রহ্মের বাচক শব্দ, এবং যে-ব্যক্তি পরমার্থ ব্রহ্মে মন স্থাপন করে “ওঁ” উচ্চারণ করে, সে মুক্তি লাভ করে।

তৈত্তিরীয় উপনিষদে শঙ্কর বলেন—“ওঁ” ব্রহ্মের নাম এবং উপাসনার প্রধান প্রতীক। উপাসক যখন “ওঁ”-এর ধ্বনি ধরে ধ্যান করে, তখন তার চেতনা ধীরে ধীরে ধ্বনির সীমা অতিক্রম করে নিঃশব্দ তুরীয় অবস্থায় প্রবেশ করে।

কঠ উপনিষদে শঙ্কর বলেন—“ওঁ” ব্রহ্মপ্রবেশের দ্বার। “ওঁ”-এর ধ্বনি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় যে নিঃশব্দে, সেই নিঃশব্দেই ব্রহ্মের উপলব্ধি ঘটে।

শঙ্করাচার্যের দৃষ্টিভঙ্গি হলো—“ওঁ” ব্রহ্মের বাচক; “অ”, “উ”, “ম” তিনটি চেতনা-অবস্থা নির্দেশ করে; নিঃশব্দ অংশ তুরীয়, অর্থাৎ ব্রহ্ম। “ওঁ”-উপাসনায় মন একাগ্র হয়ে অবিদ্যা ভেঙে যায়। শঙ্করের মতে, “ওঁ” ধ্বনিরূপে ব্রহ্মের প্রতিফলন, আর ধ্বনিহীন নীরবতায় ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।

শব্দ-ব্রহ্ম আর পর-ব্রহ্ম: অদ্বৈতে দুই স্তর আলাদা করা হয়—(ক) śabda-brahman: বেদীয় ধ্বনি-প্রবাহ/প্রণব—যার সঙ্গে আমরা উপাসনা/জপ/ধ্যানে কাজ করি; (খ) para-brahman: সমস্ত নাম-রূপ-ধ্বনি-গুণাতীত। “ওঁ” হচ্ছে বাচক (signifier), ব্রহ্ম হচ্ছে বাচ্য (signified)। যে-মুহূর্তে উপাসনা “অর্থে” স্থির হয়, বাচক-ভেদ নিজে থেকেই নেমে যায়—চূড়ান্ত পর্যায়ে, নীরবতা-সচেতন তুরীয়-নিষ্ঠা। এটাই অদ্বৈতের বাচক-বাচ্য আলোচনা: প্রতীকের মানে ধরতে পারলে প্রতীক অতিক্রান্ত হয় (অধ্যারোপ-অপবাদ ন্যায়)।

ওঁ-সাধনার ধারাগুলি—উপনিষদ-যোগ-তন্ত্র-বেদান্ত:
ছান্দোগ্য উপনিষদে “উদ্গীথ-উপাসনা”—অর্থাৎ “ওঁ” ধ্বনির ধ্যান—সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের ধ্বনিরূপে ব্রহ্মচেতনার প্রতীক হিসেবে উপাস্য।
গীতায় “ওঁ”-স্মৃতিসহ প্রাণ-নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যেখানে ধ্বনি-স্মরণ ও প্রাণপ্রবাহের সংযম একত্রে মুক্তির পথ।
যোগসূত্রে প্রণবকে ঈশ্বর-প্রণিধানের মাধ্যম বলা হয়েছে, অর্থাৎ “ওঁ”-ধ্যান ঈশ্বরচিন্তনের শ্রেষ্ঠ উপায়।
তন্ত্রে প্রণবকে বীজমন্ত্র বলা হয়েছে, যেখান থেকে অন্যান্য সমস্ত মন্ত্রের শক্তি বিকশিত হয়।
বাক্‌-তত্ত্বে বলা হয়—বাকের চার স্তর: পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা, বৈখরী। “ওঁ” উচ্চারণ বৈখরী স্তরে শুরু হয়—বাইরের ধ্বনি হিসেবে; তারপর তা মধ্যমা স্তরে মনের অর্থবোধে রূপ নেয়; তারপর পশ্যন্তী স্তরে পৌঁছে অন্তঃপ্রতীতি বা গভীর চেতনায়; শেষে নিঃশব্দ পরা-বাক্‌-এ মিলিয়ে যায়—যেখানে ধ্বনি ও অর্থ উভয়ই বিলীন হয়ে কেবল চেতনা অবশিষ্ট থাকে।

