অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো ছাব্বিশ



গীতার ভাষায়—“যদা তে মোহ–কলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি, তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ।” (গীতা, ২.৫২) অর্থাৎ, যখন মায়ার কুয়াশা কেটে যাবে, তখন তুমি সব কর্ম ও শ্রবণের সীমা অতিক্রম করবে।

জ্ঞানের উদয় মানে—অবিদ্যা নিঃশেষ, কর্তা-ভাব লোপ, সংচিত ও আগামী কর্ম দগ্ধ, প্রারব্ধ শেষ হলে চূড়ান্ত বিদেহমুক্তি। এই অবস্থায় জ্ঞানী কর্মে থেকেও অকর্মদর্শী, দেহে থেকেও দেহাতীত, জীবিত থেকেও মুক্ত।

বিদেহমুক্তি কোনো নতুন প্রাপ্তি নয়—এ কেবল সেই মুক্তির শেষদৃশ্য, যেখানে মঞ্চ সরলেও উপস্থিতির আলো নিভে যায় না; কারণ জাগ্রত, নিদ্রা, মৃত্যু—সব কিছুর ওপারে যে-চেতনা জেগে থাকে, তা-ই চিরমুক্ত, চিরজাগ্রত ব্রহ্ম।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে অবিদ্যা–নিবৃত্তির পর আত্মার ব্রহ্মস্থিতিই মুক্তির প্রকৃত রূপ। এখানে জ্ঞানের মাধ্যমে জগৎ, কর্ম এবং চেতনার সম্পর্ক নতুনভাবে উদ্‌ভাসিত হয়—যেখানে সব কিছু থাকে, কিন্তু কোনো স্বাধীনতা বা সত্যতার দাবি নিয়ে নয়।

অবিদ্যা কেটে গেলে জগৎ আর স্বাধীন সত্য বলে প্রতীয়মান হয় না। তখন বোঝা যায়—জগৎ নিজে টিকে থাকে না; এটি অধিষ্ঠান-স্বরূপ ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল এক প্রতীতি মাত্র। শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে (২.১.১৪) বলেন—“ব্রহ্মণো হি উপাধি-বদ্ধা নাম-রূপ-ব্যবহার-ভূতা ইয়াম প্রতীতি।” অর্থাৎ, ব্রহ্মের উপর উপাধি-বদ্ধ নাম-রূপের আরোপেই জগতের প্রতীতি ঘটে। যেমন দড়ির উপর সাপ দেখা যায়, তেমনি ব্রহ্মের উপর নাম-রূপের এই জগৎ দেখা যায়। এখানে দড়ি বাস্তব, সাপ প্রাতিভাসিক—এটি ভ্রম নয়, বরং অধিষ্ঠান-স্বরূপের বোধের উদাহরণ।

অদ্বৈত বেদান্তে “অধিষ্ঠান-স্বরূপের বোধ” মানে সেই চেতনার উপলব্ধি, যার উপর সমগ্র জগতের প্রতীতি দাঁড়িয়ে আছে, অথচ যা নিজে কখনও পরিবর্তিত হয় না বা নিবারিত হয় না। এটি সেই ব্রহ্ম-চৈতন্য, যা সব অভিজ্ঞতার ভিত্তি, যেমন দড়ির উপর সাপের ভ্রম টিকে থাকে দড়ির অস্তিত্বের উপর।

অধিষ্ঠান মানে, যার উপর কিছু নির্ভর করে। যেমন দড়ি সাপ-ভ্রমের অধিষ্ঠান, মরুভূমি মরীচিকা-জলের অধিষ্ঠান, তেমনি ব্রহ্ম এই জগৎ-প্রতীতির অধিষ্ঠান। যা অপরিবর্তিত থেকে পরিবর্তনের ভিত তৈরি করে, সেটিই অধিষ্ঠান।

