অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: একান্ন



‘নাস্তিত্ব’ (Nāstitva) অর্থ হলো—অস্তিত্বহীনতা, অর্থাৎ কোনো বস্তুর বা সত্তার না থাকা, না পাওয়া, বা অনুপস্থিত থাকা। দর্শনের ভাষায়, অস্তিত্ব (Sattā) ও নাস্তিত্ব (Asattā) হলো বিপরীত ধারণা। অস্তিত্ব মানে যা প্রকাশমান, প্রত্যক্ষযোগ্য বা স্বীকৃত, আর নাস্তিত্ব মানে যা প্রকাশমান নয় বা কোনো কালেই ঘটে না। তবে অনেক দার্শনিক (বিশেষত অদ্বৈত বেদান্তে) বলেন, নাস্তিত্বও একপ্রকার মানসিক ধারণা—কারণ “না থাকা”-কেও জানার জন্য “জ্ঞান” প্রয়োজন। অর্থাৎ, “নেই” জ্ঞানও একধরনের অস্তিত্বের অভিজ্ঞতা।

অস্তিত্ব ও অ-সারসত্তার দর্শনীয় সংঘাত: অদ্বৈত বেদান্ত এবং মাধ্যমক উভয়েই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে আপাত বা মিথ্যা বলে স্বীকার করে, কিন্তু কারণ ব্যাখ্যায় তারা আলাদা পথে যায়। অদ্বৈত বলে, জগৎ মিথ্যা, কারণ—এটি ব্রহ্মের জ্ঞান দ্বারা অতিক্রান্ত, অর্থাৎ উচ্চতর চেতনার জাগরণে তার সীমা প্রকাশ পায়। অন্যদিকে, মাধ্যমক বলে, জগৎ মিথ্যা কারণ—এর কোনো স্বতঃসিদ্ধ সারই নেই—এটি সম্পর্কনির্ভর, তাই আপেক্ষিক।

অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, চূড়ান্ত সত্য একটি “অস্তিত্ব”—চিরন্তন চৈতন্য, যা সব কিছুর ভিতরে অনন্তভাবে বিরাজমান। কিন্তু মাধ্যমক মনে করে, এই “অস্তিত্ব” ধারণাটিই ভুল; কারণ যা-কিছু বলা যায়, তা ধারণার সীমায় বাঁধা, আর চূড়ান্ত বাস্তবতা সেই সীমার অতীত। ফলে অদ্বৈত যেখানে একত্বে মুক্তি খোঁজে, মাধ্যমক সেখানে ধারণাহীন শূন্যতায় মুক্তি দেখে। একজন বলে, “আমি ব্রহ্ম,” অন্যজন বলে, “আমি কিছুই নই।” তবে উভয়ের লক্ষ্য এক—সমস্ত ভেদবুদ্ধি ও সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে পরম শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।

অদ্বৈত বেদান্তের ব্রহ্ম ও মাধ্যমকের শূন্যতা—দুই পথ, দুই ভাষা, কিন্তু উদ্দেশ্য এক। একজন অস্তিত্বের ঐক্যে মুক্তি খোঁজে, অন্যজন অস্তিত্বের শূন্যতায় মুক্তি পায়। একজন বলে, সবই ব্রহ্মের প্রতিফলন; অন্যজন বলে, কিছুই স্বতন্ত্রভাবে নেই। তবুও উভয়েই মানুষের চেতনাকে তার সীমা অতিক্রম করতে শেখায়—যাতে সে অভিজ্ঞতা করে এক অবর্ণনীয়, নির্দ্বন্দ্ব, সর্বাত্মক সত্যকে।

চূড়ান্ত বাস্তবতার মতোই, জ্ঞানের প্রকৃতি ও মুক্তির উপায় সম্পর্কেও অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক দর্শনের মধ্যে গভীর পার্থক্য রয়েছে। দু-পথই মানবদুঃখ ও অজ্ঞতার মূল কারণ অনুসন্ধান করে, কিন্তু একে দূর করার উপায় ব্যাখ্যা করে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথের মাধ্যমে। একজন আত্মানুভূতি-কে মুক্তির চাবিকাঠি বলে মনে করে, অন্যজন প্রজ্ঞা বা শূন্যতার প্রত্যক্ষ উপলব্ধিকে মুক্তির মূল বলে ঘোষণা করে।

অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞানের প্রক্রিয়া ও আত্মানুভূতি: অদ্বৈত বেদান্তমতে, মুক্তি (মোক্ষ) কেবল জ্ঞান (ব্রহ্ম-বিদ্যা) দ্বারাই সম্ভব; কোনো কর্ম বা পূজা দ্বারা নয়। কারণ কর্ম সবসময় পরিবর্তনশীল ফলের দিকে নিয়ে যায়, আর মুক্তি হল অপরিবর্তনীয় সত্যের উপলব্ধি—যা চেতনার নিজস্ব স্বরূপে প্রতিষ্ঠা। এই জ্ঞান কোনো বাহ্যিক শিক্ষার ফল নয়; এটি এক আত্মানুভূতি—নিজের ভিতরেই নিজের সত্য উপলব্ধি। অবিদ্যা (অজ্ঞতা) হলো সেই পর্দা, যা আত্মাকে ব্রহ্ম থেকে পৃথক বলে মনে করায়। যখন সেই অবিদ্যা জ্ঞানের আলোয় বিলীন হয়, তখন আত্মা নিজের প্রকৃত সত্তাকে অনুভব করে যে, সে আসলে ব্রহ্মই। এই উপলব্ধি অভেদ জ্ঞান—যেখানে জানার বিষয় (প্রমেয়), জানন (প্রমাণ), ও জ্ঞাতা (প্রমাতা)—এই তিনের কোনো পৃথক অস্তিত্ব থাকে না। অর্থাৎ, জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়—তিনটিই একে অপরের মধ্যে লীন হয়ে যায়, এবং যা অবশিষ্ট থাকে তা কেবল চেতনা—নিখিল ব্রহ্মস্বরূপ।

শঙ্করাচার্য বলেন, “জ্ঞানই মুক্তি; অন্য কোনো কর্ম দ্বারা মুক্তি অর্জন অসম্ভব।” এই অবস্থায়, “আমি” বা “তুমি”-র ধারণা লুপ্ত হয়, কারণ সেই চেতনা সব সীমা অতিক্রম করে অদ্বৈত অভিজ্ঞতারূপে জেগে ওঠে—যেখানে সবই ব্রহ্ম, আর কিছুই আলাদা নয়।

মাধ্যমক বৌদ্ধধর্মে জ্ঞানের প্রক্রিয়া ও প্রজ্ঞা: মাধ্যমক মতে, মুক্তি (নির্বাণ) আসে না কোনো চিরন্তন আত্মা বা সত্তার উপলব্ধি থেকে, বরং আসে সব সত্তার অ-সারসত্তা (শূন্যতা) উপলব্ধি থেকে। অদ্বৈতের মতো এখানেও অজ্ঞতাই (অবিদ্যা) দুঃখের মূল কারণ; কিন্তু এই অজ্ঞতা মানে কোনো “আত্মা” ভুলে যাওয়া নয়, বরং “আত্মা আছে”—এই ভুল ধারণা। মাধ্যমক দৃষ্টিতে, জ্ঞান মানে “বস্তু”-কে “যেমন আছে” তেমন দেখা—কোনো স্বতঃসিদ্ধ সার ছাড়া, সম্পর্কনির্ভর ও অনিত্য রূপে। এই প্রজ্ঞা (prajñā) এমন এক অন্তর্দৃষ্টি, যা অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব—উভয় ধারণাকে অতিক্রম করে। যখন মন উপলব্ধি করে যে, সব কিছুই শূন্য—অর্থাৎ কোনো স্থায়ী স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত নয়—তখন সে আর কোনো বস্তু, ধারণা বা নিজস্ব “আমি”কে আঁকড়ে থাকে না। সেই অনাসক্ত, নিস্তরঙ্গ অবস্থাই নির্বাণ।

