অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: তেষট্টি



৬. অভিমুখী ভূমি (Abhimukhī-bhūmi)—প্রত্যক্ষ স্তর / Face-to-Face Stage—এখন বোধিসত্ত্ব সত্যকে সরাসরি অভিজ্ঞতা করতে থাকেন। এটি একধরনের “অপরোক্ষানুভূতি”—যেখানে জ্ঞান আর তত্ত্ব নয়, এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা। তিনি জানেন—সব কিছু শূন্য, তবুও সব কিছু করুণার দ্বারা যুক্ত। এটি বৌদ্ধ দর্শনের অদ্বৈত বোধের সূচনা।

৭. দূরমগা ভূমি (Dūraṅgamā-bhūmi)—দূরগামী স্তর / Far-Going Stage—এখন বোধিসত্ত্ব এমন অবস্থায় পৌঁছান, যেখানে তাঁর কর্ম কেবল চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ—কোনো অহংকার বা প্রত্যাশা ছাড়াই। এটি উপায়-কৌশল (Skillful Means)-এর পর্যায়—যেখানে তিনি অন্যদের সাহায্য করেন তাদের মানসিক অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে—এ যেন জল যেমন পাত্র নেয়, তেমন আকার নেয়। এখানে করুণা এক শিল্পে পরিণত হয়।

৮. অচল ভূমি (Acalā-bhūmi)—অচল স্তর / Immovable Stage—এটি বোধিসত্ত্বের স্থিতি ও সমবিকারহীনতার স্তর। তিনি এখন অদ্বৈত সত্যে অবিচলভাবে প্রতিষ্ঠিত। বাইরের কোনো পরিবর্তন, প্রশংসা বা নিন্দা তাঁকে নড়াতে পারে না। এই স্তরে তাঁর করুণা “নির্বিকার”—সব জীবের প্রতি সমান, নিরপেক্ষ ও নিঃশর্ত।

৯. সদ্বিমুক্তি ভূমি (Sādhumatī-bhūmi)—সদ্বিবেক স্তর / Perfect Intellect Stage—এখন বোধিসত্ত্বের প্রজ্ঞা সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে ওঠে। তাঁর বোধ কেবল তাত্ত্বিক নয়—তিনি জানেন, কীভাবে প্রতিটি প্রাণের সঙ্গে সহানুভূতিতে কথা বলতে হয়। এই স্তরে তাঁর শিক্ষা স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়। তিনি এক জীবন্ত “ধর্মচক্র” হয়ে ওঠেন।

১০. ধর্মমেঘ ভূমি (Dharmamegha-bhūmi)—ধর্মমেঘ স্তর / Cloud of Dharma Stage—এটি সর্বোচ্চ স্তর—যেখানে বোধিসত্ত্ব এখন বুদ্ধত্বে সম্পূর্ণ একীভূত। তাঁর চেতনা আকাশের মতো বিস্তৃত, যেখানে করুণা বৃষ্টি হয়ে ঝরে সকল জীবের উপর। এখানে তাঁর সমস্ত কর্ম স্বতঃসিদ্ধ, নিঃশর্ত ও অনন্ত। এটাই পরিপূর্ণ বোধি (Anuttarā Samyaksaṃbodhi)—অর্থাৎ, পরম জাগরণ।

এই দশ ভূমি কোনো কেবল বাইরের ধাপ নয়—এগুলি হলো চেতনার অভ্যন্তরীণ বিবর্তনের মানচিত্র। বোধিসত্ত্বের পথ শুরু হয় আনন্দ থেকে; অতিক্রম করে জ্ঞান, করুণা, স্থিতি ও নিঃশর্ত সমবেদনা; এবং শেষ হয় অদ্বৈত জাগরণে—যেখানে ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন এক হয়ে যায়। যেমন বুদ্ধ বলেছিলেন—“যখন করুণা ও প্রজ্ঞা একই শ্বাসে প্রবাহিত হয়, তখনই বোধিসত্ত্ব জন্ম নেন।”