অধিষ্ঠান-স্বরূপ মানে সেই বাস্তব সত্তা, যাকে জানলে বোঝা যায় যে, যা দেখা যাচ্ছে, তা আসলে মায়া-প্রতীতি, যা তার অধিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল। যেমন দড়িকে জেনে বোঝা যায়, সাপ কেবল ভ্রম ছিল, তেমনি ব্রহ্মকে জানলে বোঝা যায়, জগৎ কেবল নাম-রূপের আরোপ।

উপনিষদ বলে—“সদ্বৈতদেকমেবাদ্বিতীয়ম্” (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৬.১.৪)—অর্থাৎ যা আছে, তা-ই একমাত্র সত্য; দ্বিতীয় কিছু নেই। এই ‘সৎ’-ই সমস্ত নাম-রূপের অধিষ্ঠান। শঙ্করাচার্য ছান্দোগ্যভাষ্যে বলেন—“নামরূপ-ব্যাকৃতমিদং, অধিষ্ঠানে ব্রহ্মণি প্রতীয়মানম্।” অর্থাৎ নাম-রূপ-বিশিষ্ট এই জগৎ ব্রহ্ম নামক অধিষ্ঠানের উপর প্রতীয়মান।

যখন মানুষ বোঝে—“আমি দেহ নই, মনও নই; আমি সেই চৈতন্য, যার উপর এই দেহ-মন প্রতীয়মান”—তখন অধিষ্ঠান-স্বরূপের বোধ জাগে। তখন জগৎ মিথ্যা মনে হয় না, বরং দেখা যায়, জগৎ ব্রহ্মেরই প্রকাশ, তারই প্রতিফলন। সেই অবস্থায় আর সাপ দেখা থাকে না, থাকে কেবল দড়ির জ্ঞান-চেতনার মধ্যে চেতনার বোধ।

শঙ্করাচার্য বলেন—“যথা রজুজ্ঞানেন সর্পভ্রান্তিনিবৃত্তিঃ, তথৈব ব্রহ্মবোধেন জগত্ভ্রান্তিনিবৃত্তিঃ।” (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ২.১.১৪) অর্থাৎ, যেমন দড়ির জ্ঞানে সাপ-ভ্রম নাশ হয়, তেমনি ব্রহ্ম-বোধে জগতের ভ্রম মিটে যায়। এই ব্রহ্ম-বোধই অধিষ্ঠান-স্বরূপের বোধ।

অধিষ্ঠান-স্বরূপের বোধ মানে প্রতীতির অস্বীকার নয়, বরং তার অবিকৃত ভিত্তির উপলব্ধি। প্রতীতি পরিবর্তনশীল নাম-রূপের অভিজ্ঞতা, আর অধিষ্ঠান সেই এক চৈতন্য, যেখানে প্রতীতি ঘটে, কিন্তু যা নিজে অপরিবর্তিত। বেদান্ত বলে, প্রতীতি হচ্ছে অধিষ্ঠানের প্রতিবিম্ব, আর অধিষ্ঠান প্রতীতির বাস্তবতা।

অধিষ্ঠান-স্বরূপের বোধ জাগলে জগৎ আর স্বতন্ত্র বাস্তব বলে মনে হয় না। কর্তা-ভোক্তা-বোধ মিলিয়ে যায়, চেতনা নিজের মধ্যে স্থিত হয়। গীতা (২.৫৫)–য় বলা হয়েছে—“প্রজাহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মনোগতান্… স্থিতপ্রজ্ঞঃ স তদোচ্যতে।” অর্থাৎ, যখন চেতনা নিজের মধ্যে স্থিত হয়, তখন সমস্ত প্রতীতি কেবল তার প্রতিফলনমাত্র।

অধিষ্ঠান-স্বরূপের বোধ মানে সেই আত্ম-চেতনার উপলব্ধি, যেখানে প্রতীতি ও নিবারণ এক আধারে ঘটে, আর বোঝা যায়—যা দেখা যাচ্ছে, সেটিও আমিই; আমি সেই চেতনা, যা সব কিছুর ভিত্তি ও আশ্রয়। এই বোধেই মিথ্যাত্বের জ্ঞান ও ব্রহ্ম-বোধ একত্র হয়—ভ্রম মিটে যায়, কিন্তু অধিষ্ঠান অটল থাকে। অদ্বৈতের ভাষায়, এই অবস্থাই মুক্তি—অধিষ্ঠান-ব্রহ্মে অবস্থিতি, অর্থাৎ ব্রহ্মস্থিতিই মুক্তি।