নাগার্জুন বলেন, “যে ‘শূন্যতা’ বোঝে, সে সমস্ত ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি অতিক্রম করে; আর যে শূন্যতাকে ভুল বোঝে, সে নিজেই বন্ধনে পতিত হয়।” এই প্রজ্ঞা বৌদ্ধচেতনার সর্বোচ্চ রূপ—এতে জ্ঞান কোনো স্থায়ী সত্যে পৌঁছায় না, বরং সমস্ত সীমাবদ্ধতার অবসান ঘটায়। সেই “অবসান”-ই শান্তি—যেখানে দুঃখ, আকাঙ্ক্ষা, ও দ্বৈততার সব চিহ্ন বিলীন হয়।

অদ্বৈতের জ্ঞান আত্মার চূড়ান্ত চেতনায় লীন হওয়া—“আমি ব্রহ্ম” বলে জেগে ওঠা। মাধ্যমকের জ্ঞান সকল স্বরূপের অনস্তিত্বে স্থিত হওয়া—“আমি নেই, কিছুই নেই” এই শূন্যতায় মুক্ত হওয়া।

অদ্বৈতে, জ্ঞান এক পজিটিভ অভিজ্ঞতা—চৈতন্যের ঐক্যে প্রবেশ। মাধ্যমকে, জ্ঞান এক নেগেটিভ অন্তর্দৃষ্টি—ধারণার বিলোপেই মুক্তি।

অদ্বৈতে, চূড়ান্ত বোধ “সত্য”-এর উপলব্ধি। মাধ্যমকে, চূড়ান্ত বোধ “সত্য”-এর অপনয়ন—কারণ “সত্য” ধারণাটিও একটি আপেক্ষিক নির্মাণ।

তবু উভয়ের লক্ষ্য একই: অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে, দ্বৈততার ঊর্ধ্বে এক নিস্তরঙ্গ, পরম শান্ত অবস্থায় পৌঁছানো। অদ্বৈতের আত্মানুভূতি ও মাধ্যমকের প্রজ্ঞা—দুই পথের দুই ভাষা, কিন্তু অন্ত-সত্য এক। একজন বলে, “চেতনার ঐক্যে আমি মুক্ত।” অন্যজন বলে, “সকল চেতনার শূন্যতায় আমি মুক্ত।” একজন ঈশ্বর ও আত্মার অখণ্ড সত্তায় সত্য খোঁজে, অন্যজন সকল ধারণার বিলোপে সত্যকে পায়। অদ্বৈতের মুক্তি হলো জ্ঞান-স্বরূপে প্রতিষ্ঠা, মাধ্যমকের মুক্তি হলো শূন্যতা-স্বরূপে প্রশান্তি। শেষপর্যন্ত, উভয় পথই মানুষকে শেখায়—বাস্তবতা কোনো ধারণা নয়; এটি এমন এক নীরব প্রত্যক্ষতা, যেখানে জানা-ও বিলীন, জানা-টা যে জানে, সে-ও লুপ্ত।

জগৎ ও অভিজ্ঞতার মায়া—অবিদ্যা বনাম প্রতীত্যসমুত্পাদ: অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক বৌদ্ধধর্ম উভয়েই জগৎকে “চূড়ান্ত বাস্তবতা” বলে স্বীকার করে না। কিন্তু কেন জগৎ মিথ্যা বলে মনে হয়, কিংবা কেমনভাবে এই আপাত বাস্তব জগৎ অভিজ্ঞতার রূপে উদ্ভূত হয়—সেই প্রশ্নের উত্তর তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন দার্শনিক পথে খোঁজে। অদ্বৈত এই বিভ্রান্তির কারণ হিসেবে অবিদ্যা (অজ্ঞতা) বা মায়াকে চিহ্নিত করে, আর মাধ্যমক এই জগতের উদ্‌ভব ব্যাখ্যা করে প্রতীত্যসমুত্পাদ (পরস্পরনির্ভর উদ্ভব) তত্ত্বের মাধ্যমে।