মহাযানের দার্শনিক ও মানবতাবাদী সারাংশ: মহাযান বৌদ্ধধর্মের দৃষ্টিকে প্রশস্ত করেছে। এটি কেবল ব্যক্তিগত মুক্তি নয়, বরং সমগ্র জীবের মুক্তি—এক মহাজাগতিক করুণার সাধনা। এখানে বুদ্ধ আর কেবল ঐতিহাসিক ব্যক্তি নন, বরং চেতনার প্রতীক—যা প্রত্যেকের মধ্যে জাগ্রত হতে পারে।

“সব জীবেই বুদ্ধত্ব নিহিত আছে।”—তথাগতগর্ভ সূত্র। অতএব, মহাযান মানবতাকে এক অদ্বৈত চেতনায় যুক্ত করে, যেখানে “আমি” ও “অন্য” আলাদা নয়, সবই এক অনন্ত সহাবস্থানের প্রকাশ। মহাযান কোনো নতুন ধর্ম নয়, বরং বৌদ্ধ ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিবর্তন—যেখানে করুণা, প্রজ্ঞা ও শূন্যতা একত্র হয়ে মুক্তির এক অসীম ও সমবেদনার পথ তৈরি করেছে। এখানে মুক্তি মানে শুধু দুঃখের অবসান নয়, বরং এমন এক জাগরণ, যেখানে সমগ্র জগৎই বুদ্ধত্বে উদ্‌ভাসিত।

দার্শনিক পরিণতি: চতুষ্কোটি-ভঙ্গের পর বাস্তবতা আর “হ্যাঁ-না”-র ভাষায় বর্ণনাযোগ্য থাকে না। এখানে ভাষা থেমে যায়, চিন্তা বিলীন হয়, এবং যা অবশিষ্ট থাকে, তা হলো শূন্যতা (śūnyatā)—না কিছু, না কিছু নয়—শুধু অচিন্ত্য, নিরূপণাতীত, চিরশান্ত অস্তিত্ব।

চতুষ্কোটি: অস্তি, নাস্তি, উভয়, উভয় নয়—চিন্তার চার সীমা। চতুষ্কোটি-বিনির্মুক্ত—এই চার সীমা ভেঙে মধ্যপথে স্থিত হওয়া—যেখানে না অস্তিত্ব, না অনস্তিত্ব, বরং চেতনার নিস্তব্ধ প্রত্যক্ষতা। নাগার্জুনের কৃতিত্ব এই যে, তিনি প্রমাণ করেন, সত্য কোনো প্রস্তাব নয়, কোনো অবস্থাও নয়, বরং সমস্ত প্রস্তাব ও অবস্থার অতিক্রম—একমাত্র অদ্বৈত অভিজ্ঞতা, যা বিস্তৃত বুদ্ধের “চতুষ্কোটিবিনির্মুক্ত শূন্যতা” থেকে শঙ্করাচার্যের “অদ্বৈত চৈতন্য (Brahman)” পর্যন্ত—যেখানে দুই প্রাচীন ভারতীয় পথই এক গভীর, অভিজ্ঞতাভিত্তিক অদ্বৈত সত্য নির্দেশ করে, যদিও তাদের ভাষা, পদ্ধতি ও লক্ষ্যগত ব্যাখ্যা আলাদা।

বুদ্ধের চতুষ্কোটিবিনির্মুক্ত মধ্যপথ: বুদ্ধ ও পরে নাগার্জুন যে “চতুষ্কোটিবিনির্মুক্ত” দর্শন স্থাপন করেন, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল—মানব-চিন্তার দ্বৈত সীমা ভাঙা। “অস্তি” (আছে) ও “নাস্তি” (নেই)—এই দুই প্রান্তের কোনো একটিরও মধ্যে সত্যকে খুঁজলে তা মিথ্যা হয়ে যায়। প্রায় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে নাগার্জুন দেখালেন: “যা-কিছু প্রতীত্যসমুৎপন্ন, তা-ই শূন্য।” “সংসার ও নির্বাণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।” অর্থাৎ, বাস্তবতা এমন এক মধ্যবিন্দু, যেখানে “অস্তিত্ব” ও “অনস্তিত্ব” উভয় ধারণাই বিলীন হয়। এই দর্শন তাই বলে—“সত্য চিন্তার অতীত; এটি চতুষ্কোটিবিনির্মুক্ত।” এটি কোনো সত্তা নয়, কোনো অভাবও নয়; এটি অচিন্ত্য শূন্যতা (acintya śūnyatā)—পরম শান্তি।

