অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: তেপান্ন



পঞ্চস্কন্ধ—রূপ, বেদনা, সঞ্জ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান—এদের পারস্পরিক নির্ভর সংযোগেই “পুদ্গল” নামে আমরা যাকে চিনি, সে প্রকাশ পায়। এটি এমন এক “অভিজ্ঞতার প্রবাহ” যেখানে কোনো কেন্দ্র নেই, তবু ধারাবাহিকতা আছে—যেমন নদী সবসময় বদলাচ্ছে, কিন্তু “নদী” বলে আমরা তাকে ঠিক চিনে নিই। তাই বলা হয়—“পুদ্গল পঞ্চস্কন্ধে অবস্থিত নয়, কিন্তু পঞ্চস্কন্ধ ছাড়া পুদ্গলও নেই।” অর্থাৎ, পুদ্গল কোনো স্কন্ধ নয়, তবু স্কন্ধের সমষ্টিতেই পুদ্গলের প্রতীতি জন্মায়।

বৌদ্ধ ইতিহাসে এক বিশেষ ধারার নাম “পুদ্গলবাদ” (Pudgalavāda)—যা প্রথমদিকের সংঘাবশিষ্ট (Theravāda-এর পূর্ববর্তী) শাখাগুলির মধ্যে বিশেষ করে সমিতীয় বিদ্যালয় (Sammitīya) প্রচার করেছিল। এই মতানুসারে—যদিও আত্মা নেই, তবু এক “ব্যক্তি” (পুদ্গল) আছে, যিনি কর্ম করেন, ফল ভোগ করেন, এবং মুক্তি অর্জন করেন। তাঁদের যুক্তি ছিল: যদি একেবারে কোনো “ব্যক্তি” না থাকে, তবে কে কর্মফল ভোগ করবে? কে মুক্ত হবে? তাহলে নৈতিক দায়বদ্ধতা ও কর্মতত্ত্ব অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাঁরা বলেন—পুদ্গল না ‘আত্মা’, না ‘অ-আত্মা’, বরং এক “অনির্বচনীয় সত্তা” (avācya pudgala)—যিনি কেবল অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতার মাধ্যমে বোঝা যায়।

তবে এই মতবাদ বুদ্ধের মূল অনাত্মবাদ থেকে কিছুটা বিচ্যুত বলে বিবেচিত হয়েছে। থেরবাদী ও সার্বাস্তিবাদী ভিক্ষুরা পুদ্গলবাদের বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ তাঁরা মনে করেন—যেখানে অনিত্য ও অনাত্ম, সেখানে কোনো “ব্যক্তি” রাখার জায়গা নেই। বৌদ্ধ যুক্তির দিক থেকে “পুদ্গল” ধারণা এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করে—এটি না একেবারে আত্মার স্বীকৃতি, না আবার পূর্ণ নৈরাশ্যবাদ। এটি বলে—অভিজ্ঞতার ধারক বলতে কিছু নেই, তবু অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা আছে। এই ধারাবাহিকতার নামই “পুদ্গল”—যে প্রতি মুহূর্তে ভিন্ন, তবু ধারায় এক। অতএব, “আমি” নেই—তবু “আমি হচ্ছি”—এই বোধই বৌদ্ধ দর্শনে নৈরাত্ম্য-নৈরবতার মধ্যপথ।

পঞ্চস্কন্ধের মৌলিক অর্থ: “স্কন্ধ” (Skandha) শব্দের আক্ষরিক অর্থ—গুচ্ছ, স্তূপ, বা সংগ্রহ। অর্থাৎ, পাঁচটি মানসিক-শারীরিক উপাদান মিলে গঠিত এই “সত্তা”-র নামই পঞ্চস্কন্ধ। এই পাঁচটি উপাদান একত্রে কাজ করে “আমি”-বোধের প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করে, কিন্তু প্রত্যেকটি নিজেই অনিত্য, পরস্পরনির্ভর এবং অনাত্ম। এরা হলো:

ক. রূপ (Rūpa)—দেহ বা পদার্থগত উপাদান। রূপ মানে আমাদের শারীরিক দেহ ও এর বস্তুজ গঠন—চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক ও মন (ষড়ায়তন)-এর ভৌতিক ভিত্তি। এটি পাঁচটি মহাভূত (পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ)-এর সমন্বয়ে গঠিত। রূপ অনিত্য—দেহ পরিবর্তিত হয়, নষ্ট হয়, পুনর্জন্ম নেয়; তাই এর ভেতরে কোনো স্থায়ী আত্মা নেই।

খ. বেদনা (Vedanā)—অনুভূতি বা সংবেদন। রূপ ও চেতনার মিলনে যখন কোনো বস্তু অনুভূত হয়, তখন জন্ম নেয় বেদনা। এটি সুখ, দুঃখ বা নিরপেক্ষ হতে পারে। বেদনা নিজে নিরপেক্ষ, কিন্তু আমরা তাকে আঁকড়ে ধরলেই দুঃখ শুরু হয়। বুদ্ধ বলেন—“যা অনুভব করো, তা বুঝে দেখো; যা বুঝবে, তা ছাড়ো।” বেদনা হলো সংযোগবিন্দু—যেখান থেকে তৃষ্ণা জন্ম নেয়।

গ. সঞ্জ্ঞা (Saṃjñā)—ধারণা বা স্বীকৃতি। সঞ্জ্ঞা হলো চিন্তার সেই প্রক্রিয়া, যার দ্বারা আমরা অভিজ্ঞতাকে নাম, রূপ ও পরিচয়ে চিনে নিই। যেমন দৃশ্য দেখে বলি, “এটা গাছ”, “এটা মানুষ”। সঞ্জ্ঞা স্মৃতি ও মানসিক প্রতীকের ওপর নির্ভর করে। এটি জগতকে অর্থ দেয়, কিন্তু সেই অর্থ সবসময় প্রকৃত নয়। অতএব, সঞ্জ্ঞা মিথ্যা ধারণা বা বিভ্রমের উৎসও হতে পারে।

ঘ. সংস্কার (Saṃskāra)—মানসিক গঠন ও প্রেরণা। সংস্কার মানে মনোবৃত্তি, ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও অভ্যাস। এরা কর্মের বীজ সৃষ্টি করে এবং ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করে। অবিদ্যা থাকলে সংস্কার দুঃখের চক্রকে চালু রাখে; জ্ঞান জন্মালে সংস্কার শান্ত হয়। অর্থাৎ, সংস্কার হলো মানসিক প্রতিক্রিয়া-প্রবাহ, যা অভিজ্ঞতার প্রতি প্রতিনিয়ত প্রতিক্রিয়া তৈরি করে—“আমি চাই”, “আমি চাই না”, “আমি ভয় পাচ্ছি”—এর সবই সংস্কার।

ঙ. বিজ্ঞান (Vijñāna)—চেতনা বা জ্ঞানের প্রবাহ। বিজ্ঞান মানে সচেতনতা—জানার ক্রিয়া। এটি কোনো স্থির সত্তা নয়, বরং ক্রমাগত জন্ম ও বিলয়ের প্রবাহ। চেতনা জন্ম নেয় স্পর্শে (ইন্দ্রিয় + ইন্দ্রিয়বস্তু + মনসংযোগে), এবং মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ, বিজ্ঞান কোনো “জানার আত্মা” নয়; এটি এক ধারা—জানার ধারাবাহিকতা।

অনাত্ম (Anatta / Anātman)—আত্মার অনুপস্থিতির দার্শনিক উপলব্ধি। বৌদ্ধ দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে যে-তত্ত্বটি সবচেয়ে বেশি বিপ্লব এনেছিল, সেটিই অনাত্মবাদ। এই তত্ত্ব একদিকে উপনিষদীয় “আত্মা”-বোধের চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে মানবচেতনার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনের এক গভীর পথ। “অনাত্ম” শব্দের অর্থ—“আত্মা নেই”। কিন্তু এটি কেবল কোনো নেতিবাচক অস্বীকার নয়; বরং অস্তিত্বের গূঢ় প্রকৃতিকে উন্মোচন করার এক ইতিবাচক জ্ঞান। এখন আমরা দেখব—“আত্মা” (Ātman) এবং “অনাত্ম” (Anātman) ধারণার মধ্যে মৌলিক দার্শনিক পার্থক্য ও গভীর সাযুজ্য। দুটিই মুক্তির সন্ধানে জন্ম নেওয়া দুটি মহান পথের দৃষ্টিভঙ্গি—একটি উপনিষদীয়, অপরটি বৌদ্ধ। কিন্তু তারা মুক্তিকে দেখে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোণ থেকে।