জ্ঞান উঠলে অবিদ্যা-মূলক কর্মফল (সংচিত ও আগামি কর্ম) নষ্ট হয়, কিন্তু প্রারব্ধ-কর্মের ফল দেহ-মন-ইন্দ্রিয়কে কিছুদিন সচল রাখে। শঙ্কর বলেন (ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য, ৪.১.১৫)— “জ্ঞানোদয়াত্ প্রারব্ধকর্মণো ন নাশঃ।” অর্থাৎ, জ্ঞান উঠলেও প্রারব্ধকর্ম শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেহ টিকে থাকে। তবে এই কর্ম আর বন্ধনের কারণ নয়, কারণ কর্তা-ভাব বিলুপ্ত হয়েছে। কর্ম ঘটে, কিন্তু “আমি করছি” এই ধারণা থাকে না। সেই কর্ম তখন লীলা হয়ে ওঠে—চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, যেখানে কর্ম কেবল নাম-রূপের স্তরে ঘটে, আত্মার স্তরে নয়।

অদ্বৈত বেদান্তে ‘আগামী কর্ম’-কে অবিদ্যা-মূলক বলা হয়, কারণ কর্মের উৎপত্তির মূলেই অবিদ্যা কাজ করে। অবিদ্যা মানে নিজের প্রকৃত স্বরূপ না জানা—আত্মাকে ব্রহ্ম বলে না জেনে মানুষ ভাবে, “আমি দেহ”, “আমি কর্তা”, “আমি ভোক্তা”। এই কর্তা-ভাবই অবিদ্যার ফল, আর এই কর্তা-ভাব থেকেই কর্ম জন্মায়।

যখন কেউ ভাবে, “আমি করছি”, তখনই সে ভবিষ্যতের ফলের প্রত্যাশায় কাজ করে। সেই কর্মই আগামী কর্ম, অর্থাৎ নতুনভাবে সৃষ্ট কর্ম, যা ভবিষ্যতে ফল দেবে। কিন্তু এই “আমি করছি” ধারণা নিজেই অবিদ্যা-জনিত। তাই আগামী কর্মের মূলও অবিদ্যা।

সংচিত কর্ম, অর্থাৎ পূর্বজন্মের সঞ্চিত কর্ম, সেগুলিও কর্তা-ভাব থেকেই জন্মেছিল। অতএব, তাদের মূলও অবিদ্যা। জ্ঞান উঠলে অবিদ্যা নাশ হয়, কর্তা-ভাব মুছে যায়, ফলে নতুন আগামী কর্ম আর উৎপন্ন হয় না। পুরোনো সংচিত কর্ম দগ্ধ বীজের মতো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে (৪.১.১৫) বলেন—“অবিদ্যামূলকঃ কর্তা–ভাবঃ, তদুদ্ভবেন কর্ম।” অর্থাৎ কর্তা-ভাব অবিদ্যা-মূলক, আর সেই কর্তা-ভাব থেকেই কর্ম উৎপন্ন হয়। তাই কর্মও অবিদ্যা-মূলক।

অবিদ্যা থেকেই মন, মন থেকে কর্ম, কর্ম থেকে ফল। যতক্ষণ অবিদ্যা আছে, ততক্ষণ কর্তা-ভাব আছে; যতক্ষণ কর্তা-ভাব আছে, ততক্ষণ নতুন কর্ম জন্ম নেবে। বৃহদারণ্যক উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায়ে (বিশেষ করে ৪.৪.৫-৪.৪.৬) এই ভাবের পাদচারণা স্পষ্ট।