অদ্বৈত বেদান্তে ব্রহ্মের ধারণা: শঙ্করাচার্য, প্রায় ছয় শতাব্দী পর অষ্টম শতাব্দীতে এসে, অদ্বৈত বেদান্তে ঘোষণা করলেন—“ব্রহ্ম সত্যম্, জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।”—ব্রহ্মই একমাত্র সত্য; জগৎ আপাত ও মায়াময়; জীব ও ব্রহ্ম এক। এখানে “ব্রহ্ম” হলো চিরচৈতন্য, যা অপরিবর্তনীয়, অদ্বৈত, ইন্দ্রিয় ও ভাষার অতীত। অদ্বৈতে মুক্তি (মোক্ষ) মানে—নিজেকে ব্রহ্মরূপে উপলব্ধি করা, অর্থাৎ “অহং ব্রহ্মাস্মি”—সরাসরি এই অপরোক্ষানুভূতি।

শূন্যতা ও ব্রহ্ম—মিল ও অমিল: এখন দেখা যাক, এই দুই তত্ত্বের মধ্যে গভীর মিল ও সূক্ষ্ম পার্থক্য।

দ্বন্দ্বের অতীততা: দু-জনেই বলেন, সত্য কোনো “হ্যাঁ–না”-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বুদ্ধের শূন্যতা চতুষ্কোটিবিনির্মুক্ত; শঙ্করের ব্রহ্ম “নির্বিশেষ, নিরুপাধিক, নিরগুণ”—অর্থাৎ চিন্তা ও গুণের অতীত।

ভাষার সীমা: উভয়ই বলে—সত্যকে শব্দে প্রকাশ করা যায় না। তৈত্তিরীয় উপনিষদের ব্রহ্মানন্দবল্লী অধ্যায়ের ২.৯ নং শ্লোকটি দেখি—“যতো বাকো নিবর্তন্তে, অপ্রাপ্য মনসা সহ।/আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্‌ ন বিভেতি কুতশ্চন ইতি। এর অর্থ: “যেখান থেকে বাক্‌ (বাণী) ও মন উভয়েই ফিরে আসে, তাকে না পেয়ে—সেই ব্রহ্মের আনন্দকে যিনি জানেন, তিনি আর কোনো কিছুকে ভয় পান না।”

ভাষা সর্বদা দ্বৈত কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে—সত্য-মিথ্যা, আছে-নেই, এক-অন্য, ভালো-মন্দ। কিন্তু শূন্যতা এই সব দ্বৈততার উৎসের আগের অবস্থা। যেখানেই আমরা যাই—মন কিছু নাম দিতে চায়, কিন্তু শূন্যতা নামের আগে, চিন্তার আগে, ধারণার আগে। তাই উপনিষদের মতোই (যত্র বাচো নিবর্তন্তে, অপ্রাপ্য মনসা সহ) বৌদ্ধরাও বলেন—যেখানে ভাষা ও মন ফিরে আসে, যাকে তারা ধরতে পারে না—সে-ই শূন্যতার পরম অবস্থা। এ এমন এক শূন্যতা, যাকে বলা যায় না, বোঝানো যায় না, কিন্তু যা সর্বপ্রকার কথন, দ্বন্দ্ব ও চিন্তার সীমা অতিক্রম করে নিজেই নিজেকে প্রকাশ করে। নাগার্জুন বলেন, “শূন্যতা নির্বচনীয় নয়, কারণ তা সব বচনের ভিত্তি।” এটি বৌদ্ধ দর্শনের অন্যতম গভীর ও সূক্ষ্ম স্তরে, বিশেষ করে নাগার্জুনের মাধ্যমক দর্শন ও পরবর্তীকালের প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রসমূহ-এর ব্যাখ্যায় এই ধারণাটি আছে—“নির্বচনীয়তীতম্‌ শূন্যতা” (নির্বচনীয় (nirvacanīya): যাকে বর্ণনা করা যায় বা নাম দিয়ে ধরা যায়, অতীত (atīta): যা তারও অতীত বা ওপারে; অর্থাৎ, নির্বচনীয়তীতম্‌ মানে—যা সমস্ত ভাষা, ধারণা ও চিন্তার সীমা অতিক্রম করেছে।)

