অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: তিরানব্বই



অদ্বৈত দর্শনে অবিদ্যার ধারণাটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং কেন্দ্রীয়। এটি শুধুই একটি নেতিবাচক (নাস্তি-বোধক) অস্তিত্ব নয় ('নেই' বলা যায় না), আবার ব্রহ্মের সমকক্ষ কোনো স্বাধীন সত্তাও নয় ('আছে' বললেও ব্রহ্মকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বসে)। এই দ্বান্দ্বিক অবস্থানের সমাধান অদ্বৈত বেদান্তের অনির্বচনীয়তা তত্ত্বে নিহিত। অবিদ্যাকে 'সৎ' (বিদ্যমান) বা 'অসৎ' (অবিদ্যমান) কোনোটিই বলা যায় না—এটিকে সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়ম্ বলা হয়, অর্থাৎ সৎ ও অসৎ উভয় থেকে অনির্দিষ্ট বা অবর্ণনীয়।

তবে, ব্যাবহারিক স্তরে অবিদ্যাকে 'ভাবরূপ' হিসেবে গণ্য করা হয়। 'ভাবরূপ' একটি ইতিবাচক সত্তা বা অস্তিত্ব, যদিও তা পারমার্থিকভাবে মিথ্যা। এর এই ভাবরূপী অস্তিত্বের কারণ হলো, জ্ঞান বা ব্রহ্মানুভূতি উৎপন্ন না হওয়া পর্যন্ত অবিদ্যা সক্রিয়ভাবে কার্যক্ষম থাকে। এটি তিন ভাবে কাজ করে:

১. আবরণ শক্তি: অবিদ্যা ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপকে ঢেকে রাখে, যেমন মেঘ সূর্যকে ঢেকে রাখে। এর ফলে আমরা আমাদের আত্মস্বরূপকে চিনতে পারি না এবং নিজেদেরকে দেহ-মন-বুদ্ধির সমষ্টি বলে ভুল করি।
২. বিক্ষেপ শক্তি: আবরণ ঘটানোর পাশাপাশি অবিদ্যা জগৎ ও জীবের বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রপঞ্চের সৃষ্টি করে। এটি অনিত্য, অনাত্ম ও দুঃখময় জগৎকে সত্য বলে প্রতীয়মান করায়, যা মূলত অবিদ্যার প্রক্ষেপণ।
৩. অভিজ্ঞতা নির্মাণ: এই আবরণ ও বিক্ষেপের ফলেই আমাদের জাগতিক অভিজ্ঞতা, বন্ধন এবং কর্মফল ভোগ তৈরি হয়। যতক্ষণ অবিদ্যা থাকে, ততক্ষণ এই জগৎ ও তার কার্যকলাপ বাস্তব বলে মনে হয়।

'ভাবরূপ'-এর এই ধারণাটি ন্যায় ও মীমাংসা দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আপত্তির উত্তর দেয়। ন্যায়-মীমাংসা মনে করে, শুদ্ধ অভাব (অসত্তা) কখনও কোনো কাজ করতে পারে না; কাজ করতে হলে শক্তির প্রয়োজন। যেহেতু অবিদ্যা আবরণ ও বিক্ষেপের মতো কার্য সম্পাদন করে, তাই এটিকে কেবল 'অভাব' বা 'নেই' বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এজন্য অদ্বৈত বেদান্ত অবিদ্যাকে একধরনের শক্তিতুল্য ধারণা করে, যা ব্রহ্মের উপর আরোপিত একটি শক্তি।

তবে, এই শক্তির স্বাধীন সত্তা নেই। পারমার্থিক সত্যের উপলব্ধির সাথে সাথেই অবিদ্যার এই শক্তিমত্তা বিলীন হয়ে যায়। উপমা হিসেবে বলা হয়, ব্রহ্মের আলো (জ্ঞান) যতক্ষণ না ধরা পড়ে, ততক্ষণই অবিদ্যার ছায়া (মায়া বা ভ্রম) পড়ে। ব্রহ্মজ্ঞান উদিত হলে অবিদ্যা তার সমস্ত কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে, ঠিক যেমন সূর্যোদয়ে অন্ধকার দূর হয়। এর কোনো পৃথক অস্তিত্ব থাকে না, বরং তা ব্রহ্মে বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু এই বিলীন হওয়া 'অসৎ' হওয়ার কারণে নয়, বরং এর স্বাতন্ত্র্যহীনতা ও মিথ্যাত্বের কারণে। এটি ব্রহ্মে অধ্যস্ত, অর্থাৎ ব্রহ্মের উপরে আরোপিত একটি মিথ্যা সত্তা।

অদ্বৈত বেদান্তে জগৎ বা মায়ার প্রকৃতি বোঝাতে একটি মহত্তর সংজ্ঞা ব্যবহৃত হয়েছে—“সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়ম্”, অর্থাৎ যা না সম্পূর্ণভাবে সত্য, না সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা; যা এই দুইয়ের কোনো একটির মধ্যেই ফেলা যায় না। “সত্” মানে যা চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়—যেমন ব্রহ্ম; “অসত্” মানে যা একেবারে নেই, যেমন আকাশে ফুল। কিন্তু জগৎ এই দুইয়ের কোনোটি নয়। জগৎকে “সত্” বলা যায় না, কারণ জ্ঞানের উদয়ে এটি বিলুপ্ত হয়; আবার “অসত্” বলা যায় না, কারণ এটি প্রতিদিন অভিজ্ঞতায় প্রতীয়মান হয়। তাই এর স্বরূপ অনির্বচনীয়—বর্ণনা ও নির্দিষ্টকরণের অতীত।

শঙ্করাচার্য ও তাঁর পরবর্তী আচার্যগণ বলেন, জগৎ ও মায়া একইভাবে সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়, কারণ এগুলি আত্মবোধে বিলুপ্ত হয়, অথচ অজ্ঞানের অবস্থায় বাস্তবের মতো দেখা যায়। যেমন স্বপ্নের হাতি না সম্পূর্ণ বাস্তব, না সম্পূর্ণ অবাস্তব—স্বপ্ন চলাকালীন সে অভিজ্ঞতাযোগ্য, কিন্তু জেগে উঠলে তার অস্তিত্ব বিলীন; তেমনি জাগ্রত জগৎও ব্রহ্মজ্ঞানে বিলীন হয়ে যায়। এই কারণেই অদ্বৈত বলে, জগৎ “মিথ্যা”—অর্থাৎ, না সত্য, না মিথ্যা, বরং অনির্বচনীয়।

এই অনির্বচনীয়তা অবিদ্যার প্রকৃতি নির্দেশ করে। অবিদ্যা থেকেই মায়ার উদ্ভব, এবং মায়াই নামরূপ জগতের কারণ। যদি মায়া সত্য হতো, তবে জ্ঞান দ্বারা বিলুপ্ত হতো না; আবার যদি অসত্য হতো, তবে অভিজ্ঞতায় প্রতীয়মানও হতো না। তাই এর প্রকৃতি অনির্বচনীয়। এটি আপাত-বাস্তবতা—যতক্ষণ জ্ঞান উদিত হয়নি, ততক্ষণ এটি সত্যের মতোই দৃশ্যমান, কিন্তু জ্ঞানের আলোয় এর সমস্ত প্রক্ষেপণ লীন হয়ে যায়।

“সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়ম্”, এই একটিমাত্র বাক্যে অদ্বৈতের সম্পূর্ণ দর্শন সংক্ষিপ্ত আকারে চলে আসে—যেখানে জগৎ ও মায়া চূড়ান্ত অর্থে ব্রহ্মেরই প্রকাশ, কিন্তু অজ্ঞানের আচ্ছাদনে তা দ্বৈত রূপে প্রতীয়মান। জ্ঞান উদিত হলে বোঝা যায়, এই প্রতীয়মান জগৎ কখনোই পরমসত্য ছিল না; তার অস্তিত্ব কেবল মায়ার অনির্বচনীয় ছায়া মাত্র। সুতরাং জগৎ, মায়া ও অবিদ্যা—সবই সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়ম্, যা আপাতভাবে আছে, কিন্তু পরমার্থত নেই; যা দেখায়, কিন্তু বাস্তবে কেবল ব্রহ্মই একমাত্র সত্য।

অদ্বৈত বেদান্তে অবিদ্যা বা মায়া কোনো নিছক অজ্ঞানতা বা শূন্যতা নয়; বরং এটি একপ্রকার ইতিবাচক অস্তিত্বসম্পন্ন শক্তি—ভাবরূপা। শঙ্করাচার্য বলেন, অবিদ্যা ভাবরূপ, কারণ যদি এটি কেবল অভাবরূপ বা অনুপস্থিতিরূপ হতো, তবে কোনো কার্য উৎপন্ন করতে পারত না। কিন্তু আমরা দেখি, অবিদ্যা থেকেই এই আপাত জগতের সৃষ্টি, নামরূপের প্রক্ষেপণ এবং আত্মার সঙ্গে দেহ-মানসের ভ্রান্ত অভিন্নতা ঘটে। যেমন দড়ির উপর সাপের বিভ্রম ঘটে, তেমনি ব্রহ্মের (পর্দার ন্যায়—প্রক্ষেপণের বৈচিত্র্য পর্দার স্থিরতাকে স্পর্শ করতে পারে না) উপর জগতের প্রক্ষেপণ ঘটে—এই প্রক্ষেপণ কেবলমাত্র কোনো অনুপস্থিতি দ্বারা সম্ভব নয়, বরং সম্ভব এক ইতিবাচক বিভ্রমশক্তি দ্বারা; সেই শক্তিই অবিদ্যা।

সুরেশ্বরাচার্য তাঁর ‘নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি’ ও ‘বৃহদ্বার্ত্তিক’-এ বলেন, ভাবরূপ অবিদ্যাই নামরূপের কারণ। চৈতন্যের মধ্যেই এক অচিন্ত্য সম্ভাবনা রূপে এটি লুকিয়ে থাকে। এই অবিদ্যা না সম্পূর্ণ বাস্তব, না সম্পূর্ণ অবাস্তব; কারণ এটি ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা নিবার্য, কিন্তু জ্ঞানোদয় না হওয়া পর্যন্ত কার্যকর। তাই এটি সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়ম্—না একেবারে সত্য, না একেবারে মিথ্যা।

প্রকাশাত্মনাচার্য ‘বিভরণ’-এ এই মতকে আরও স্পষ্ট করে বলেন—অবিদ্যা ভাবরূপ, অনির্বচনীয় এবং সাক্ষীচৈতন্যাশ্রিতা। অর্থাৎ, এটি আত্মার থেকেই অচিন্ত্যভাবে উদ্ভূত, আত্মাকে আচ্ছাদিত করে এবং জগতের প্রক্ষেপণ ঘটায়। অবিদ্যার দুই প্রধান ক্রিয়া—আবরণ (আচ্ছাদন) ও বিক্ষেপ (প্রক্ষেপণ)—এই দুই শক্তিই তার ভাবরূপ প্রকৃতি নির্দেশ করে। যদি এটি নিছক অভাবরূপ হতো, তবে কিছুই আচ্ছাদিত বা প্রক্ষেপিত হতে পারত না।

এইভাবে শঙ্কর, সুরেশ্বর ও প্রকাশাত্মন—সকলেরই অভিমত যে, অবিদ্যা কোনো নৈর্ব্যক্তিক শূন্যতা নয়; এটি একটি অনির্বচনীয় বাস্তবতা, যা চৈতন্যের ছায়ারূপে প্রকাশিত হয়ে জগৎকে প্রতীয়মান করে। জ্ঞান উদিত হলে যেমন অন্ধকার বিলুপ্ত হয়, তেমনি অবিদ্যাও বিলীন হয়; কিন্তু যতক্ষণ তা বিদ্যমান, ততক্ষণ এটি ভাবরূপ শক্তি হিসেবে কার্যকর থাকে।

অতএব, “অবিদ্যা ভাবরূপা”—এই বক্তব্যের অর্থ এই যে, অবিদ্যা এক ইতিবাচক অস্তিত্বসম্পন্ন, কার্যক্ষম, অনির্বচনীয় এবং জ্ঞানপ্রাপ্তিতে নিবার্য সত্তা; এটি না সম্পূর্ণ সত্য, না সম্পূর্ণ মিথ্যা, বরং আপাত বাস্তবতা বা মায়া—যার দ্বারা ব্রহ্ম নিজেই জগৎরূপে প্রকাশিত বলে প্রতীয়মান হয়।

শঙ্কর এক বিশেষ পথ অবলম্বন করেছেন আত্মজ্ঞান লাভের জন্য—অধ্যারোপ-অপবাদ। এই পদ্ধতিটি সাধারণ মানবীয় উপলব্ধির স্তর থেকে শুরু করে পরম সত্যের দিকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়। প্রথমত, আমাদের বোঝার সুবিধার্থে ব্রহ্মের উপর বিভিন্ন উপাধি আরোপ করা হয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাকার, নির্বিশেষ ব্রহ্মকে একবারে উপলব্ধি করা কঠিন, তাই তাঁকে 'সৃষ্টিকর্তা', 'পালনকর্তা' ইত্যাদি সগুণ উপাধি দ্বারা ভূষিত করা হয়। এই আরোপের উদ্দেশ্য হলো, ব্রহ্মের প্রতি একটি প্রাথমিক ধারণা তৈরি করা, যা মানুষের সীমিত বুদ্ধি দিয়ে ধারণ করা সম্ভব।

তবে, এই উপাধি আরোপই শেষ নয়। এরপর আসে অপবাদের প্রক্রিয়া, যেখানে আরোপিত প্রতিটি উপাধি একে একে খসিয়ে দেওয়া হয়। এই অপবাদের শক্তি কাজ করে জ্ঞানের এক বিশেষ রূপে, যাকে বলা হয় অখণ্ডাকার-বৃত্তি বা ব্রহ্মাকার-বৃত্তি। এই বৃত্তি হলো এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে মন ব্রহ্মের অখণ্ড স্বরূপের সাথে একাত্ম হয়। এটি কোনো সাধারণ জ্ঞান নয়, বরং এক গভীর ও নিরবচ্ছিন্ন উপলব্ধি।

শ্রুতি-শ্রবণের মাধ্যমে, বিশেষ করে "আমি ব্রহ্ম" (অহং ব্রহ্মাস্মি) মহাবাক্যের লক্ষণা-বৃত্তি (ভাগত্যাগ-লক্ষণা) দ্বারা এই জ্ঞান লাভ হয়। ভাগত্যাগ-লক্ষণা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে বাক্যের আংশিক অর্থ ত্যাগ করে একটি সামগ্রিক অর্থে পৌঁছানো হয়। যেমন, "আমি ব্রহ্ম" বাক্যে, 'আমি' এবং 'ব্রহ্ম' উভয় শব্দের আংশিক অর্থ ত্যাগ করে তাদের অভেদত্বকে বোঝানো হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বুদ্ধিতে যে নিরবচ্ছিন্ন ব্রহ্ম-আকৃতি তুলে ধরা হয়, তাকে বলা হয় বৃত্তি-ব্যাপ্তি। এটি হলো মনের সেই অবস্থা, যেখানে মন সম্পূর্ণরূপে ব্রহ্মের উপর নিবদ্ধ থাকে এবং ব্রহ্মের স্বরূপকে প্রতিফলিত করে।

যখন এই বৃত্তি নিজ অধিষ্ঠান-চৈতন্যে দীপ্ত হয়ে ওঠে, তখন তাকে বলা হয় ফল-ব্যাপ্তি। ফল-ব্যাপ্তি বলতে নতুন কোনো বস্তু লাভ নয়, বরং পূর্বে লুকানো 'আমি'-স্বরূপের উদ্ভাসকে বোঝায়। এটি কোনো নতুন সৃষ্টি নয়, বরং যা আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, তার আবরণ উন্মোচন। এই 'আমি'-স্বরূপটি জন্মগতভাবে ব্রহ্মের সাথে অভিন্ন, কিন্তু মায়ার আবরণে তা এতদিন অপ্রকাশিত ছিল। ফল-ব্যাপ্তি সেই আবরণকে দূর করে আত্মস্বরূপকে প্রকাশিত করে।