অদ্বৈত বেদান্তে জগৎ—অবিদ্যা ও মায়ার প্রতিফলন: অদ্বৈত বেদান্তে জগতের মিথ্যাত্ব ব্যাখ্যা করা হয় অবিদ্যা নামক এক মৌলিক অজ্ঞতার মাধ্যমে। অবিদ্যা মানে এমন এক অন্ধকার, যা বাস্তবের সত্য স্বরূপ—অর্থাৎ ব্রহ্ম—আচ্ছন্ন করে রাখে। যেমন চাঁদের আলো মেঘে ঢাকা পড়লে চাঁদ অদৃশ্য হয় না, কেবল অদৃশ্য বলে মনে হয়, তেমনই ব্রহ্মও কখনও বিলীন হয় না, কিন্তু অবিদ্যার আচ্ছাদনে সে অপরিচিত থাকে। এই অবিদ্যা থেকেই জন্ম নেয় মায়া—যা ব্রহ্মের উপর একটি আপাত প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করে, যেন জগৎ সত্যিই বিদ্যমান। মায়া কোনো বাস্তব সত্তা নয়, আবার পুরোপুরি মিথ্যাও নয়; এটি “অনির্বচনীয় (অবর্ণনীয়)”—না বাস্তব, না অবাস্তব। এটিই জগতের মধ্যবর্তী অবস্থাকে নির্দেশ করে—যেখানে দেখা যায়, অনুভব করা যায়, কিন্তু জানলে বোঝা যায় যে, তা ব্রহ্মের প্রতিফলনমাত্র।

শঙ্করাচার্য বলেন, “যেমন স্বপ্নে-দেখা শহর জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়, তেমনি এই জগৎ জ্ঞানোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়।” অদ্বৈতের মতে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, আর জগৎ ব্রহ্মের জ্ঞানহীন প্রতিচ্ছবি। অতএব, জগতের অস্তিত্ব অবিদ্যা-নির্ভর, এবং জ্ঞানের দ্বারা তা “বাধ” (sublated) বা অতিক্রান্ত হয়। যখন জ্ঞান জন্মায়, তখন দেখা যায়—জগৎ কোনো পৃথক বাস্তবতা নয়, বরং চৈতন্যেরই প্রতিফলিত রূপ।

মাধ্যমক বৌদ্ধধর্মে জগত—প্রতীত্যসমুত্পাদের নিত্য প্রবাহ: মাধ্যমক দর্শনে জগতের কোনো স্থায়ী ভিত্তি বা সারসত্তা নেই। যা-কিছু আছে, তা অন্য কিছুর কারণে আছে—এটিই প্রতীত্যসমুত্পাদ (Dependent Origination)। এর অর্থ, কোনো বস্তু, ভাব বা সত্তা নিজের মধ্যে স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়; বরং সবই পারস্পরিক সম্পর্কের জালে গঠিত।

প্রতীত্যসমুত্পাদ (Dependent Origination)—এটি বৌদ্ধ দর্শনের অন্যতম মৌলিক এবং গভীর ধারণা। সংস্কৃত শব্দটি দুটি অংশে গঠিত: “প্রতীত্য” অর্থ নির্ভর করে বা শর্তসাপেক্ষে, “সমুত্পাদ” অর্থ উদ্‌ভব বা উৎপত্তি। অর্থাৎ, “প্রতীত্যসমুত্পাদ” মানে হলো—সব কিছু অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করে উদ্‌ভূত হয়; কোনো কিছুই এককভাবে বা স্বতন্ত্রভাবে বিদ্যমান নয়।

বুদ্ধ এই সত্যটিকে এভাবে সংক্ষেপে প্রকাশ করেছিলেন: “ইদং সত্তি, ইদং ভবতি; ইদং অসত্তি, ইদং ন ভবতি।” অর্থাৎ—“যখন এটি আছে, তখন সেটি ঘটে; যখন এটি নেই, তখন সেটিও ঘটে না।” এই সূত্রে বলা হচ্ছে—কোনো কিছুই নিজের মধ্যে স্বাধীন নয়, বরং সমস্ত সত্তা ও ঘটনা পরস্পরের উপর নির্ভর করে। এটাই নির্ভর-উৎপত্তির সূত্র (Law of Conditional Arising)।