এই কারণেই গুরু যে “ওঁ”-জপ বা ধ্যানের বিশেষ পদ্ধতি শেখান—উচ্চারণ, মাত্রা, শ্বাসপ্রবাহ, নাদানুসন্ধান ইত্যাদি—তা আসলে শাস্ত্রসম্মত উপায়গুলিরই নানা প্রয়োগভেদ। দীক্ষার ভঙ্গি বা অনুশীলনের রীতি ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু দর্শনগত লক্ষ্য একটাই—ধ্বনির অন্তঃস্বরূপে পৌঁছে পরা-চেতনায় (আত্মবোধে) স্থিত হওয়া।

প্রতীককে অতিক্রম—অলধ্যারোপ-অপবাদ ও পথ্য-সত্য: শাস্ত্র প্রথমে প্রতীক আরোপ করে—মন নোঙর পাক, ভক্তি-একাগ্রতা জন্মাক (অধ্যারোপ)। পরিণত বোধ এলে তা বলে—প্রতীক ত্যাগ করে অর্থে স্থির হও (অপবাদ)। তাই “ওঁ” হলো পথ্য-সত্য: চিকিৎসকসুলভ উপায়, গন্তব্য নয়। নৌকা নদী পার করায়; ওপারে গেলে নৌকাই ফেলে আসতে হয়। মাণ্ডূক্যের “আমাত্রা” সেই ফেলে-আসা বিন্দু—ধ্বনি-নিস্তব্ধ, সচেতনতা-মাত্র।

গুরু যে-ই হন—রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের পরম্পরা, চিন্ময় বা দশনাম শঙ্কর-পরম্পরা (দশনাম শঙ্কর (Daśanāma Śaṅkara) বলতে বোঝানো হয় আদি শঙ্করাচার্যে-প্রবর্তিত সন্ন্যাস-পরম্পরা, যেখানে সন্ন্যাসীদের দশটি নাম বা উপাধি নির্ধারণ করা হয়েছে—“দশ-নাম-পরম্পরা”), কিংবা অন্য কোনো বৈদিক বা যোগীয় গুরু—সবাই “ওঁ”-চিন্তনের এক মূল সত্যকেই কেন্দ্র করে কাজ করেন। পার্থক্য থাকে কেবল অনুশীলনের শৈলীতে। কেউ মাত্রা-রীতি শেখান—“অ-উ-ম” কীভাবে উচ্চারণ হবে, কতক্ষণ ধরে হবে; কেউ নিশ্বাসের লয় মেলান—শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার সঙ্গে ধ্বনির সামঞ্জস্য রাখেন; কেউ নাদের ধ্যান শেখান—অন্তর্নিহিত শব্দ বা অনাহত নাদের অনুধাবন; কেউ দেহভঙ্গি ও দৃষ্টি-বন্ধের ভিন্ন পদ্ধতি দেন। এগুলি সবই উপায়গত, তত্ত্বগত নয়।

কোনো গুরুই “ওঁ”-কে অস্তিত্বতাত্ত্বিকভাবে নতুন কিছু বানান না। “ওঁ” চিরন্তন, বেদের মূল ধ্বনি, ব্রহ্মের প্রতীক। গুরু কেবল এর ধ্যানকে সহজ, সুরক্ষিত ও নিয়মিতভাবে অভ্যাসযোগ্য করে তোলেন। গুরু-অনুশাসনের উদ্দেশ্য তত্ত্ব প্রবর্তন নয়—বরং অনুশীলনের তিনটি দিক নিশ্চিত করা:
অভ্যাসযোগ্যতা, যাতে শিষ্য ধীরে ধীরে গভীর হতে পারে; স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা, যাতে শ্বাস-প্রশ্বাস, স্নায়ু ও মন সুষম থাকে; আর নিয়মিততা, যাতে ধ্যান অভ্যাসে পরিণত হয়।