অভিজ্ঞতামূলক উপলব্ধি: বুদ্ধ বলেন, শূন্যতা বুদ্ধির উপলব্ধি নয়, বরং প্রজ্ঞার অভিজ্ঞতা। শঙ্কর বলেন, ব্রহ্মজ্ঞানও কোনো ধারণা নয়, বরং অপরোক্ষানুভূতি—আত্মানুভব।

মুক্তির প্রকৃতি: দু-জনের কাছেই মুক্তি মানে—মন, অহং ও তৃষ্ণার বিলোপ। বৌদ্ধের “নির্বাণ” ও বেদান্তের “মোক্ষ” উভয়ই চূড়ান্ত নিস্তব্ধতা ও চৈতন্যের বিশ্রাম।

অমিলসমূহ (দার্শনিক পার্থক্য):

চেতনার অস্তিত্ব: বৌদ্ধ মধ্যমকে চেতনা-সহ সমস্ত কিছুই “নিরস্বভাব” (স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বহীন); অদ্বৈতে চেতনা বা আত্মাই একমাত্র চিরন্তন বাস্তব।

বাস্তবতার অস্তিত্বগত অবস্থান বা সত্তাতাত্ত্বিক মর্যাদা (ontological status): বৌদ্ধ শূন্যতা বলে না যে, কিছুই নেই, বরং “স্বত্বহীন সম্পর্কনির্ভরতা”-র উপর জোর দেয়; অন্যদিকে বেদান্তের ব্রহ্ম হচ্ছে “স্বপ্রকাশমান, চিরসত্তা”—যা অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়।

নির্বাণ বনাম মোক্ষ: নির্বাণে সব অনন্ত প্রক্রিয়ার অবসান ঘটে; মোক্ষে আত্মা তার প্রকৃত অবস্থায় স্থিত হয়—“সত্তা-চৈতন্য-আনন্দ” রূপে।

পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি: বৌদ্ধ তত্ত্ব বিশ্লেষণাত্মক (চিন্তার গঠন ভেঙে দেয়); বেদান্ত অভিন্নতামূলক (চিন্তাকে একত্বে রূপান্তর করে)।

জেন (Zen) ও অদ্বৈতের সংযোগ: জেন (চান) বৌদ্ধধর্ম মূলত মধ্যমকের এই “চতুষ্কোটি-বিনির্মুক্ত” দর্শনের জীবন্ত অনুশীলন। জেন দর্শনে বলা হয়—“যখন তুমি চিন্তা করছ না, তখনই সত্যকে দেখছ।” “No mind, no self—only suchness (tathatā).” এখানে “শূন্যতা” কোনো ভাবনা নয়; এটি নিঃচিন্ত-চেতনা, যেখানে সব ভাব-আকার মিলিয়ে যায় এক নিখাদ উপস্থিতিতে।

অদ্বৈতেও একই কথা বলা হয়—“মনঃনাশঃ লয়ো নৈব, মানসো ব্রহ্মদর্শনম্।” (মন ধ্বংস নয় (হয় না), মন ব্রহ্মে লীন হওয়া (হয়)।) অর্থাৎ, উভয়েই বলে—চিন্তা থামলে, চিন্তার উৎস প্রকাশিত হয়। একজন একে বলে “শূন্যতা”, অন্যজন বলে “চৈতন্য”।

দর্শনের গভীর ঐক্য: দুটি পথের মিলকে এক বাক্যে বলা যায়—শূন্যতা ও ব্রহ্ম, নৈরাত্ম্য ও আত্মা, নির্বাণ ও মোক্ষ—সবই এক অভিজ্ঞতার দুই ভাষা। যেখানে মন নিজের সীমানা অতিক্রম করে, সেখানে যা থাকে—তা—না “আছে”, না “নেই”, বরং অচঞ্চল নীরবতা, অদ্বৈত চেতনা, বা শূন্যতা—যা-ই বলা হোক, তা অবর্ণনীয়।