৪.৪.৫-এ বলা হয়েছে: “যত্ কামো ভবতি তৎ ক্রতুর্ ভবতি; যত্ ক্রতুর্ ভবতি তৎ কর্ম করোতে; যত্ কর্ম করোতে তদ্ অভিসম্পদ্যতে।” অর্থাৎ, ইচ্ছা দ্বারা সংকল্প, সংকল্প দ্বারা কর্ম, কর্ম দ্বারা ফল।

৪.৪.৬-এ বলা হয়েছে, নিষ্ক্রিয়ভাবে বাসনা-সংযুক্ত কর্ম ফলবাহক—“সক্তঃ সহ কর্মণৈতি …”—যে বাসনায় আবদ্ধ হয়ে কর্ম করে, তাকে (কর্মের) ফল ভোগ করতে হয়, (তার) পুনর্জন্ম হতে হয়।

জ্ঞানে অবিদ্যা নাশ হলে কর্তা-ভাব থাকে না, ফলে আগামী কর্মও আর সৃষ্টি হয় না। সংচিত কর্মও দগ্ধ বীজের মতো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কেবল প্রারব্ধ কর্ম দেহের প্রাবল্যে কিছুদিন থাকে, পরে সেটিও শেষ হয়ে যায়।

অদ্বৈত বেদান্তে সব কর্মই অবিদ্যা-মূলক, কারণ কর্মের উৎস কর্তা-ভাব, আর কর্তা-ভাব জন্মায় অবিদ্যা থেকে। যতক্ষণ অবিদ্যা আছে, ততক্ষণ কর্তা-ভাব থাকে; যতক্ষণ কর্তা-ভাব থাকে, ততক্ষণ কর্ম জন্ম নেয়। কিন্তু জ্ঞান উঠলে অবিদ্যা নাশ হয়, কর্তা-ভাব লোপ পায়, ফলে নতুন কর্ম (আগামী) জন্মায় না এবং পুরোনো সঞ্চিত কর্ম দগ্ধ বীজের মতো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তবে প্রারব্ধ কর্ম জ্ঞানীর কাছেও থেকে যায়—এটাই সূক্ষ্ম বিষয়।

শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে (৪.১.১৫) স্পষ্ট করে বলেন—“প্রারব্ধস্য তু অপরিশেষে দেহপাতে বিদেহমুক্তিঃ।” অর্থাৎ, প্রারব্ধ কর্ম জ্ঞান দ্বারা নষ্ট হয় না, বরং দেহপাতে শেষ হয়।

প্রারব্ধ কর্ম অবিদ্যা-মূলক হলেও, জ্ঞানের পরে সেটি আর কার্যকর অবিদ্যা নয়। কারণ এর ফল ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে—এই দেহ, এই জন্ম, এই জীবনযাত্রা—সব প্রারব্ধের ফল। এখন তা যেন ছোড়া তীরের মতো, একবার ছুটে গেলে মাঝপথে থামে না। তীর ছোড়ার কারণ অবিদ্যা হতে পারে, কিন্তু তীরের গতি নিজে আর অবিদ্যা দ্বারা পরিচালিত নয়।

"কুম্ভকারের চাকা” (potter’s wheel) উপমাটি যোগবাসিষ্ঠ (Yoga Vasistha) গ্রন্থে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্রারব্ধ কর্মের স্বরূপ বোঝাতে—যেমন একটি কুম্ভকার চাকা একবার ঘোরাতে শুরু করলে তার ঘূর্ণন কিছুক্ষণ নিজের গতিতে চলতে থাকে, তেমনি জ্ঞানী ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের পরেও প্রারব্ধ কর্ম (যা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে) দেহে কিছুসময় চলতে থাকে, তবে নতুন কর্ম সৃষ্টি হয় না।

বৃহদারণ্যক উপনিষদভাষ্যে (৪.৪.৬) শঙ্করাচার্য আরও ব্যাখ্যা করেন—দেহ অবিদ্যা-জনিত হলেও প্রারব্ধরূপে কিছুদিন থাকে; জ্ঞানে অবিদ্যা নাশ হলে কর্তা-ভাব আর থাকে না, ফলে নতুন কর্ম আর জন্মায় না।