বারোটি নিদান বা কারণশৃঙ্খল: প্রতীত্যসমুত্পাদ বা নির্ভর-উৎপত্তি তত্ত্ব বুদ্ধের দার্শনিক বোধের কেন্দ্রবিন্দু। এটি ব্যাখ্যা করে—কীভাবে দুঃখ জন্ম নেয় এবং কীভাবে সেই দুঃখের চক্র (সংসার) থেকে মুক্তি সম্ভব। এই তত্ত্বে বলা হয়, কোনো সত্তা স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল নয়; সব কিছুই শর্তসাপেক্ষে উদ্ভূত ও বিনষ্ট হয়। বুদ্ধ এই নীতিকে ব্যাখ্যা করেছেন বারোটি নিদান বা “কারণশৃঙ্খলা”-র মাধ্যমে। এই বারোটি পরস্পর-সংযুক্ত ধাপ, যাদের মাধ্যমে অজ্ঞতা থেকে দুঃখ এবং অবশেষে মুক্তির পথ পর্যন্ত মানসিক ও অস্তিত্বগত প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা হয়।

১. অবিদ্যা (Avidyā—Ignorance): অবিদ্যা মানে “অজ্ঞতা”—চূড়ান্ত সত্য সম্পর্কে অজ্ঞানতা। এটি সেই অন্ধকার, যা সমস্ত দুঃখের মূল। অবিদ্যা হলো জগৎ, আত্মা ও বস্তু সম্পর্কে ভুল ধারণা—আমরা যা দেখি, তা স্থায়ী, স্বতন্ত্র ও সত্য বলে মনে করি; অথচ সবই অনিত্য, নির্ভরশীল ও শূন্য। অবিদ্যা মানে না জানার অক্ষমতা নয়, বরং ভুলভাবে জানা—“আমি আছি”, “আমার আছে”, “আমিই ভোগী” এই অহংকেন্দ্রিক ভুল ধারণাই অবিদ্যা। এটি প্রথম কারণচক্র, যা বাকিদের জন্ম দেয়।

২. সংস্কার (Saṃskāra—Mental Formations): অবিদ্যা থেকেই জন্ম নেয় সংস্কার—ইচ্ছা, অভ্যাস ও মানসিক প্রেরণার ধারা। এগুলি হল সেই কর্মবীজ, যা ভবিষ্যৎ জন্ম ও অভিজ্ঞতার কারণ। সংস্কারকে বলা হয় “ইচ্ছানির্ভর ক্রিয়া”, যা মানসিকভাবে আমাদের চিন্তা ও আচরণ গঠন করে। এরা অজ্ঞতার ফলে বিকৃতভাবে কাজ করে—অজ্ঞতা থাকলে সংস্কার দুঃখের দিকে পরিচালিত হয়; জ্ঞানের আলো এলে এগুলো নিঃশেষ হয়।

৩. বিজ্ঞান (Vijñāna—Consciousness): সংস্কার থেকে উদ্ভূত হয় বিজ্ঞান, অর্থাৎ চেতনার প্রবাহ। এটি কোনো আত্মার স্থায়ী কেন্দ্র নয়, বরং একমুহূর্ত থেকে অন্য মুহূর্তে সঞ্চারিত মানসিক প্রক্রিয়া। এই বিজ্ঞানই অতীত সংস্কারের ফল ও ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি। বৌদ্ধ দৃষ্টিতে, বিজ্ঞান মানে কোনো “জানার আত্মা” নয়—বরং “জ্ঞানের অবিরাম প্রবাহ”, যা প্রতিটি জন্মের সাথে নতুনভাবে প্রকাশ পায়।

৪. নামরূপ (Nāma-Rūpa—Mind and Body): চেতনা (বিজ্ঞান) যখন কোনো উপযুক্ত পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সৃষ্টি হয় নামরূপ—অর্থাৎ মানসিক উপাদান (নাম) ও শারীরিক গঠন (রূপ)। “নাম” অর্থে চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা, মনন; “রূপ” অর্থে দেহ ও ইন্দ্রিয়। এ দুটি একে অপরের পরিপূরক—মন ছাড়া দেহ অর্থহীন, দেহ ছাড়া মন কার্যক্ষম নয়। এই সংযোগই জীবনের অভিজ্ঞতার প্রাথমিক ভিত্তি।