এই বৃত্তি নিজেই সাময়িক বা সময়-নির্ধারিত, অর্থাৎ এর একটি নির্দিষ্ট সময়কাল আছে। কাজ শেষ হলেই তা থেমে যায়। এই বৃত্তির প্রধান কাজ হলো অজ্ঞানের আবরণকে ভেদ করা। এই ভেদ করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় নিবৃত্তি-লক্ষণ-জ্ঞান। এটি কোনো নতুন জ্ঞান উৎপাদন করে না, বরং বিদ্যমান অজ্ঞানতাকে বিলুপ্ত করে। অজ্ঞানতার বিলোপের মাধ্যমে আত্মস্বরূপের প্রকাশ ঘটে, যা অদ্বৈত বেদান্তের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই প্রক্রিয়াটি "উৎপাদন নয়, বিলোপ"—এই দর্শনের মূল ভিত্তি। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, মোক্ষ কোনো প্রাপ্তি নয়, বরং অজ্ঞানতার নিবৃত্তি।

অধ্যারোপ-অপবাদ (adhyāropa-apavāda)—অদ্বৈত বেদান্তের সবচেয়ে মৌলিক ও সূক্ষ্ম শিক্ষণ-পদ্ধতি। এটি শঙ্করাচার্যের দর্শনে “জ্ঞান-উৎপত্তি” ও “মায়া-নিবারণ”-এর মূল প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত। নিচে এর অর্থ, ধাপ, ও দার্শনিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ আকারে দিচ্ছি—

অদ্বৈত মতে চূড়ান্ত সত্য কেবল ব্রহ্ম—এক, অখণ্ড, নিরাকার, নির্দোষ, স্বপ্রকাশমান। কিন্তু অজ্ঞানের কারণে এই ব্রহ্মের উপর জগৎ, দেহ-মন, ঈশ্বর-জীব-ভেদ প্রভৃতি বহুপ্রকার ভাবের প্রক্ষেপণ ঘটে। এই বিভ্রম দূর করতে গুরু ধীরে ধীরে শিষ্যের মনকে পরিশোধন করেন “অধ্যারোপ-অপবাদ” পদ্ধতিতে।

অধ্যারোপ (adhyāropa) মানে—কোনো কিছুর উপর অন্য কিছুর ভুলভাবে আরোপ করা। যেমন দড়ির উপর সাপ আরোপ করা, বা ব্রহ্মের উপর জগৎ-ভাব আরোপ করা। প্রথম ধাপে গুরু জগৎ-সৃষ্টির, ঈশ্বরের, কর্ম-ফলের, ও আত্মার ভেদভেদীয় ব্যাখ্যা দেন—যাতে শিষ্য ধীরে ধীরে ধারণা করতে পারে যে, এই বিশ্ব ও জীব সবই এক ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন। এই ব্যাখ্যা আপাত-সত্যের স্তরে (ব্যাবহারিক সত্যে) কার্যকর।

উপনিষদের গুরু–শিষ্য কোনো সামাজিক পদমর্যাদা নয়, এক অন্তর্মুখী অনুসন্ধানের পরস্পর-প্রতিশ্রুতি। ‘উপনিষদ’ শব্দটাই ইঙ্গিত দেয়—উপ-নি-সদ, নিকটে বসে শোনা-বোঝা-আত্মস্থ করা। এখানে গুরু ব্যক্তি-উপাসনার কেন্দ্র নন; তিনি শাস্ত্র-বাক্যের (শ্রুতি) জীবন্ত উন্মোচক—শ্রোত্রিয়ো ব্রহ্মনিষ্ঠঃ—যাঁর কাছে বেদান্ত শুধু তথ্য নয়, প্রত্যক্ষস্থিতি। তাঁর কাজ অলৌকিকতা দেখানো নয়, অজ্ঞান ভেদ করা; উপায় হচ্ছে শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসন, ন্যায়-উপমা-আধ্যারোপ-অপবাদে ধীরে ধীরে ‘আমি দেহ’ অভ্যাস ভেঙে ‘আমি চিত্’ প্রতীতি জাগিয়ে দেওয়া।