এই অবস্থায় জ্ঞানী জানেন, “আমি দেহ নই; দেহ প্রারব্ধের বেগে চলছে।” দেহের অভিজ্ঞতা থাকে, কিন্তু তাতে তাঁর কোনো অহংকার বা বন্ধন জন্মায় না। যেমন ছোড়া পাথর গড়িয়ে যায়, কিন্তু যে-ব্যক্তি ছুড়েছিল, সে এখন সাক্ষীমাত্র।

বৃহদারণ্যক (৪.৪.৬)–এর মতো শঙ্করাচার্য এখানেই উপসংহার টানেন—জ্ঞানে অবিদ্যা নাশ হয়, নতুন কর্ম আর জমে না, সংচিত কর্ম নিঃশেষ হয়, প্রারব্ধ শেষ হলে দেহ পতন ঘটে, আর আত্মা চূড়ান্তভাবে ব্রহ্মে লীন হয়—এটাই বিদেহমুক্তি।

অদ্বৈত বলে, মুক্তি কোনো ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি নয়, মৃত্যুর পরের অবস্থা নয়; এটি বর্তমানেই এক অভ্যন্তরীণ উপলব্ধি—চেতনার নিজের স্বরূপে স্থিতি। শঙ্কর গীতা ভাষ্যে (২.৭২) বলেন—“এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ।” অর্থাৎ, এই ব্রহ্মস্থিতিই মুক্তির স্বরূপ। এখানে জানা যায়—“আমি কর্তা নই, ভোক্তা নই; আমি নিত্য সাক্ষী-চেতনা।” এই অপরোক্ষ অভিজ্ঞতায় (aparokṣānubhava) জানা, জানন ও জানার বিষয় একাকার হয়ে যায়।

গীতায় (৫.১০) বলা হয়েছে— “ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ।” অর্থাৎ, “যে ব্রহ্মে অর্পিত কর্ম করে এবং আসক্তি ত্যাগ করে, তার কর্ম তাকে আর বেঁধে রাখে না।” তখন মানুষ জগতে থেকেও জগতের ভারে নত হয় না। সে পদ্মপাতার মতো জলে থেকেও জলে অস্পৃষ্ট থাকে, কারণ চেতনার আলো তাকে ভিজতে দেয় না। বাতাসের মতো চলে, কিন্তু আকাশের মতো অচঞ্চল—বাইরে গতি, ভেতরে স্থিরতা।

এই অবস্থাকেই বলা হয় জীবনমুক্তি—যেখানে জগৎ থাকে, কর্ম থাকে, কিন্তু বন্ধন থাকে না। কর্ম অসত্য (অসৎ বা অনস্তিত্বশীল) নয়, তবে স্বাধীন সত্যও নয়—এটি নির্ভরশীল, অধিষ্ঠান-প্রতীতি।

অবিদ্যা কেটে গেলে, কর্তা-ভাব লুপ্ত হলে, জগৎ আর “স্বাধীন বাস্তবতা” বলে প্রতীয়মান হয় না। সব কিছুই তখন দেখা যায় চেতনার স্ব-প্রকাশে প্রতিফলিত নাম-রূপ হিসেবে। এই অবস্থাই ব্রহ্ম-স্থিতি, অবিদ্যা-নিবৃত্তি ও জীবনমুক্তির ঐক্যবিন্দু—যেখানে জগৎ আছে, কর্ম আছে, কিন্তু বন্ধন নেই। থাকে কেবল এক নিরবচ্ছিন্ন স্ব-প্রভ চেতনা, যা সব কিছুকে ধারণ করে, অথচ নিজে অচল, অব্যয়, অদ্বিতীয়। ছান্দোগ্য উপনিষদ (৬.২.১) বলে—“একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্ম।” এই একাত্ম উপলব্ধিই মুক্তি—যেখানে সমস্ত অবিদ্যার আবরণ দূরে সরে গিয়ে জানা, কারণ, ফল—সব বিলীন হয়ে যায় এক অনাদি, নিরাকার, স্বয়ং-প্রকাশ চেতনায়।