বুদ্ধ: “চতুষ্কোটিবিনির্মুক্ত শূন্যতা—দ্বৈত চিন্তার বিলুপ্তি।” শঙ্কর: “অদ্বৈত চৈতন্য-জ্ঞান-জ্ঞেয়-জ্ঞাতা’র ঐক্য।” দু-জনেই বলেন, সত্য—চিন্তার বাইরে, শব্দের বাইরে, কিন্তু অভিজ্ঞতার মধ্যে।

দার্শনিক সারসংহতি: অদ্বৈত বলে—চূড়ান্ত বাস্তবতা চেতনার পূর্ণতা। মাধ্যমক বলে—চূড়ান্ত বাস্তবতা চিন্তার শূন্যতা। কিন্তু চেতনার পূর্ণতা ও চিন্তার শূন্যতা—দুটিই একই বিন্দুতে মিলিত হয়—একটি এমন অবস্থায়, যেখানে কোনো দ্বৈততা, ধারণা, বা ভাষা অবশিষ্ট থাকে না।

অদ্বৈতের “সচ্চিদানন্দ” ও মাধ্যমকের “শূন্যতা”—দুই নাম, এক অভিজ্ঞতা। অদ্বৈতের ব্রহ্ম শূন্য নয়, কিন্তু তার কোনো গুণ নেই। মাধ্যমকের শূন্যতা শূন্য, কিন্তু সেই শূন্যতাই সর্বগুণের সম্ভাবনা। ব্রহ্ম হলো শূন্যতার স্ব-প্রকাশিত রূপ, আর শূন্যতা হলো ব্রহ্মের নির্লিপ্ত আয়না।

অন্ত-এর সাযুজ্য: অদ্বৈত ও মাধ্যমক—দুটি দার্শনিক নদী, যাদের উৎস আলাদা হলেও গন্তব্য একই। একটি প্রবাহিত হয় অস্তিত্বের অন্তর্গত ঐক্যর দিকে, অন্যটি প্রবাহিত হয় অস্তিত্বের অন্তর্গত শূন্যতার দিকে, কিন্তু তারা দু-জনেই মিলিত হয় নীরবতার সমুদ্রে। সেই নীরবতা—না পূর্ণ, না শূন্য; না ব্রহ্ম, না নির্বাণ/নিব্বান; না অস্তিত্ব, না অনস্তিত্ব—বরং উভয়েরও অতীত, যা কেবল অনুভব করা যায়, বলা যায় না। যাকে অদ্বৈত বলে “ব্রহ্ম”, আর মাধ্যমক বলে “শূন্যতা”—তা আসলে একটিই—চেতনার নীরব সত্য, যেখানে জানা-ও বিলীন, জানা-টা যে জানে, সে-ও বিলীন। সেখানেই ব্রহ্ম ও শূন্যতা একে অপরের ছায়া, একই পরম আলোয় মিশে থাকে—নাম ভিন্ন, অথচ সত্তা এক, যেমন নীরবতা ও অনন্ততা একই উপস্থিতির দুই দিক। যেখানে ভাবনা থামে, সেখানে দর্শন শুরু হয়; যেখানে ভাষা থামে, সেখানে ব্রহ্ম ও শূন্যতা মিলিত হয়। সেই মিলনবিন্দুই সত্যের একমাত্র আবাস—যা চেতনার পরম নিস্তব্ধতায় চিরকাল দীপ্ত, অথচ চিরকাল নির্বাক।

তথতা (Tathatā) নিয়ে কিছু কথা বলি। তথতা মানে—“যেমন আছে, তেমনই থাকা”। তথতা (পালি: tathatā) শব্দের অর্থ “suchness” বা “thusness”—অর্থাৎ, বাস্তবতা যেমন আছে, তেমনই। এটি বৌদ্ধ দর্শনের এমন একটি শব্দ, যা সমস্ত চিন্তা, বিচার, নাম ও ভাষার সীমার বাইরে এক নিঃশব্দ বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে।