যখন আমরা কোনো বস্তু বা ঘটনা দেখি, আমরা সাধারণত তাকে “কিছু” বলে চিহ্নিত করি—এই ভালো, এই খারাপ, এই সুন্দর, এই আমার, ইত্যাদি। এইসব নাম, ধারণা, তুলনা, পছন্দ-অপছন্দ—সবই চেতনার ভেতরের নির্মাণ। কিন্তু বাস্তবতা নিজে এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যখন মন সমস্ত ব্যাখ্যা, প্রতিক্রিয়া ও ভাষা ফেলে দিয়ে জগতকে যেমন আছে, তেমনভাবে দেখে, তখন যে নির্মল উপলব্ধি জন্মায়, সেটিই তথতা।
তথতা ও শূন্যতা: শূন্যতা (śūnyatā) এবং তথতা (tathatā)—এই দুটি ধারণা একে অপরের পরিপূরক। শূন্যতা বলে, “কোনো সত্তার নিজস্ব, স্বতঃসিদ্ধ সারবত্তা নেই; সব কিছুই পরনির্ভর।” অন্যদিকে, তথতা বলে, “এই পরনির্ভর, পরিবর্তনশীল বাস্তবতাই পূর্ণ, যেমন আছে, তেমনই।” অর্থাৎ, শূন্যতা বাস্তবতার বিশ্লেষণাত্মক দিক—এটি মায়ার গঠন ভেঙে দেয়, “আমি” ও “অন্য”-এর বিভেদ বিলুপ্ত করে। আর তথতা হলো সেই ভাঙনের পরের শান্ত উপস্থিতি—যেখানে আর কোনো বিভেদ নেই, শুধু এমন থাকা। শূন্যতা দেখায় “কিছুই স্থায়ী নয়”; তথতা অনুভব করায় “যা আছে, তাতেই সম্পূর্ণতা।”
মহাযান সূত্রে তথতা: বিভিন্ন মহাযান সূত্রে তথতার ব্যাখ্যা এসেছে। প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রে বলা হয়েছে, “যা শূন্য, তা-ই তথতা; যা তথতা, তা-ই নির্বাণ।” অর্থাৎ, তথতা কোনো দ্বিতীয় বাস্তবতা নয়, বরং সেই একই শূন্যতা—যা এখন আর চিন্তার নয়, বরং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার রূপে জাগে। অবতংসক সূত্রে তথতাকে বলা হয়েছে ধর্মধাতুর স্বরূপ—এক অবিভাজ্য চেতনা, যেখানে সব কিছু একে অপরের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কে উদ্ভাসিত। লঙ্কাবতার সূত্রে বলা হয়েছে, “তথতা উদ্ভাসিত হয় সেই চেতনার মধ্যে, যেখানে বিষয়-বস্তু-ভেদ বিলীন।”
অভিজ্ঞতার স্তরে তথতা: তথতা কোনো ধারণা নয়; এটি অভিজ্ঞতা। যখন মন শান্ত, বিচারহীন ও আকাঙ্ক্ষাহীন হয়, তখন বাস্তবতা নিজের মতো করে নিজেকে প্রকাশ করে—নাম বা রূপের প্রয়োজন ছাড়াই। এই অভিজ্ঞতায় দেখা ও দেখা-যাওয়া এক হয়ে যায়; অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের বিভেদ লুপ্ত হয়। বোধিসত্ত্বের জন্য এই অবস্থাই চূড়ান্ত উপলব্ধি—যেখানে তিনি কিছু অর্জন করতে চান না, কারণ তিনি বুঝেছেন, যা আছে, সেটিই যথেষ্ট। এই “যেমন আছে, তেমনভাবে থাকা”-ই তথতা।
দর্শনের আঙিনায় তথতা: তথতা বোঝায়, কোনো আলাদা “চূড়ান্ত সত্তা” নেই—আছে কেবল এই পরিপূর্ণ এমনত্ব, যা প্রতিটি মুহূর্তে নিজে নিজে প্রকাশিত হচ্ছে। এটি না ঈশ্বর, না কোনো পদার্থ, না কোনো নৈরাশ্যবাদী শূন্যতা—বরং এক নীরব, সর্বব্যাপী উপস্থিতি। তুমি এটিকে নাম দিতে গেলে তা হারিয়ে যায়; তুমি কেবল তাকে “দেখতে” পারো, যখন “দেখা” ক্রিয়াটাই থেমে যায়।
চেতনার স্তরে: যখন জ্ঞান ও করুণা একে অপরের মধ্যে মিশে যায়, যখন অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে কোনো “আমি” অবশিষ্ট থাকে না, তখন তথতা নিজের স্বচ্ছ দীপ্তি নিয়ে উদ্ভাসিত হয়। এটি কোনো অতিপ্রাকৃত বাস্তবতা নয়—এটি এখানেই, এখনই, প্রতিটি ঘটনার ভেতরেই বিদ্যমান। তোমার নিঃশ্বাসে, পাতার দোলায়, বৃষ্টির শব্দে—সব কিছুতে তথতার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটছে।
তথতা মানে “যেমন আছে, তেমনভাবে থাকা”—না ভালো, না মন্দ; না শূন্য, না পূর্ণ; শুধু এমনই, নিঃশব্দ, অবিচল, অবিভক্ত উপস্থিতি। শূন্যতা বলে: কিছুই স্বতন্ত্র নয়। তথতা বলে: তবু সব কিছু তেমনি পূর্ণ, যেমন আছে। যেখানে দ্বন্দ্ব থেমে যায়, যেখানে ভাষা ব্যর্থ হয়, যেখানে মন আর বিভাজন করে না—সেখানেই তথতা।
ব্রহ্ম ও তথতা: চেতনা ও ‘এমনতা’-র দুই দিগন্ত—অদ্বৈত বেদান্ত ও মহাযান বৌদ্ধধর্ম—ভারতীয় দর্শনের দুই মহান শিখর। দু-পথই চূড়ান্ত বাস্তবতার সন্ধানে—এমন এক সত্য, যা সমস্ত দ্বন্দ্ব, সীমা, ভাষা ও চিন্তার ওপারে। তাকে একজন বলে ব্রহ্ম, অন্যজন বলে তথতা। শব্দ আলাদা, কিন্তু নীরবতার দিক এক।
দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা: অদ্বৈত বেদান্ত শুরু হয় আত্মা থেকে; বুদ্ধ শুরু করেন অনাত্ম থেকে। অদ্বৈত বলে—“আত্মা বা চেতনা চিরন্তন ও অবিভাজ্য, সেই আত্মাই ব্রহ্ম।” বৌদ্ধ বলে—“যেখানে আত্মা বলে কিছু নেই, সেখানেই অনাসক্ত চেতনা বা তথতা।” অদ্বৈতের ভাষায় সব কিছুর ভিত্তি এক চিরন্তন সত্তা, আর মহাযান বলে, কোনো সত্তা নেই—কিন্তু সেই অসত্তার মধ্যেই পূর্ণতা।
ব্রহ্ম—চেতনার পরম ঐক্য: অদ্বৈত বেদান্তে ব্রহ্ম হলো একমাত্র পরম সত্য। তিনি নিরাকার, নির্গুণ, চিরন্তন এবং চেতনার রূপে স্বয়ংপ্রকাশমান। সব কিছু ব্রহ্ম থেকে উদ্ভূত, আবার ব্রহ্মেই লীন। ব্রহ্মকে বলা হয় সৎ-চিৎ-আনন্দ—অস্তিত্ব, চেতনা ও আনন্দের একতা। যখন অবিদ্যা মুছে যায়, তখন জানা যায়—জীব, জগৎ ও ঈশ্বর—এ তিনে কোনো পার্থক্য নেই। শঙ্করাচার্যের ভাষায়, “ব্রহ্মই একমাত্র বাস্তব; অন্য সব নাম ও রূপ মাত্র।”
তথতা—বাস্তবতার এমনতা (‘এমন—যেমন আছে, তেমন থাকা’-র বৈশিষ্ট্য): মহাযান বৌদ্ধ দর্শনে তথতা মানে “যেমন আছে, তেমনই থাকা”—এ এমন এক বাস্তবতা, যা কোনো নাম, ধারণা, বা দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আবৃত নয়। এটি শূন্যতার অভ্যন্তরীণ উন্মোচন—যেখানে সব কিছু নির্ভরশীল, পরস্পরনির্ভর, অথচ নিখুঁত।
তথতা কোনো আলাদা সত্তা নয়; এটি সেই নিঃশর্ত উপস্থিতি, যা সব ঘটনার মধ্য দিয়ে জ্বলজ্বল করে। বুদ্ধ বলেছিলেন, “তথতা সেই অবস্থা, যেখানে নাম ও রূপের বিভাজন লুপ্ত।” এটি চেতনার কোনো বিষয় নয়, বরং চেতনা নিজেই—কিন্তু ‘আমি’-বোধহীন।
বাস্তবতার ধারণাগত পার্থক্য: অদ্বৈত বেদান্ত বাস্তবতাকে “চেতনা-সত্তা” হিসেবে দেখে; বৌদ্ধ দর্শন তথতাকে দেখে “চেতনার নিঃশর্ত এমনতা” হিসেবে। অদ্বৈত স্থাপন করে এক অখণ্ড আত্মা, বৌদ্ধ মুছে দেয় আত্মার ধারণাই। অদ্বৈতে বলা হয়, “আত্মা চেতনা রূপে অনন্ত”; বৌদ্ধ বলে, “চেতনা অনন্ত, কিন্তু তাতে কোনো আত্মা নেই।” অদ্বৈতের ব্রহ্ম একটি ধ্রুব সত্তা—যাকে নিত্য, সত্য, চিত্, আনন্দ বলে। বৌদ্ধের তথতা কোনো ধ্রুব নয়—এটি অনিত্য, পরনির্ভর, অথচ চিরসম্পূর্ণ। অদ্বৈত বলে, “সবই চেতনার প্রকাশ।” বৌদ্ধ বলে, “সবই নির্ভরতার প্রকাশ।”
ভাষা ও চিন্তার সীমা: দু-পথই একমত—চূড়ান্ত সত্যকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। উপনিষদে বলা হয়েছে, “যতো বাকো নিবর্তন্তে, অপ্রাপ্য মনসা সহ।” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ-এর ব্রহ্মানন্দবল্লী, ২.৪.১) অর্থাৎ, ব্রহ্ম বা পরম সত্য এমন এক বাস্তবতা, যাকে চিন্তা বা ভাষা দিয়ে পাওয়া যায় না। মহাযান সূত্রে বলা হয়েছে, “যেখানে নাম ও রূপের পার্থক্য নেই, সেখানেই তথতা।” ভাষা, ধারণা, যুক্তি—সবই আপেক্ষিক; চূড়ান্ত সত্য তাদের আগেই আছে, তাদের দ্বারা প্রকাশযোগ্য নয়। এজন্য ব্রহ্ম “অনির্বচনীয়”, তথতা “নির্বচনীয়তীত।” (একটু পর এর ব্যাখ্যা দিচ্ছি।)
অভিজ্ঞতার স্তরে মিল: যখন মন সম্পূর্ণ নিঃস্তব্ধ হয়, যখন “আমি” ও “অন্য” মিশে যায়, যখন অভিজ্ঞতাকারী ও অভিজ্ঞতা এক হয়ে যায়—তখন যে নিঃশব্দ উপস্থিতি জাগে, অদ্বৈত তাকে বলে ব্রহ্ম, বৌদ্ধ তাকে বলে তথতা। একজন বলে, “আমি ব্রহ্ম।” অন্যজন বলে, “‘আমি’-র ধারণাটিই নেই, আছে ‘শুধু থাকা’।” কিন্তু উভয়ের অভিজ্ঞতা এক—এক অখণ্ড চেতনা, এক শান্ত নীরবতা, এক সীমাহীন মুক্তি।
মুক্তি ও নির্বাণের প্রেক্ষাপট: অদ্বৈতে মুক্তি মানে আত্মজ্ঞান—“আমি ব্রহ্ম।” বৌদ্ধে নির্বাণ মানে ধারণার পরিসমাপ্তি—“আমি নেই।” দুটি পথ বিপরীত দিক থেকে চলে এসে একবিন্দুতে মিলিত হয়। অদ্বৈতে জ্ঞান মুছে দেয় অবিদ্যা, বৌদ্ধে প্রজ্ঞা মুছে দেয় আসক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি। ফল একই—ভয়হীনতা, অনাসক্তি, এবং নিঃশেষ শান্তি।
চেতনা ও এমনতার ঐক্য: ব্রহ্ম হলো চেতনার পরিপূর্ণ প্রকাশ, তথতা হলো সেই চেতনার নিঃশর্ত এমনতা। একজন বলে, “সবই আমি।” অন্যজন বলে, “কিছুই আলাদা নয়।” দু-জনই বলে—দ্বন্দ্ব নেই, বিভেদ নেই, কেবল এই। শেষে উভয় ঐতিহ্য এসে মিশে যায় একই নীরব সত্যে, যেখানে ভাষা থেমে যায়, চিন্তা স্তব্ধ হয়, আর যা অবশিষ্ট থাকে, সেটিই চেতনার নিঃশেষ স্বচ্ছতা।
ব্রহ্ম ও তথতা—দু-জনই অদ্বৈত চেতনার প্রকাশ। ব্রহ্ম হলো সেই চেতনার আত্মপ্রকাশ, তথতা হলো সেই চেতনার নিঃস্বার্থ এমনতা। ব্রহ্ম বলে, “আমি আছি।” তথতা বলে, “আছে—কিন্তু কোনো আমি নেই।” দু-জনেই চালিত করে এক অনির্বচনীয় উপস্থিতির দিকে, যেখানে সমস্ত দৃষ্টি, ধারণা, দ্বন্দ্ব, নাম, রূপ বিলীন হয়ে যায়। সেখানে কেবল নীরবতা—এমন এক নীরবতা, যা কোনো শূন্যতা নয়, বরং সব কিছুর স্বচ্ছ ভিত্তি, যেখানে দেখা যায়—ব্রহ্মই তথতা, তথতাই ব্রহ্ম।
ব্রহ্মের অনির্বচনীয়তা ও শূন্যতার নির্বচনীয়তীততা—দুটি ভিন্ন পথ, কিন্তু এক নীরব সত্যের দিকে অগ্রসর।
ভাষা ও নীরবতার সীমান্তে: মানুষের বুদ্ধি ও ভাষা বাস্তবতাকে ধরতে চায়; সে জগৎকে নাম দেয়, ভাগ করে, সংজ্ঞায়িত করে। কিন্তু একপর্যায়ে এসে ভাষা নিজের সীমা চিনে ফেলে—যে-বাস্তবতার দিকে সে এগোয়, সেটি আর শব্দে ধরা যায় না। অদ্বৈত বেদান্ত ও মহাযান বৌদ্ধ দর্শন—দু-জনেই সেই সীমান্তে এসে দাঁড়ায়। একজন বলে, “ব্রহ্ম অনির্বচনীয়”—অন্যজন বলে, “শূন্যতা নির্বচনীয়তীত।” একই সত্য, দুই ভাষা; একই নীরবতা, দুই দিক থেকে প্রবেশ।
ব্রহ্মের অনির্বচনীয়তা: ব্রহ্ম কোনো ধারণা নয়, কোনো বস্তু নয়। তিনি সেই চেতনা, যার মধ্যে সব ধারণা, বস্তু ও অভিজ্ঞতা ঘটে। যা-কিছু বলা হয়, তা সীমাবদ্ধ, আপেক্ষিক—আর ব্রহ্ম সেই সীমার আগের অসীম নীরবতা। যখন উপনিষদ বলে—“যতো বাকো নিবর্তন্তে, অপ্রাপ্য মনসা সহ”—তখন তা স্বীকার করছে যে, ভাষা যতই সূক্ষ্ম হোক, ব্রহ্ম সেখানে পৌঁছাতে পারে না, কারণ ভাষাই তাঁর প্রকাশ। ব্রহ্মকে বলা যায় না, কিন্তু তিনি নিজে বলার উৎস।