উপনিষদীয় আত্মা: চিরন্তন স্বরূপের উপলব্ধি—উপনিষদীয় দর্শনে “আত্মা” মানে সেই পরম চেতনা, যা অপরিবর্তনীয়, নিত্য ও সর্বব্যাপী। এই আত্মাই ব্রহ্ম—“অহং ব্রহ্মাস্মি” (আমি ব্রহ্ম)—এ কথা বলেই ঋষিরা ঘোষণা করেছিলেন যে, মুক্তি মানে নিজের অন্তঃসত্তাকে চেনা। এই আত্মা কোনো ব্যক্তি নয়, কোনো মানসিক অবস্থা নয়; এটি সমস্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী—যে দেখে, কিন্তু নিজে পরিবর্তিত হয় না; যে জানে, কিন্তু কখনও জানার বিষয় হয় না।

উপনিষদ বলে, “যে আত্মাকে জানতে পারে, সে অনন্ত, সে অমর, সে নিত্যসত্তা।” অতএব, উপনিষদীয় মুক্তি হলো আত্মস্বরূপ-উপলব্ধি—জাগতিক পরিচয়ের পেরিয়ে সেই এক, অদ্বৈত, পরম চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া।

বৌদ্ধ অনাত্ম: স্বরূপের শূন্যতা ও অনিত্যতার উপলব্ধি—বুদ্ধ এই “আত্মা” ধারণার ওপরই প্রশ্ন তোলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন—যে-দেহ পরিবর্তিত হয়, যে-মন প্রতিক্ষণে বদলায়, যে-অনুভূতি আসে-যায়—তার ভেতরে কোথায় সেই অপরিবর্তনীয় আত্মা? বুদ্ধ দেখান, “আমি” নামে যা ধরা হয়, তা আসলে পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টি—দেহ, অনুভূতি, ধারণা, মানসিক গঠন ও চেতনার প্রবাহ।

এ সবই অনিত্য, শর্তসাপেক্ষ, এবং কোনো চিরস্থায়ী কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত নয়। সুতরাং “আমি” নামটি একটি মানসিক মায়া, যা আসলে সম্পর্ক-নির্ভর প্রবাহমাত্র। বুদ্ধের ভাষায়—“যে দেখে, সব কিছু অনিত্য; সে দেখে, সব কিছু অনাত্ম; আর যে দেখে অনাত্ম, সে দুঃখ থেকে মুক্ত।” অর্থাৎ, অনাত্ম মানে “নেই” নয়, বরং “স্বতঃসিদ্ধ নেই”—কিছুই নিজের দ্বারা নেই; সবই পরস্পরনির্ভর।

আত্মা ও অনাত্মের মৌলিক পার্থক্য: উপনিষদ বলে—একটি অপরিবর্তনীয় আত্মা আছে, যা সমস্ত পরিবর্তনের নেপথ্যস্বরূপ। বৌদ্ধ দর্শন বলে—কোনো অপরিবর্তনীয় আত্মা নেই; পরিবর্তনই অস্তিত্বের একমাত্র ধ্রুবক। একটি দেখে অস্তিত্বের শাশ্বত কেন্দ্র, অন্যটি দেখে অস্তিত্বের শূন্য কেন্দ্র। একটি বলে, “আমি ব্রহ্ম,” অন্যটি বলে, “আমি নেই, তবু জাগ্রত।” কিন্তু লক্ষ্য উভয়েরই এক—অহং-অতিক্রম। একজন বলে, “নিজেকে জানো,” অন্যজন বলে, “নিজেকে দেখো, আর দেখবে—নিজ বলে কিছুই নেই।”

অভিজ্ঞতার স্তরে সাযুজ্য: যখন একজন উপনিষদীয় সাধক “আত্মানন্দে” স্থিত হন, আর একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু “শূন্যতার নিস্তরঙ্গ শান্তি”-তে স্থিত হন, তখন দু-জনেই একই অভিজ্ঞতার ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করছেন। উপনিষদ সেই অবস্থাকে বলে “সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম”—অস্তিত্ব, চেতনা, আনন্দের পূর্ণ ঐক্য। বৌদ্ধদর্শন সেই অবস্থাকে বলে “নির্বাণ”—শর্তের অন্ত, বোধের নিস্তরঙ্গ উপস্থিতি। একজন বলে, আত্মা চিরন্তন, অন্যজন বলে, আত্মা শর্তসাপেক্ষ, কিন্তু উভয়ের কারুরই অভিজ্ঞতায় অহং নেই—যেখানে নেই কেন্দ্র, নেই আকাঙ্ক্ষা, নেই দুঃখ।

দুটি পথ, এক নীরবতা—আত্মা ও অনাত্ম—দুটি পথের দিক আলাদা, কিন্তু গন্তব্য একই নীরবতায় মিলিত। উপনিষদীয় আত্মা ব্রহ্মে বিলীন হয়, বৌদ্ধ অনাত্ম শূন্যতায় স্থিত হয়। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই দ্বৈততা বিলুপ্ত—যে জানল (জ্ঞাতা) ও জানার বিষয় (জ্ঞেয়), অভিজ্ঞ ও অভিজ্ঞতা—সব পার্থক্য—সব নিঃশেষ। শেষপর্যন্ত, বুদ্ধ যাকে বলেন “শূন্যতা”, উপনিষদ তা-ই বলেন “আত্মা”—একটি নীরব, পরম, অনির্বচনীয় উপস্থিতি, যাকে কেউ বলে অস্তিত্বের পূর্ণতা, আর কেউ বলে অস্তিত্বের অতিক্রম।

আত্মা ও অনাত্ম—দুই বিপরীত দিক থেকে শুরু করেও একই সত্যকে স্পর্শ করে। আত্মবোধ বলে—“আমি চেতনা নিজেই।” অনাত্মবোধ বলে—“চেতনা আছে, কিন্তু ‘আমি’ নেই।” একজন ব্রহ্মের দিকে মিশে যায়, অন্যজন শূন্যতার দিকে মিলিয়ে যায়। কিন্তু উভয়েই পৌঁছায় সেই স্থানে, যেখানে না কোনো জানা, না অজানা, না কোনো অভিজ্ঞতা, না অভিজ্ঞতা লাভকারী—শুধু এক অনন্ত নীরবতা, যাকে বলা যায়—সত্যের অদ্বৈত উপস্থিতি।

পঞ্চস্কন্ধ বিশ্লেষণ—“আমি”র ভাঙন: বুদ্ধ বললেন—মানুষ কোনো একক আত্মা নয়; বরং পাঁচটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল উপাদানের সমষ্টি—রূপ, বেদনা, সঞ্জ্ঞা, সংস্কার, ও বিজ্ঞান। এই পাঁচটি উপাদান একত্রে কাজ করে “আমি”-র ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে। যখন আমরা বলি “আমি ভাবছি”, “আমি সুখী”, বা “আমি কষ্ট পাচ্ছি”, আসলে কোনো স্থির “আমি” নেই—শুধু স্কন্ধগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া চলছে। এই বোঝাপড়াই হলো অনাত্মের সূচনা: “আমি” নেই, শুধু অভিজ্ঞতা আছে।