চেতনা যে কথা বলে, বুদ্ধি যে চিন্তা করে, মন যে উপলব্ধি করে—সবই ব্রহ্মের মধ্যেই ঘটে, তবে তাঁকে কোনো চিন্তা দিয়ে ধরা যায় না। এইজন্যই উপনিষদের দৃপ্ত উচ্চারণ: “নেতি নেতি”—না এ, না সে—কারণ যতই তুমি কোনো গুণ দাও, ব্রহ্ম সেই গুণেরও অতীত। তিনি নির্গুণ, কিন্তু নিস্তেজ নন; তিনি অনন্ত, কিন্তু নিস্তব্ধতায় দীপ্ত।
শূন্যতার নির্বচনীয়তীততা: নাগার্জুনে ও প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রে শূন্যতা ভাষার এক অচিন্ত্য অঞ্চল। শূন্যতা মানে শূন্য গহ্বর নয়, বরং এমন এক বাস্তবতা, যেখানে সমস্ত ধারণা, নাম, ভেদ, অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের দ্বন্দ্ব মিলিয়ে যায়। নাগার্জুনের চতুষ্কোটি যুক্তি বলে দেয়—কোনো বস্তু—’না আছে’; ‘না নেই’; ‘না আছে’ ও ‘নেই’—দুই-ই; ‘না আছে’-’নেই’—উভয়ের অতীত—অর্থাৎ, ভাষার চারদিকেই শূন্যতা অব্যক্ত।
শূন্যতা এমন কোনো “অবস্থা” নয়, যাকে তুমি ধারণা হিসেবে ধরতে পারো; তাকে ধরলেই ভুল হবে। কারণ ধরার কাজটাই দ্বৈততার সৃষ্টি করে—ধরনেওয়ালা ও ধরা পড়া, বিষয় ও বস্তু। শূন্যতায় এই বিভেদই বিলুপ্ত। তাই নাগার্জুন সতর্ক করেন—“শূন্যতাকে কোনো দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে যে ধরে, সে আবার মায়ায় পড়ে।” এইজন্যই শূন্যতা নির্বচনীয়তীত—যাকে বর্ণনা করার চেষ্টাই তাকে বিকৃত করে।
দুই দর্শনের অভিন্ন হৃদয়: অদ্বৈতের ব্রহ্ম ও মাধ্যমকের শূন্যতা, দু-জনেরই স্বরূপ এক—অভেদ, অনন্ত, অচিন্ত্য, ভাষাতীত। বেদান্ত বলে—“ব্রহ্ম সর্বত্র, কিন্তু তাঁকে দেখা যায় না, কারণ তিনি দেখার চেতনা নিজেই।” বৌদ্ধ বলে—“শূন্যতা সর্বত্র, কিন্তু তাকে ধরা যায় না, কারণ তিনি ধরা পড়ার সমস্ত প্রক্রিয়ার অতীত।” দু-জনেই শেখায়—যখন মন থেমে যায়, ভাষা স্তব্ধ হয়, তখন যা অবশিষ্ট থাকে, তা-ই পরম সত্য।
তবে অদ্বৈত সেই অভিজ্ঞতাকে বলে চেতনার আত্মপ্রকাশ, আর বৌদ্ধ বলে—অদ্বৈত এমনতা—তথতা। অদ্বৈতের ব্রহ্ম হলো “আমি আছি”-র নিঃশেষ জ্ঞান; বৌদ্ধের শূন্যতা হলো “আমি নেই”-র নিঃশেষ শান্তি; কিন্তু একবার “আমি” ও “নেই” উভয়ই থেমে গেলে, অবশিষ্ট থাকে একই দীপ্ত শূন্যতা—যেখানে থাকে—না আত্মা, না অনাত্মা, শুধু এক নীরব উপস্থিতি।
ভাষার অক্ষমতা ও উপলব্ধির আহ্বান: এই দুই পথই বলে—বুঝতে গেলে ভেবো না, বরং জেনে ফেলো নীরবতায়। কারণ ভাষা দ্বন্দ্বের সন্তান; আর সত্য সবসময়ই অদ্বৈত। ব্রহ্ম-জ্ঞান আসে, যখন জানবার ইচ্ছেও থেমে যায়। শূন্যতার উপলব্ধি ঘটে, যখন কিছু উপলব্ধি করার মনও নিঃশেষ হয়। সেখানে নীরবতা আছে, কিন্তু মৃত নয়; এটি চেতনার পূর্ণ জাগরণ।