পরিবর্তনের মধ্যেই অস্তিত্ব—অনিত্যতা ও অনাত্মের যোগসূত্র। বুদ্ধ বলেন—যা-কিছু পরিবর্তনশীল, তা স্থায়ী নয়; আর যা স্থায়ী নয়, তা আত্মা হতে পারে না। দেহ বদলায়, চিন্তা বদলায়, অনুভূতি বদলায়, চেতনা বদলায়—তাহলে “আমি” কোথায় অপরিবর্তনশীল? যদি প্রতিটি মুহূর্ত নতুনভাবে গড়ে ওঠে, তাহলে পূর্বের “আমি” বর্তমানের সঙ্গে অভিন্ন কীভাবে হবে? অতএব, অনিত্যতা (anicca)-ই প্রমাণ করে অনাত্ম—কারণ, পরিবর্তনের জগতে কোনো স্থির কেন্দ্র থাকতে পারে না।

অনাত্ম মানে নাস্তিত্ব নয়। একটি বড়ো ভুল ধারণা হলো—অনাত্ম মানে “কিছুই নেই।” কিন্তু বুদ্ধ তা বলেননি। তিনি বলেননি, “কিছুই নেই”, বরং বলেছেন—“যা-কিছু আছে, তা নিজের দ্বারা নেই।” অর্থাৎ, সব কিছু পরস্পর নির্ভরশীল, প্রতীত্যসমুত্পন্ন। “আমি”ও সেই সম্পর্কেরই একটি প্রক্ষেপণ। যেমন তরঙ্গ আলাদা নয় সমুদ্র থেকে, তেমনি “আমি”ও আলাদা নয় সমগ্র অস্তিত্ব থেকে। অনাত্ম মানে “আমি নেই” নয়, বরং “আমি একক ও স্বতন্ত্র নয়”—আমার অস্তিত্ব অন্য সকল কিছুর সঙ্গে যুক্ত, নির্ভরশীল ও অনিত্য।

অনাত্ম ও দুঃখের মূল বিশ্লেষণ: দুঃখের মূল কারণ হলো “আমি”-বোধ। যখন আমরা বলি—“আমি সুখী হতে চাই”, “আমি ভয় পাচ্ছি”, “আমার কিছু হারিয়ে গেল”—এমন সব চিন্তার কেন্দ্রেই আছে “আমি”-র ধারণা। অর্থাৎ, আসক্তি ও তৃষ্ণা সবই আত্মবোধের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু যখন কেউ দেখে—“এই ‘আমি’-টি কেবলই ধারণা, এক ধারাবাহিক মনস্তাত্ত্বিক প্রবাহ ছাড়া কিছু নয়”—তখন আসক্তির মূলে আগুন নিভে যায়, এবং তখনই শুরু হয় মুক্তি।

অনাত্মের উপলব্ধি ও নির্বাণ: অনাত্ম-কে বোঝা মানে “নিজেকে হারানো” নয়, বরং “নিজের ভ্রান্ত ধারণাকে ভাঙা”। যখন “আমি”র মিথ্যা কেন্দ্র বিলীন হয়, তখন চেতনা নিজের স্বচ্ছ অবস্থায় স্থিত হয়—যেখানে নেই অহং, নেই ভয়, নেই আকাঙ্ক্ষা। এই অবস্থাই নির্বাণ—চেতনার নিস্তরঙ্গ স্বরূপ, যেখানে কোনো কেন্দ্র নেই, অথচ সব কিছু উপস্থিত। এখানে কেউ নেই, যে “জানছে”, তবু জানা আছে; কেউ নেই, যে “আছে”, তবু থাকা আছে।

আত্মা থেকে চেতনার দিকে রূপান্তর: অনাত্ম তত্ত্ব অস্তিত্বের ধারণাকে “সত্তা”-কেন্দ্রিকতা থেকে “প্রক্রিয়া”-কেন্দ্রিকতায় স্থানান্তর করে। এখানে জীবনের অর্থ কোনো “আমি”-র স্থায়িত্বে নয়, বরং চেতনার ক্রমাগত জাগরণে। বুদ্ধ এইভাবে আত্মা-দর্শনকে চেতনা-দর্শনে রূপান্তরিত করেন। তিনি বলেন, যে-“আমি”-কে আমরা আঁকড়ে ধরি, সেটিই মায়া; যে-চেতনা নিজেকে দেখে, সেটিই প্রজ্ঞা।